কখনোই উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখিনি কিন্তু
আসসালামু আলাইকুম। সবার প্রথমে মহান আল্লাহ তায়ালার লাখো লাখো শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। সবার প্রথমে ধন্যবাদ জানাতে চাই আমাদের প্রিয় মেন্টর Iqbal Bahar Zahid স্যার কে যিনি এত সুন্দর একটি প্ল্যাটফর্ম আমাদেরকে তৈরি করে দিয়েছেন। যার বদৌলতে লাখো তরুণ বেকারত্বের অভিশাপ থেকে বের হয়ে এসে উদ্যোক্তা হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন।
কিভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না, কারণ আগে কখনো নিজের বিষয়ে লেখালেখি করি নি। গ্রুপে অনেকের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প এবং ব্যর্থতা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ব্যর্থতাকে শক্তিতে রূপান্তর করে সফলতা অর্জন করার যে গল্প এটা আমাকে সত্যিই অনেক অনুপ্রাণিত করে। আমিও অন্য সকল উদ্যোক্তার মত জীবনে বহু ধরনের বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করেই যাচ্ছি। মাঝে মাঝে মনে হয় সবকিছু বন্ধ করে দেই কিন্তু পরক্ষণেই স্যারের কথা মনে পড়ে যে কিনা লেগে থাকতে বলেছিলেন। তাইতো হাজারো সমস্যা সমাধান করে আজও লেগে আছি উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নে।
আসলে ছোটবেলা থেকে কখনোই উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখি নি, মূলত স্বপ্ন দেখার সুযোগ পাইনি। ভাবছেন এ আবার কেমন কথা! আসলেই সত্যি! বাবার সেনাবাহিনীতে চাকরির কারণে কখনোই সেনানিবাসের বাইরে যে একটা পৃথিবী আছে এটা বুঝতে পারিনি। জন্মের পর থেকেই দেখে আসছি কঠোর নিয়ম কানুন এবং শৃঙ্খলা। যদিও এই গুণগুলো মনের অজান্তেই নিজের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল কিন্তু এর দ্বারা কিছু সমস্যাও মোকাবেলা করতে হয়েছে। বড় হওয়ার পরে বুঝতে পারি যে সেনানিবাসে থাকার ফলে মুক্তভাবে চিন্তাভাবনা করার কোন সুযোগ নেই। মনে হয়েছিল সমস্ত পৃথিবীতে বোধহয় এত সুন্দর গোছানো। যাই হোক পরবর্তীতে যখন বাবার চাকরি শেষ হলো মূলত প্রকৃত পৃথিবীটাকে চিনতে পেরেছিলাম তখনই। আর হ্যাঁ যেহেতু আমরা সেনানিবাসে থাকতাম তাই আমাদের জন্মের পর থেকেই একটা ধারণা ছিল যে পৃথিবীতে পায়ের পথ বোধহয় শুধু চাকরি!
ঘুড়ে বেরিয়েছে বিভিন্ন সেনানিবাসে সেনানিবাসে বাবার বদলির কারণে। দেখেছি অনেক জায়গা, অনেক মানুষ। এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করেছি রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এবং পরবর্তীতে অনার্স ও মাস্টার্স করতে হয়েছে রংপুরের বিখ্যাত কারমাইকেল কলেজে। প্রকৃতপক্ষে কঠোর এই পৃথিবীটাকে অনুধাবন করতে পারি অনার্স করার সময়। যাহোক লেখাপড়া শেষ হলো, ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল চাকরির জন্য। অনার্স পাশ করতে না করতেই যেতে হলো ঢাকায় পার্ট টাইম চাকরি করার জন্য, যেহেতু বাবার চাকরি শেষ।
সবেমাত্র অনার্স পাশ করা অবস্থায় চাকরি পাওয়াটা খুব একটা সহজ ছিল না সেসময়। এক বন্ধুর রেফারেন্স দিয়ে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম পিৎজা হাটে। আমার খুব পরিষ্কার মনে আছে ইন্টারভিউ নেয়ার আগে ছোট্ট একটা লিখিত পরীক্ষা হয়েছিল। সম্পূর্ণ ইংরেজি ভার্সনে। পরীক্ষাও বেশ ভাল হয়েছিল। ভেবেছিলাম চাকরিটা বোধহয় হয়েই যাবে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার 30 মিনিট পর একজন কর্মকর্তা এসেই আমার নাম ধরে ডাকলেন, আমি মনে মনে বেশ খুশি হলাম। ভেতরে নিয়ে গেল, এবং বলল এসব চাকরি আপনার জন্য নয়, পড়াশোনা চালিয়ে যান ভালো চাকরি পাবেন। কষ্টে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল।
পরবর্তীতে লেখাপড়া চালিয়ে গেলাম এবং বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলাম এবং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ লিখিত পরীক্ষায় নির্বাচিত হচ্ছিলাম। প্রতিবারই মনে হয় এবার বোধহয় চাকরিটা হয়ে যাবে । কিন্তু তা হয় না, জানিনা কেন।
যেহেতু লেখাপড়া ছিল ইংরেজি বিষয়ে সেই ক্ষেত্রে হঠাৎ একটা কল সেন্টারে চাকরি পেয়ে যাই। কিন্তু কল সেন্টারের চাকরির কোন অভিজ্ঞতা আমার ছিল না এবং কি কাজ করতে হবে সেটা আমি জানতাম না। শুধুমাত্র স্পোকেন ইংরেজিতে ভালো ছিলাম জন্যই সেই কম্পিটিশনে নির্বাচিত হয়ে ছিলাম এবং তারা আমাকে নিয়োগ দিয়েছিল। পরবর্তীতে কল সেন্টারে খুব একটা ভালো করতে পারিনি কারণ কল সেন্টার এর মূল কাজ ছিল থার্ড পার্টি হিসেবে টেলি মার্কেটিং এর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের প্রোডাক্ট সেল করা। খুব বেশি দিন কাজ করা হয়নি কল সেন্টারে। আবারো বেকার!
আরো কিছু দিন গেল বেকার অবস্থায়। পরবর্তীতে এক বন্ধুর সুবাদে জয়েন করি একটি থার্ড পার্টি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্মে । যারা বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি থেকে শুরু করে বড় বড় দেশীয় কোম্পানির সেলস করে দিত। আমার কাজ অবশ্য ছিল ঢাকা হেড অফিসে, রিপোর্ট ম্যানেজমেন্ট এর কাজ। ভালই যাচ্ছিল দিনগুলো হঠাৎ একদিন আমার প্রিয় বস এসে বললেন, ‘‘মুকুল , আমাদের প্রজেক্ট শেষ কাল থেকে অফিসে না আসলেও চলবে।”
কি আর করা, আবারো বেকার।শেষ পর্যন্ত ঢাকা ছেড়ে রংপুরে চলে আসলাম এসে শুরু করলাম টিউশনি করানো। কিন্তু এখানেও কম্পিটিশন কম নয়! বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এর শিক্ষকরা একটা গোপন সিন্ডিকেট এর মাধ্যমে টিউশনি করতেন। যারা বেকারত্বের কারণে টিউশনি করতেন অনেকটা তাদের মরার উপর খাড়ার ঘা অবস্থা। কারণ তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোন পরিচয় নেই, আমারও ছিল না। শুরু করি অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিং। এক্ষেত্রে অবশ্য সার্বিক সহযোগিতা করেছিল মমিনুল ইসলাম আমার খুবই কাছের বন্ধু, যাকে শুধু বন্ধু বললে আমার তাকে ছোট করা হবে, সে আমার ভাই। একই সাথে যুক্ত হয় গুগল এর একটি প্রজেক্টে। ভালই যাচ্ছিল দিনগুলি, কিন্তু সামাজিক চাপের কারণে আমাকে বেছে নিতে হয় অন্য পথ। চাকরি ছাড়া নাকি ইনকাম করা আর বেকার থাকা একই কথা! ভুলে গেলাম ফ্রিল্যান্সিং এর কথা এবং বেছে নিলাম সরকারী চাকুরীর প্রস্তুতি নেওয়া। শুরু হলো আবারও পড়াশোনা, আবারো সেই অসুস্থ প্রতিযোগিতা যা আমার জীবনের সোনালী সময় কেড়ে নিয়েছিল।
আমার এই চরম সংকটে আমার বন্ধু Asaduzzaman Khokon, যার অবদান আমি কখনই অস্বীকার করতে পারিনা, আমাকে ইন্টারন্যাশনাল গ্রামার স্কুলের সহকারি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করানোর ব্যবস্থা করে। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের সমস্যার কারণে আমাকে আবারো চাকরিটা ছেড়ে দিতে হয়। এবার অবশ্য খুব একটা বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি, যোগদান করি ‘‘রংপুর গ্রুপ” এ যাদের আছে বেশ কয়েকটি ব্যবসা। জানিনা সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য আমাকে জয়েন করতে হয় এইচ আর বিভাগে। চাকরি ভালই যাচ্ছিল, কিন্তু সমস্যা হয়ে গিয়েছিল আমার অধীনস্থ অফিস সহকারির। আমার কারণে সে আর নিয়োগ বাণিজ্য করতে পারেনি, যার ফলে ম্যানেজমেন্ট এর কাছে বিভিন্ন ভাবে আমাকে হয়রানির শিকার হতে হয়। এভাবেই দিন পার হতে লাগলো এবং শেষমেষ আবারো চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। পড়ে গেলাম আবার হতাশায়, একা নই, সপরিবারে। কারণ এর মধ্যে আমি বিয়ে করেছিলাম এবং আমার একটা ছেলেও জন্ম নিয়েছে।
কোন উপায়ান্তর না পেয়ে পরবর্তীতে যোগদান করলাম ভেটেরিনারি ঔষধ কোম্পানিতে রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে। আবারো সেই সেলস। বেশ কিছুদিন কাজ করলাম এবং শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ থাকার ফলে এনটিআরসিএ এর মাধ্যমে একটি কলেজে শিক্ষকতা করার সুযোগ পাই। তৈরি হল আমার প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়, শুরু হলো নতুন করে পথচলা। তবে জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করি সেলস কোম্পানিতে কাজ করার ফলে। দেখতে পাই অফুরন্ত সুযোগ। কাজ করা শুরু করি কেয়ার এগ্রো নামের পেজে। কাজ শুরু করে বিভিন্ন ধরনের অর্গানিক প্রডাক্ট নিয়ে। অ্যান্টিবায়োটিক মুক্ত মাংস এবং ডিম ছিল আমার প্রথম প্রোডাক্ট। বেশ ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল রংপুর শহরে। পরবর্তীতে যুক্ত হয় গরুর খাঁটি দুধ। ব্যবসা ধীরে ধীরে বাড়ছে কিন্তু যতটুকু প্ল্যান অনুযায়ী হওয়ার কথা তা হচ্ছিল না। কারণ হিসেবে খুঁজে পেলাম কিছু গাইডলাইনের ঘাটতি। কিন্তু গাইডলাইন কে দিবে!!??
হ্যাঁ, আমার বন্ধু, আমার ভাই Mominul Islam জানালো এই গ্রুপের কথা। সত্যিই! অসাধারণ! গাইডলাইন পেয়ে গেছি এই গ্রুপে! এত সুন্দর ভাবে একজন সাধারণ লোক কে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার স্টেপ বাই স্টেপ সিস্টেম আমি আর কোথাও দেখিনি। বারবার ধন্যবাদ দিয়ে আসলে ইকবাল বাহার জাহিদ স্যার কে ছোট করতে চাই না। স্যার এর প্রতিটি কথা যেন একেকটি আশীর্বাদ। প্রতিদিন বসে থাকি কখন স্যারের নতুন সেশন আসবে, কখন নতুন লাইভ আসবে। সবচেয়ে বড় পাওয়া হচ্ছে তার এই গ্রুপে লক্ষ লক্ষ ভালো মানুষ। যেখানে নেই কোন প্রতিহিংসা, বরং রয়েছে সহযোগিতা, রয়েছে সৎ পরামর্শ। আর তাইতো এখন আমি স্বপ্ন দেখি উদ্যোক্তা হওয়ার, স্বপ্ন দেখি নিজে কিছু করার। আর বারবার মনে করি স্যারের সেই কথা “চাকরি করব না, চাকরি দেব”।
সবার সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।
মোঃ মুজাহিদুল ইসলাম মুকুল
শিক্ষক এবং উদ্যোক্তা
ব্যাচ নং ১৪
রেজিস্ট্রেশন নম্বরঃ ৬৩২৩৫
নিজ জেলা রংপুর।
পেজ: কেয়ার এগ্রো:
দই ওয়ালা