আমার জীবনের গল্প ও উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা
ছোট্ট পরিবার আমার। মা বাবা আমার বড় বোন আর আমি আলহামদুলিল্লাহ।
ভাই নেই, যে কেউ শুনলে আমাদের চেয়ে উনিই আফসোস করতেন ভাই নেই আমার!
আব্বু তখন আমাকে কাছে নিয়ে বলতো এইটাই আমার ছেলে।
আমাকে আমার পরিবারের কেউ কখনো নাম ধরে ডাকেনি, এখনো ডাকে না। আব্বু ডাকে আমাকে "আব্বা" বলে। আজো সেই ডাকোই আছে। বাকিদের কাছে আমি ‘বাবু', আমার ২৩ মাসের একটা ছেলে আছে আলহামদুলিল্লাহ ❤️❤️❤️
বাবা ব্যবসা করেন, মা চাকুরী। কোন বাবা মা তাদের সন্তানদের নিয়ে এমন স্বপ্ন কেন জানি দেখেন না যে সে একজন সফল ব্যবসায়ী হবে, সময়ের সাথে নিজেকে জেনে হয়ে ওঠে। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বাবা মা চেয়েছেন মেয়ে পড়াশোনা কম্পিলিট করে ভালো একটা চাকুরী করবে।
আমিও এইটাকেই গন্তব্য হিসেবে মাথায় জায়গা করে দেই। মনের কথা জানা ছিলো না।
কিন্তু আব্বুর বিজনেসের সাথে জড়িত ছিলাম আব্বুর প্রথম বিজনেস শুরুর দিন থেকেই মনে আছে আমার🥰
তার আগে আব্বুরা বেশ কয়েকজন বন্ধু সহ এক মামার আন্ডারে চাকুরী করতেন।
স্মরণ থাকার কারন হলো আব্বু বিজনেস শুরু করেন হাঁসের ভোয়া, সাদা পালক কালেক্ট করার কাজ দিয়ে, যা গ্রাম পর্যায় থেকে বিভিন্ন হকারদের মাধ্যমে সংগ্রহ করে আনতে হতো এবং কেজি ভাবে কেনা হতো, পালক কেনা হতো পিস হিসেবে।
তো প্রথম প্রয়োজনীয় জিনিস ছিল দাড়িপাল্লা। ছোট মানুষ আমি এটা অন্তত বুঝে গেছি যে এতে ওজন করা হয়। কি ওজন করবো ভেবে না পেয়ে দিয়ে দিলাম পায়ের জুতা দুইটা উঠিয়ে☺️☺️☺️ আম্মু তখন বোঝালে সরি ফিল করেছিলাম।
প্রাইমারিতে পড়ি, যোগ বিয়োগ গুন ভাগ ক্যালকুলেটর ব্যবহার করে মজা করেই করি আর আব্বুর কাজের সাথী হয়ে যাই। বিকেল করে আব্বুর দোকানে কাজের চাপ থাকতো আর আমিও চলে যেতাম বিকেলেই। বাড়ির কাছাকাছি দোকান জন্য সমস্যা হতো না।
২০০৪ এ আমি ক্লাস সিক্সে তখন। জেলা স্কুলে চান্স টা হয়ে গিয়েছিল।
স্কুল, প্রাইভেট, কোচিং এক এক করে যোগ হতে হতে দোকানে সময় দেয়া কমে গেলো।
তারপরেও সময় সুযোগ পেলেই আব্বুর সাথে। আব্বুর হকার পাইকার সব পরিচিত।
ধীরে ধীরে বিজনেস পলিসির পাইকারী তে কিনে পাইকারি বা খুচরা সেল করার ম্যাথটা মাথায় ঢুকে গেলো।
দোকানের বেচা কেনা, বাকি বকেয়ার হিসেব লিখিত হতে থাকলো আমার হাতে।
আব্বুর কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকায় লিখা লিখির কাজের জন্যও পরতো আমার ডাক। আব্বু কিছু সময় না থাকলে বা বাইরে থেকে ফিরতে দেরি হলে সময়ে দোকান খোলা, প্রডাক্ট পাইকারি খুচরা সেল করা আমার কাজে যুক্ত হয়। ততদিনে অনেক কিছুই আয়ত্বে চলে আসে।
এভাবেই চলছিল।
অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ২০০৮ এ ঘটে যায় এক দুর্ঘটনা। সেখান থেকে বের হয়ে আসাটা সহজ ছিলো না। একবারের জন্য ভেবেছিলাম জীবনের সমাপ্তি!!! কিন্তু পরিবারের সাপোর্ট ও ভালোবাসায় কঠিন হলেও অসম্ভব হয়নি।
বাসা থেকে পরের বারে এস এস সি দিতে বলে যেহেতু মানসিক ভাবে অসুস্থ কিন্তু সেবারেই দেই। ফলাফল স্বরূপ কাংখিত ফলাফলটা আর হয় না।
২০০৯ এস এস সি পাশ করার অনেক বান্ধবী তখনই পড়াশোনার জন্য বাইরে চলে গেলো। আব্বুকে একা রেখে আমার সাহস ইচ্ছা কোনটাই হলো না।
ভর্তি হয়ে গেলাম জয়পুরহাট সরকারি কলেজে কমার্সে।
তখন নতুন বন্ধু মহল যোগ হলো। রোড সাইডে আব্বুর দোকান থাকায় কলেজের বন্ধু বান্ধব, কলেজ টিচার, প্রাইভেট টিচার সবার চোখে পড়তে থাকলাম আমি দোকান করছি আব্বুর সাথে। সবাই এগিয়ে এসে কথা বলত, আব্বুর সাথে পরিচিত হতো৷
কারোর খারাপ লাগতো কিনা জানি না কিন্তু অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করতো আমার খারাপ লাগে কি না! না, আমার একটুও খারাপ লাগতো না। খুব আনন্দই লাগতো শুধু এটুকু ভেবে যে আমার ভাই নাই, ভাইয়ের কাজ টুকু আমি করতে পারছি আলহামদুলিল্লাহ।
পোশাক জগতে এক এক সময় এক এক ট্রেন্ড চলে। তখন চলছিলো এমব্রয়ডারি কাজ। শাড়ি, থ্রি পিস, বোরখা সব কিছুতেই।
আমরা দুই বোনই কোথাও সেলাই না শিখলেও টেইলারিং এর কাজ নিজেদের আগ্রহ থেকে বাড়ির নতুন পুরাতন কাপড়ের উপর অভিযান চালিয়ে শেখা ছিলো আলহামদুলিল্লাহ। নিজেদের কাপড় আজো নিজেরাই শেলাই করি।
আম্মুর সাথে লেগে পড়লাম একটা এমব্রয়ডারি মেশিন কিনে দেয়ার জন্য। আপু আম্মু কিছুদিনের মধ্যে বগুড়া থেকে মেশিন নিয়ে এলো। এখন দুই বোনের কাজ শিখতে হবে। তার পর তো কত প্ল্যান!!!!
বাজারের এক দোকানী আংকেলকে ঠিক করলাম কিন্তু কাজ হলো না। ঠিক ভাবে আয়ত্ব করতে পারলাম না। মেশিন কাপড় কোনটাই মেইনটেইন হয় না।
অনেক দিন মেশিন পরে থাকার পরে মাত্র ৯০০০ টাকায় বিক্রি করে দেয়া হলো।
এই ছিলো প্রথম অসফলতা😰😰😰
একই পিছুটানে Hsc এর পড়েও জয়পুরহাটের গন্ডি পেরুতে পারলাম না। কিন্তু তখনো মাথায় ছিলো পড়াশোনা করে ভালো একটা চাকুরী পেতে হবে। মনে কি ছিলো তখনো বুঝে উঠতে পারিনি। কিন্তু নিজে কিছু করার ঝোক আছে তা বুঝে গেছি।
সীদ্ধান্ত নেয়া হলো অনার্স মাস্টার্স অনেক লং প্রসিডিওর। তখনকার ধারণা টেকনিক্যাল লাইনে দ্রুত কিছু করা সম্ভব হবে। ভর্তি হয়ে গেলাম জয়পুরহাটের সাইবারটেক পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট এ কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টে। পড়াশোনা, আব্বুর দোকানে সাহায্য সব মিলিয়ে ভালো চলছিল।
তখন অনলাইনে ধুম পড়েছিল কাজ করে টাকা ইনকাম করা। ফ্রিল্যান্সার, ডোলেন্সার কি কি নাম সবের। এখন মনে হলে হাসি পায়।
আম্মুকে জানালাম সবাই করছে, আমিও করবো। প্রথমে না মানলেও পরে রাজি হয়েছিল।
২০১২এর জানুয়ারি ১০, আব্বু ৩২,০০০ টাকা দিয়ে ল্যাপটপ কিনে দেয়। তখন ব্রডব্যান্ডের লাইন এতো ইভেইলেবল ছিলো না। সিটিসেল মডেম কিনেছিলাম যেটাতে ফোনের মত নেট প্যাকেজ উঠাতে হতো, বেশি ইউসে ফোনের ডাটার মতই টেনশন থাকতো কখন যে শেষ হয়ে যায় 🙄🙄🙄
সাইড গুলোতে নিজের আইডি খুলতেও বেশ কিছু টাকা চলে গেলো।
এগুলোই ছিলো একা কিছু করার প্রথম ধাপের চেষ্টার ইনভেস্টমেন্ট। যেইটা ছিলো সম্পুর্ন ভুল সীদ্ধান্ত😒
একটা টাকাও আসেনি আমার সেই দিকে সময় দেয়াতে। দ্বিতীয় বারের মত অসফল😰
এরই মাঝে কিছুদিনের মধ্যেই আব্বু অসুস্থ হয়ে পড়লো। বেশ কিছুদিন পার হওয়ার পরেও কোন ভাবে আব্বুর সঠিক রোগ নির্নয় সম্ভব হয়নি।
জয়পুরহাট সদর হাসপাতাল থেকে আব্বুকে রেফার্ড করা হলো বগুড়া শহীদ জিয়া মেডিক্যালে। সবাই গেলো। আমি থেকে গেলাম। পরিস্থিতি যাই হোক, দোকানের হকারগুলোর সমস্যা হয়ে যাবে দোকান বন্ধ হলে এই জন্য।
জানা গেলো আব্বুর এপেন্ডিসাইটিস পেটের ভেতরেই জয়পুরহাট থাকতেই ব্লাস্ট হয়ে গিয়েছিল জন্য অস্বাভাবিক পেইন আর পেট ফোলা শুরু হয়েছিল।
সাথে ডায়াবেটিস আসছে সেও অনেক বেশি।
আপু চলে আসলো, আম্মু আমার ফুফাতো বোন আব্বুর সাথে বগুড়া।
জীবনের এমন সময়ে খুব করে অনুভুত হলো একটা পুরুষ মানুষের! একটা ভাইয়ের!
আম্মু বগুড়া যাবার সময় দোকানে রেখে গিয়েছিল মাত্র ৬০/-। একটা ৫০ টাকার নোট আর একটা ১০ টাকার নোট। দোকানে কিছু মাল ছিলো।
শুরু করলাম একদমই কোন সাপোর্ট ছাড়া আব্বুর ব্যবসা সামলানো আলহামদুলিল্লাহ। অন্য কোন উপাই বা কোন রাস্তা ছিলো না। দোকান করেছি, আব্বুর ফোন আমার কাছে ছিলো জন্য যতটুকু সম্ভব সবার সাথে কন্টাক্ট করে মাল উঠিয়েছি, কখনো কাছাকাছি জায়গা গুলোতে নিজেই গিয়েছি৷।
দায়িত্ব যে বড় জিনিস, আমাকে আব্বুর ট্রিটমেন্টের জন্য তো টাকা পাঠাতে হবে!
এর মাঝে একদিন গিয়েছিলাম বগুড়াতে আব্বুকে দেখতে। দুই জন দুজনের চোখে তাকাতে পারিনি। আব্বু পাশ ফিরে কান্না করছিল। আজো জানা হয়নি সেই কান্নার পেছনে কি লুকানো ছিলো!!!
০৭/০৩/২০১২ আম্মুদের বিবাহ বার্ষিকীর দিন আব্বুর অপারেশন হয়। তখন আমার প্রথম সেমিস্টারের পরীক্ষা চলছিল। পরীক্ষা, বিজনেস, আব্বুর চিন্তা সব মিলিয়ে আমি মানিসিক ভাবে খুব খারাপ সময় পার করছিলাম।
আল্লাহর অশেষ রহমতে আব্বুর অপারেশন সাকসেসফুল হলো।
কংকাল স্বরুপ আব্বু বাসায় ফিরলো৷ গায়ে চামড়াটা ছাড়া দেখতে আর কিছুই ছিলো না। বাড়ির সব ছোট বড় আয়না সরিয়ে ফেলা হলো।
দীর্ঘ চার মাস একা বিজনেস সামাল দিয়ে ধরে রাখতে ভালো খারাপ অনেক পরিস্থিতির স্বীকার হতে হয়েছে। আশেপাশের আংকেলরা অনেক সাহায্য করতো দোকান খুলতে, বন্ধ করতে, মাল আসলে দোকানে উঠাতে। কিছু মানুষ আসতো গল্প করতে, কেউ এসে এমন জিনিস চাইতো যা সে নিজেও জানে এই দোকানে তা পাওয়া যায় না!
একবার এক লোক এসে কথার ছলে টাকা খুচরো করে চাইলো, তাকে জানালাম যে নেই। সে তার তার ১০০০ টাকার নোট ফেরত চাইলো৷ আমি তো নেইনি জানালেও সে বললো আমি নাকি নিয়ে ড্রয়ারে রেখেছি৷ ফেরত দেয়ার পরে খেয়াল করলাম সে ফ্রিতে আমার টাকাটা নিয়ে গেলো।
আর একবার কেউ একজন সুযোগ বুঝে আমার হাতে ১০০০ টাকার জাল নোট ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো। তখন ১০০০ টাকা আমার জন্য লাখ টাকা!!!
চুল কেনা হতো কেজি দরে। শুরুর কিছুদিন আমি সাহস করে না কিনলেও পরে কেনা শুরু করেছিলাম। যেহেতু কেজি দরে, দামও ছিলো ৬০০০/৭০০০ টাকা কেজি জন্য যাচাই করে কেনা খুব দরকার ছিলো।
এদিকে বিশ্বস্ত হকার গুলো কৌশলে পাকা চুলে কলপ লাগিয়ে, চুলের মধ্যে ধুলো মিশিয়ে ওজন বাড়ানোর চেষ্টা চালাতে। কিন্তু তাদের এই চালাকি ধরতে পেরে আমি চিরনি অভিযানের মত চুল বেছে পরিষ্কার করে ওজন নিলে তাদের ভালো লাগতো না। তাদের চাহিদা টাকা দিয়ে ধুলো ময়লা কিনে নেই!!!!
ধীরে ধীরে আব্বুর শরীর ভালো হলে বিকেল করে দোকানে এসে একটু বশত। যেই আব্বু ছোট বেলায় আমাকে দোকানে বসিয়ে নাস্তা এনে খাওয়াতো, সেই আব্বুকে সময়ের ব্যবধানে আমি দোকানে বসিয়ে চা নাস্তা খাইয়ে কখনো কাউকে পেলে কারোর সাথে, কখনো নিজে গিয়ে বাসায় রেখে আসতাম😊😊
আব্বুর সুস্থতার পরে আগের নিয়মে বিজনেস চলতে থাকলেও আর আগের জায়গায় ফিরে যাওয়া সম্ভব হলো না৷
বেশি কাজ বা বাইরে গিয়ে মাল কেনা আব্বুর পক্ষে সম্ভব ছিলো না আর। ডাঃ ও কড়া নিষেধ করেছিল।
দোকানের চাপ কমতে থাকলো।
আবারো একবার চিন্তা করলাম বাসা থেকে কাপড় সেল করার। আম্মু কিস্তি উঠিয়ে দিলো ২৫০০০/- টাকা। গজ কাপড় এক কালার ও প্রিন্টের, কিছু থ্রিপিস নিয়ে আসালাম সৈয়দপুর থেকে। চলছিল মোটামুটি। কিন্তু মাঝপথে একেবারেই থেমে গেলো! আর কোন রেস্পন্সই না আসাতে পাইকারিতে কিছু কাপড় সেল করে দেয়া হলো এক আপুর কাছে। কিছু এক কালার কাপড়ে হ্যান্ড পেইন্ট করে সেল করা হয়েছিল, কিছু থাকলো বাসার কাজেই ব্যবহার হলো। তখনও অনলাইনের সাথে এমন সখ্যতা ছিলো না।
ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং এর পাশাপাশি মাইক্রোসফট অফিস এপ্লিকেশনের ৩ মাসের কোর্স করে নিলাম আলহামদুলিল্লাহ।
২০১৫ তে ডিপ্লোমা শেষ করে এবার ঢাকা পারি জমাতে হলো আমাকে। সি জি পি এ ৩.৭২ আউট অফ ৪ আলহামদুলিল্লাহ।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং করা হলো আইটি বাংলা ইন্সটিটিউট এ সি সি এন এ'র উপর।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং শেষে পেপারে চোখে পড়লো ক্রিয়েটিভ আইটি ইন্সটিটিউট এর গ্রাফিক ডিজাইন কোর্স এর বিজ্ঞপ্তি। এপ্লাই করলে পরীক্ষা দেয়ার পরে ৫০% স্কলারশিপে সুযোগ পেলাম। শেষ করলাম। আলহামদুলিল্লাহ অনেক কিছুই আয়ত্ব করলাম খুব আগ্রহ আর মজার সাথে। কিন্তু শেষে এসে আমার সে সময়ের পাওয়ার ল্যাপটপ টা নষ্ট হয়ে গেলো😰
বার বার সার্ভিসিং করিয়েও শেষ রক্ষা হলো না। যদিও আজো আছে স্মৃতি হিসেবে আমার কাছেই।
প্র্যাক্টিসটা থেমে গেলো। গ্রিন ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন নিলাম, সাথে ৯০০০ টাকার সেলারিতে চাকরী। ইভেনিং ব্যাচ থাকায় ক্লাস থাকতো ৬-৯ টা, শুক্রবার ৪ঃ৩০ থেকে গ্যাপ দিয়ে চলতো রাত ৮ টা। চাকরী, ক্লাস সব মিলিয়ে চলছিল ভালো কিন্তু শান্তিটা হারিয়ে গিয়েছিল।
এরই মাঝে ২০১৭ তে আব্বু হার্ড স্ট্রোক করেন😰
আমি ঢাকায়, আমাকে ইমিডিয়েট জানানো হয় না কিন্তু আমার মন থেকে কেমন যেনো লাগছিল। পরে বাসায় এসে সব জানতে পেরে মাথা আর কাজ করছিলো না। তখন পর্যন্ত জয়পুরহাটে সর্বোচ্চ ট্রিটমেন্ট করা হয়েছে, পরিস্থিতি ভালো না, হাতে কোন প্রকার টাকা নেই। আম্মু কিছু সময় আব্বুকে বাসায় রেখে টাকা এরেঞ্জ করার চিন্তা করে। তার পরে ঢাকায় নেবে।
আমার মন মানে না অসুস্থ মানুষটাকে এভাবে বাসায় রাখতে। আমার সাথেই আপু আম্মু সহ আব্বুকে নিয়ে চলে যাই ঢাকাতে। মিরপুর ২ এ ছিলাম তখন। স্টেডিয়ামের সামনে দুই জন সহ এক আপুর বাসায় রুম শেয়ার করতাম। ওখানেই ১৬ দিন আব্বুকে রাখলাম। হার্ড ফাউন্ডেশনে আব্বুর এন জিও গ্রাম করানো হলো। তখন ব্লক ৯৩%।
ইমিডিয়েট সার্জারি প্রয়োজন। আর্থিক ভাবে হাতের অবস্থা একেবারেই খারাপ। মাথায় আকাশ ভেংগে পরেছে অনেক আগেই কিন্তু নিজেকে শক্ত থাকতে হবে!
আম্মুকে বাসায় পাঠালাম। অফিস থেকে খুব সামান্যই টাকা এরেঞ্জ হলো, আব্বুর দোকান ছেড়ে দিয়ে ৫৭,০০০/- টাকা পাওয়া গেলো।
এভাবে সম্ভব না বুঝে গেলাম। টাকা চিনেছি মুলত এই সময়ে এসেই।
ফান্ডিং ছাড়া কোন উপায় দেখলাম না আমি। শুরু করে দিলাম আব্বুর চিকিৎসার ফান্ড কালেক্ট বিভিন্নি ভাবে। ভার্সিটিতে কথা বলে অনুমতি নিয়ে একদল আপু ভাইয়া নেমে পড়লো কালেকশনে। অফিসে তো সেই বাসায় আসা থেকেই অনুপস্থিত! তারপরেও গিয়ে স্যারের সাথে কথা বললে অফিস থেকে কিছু টাকা পেলাম। সাথে আগের মাসের সেলারি এড হলো ১২,০০০/-টাকা। ফেইসবুকে লিখা শুরু করলাম। আলহামদুলিল্লাহ সারা পেলাম। এরই মাঝে গ্রামীণ ব্যাংকের মেডামের সাথে এক পরিচিত শুভাকাঙ্ক্ষীর দ্বারা দেখা হলো। উনিও কিছুটা এগিয়ে আসলেন।
এদিকে প্রতিটা দিন, প্রতিটা রাত কাটছে আব্বুকে নিয়ে ভয়ে। সারাটা দিন এসবে ঢাকার মত শহরে কেটে গেছে। আব্বুর ওষুধ চলছে। আমার রুম ভাড়া, এক্সট্রা তিনটা মানুষের খরচ সব চলছে আল্লাহর রহমতে।
আল্লাহর দুনিয়ায় ভালো মানুষ গুলোর দেখা ও সাহায্য পেয়েছিলাম জন্য মনোবল কাজ করছিল। কিন্তু খারাপ মানুষেরও অভাব ছিলো না। সোস্যাল মিডিয়ার কেউ কেউ তো চিকিৎসার পুরো দায়িত্ব নিতে চায় কিন্তু বিনিময়ের মাধ্যমে।
গ্রামীণ ব্যাংকের মেডাম তার পরিচিত একজনের সাথে কন্টাক্ট করিয়ে দেয় যে কিনা মাত্র ৪০,০০০/- টাকায় সরকারি হৃদরোগ হস্পিটালে আব্বুর চিকিৎসা কম্পিলিট করাবে৷ উনার সাথে কথা হলে দেখা করে আব্বুর ডিস্ক নিয়ে গেলো সেদিন প্রায় মাগরিবের সময় মিরপুর স্টেডিয়ামের সামনে থেকে। সাথে আমার শান্তিও চলে গেলো। মনে হলো আব্বুর জীবনটা কারোর হাতে সপে দিলাম ( আস্তাগফিরুল্লাহ)!!!
রুমে গিয়ে আম্মু আপুর সাথে আলোচনা করলাম যে আমার মন সাই দিচ্ছে না তারপর রওনা হলাম আজিমপুরের উদ্দেশ্যে। উনার থেকে আব্বুর এন জিও গ্রামের ডিস্ক ফিরিয়ে আনতে। সে সময় তো ঢাকার রাস্তা গুলোয় জ্যাম দিগুন হয়ে যায় জন্য ফিরতেও দেরি হয়ে গেলো।
ভার্সিটির বড় ভাই সহ ডাঃ এর সাথে আর্থিক সমস্যার কথা জানালে ডাঃ অন্য দেশের কম দামের রিং সাজেস্ট করলেন। দামে কম মানে ভালো হয় কি করে! এখানেও মনের সাথে মিলল না।
আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে টাকা এরেঞ্জ হয়ে গেলো, আব্বুর ডায়াবেটিস অনেক বেশি জন্য এক্সট্রা ট্রিটমেন্ট। সার্জারির দিন আমাকে ডাঃ রুমে ডেকে দেখালো ব্লক ৯৯%। ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। এ ভয় লিখে বোঝানোর মত না। অপারেশন সাকসেসফুলি হয়ে গেলো আলহামদুলিল্লাহ।
কিন্তু এতোদিনের মেন্টালি প্রেশারে আমি এই শেষে এসে অসম্ভব অসুস্থ হয়ে পড়লাম। প্রেশার ৪০ এ নেমে এসেছিল। পরে আল্লাহর রহমতে সুস্থ হয়েছি আলহামদুলিল্লাহ।।।
এর মাঝে আমার রুম যেহেতু তিন তলায় ছিলো, একটা নিচ তলার রুম ভাড়া নিয়েছিলাম এক মাসের জন্য। যেখানে আব্বুকে অপারেশনের পরে রেখে পরে চেকআপ করিয়ে বাসায় এনেছিলাম।
তারপর আগের রুটিন, ক্লাস, অফিস, রান্না, খাওয়া। শান্তিটা তখনও ছিলো না। কিন্তু পরিস্থিতি আর প্রাইভেটে পড়ার মত থাকলো না। নিজে জব করে করা সম্ভব ছিলো কিন্তু সময়ের অভাব হয়ে গেলো। বিডি জবসএ এপ্লায় করলাম স্মার্ট কেয়ার করপোরেশন, বনানী তে। কিছুদিনের মধ্যেই চাকরীটা হয়ে গেলো। ব্যাটার সেলারি, সপ্তাহে দুই দিন ছুটি, সকালে চা, দূপুরে লাঞ্জ, বিকেলে নাস্তা সব কিছুই ভালো।।।
সমস্যা যাতায়াতে! মিরপুর ২ থেকে বনানী যাওয়ার সময় সিরিয়ালের বাসে যেতে তেমন সমস্যা না হলেও আসার সময় তো আমার মত হাজারো চাতক পাখি গাড়ীর জন্য চেয়ে থাকতো! কখনো কখনো ৯/১০ টা বেজে যেত রুমে ফিরতে।
ভাবলাম যে শহরে পড়াশোনাই ছিল মূল বিষয় সেখানে পড়াশোনা না হলে এভাবে কষ্ট করে লাভ! আব্বুকে বাসায় রেখে সব সমিয়ের জন্য একটা চিন্তা থাকতো, প্রথম বারে আব্বু ফোন পিক না করলেই যেন মাথায় কি কি এসে ভর করতো!!!
বাসায় কথা বলে চলে আসার সীদ্ধান্ত নিলাম। চলেও এলাম ২০১৭ এর নভেম্বর মাসে।
বাসায় এসেও ভালো লাগে না ব্যস্তময় জীবন থেকে এসবে আর এডজাস্ট হয়না।
আবার কয়েকটা পলিটেকনিকে সিভি ড্রপ করলাম। একটা থেকে কল এলো, পরীক্ষা, ভাইভা, সব শেষে ডিসেম্বরে জয়েন করলাম। সেলারি তেমিন বেশি না হলেও জয়পুরহাটের মত শহরে এ সেলারিতে একটা পুরুষ মানুষ খুব ভালো সংসার চালাতে পারে। অন্যান্য কোন খরচ যেহেতু নেই শুরু করে দিলাম।
শুরু করলাম অফিস এক্সিকিউটিভ হিসেবে কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে পাশাপাশি টিচার, একাউন্টেন্ট, গ্রাফিক্স ডিজাইনার সব হয়ে হিমশিম খেয়ে গেলাম। কিন্তু সেলারি থাকলো সেই একই জায়গায় ১২,০০০/-
তার উপর ই ডি স্যারের ব্যবহার খারাপ হতে থাকলো। ৫ মাস পরে ছেড়ে দিলাম চাকরিটা।
এর পর পরই বিয়ে হয়ে গেলো। চলে এলাম পঞ্চগড়ে। বেকার থাকার সাধ নেই, চাকুরী করার ইচ্ছাটা মন থেকে নেই, বর ও আমার ইচ্ছা। এক ছেলে সন্তানের মা হলাম আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু কিছু করার ইচ্ছাটা মনে আছেই।
০৫/০১/২০২০ এ ফুটফুটে ছেলে বাচ্চার মা হয়ে গেলাম আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর সব চেয়ে বড় নিয়ামত আমার ঘরে🥰🥰 কিন্তু সি সেকশন ডেলিভারি, ডেলিভারিতে কম্পিলিকেশন সাথে গল ব্লাডারের সমস্যায় দীর্ঘ এক মাসেও বেড থেকে একা উঠতে পারলাম না। দের মাসে হালকা সুস্থ হলে এক মাস ২২ দিনের বাচ্চাকে নিয়ে চলে এলাম পঞ্চগড়ে।
তারপরে একা সংসার, বাচ্চা, সাথে কিছু করার ইচ্ছা! কেন না চাকুরী আর কল্পনাতেও নেই।
এবার আমি ৫০০০ সাথে আপু এড হলো ৩০০০/- এর ৮০০০ টাকা দিয়ে পাইকারি কিছু থ্রিপিস কিনলাম। উদ্দেশ্য অনলাইনে সেল করা। চেষ্টা চললো কিন্তু সঠিক ভাবে না। সেল হলো কিন্তু অফলাইনেই৷।। তারপর অফলাইনে সেলের উদ্দেশ্যে আবারো গজ কাপড় আনালাম ঢাকা থেকে। সাথে কুশন কভারে হাতের কাজ শুরু করলাম।
খিমারও নিয়েছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ অনলাইন অফলাইন মিলে সেল হতে থাকলো।
এরই মাঝে আল্লাহর রহমতে পৌছে গেলাম প্রিয় পরিবার 🌺নিজের বলার মত একটা গল্প ফাউন্ডেশনে🌺 যে সময় গ্রুপের দেখা পেলাম সেই সময়টায় ব্যক্তিগত ভাবে মানসিক দিক থেকে খুবই খারাপ সময় কাটছিল। কিন্তু শ্রদ্ধেয় স্যার ও স্যারের সেশন গুলো যে সে সময় আমাকে কিভাবে সাপোর্ট করেছেন তা স্যারের সম্পুর্ন অজানা, আমি আর আমার আল্লাহ জানেন❤️❤️❤️
পরিবারের সহায়তায় রেজিষ্ট্রেশন করে ফেললাম। চললো ভালো মানুষ ও উদ্যোক্তা হওয়ার সেশন চর্চা।
কিন্তু সত্য কথা বলতে পুরো সন্তুষ্টিটা মন থেকে ছিলো না। কেনা বেচা করে ব্যবসা করছিলাম। পাইকারি এনে খুচরা বিক্রি। কিন্তু নিজের কোন উদ্ভাবন ছিলো না কারণ এইটাই ছিলো। উদ্যোক্তাকে তো পাইকারি আর খুচরার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে নাহ!
এর পরে নতুন কোন টাকা আর এড করিনি।
বরফি বানিয়ে শুরু করেছিলাম আবারো একবার।
থ্রিপিস সেলের কিছু টাকা দিয়ে কিনে ফেললাম কুশিকাটার সুতা ও যাবতীয় জিনিস। বেবিদের গলা, টুপি বানানো চলতে থাকলো, পিক দেখে প্রি অর্ডারও আসতে থাকলো আলহামদুলিল্লাহ।
এর পরে এড হলো বুটের বরফি, যা প্রথম কাস্টমার নিজে থেকে চাওয়ার পরে এসেছে, পায়েস আলহামদুলিল্লাহ। পাঞ্জাবি আর কুশন কভারে সুই সুতার কাজ চলতে থাকলো, চলছে। যার প্রতিটা ডিজাইন নিজেই করি আলহামদুলিল্লাহ।
এখন আমি সন্তুষ্টির সাথে কাজ করি। কষ্ট হয়, সময় ম্যানেজ করতে হয় ছোট বাচ্চাকে নিয়ে কিন্তু আমি খুশি।
কিছু লোকের কিছু কথা কানে আসে কিন্তু মন আর মগজে জায়গা দেই না।
এখন আমি আলহামদুলিল্লাহ একটা আত্মতৃপ্তির সাথে যেকোনো কাজ করছি।
একজন ক্রেতা যখন বিশেষ করে আমার হোম মেইড ফুডের রিভিউ দেয় আমার অসম্ভব ভালো লাগে, আর ভাবি এই ভালো লাগাই আমি খুঁজেছি আলহামদুলিল্লাহ।
আপনাদের সাথে আছি
🌺সুজির বরফি/কাটলী
🌺চালের আটার বরফি/কাটলী
🌺বুটের ডালের বরফি
🌺স্পেশাল পায়েস
🌺গরুর ভুড়ি
🌺গুড়ো মশলা
🌺খাদী পাঞ্জাবী
🌺হাতের কাজের পাঞ্জাবী
🌺কুশিকাটার পন্য নিয়ে আলহামদুলিল্লাহ
আমার পেইজঃ
https://www.facebook.com/Prottasha70/
বরফি/কাটলী আইটেম বেছে নেয়ার কারন ছিলো বেশিরভাগ বাসায় এগুলো করা হয় বছরে একবার, সেও আবার শবে বরাতে। কোন কোন বাসায় খাটুনি, পারফেকশন আর সময়ের জন্য করাই হয়না। কিন্তু পছন্দ প্রায় সকলের আলহামদুলিল্লাহ।
গরুর ভুড়িতেও ছিলো একই চিন্তা। ভালো লাগে না এমন মানুষের অভাব কিন্তু ঝামেলা লাগে জন্য গরুর গোশের মত আর গরুর ভুড়ি খাওয়া হয় না।
দুই জিনিসই ছোট বেলায় আমার বাসাতেও রেগুলার করা হতো না।
আজ একা কাজ করছি কিন্তু ইনশাআল্লাহ আপনাদের দোয়া ও ভালোবাসা থাকলে এই কাজের মাধ্যমেই কিছু মানুষের কর্মসংস্থান করতে পারবো ইনশাআল্লাহ।।।
📌"স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৬৯৫
Date:- ০৯-১০/১২/২০২১ইং
আমাতুন নূর রোজ
ব্যাচ নংঃ ১৩
রেজিষ্ট্রেশনঃ ৫৪২৯৫
জেলাঃ পঞ্চগড়