শেষ হইয়াও হইল না শেষ
🌺আমার জীবন থেকে,, আমার জীবনের গল্প🌺
______________________________ গল্প শুরু
ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানার উন্নয়নশীল একটি গ্রাম কান্দিপাড়ায় আমার জন্ম।ঐখানে আমাদের পরিবারকে "সরকার বাড়ি" নামে একডাকে চিনে। ঐখানে আমাদের পরিবার থেকে চল্লিশ একর জমি দান করা হয়েছে।যার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে একটি গার্লস হাইস্কুল,একটি বয়েজ হাইস্কুল, একটি ডিগ্রি কলেজ,পাঁচ থেকে ছয়টি কিন্ডারগার্টেন স্কুল, একটি মসজিদ,একটি মাদ্রাসা,একটি সরকারি প্রাইমারি স্কুল এবং একটি সাবরেজিস্টার অফিস।
আমার দাদাভাই সেই পাকিস্তান আমলের বি,এস,সি, বিটি ছিলেন।তিনি গার্লস হাইস্কুল এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।তাঁর নামঃ-এ,কে,এম,আমানত উল্লাহ।আমার বাবা একাই একটি ছেলে ছিলো, আমার দাদার আর ফুফুরা ছিলেন পাঁচজন।সবাই তাঁরা উচ্চ শিক্ষত হয়েছিলেন। আমার দাদুও বনেদিপরিবার থেকেই এসেছিলেন।তাঁর নাম সুফিয়া খানম ছিলো।
_______________দাদা ভাই কষ্ট করে লেখাপড়া করেছেন
আমার দাদাভাই বলতেন ওনি খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করেছিলেন। কারণ আমার দাদাভাই যখন ছোট্ট ছিলেন তখন ওনার বাবা মারা যায়।আমার বড় মা (অর্থাৎ দাদাভাই এর মা) তখন ওনার সাত জন ছেলেমেয়েকে নিয়ে বিপদে পড়ে যান। কারণ তখন না'সরিক প্রথা ছিল। তবে ভাগ্য ভালো যে দাদাভাই এর দাদা বেঁচে ছিলেন। তাই ওনি সরাসরি নাতিদের নামে সম্পত্তি লিখে দিয়েছিলেন। একে একে দাদাভাই এর বাবা,তারপর দাদা এবং ছোট ভাই টা মারা যায়। তখন পরিবারে দাদাভাই আর ওনার পাঁচ বোন ও মা বেঁচে থাকে। বড় মার পরার জন্য একটি কাপড় ছিলো। ওনি স্বামী হারিয়ে আর্থিক কষ্টের মধ্যে পরে যান।ওনি গোসল করলে অর্ধেক কাপড় শুকাতেন আর বাকি অর্ধেক কাপড় পরতেন। ওনার খুব আত্মসম্মানবোধ ছিলো। তাই ওনি কারোর কাছ থেকে কোন সাহায্য নিতেন না। এমন কি ওনি জমিদার বংশের মেয়ে হয়েও বাবার বাড়িতে মৃত স্বামীকে ছোট করতে চাননি।
দাদাভাই এন্ট্রান্সপরীক্ষা (মানে এখনকার এস,এস,সির সমমান)পাস করার পর ময়মনসিংহ সদরে গেলেন চাচার বাসায় থেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হবেন বলে। কিন্তু চাচা প্রথমে রাজি হতে চান নি।তারপর দাদাভাই এর অনেক অনুরোধ করার পর রাজি হলেন। থাকতে দিলেন ঘোড়ার ঘরে। অর্ধেক ঘরে ঘোড়া থাকতো আর অর্ধেক ঘরে দাদাভাই থাকতেন। অথচ ময়মনসিংহের বাড়িটা ছিলো বিশাল বড়। ঐ সময়ই দুতলা দুপলেক্স বাড়ি থাকা সত্যেও।
খাতাবই কিনার টাকা থাকতো না। অন্যের বই ধার করে এনে পড়াশোনা করেছিলেন। আর চাচার বাসার যাবতীয় ফরমায়েশ ও করে দিতে হতো কোনদিনও নাকি ওনি সকালের নাস্তা খেয়ে কলেজে যেতে পারতেন না। বাড়িতে আসলে মা-বোনদের জন্য ও কাজ করতেন। জমি চাষ করা থেকে শুরু করে ফসল মারানো পর্যন্ত। ছুটিতে এসে এসে এই কাজগুলো করতেন। কোন লোক রাখতেন না। মুজুরি দিতে পারবেন না বলে।
একটি পরিবারের প্রধান মারা গেলে সেই পরিবারে কঠিন ধ্বস নামে। তার বাস্তব প্রমান ছিলএটা।
তারপরও দাদাভাই থেমে থাকেনি পড়াশোনা শেষ করে। যখন কিনা সামান্য লেখাপড়া জানলেই চাকরি হতো, সেইখানে ওনি বি,এস,সি,বিটি হওয়ার পরও তিনি উচ্চ পদে চাকরি না করে গার্লস হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং ওনার দাদার স্থাপিত বয়েজ হাইস্কুল কে উন্নতির সর্ণ শিখরে নিয়ে যান এবং এ স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে নিজের গ্রামের মানুষের জন্য আত্মত্যাগ করলেন। তার ই ফলশ্রুতিতে বর্তমানের কান্দিপাড়া।
এক পুরুষ জঙ্গল পরিষ্কার করে আর সাত পুরুষ সেটা ভোগ করে।
আমার বাবা পড়াশোনা করেছিলেন ঠিকেই কিন্তু খুব আরাম প্রিয় এবং সৌখিন ছিলেন। মন চাইলে কাজ করেছেন আর মন না চাইলে কাজ করেন নি।দাদার রেখে যাওয়া অনেক জমি আর মার্কেটের ভাড়া এবং মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দিয়ে ভালোই জীবন যাপন করেছেন। অথচ ওনিও ইন্জিনিয়ার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে আব্বু আর দাদাভাই পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন। যুদ্ধের সময় আমাদের কাঠের দোতালা বাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং আমার দাদা দাদুসহ আব্বুরা ছয় ভাই-বোন ও বড় মায়ের, দেখা মাত্রই গুলির ওয়াডার হয়েছিল।
আমার আম্মুও খুব পরিশ্রমি ছিলেন। আম্মু যখন অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল তখন আব্বুর সাথে বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু আম্মু পড়াশোনা ছাড়েন নি আমার দাদাভাই + আমার আব্বু, আম্মুর পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে পড়াশোনা করিয়েছিলেন। আম্মু বর্তমানে বি,এ,বি,এড এবং হাইস্কুলের শিক্ষীকা। ওনার এখনো১৩-১৪ বছর চাকরির সময় আছে। আমার মাও একজন মহীয়সী নারী।কারণ আমাদের পরিবারটা ছিলো অনেক বড়। সব সময়ই ৩০- ৪০ জন মানুষ রোজ আমাদের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করতো।কারণ সব সময়ই দশ বারো জন জায়গির থাকতো দূর-দূরান্ত থেকে এসে লেখাপড়া করার জন্য। আব্বুর ফোফাত ভাই বোন রাও এখানে মানুষ হয়েছে। আমার ফুফু ছিলেন পাঁচ জন। চার পাঁচ জন কাজের লোক ছিল। তারপরও এক ছেলের বউ হিসেবে সব দেখাশোনা করা এবং তদারকি করার পরও আম্মু পড়াশোনা ছাড়েন নি। তারপর আবার হলাম আমরা পাঁচ ভাই বোন । সব মিলিয়ে বিশাল দ্বায়িত্ব। সব পালন করেও পড়াশোনা করেছিলেন।
ঠিক ঐ সুত্রধরে আমিও আগানোর চেষ্টা করেছি।
২০০৪ সাল।
আমি আব্বু-আম্মুর বড় সন্তান ছিলাম।এইচ,এস,সি পরীক্ষার রেজাল্ট আউট হয়েছে। কেমিস্ট্রি তে ফেল করেছি। কারণ আমি আমার আম্মুর ফোফাতো ভাই এর ছেলের সাথে একটু একটু মন দেয়া নেয়ার কাজ চলছিল। ঐ" কেমিস্ট্রি তে অনার্স পড়তো। সেই সুবাদে আমাকে সে কেমিস্ট্রি পড়াতো। যাই হোক আম্মু বুঝতে পারলো আর আব্বুকে বললেন। এদিকে রেজাল্ট ও খারাপ হলো। একটা কঠিন মন খারাপ 😭। আমাকে না জানিয়ে বিয়ে ঠিক করে ফেললেন। ওনারা প্রতিষ্ঠিত ছেলে ছাড়া বিয়ে দিবেন না। আবার আমাকেও সময় দিবেন না।বিয়ে ঠিক ঠাক করে কার্ড বিলি করে আমাকে বাড়িতে নেয়া হলো। যে মেয়ে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে স্কলারশিপ পেয়েছিল সে এভাবে ঝরে পরলো। বিয়ে হয়ে গেল ২০০৪ এর ১৪ ই ডিসেম্বর। শুরু হলো জীবনের নতুন অধ্যায়। নতুন পরিবেশে নতুন মানুষদের সাথে মানিয়ে নিতে নিতে কখন যে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম। ভুলে গিয়েছিলাম আমার এমবিশান, ভুলে গিয়েছিলাম আমার নিজেরও একটা সত্তা আছে। আমি শুধু একজনের স্ত্রী ছাড়াও আমার একটা নিজের দেবার মতো পরিচয় থাকা উচিৎ। পড়াশোনা টাও আবার শুরু করেছিলাম অনেক দেরিতে। ততদিনে পড়াশোনা শেষ করতে করতেই সরকারি চাকরির বয়স চলে গেল। যে মেয়েটা স্বপ্ন দেখতো হয়তোবা একজন বিশ্বক্ষ্যাত কার্ডিওলজিষ্ট (ডাক্তার) হবে অথবা একজন বি,সি,এস ক্যাডার😭😭😭😭.......... ….....…..…............…......................
না আমি কিছুই হতে পারিনি। পারিনি বাবার মৃত্যুর সময় পাশে দাঁড়াতে😭😭😭😭😭😭😭, পারিনি মায়ের পাশে দাঁড়াতে, পারিনি বড় বোন হিসেবে ভাই বোনদের পাশে দাঁড়াতে।
শুধু মন রক্ষা করে চলতে চলতে অনেক টা সময় পার হয়ে গেল।
যাই হোক, এত কিছুর পরেও যখন আমি উদ্যোগক্তা হবার স্বপ্ন দেখার সাহস করেছি শুধু আমাদের শ্রদ্ধেও মেনটর্স" ইকবাল বাহার" স্যারের নিজের বলার মতো একটা গল্প ফাউন্ডেশন এর জন্য। এই ফাউন্ডেশনের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম সাবিনা ইয়াসমিন আপুর মাধ্যমে। আমি ওনাদের দুইজনের প্রতিই কৃতজ্ঞতা জানাই আমার অন্তরের অন্তস্তল থেকে।
আজ এখানেই শেষ করছি গল্প। তাছাড়া একদিনে তো একটা জীবনের সব বলে বা লিখে শেষ করা যায় না। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের
ছোট্ট গল্পের মতো --
"শেষ হইয়াও হইল না শেষ "।
সবার সুস্বাস্থ্য কামনা করে এবং দোয়া চেয়ে এখানেই শেষ করছি।
আল্লাহ হাফেজ।
__________________________________________________
📌"স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৬৮৭
Date:- ০১/১২/২০২১ইং
সুলতানা ফেরদৌস তানিয়া,
ব্যাচ নং--১৪,
রেজিষ্ট্রেশন নং—৫৯৬৭০।