লেখাপড়া কে কোরবানি দিয়ে চলে গেলাম বিদেশ নামক প্রবাসে।
✍️আমার ছোট্ট বেলা বৈশাখের আমেজ ছিল ভিন্ন।ছোট্ট বেলায় বৈশাখের এক মাস আগে থেকেই বৈশাখের আমেজ শুরু হয়ে যেত। প্রত্যেকদিন গণনা করতাম কবে বৈশাখ আসবে?কি কিনব সে নিয়ে একটি তালিকা করে ফেলতাম। বাবা- মা কাছে মেলা থেকে কিছু কেনার জন্য টাকা চাইতাম এবং আগে থেকেই কিছু টাকা সংগ্রহ করে রাখতাম বৈশাখী মেলার জন্য। বৈশাখের দিন সকাল বেলা থেকেই আমি উগ্রীব হয়ে উঠতাম কখন যাব মেলায়? ছটফট করতাম কখন যাব, দেখব মেলা,কিনব নানা কিছু। বন্ধুরা মেলা থেকে অনেক জিনিস কিনে আনত এবং এসে আমাকে দেখাতো, প্রচন্ড রাগ হত। আম্মুর কাছে গিয়ে বলতাম কখন মেলায় নিয়ে যাবে সকল বন্ধুরাই সব খেলনা কিনে নিয়ে এসে পড়ল কবে কিনব,খেলব কখন?বাবা সকল কাজকর্ম শেষ করে সাইকেলে চড়িয়ে আমাকে মেলায় নিয়ে যেতেন।সেকি আনন্দ লাগতো,সেটা বলে বুঝাতে পারবনা। বাবা আগেই বলে দিতেন বেশী কিছু কিনে দিতে পারবনা। তাও মন খুন্ন করতামনা। মেলায় গিয়ে বায়না ধরতাম, গাড়ী,খেলনা পিস্তল, বাশিঁ, পুতুল, মোবাইল ও নানা ধরনের বাহারী খাবার কিনে দিতে হবে।আব্বু সাধ্যমত জিনিস কিনে দিতেন আমায়। মেলায় আব্বু বলত যত পার খেতে পার। আমার আবদার গুলো ছিল অতি নগন্ন।কিন্তু আনন্দের কমতি ছিলনা।গ্রামের মেলা নানা ধরনের জিনিসের দোকান বসত,দোকানিরা সেসব জিনিস আমাদের কাছে ক্রয় করত। কু্মাররা মাটির তৈরি হাড়িঁ পাতিল, ষাড়ঁ, ঘোড়া, হাতি, সিংহ,বাঘ বানিয়ে মেলায় নিয়ে বিক্রি করত। মেলাতে গিয়ে বাছাই করতাম কি কিনব?এটা না ওটা, সবই ভাল লাগত। সেসময় দেখতাম সকল অকল্যাণ দূর করার জন্য মঙ্গল শোভাযাত্রা,ও র্যালি করত যা বাঙ্গালী ইতিহাস ঐতিহ্য তুলে ধরা হত। নাগর দোলা চড়া, গান শোনা,আরও কত কি করেছি।
🌺যৌথ পরিবার 🌺
আমাদের একটি সুন্দর পরিবার ছিল, সেই পরিবারে ছিল আমার দাদা আমার দাদী আমার বাবা আমার কাকা আমার মা। আমার বাবারা ছিল দুই ভাই , আমার দাদা এবং দাদী এমনকি আমার কাকা কাউকে আমি দেখি নাই, আমার জন্মের পূর্বেই উনারা পরলোকগমন করেন, আমি তাদের সকলের জন্য দোয়া করি মহান রাব্বুল আলামীন তাদেরকে যেন জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করেন, আমরা সবাই যৌথ পরিবারে ছিলাম, দাদা মারা যাবার পর আমার বাবা এবং আমার কাকা আলাদা হয়ে গেছেন,
🌹বাবার পরিচিতি 🌹
আমার বাবা ছিলেন আমার দাদার বড় ছেলে, আমার বাবা ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা আমরা তখন সবাই ছোট, বাবার উপার্জন দিয়ে আমাদের খুব ভালো ভাবেই সংসার চলছিল । আমাদের দিনগুলো মোটামোটি ভালোই কেটে যাচ্ছিলো।
🌺মা এর পরিচিতি 🌺
আমার মা ছিলেন আমার নানার সংসারের প্রথম কন্যা সন্তান,
আমার মার শিক্ষাগত যোগ্যতা তৎকালীন সময়ে অষ্টম শ্রেণী পাস করেছিলেন, তারপর আমার মার বিবাহ হয়ে যায় আমার বাবার সাথে। আমার মা ও ছিলেন একজন চাকুরিজীবী।
তিনি ছিলেন একজন স্বাস্থ্যকর্মী।
আমাদের ছিল ছোট একটি সংসার, যেখানে আমরা সদস্য সংখ্যা ছিলাম মাত্র পাঁচজন, পাঁচজনের মধ্যে হচ্ছে দুই বোন আমি সহ তিন ভাই।
আমাদের পরিবারের সকলের বড় ছিল আমার বড় আপু তারপর আমার ভাই, তারপর মেজ আপু তারপর আমি তারপর আমার ছোট ভাই।
তখন আমার বড় বোন এবং বড় ভাই এমনকী আরো এক বোন স্কুলে পড়াশোনা করতো।
তখন আমি ছোট।
ওই সময় আমাদের সংসারটা খুবই সুন্দর ভাবে চলে যাচ্ছিলো।
এমতাবস্থায় আমার বাবা খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন থেকে শুরু হয় আমাদের সংসারে নানান ধরনের সমস্যা,
বাবাকে চিকিৎসার জন্য অনেক হসপিটালে নেওয়া হয় চিকিৎসা করানো হয় তারপর কিছুটা সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন বাড়িতে।
তার কিছুদিন যেতে না যেতেই আমার বাবা আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন।
সেই অসুস্থতা হতে আর সুস্থ হতে পারেননি,এই অসুস্থতা নিয়েই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে আমাদের এতিম করে মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যান চিরতরে।
আমি সব সময় দোয়া করি আমার বাবার জন্য মহান রাব্বুল আলামিন যেন আমার বাবাকে বেহেশতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করেন।
তারপর থেকেই নেমে আসে আমাদের জীবনে অন্ধকারের ছায়া, মা চাকুরী ছেড়ে চলে আসেন আমাদের মাঝে।সেই থেকে মা একা সংসার এবং আমাদের দেখাশুনা শুরু করেন,
আমাদের কৃষি জমি ছিল অনেক, আমার বাবা মারা যাবার পর সেই কৃষি জমিতে হাল চাষ থেকে শুরু করে রোপন বাছাই মাড়াই, কৃষিকাজ বলতে যা কিছু আছে সম্পূর্ণ কাজ আমার মা এবং আমার বড় বোন করতেন,
প্রতিটা দিন প্রতিটা মাস প্রতিটা বছর।
এমনকি বছরের পর বছর আমার মা কষ্ট করে আমাদেরকে লালন পালন করে শিক্ষিত করে বড় করে তুলেছেন।
তারপর বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেলো আমি তখনও ছোট, প্রথমশ্রেণীতে পড়ি, আমি আবার পড়ালেখা একটু ভালো ছাত্রই ছিলাম।
🥀আমার স্কুল জীবন 🥀
আমি তখন আমাদের গ্রামের বাড়ি সরকারি স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে অধ্যায়ন করি তারপর দ্বিতীয় শ্রেণি তারপর তৃতীয় শ্রেণি শেষ করলাম।
তারপর আমার মার চিন্তা ভাবনা ছিল আমাকে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করাবেন, যেই চিন্তা সেই কাজ
আমি ভর্তি হয়ে গেলাম আমাদের গ্রাম থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে একটি আলিয়া মাদ্রাসা ছিল সেখানে ভর্তি হলাম আবার সেই প্রথম শ্রেণীতে।
তখনও আমাদের সংসারে টানাপোড়েন লেগেই ছিল।
মা চিন্তা করেছিল এভাবে আর কতদিন, আমাদের সকলের লেখাপড়ার খরচ চালাতে অনেক সমস্যা হচ্ছিল ওই সময় আমাদের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না, আমাদের জায়গা জমি কৃষিজমি অনেক ছিল। তখন আমার মা চিন্তা করল মালয়েশিয়াতে যাবেন কাজের জন্য, মালয়েশিয়াতে প্যানাসনিক কোম্পানি তখন বাংলাদেশ থেকে কিছু নারী শ্রমিক নেবে,
তখন আমার মা আমাদের সংসারের সমস্ত দায়িত্ব আমার বড় বোন এবং ভগ্নিপতির হাতে তুলে দিয়ে আমাদের সুখ-শান্তির এবং ভালোভাবে যেন লেখাপড়া করতে পারি সেই জন্য আমাদের মা চলে গেলেন বিদেশের বাড়িতে ।
আমার মা আমাদের দুই বোন এবং তিন ভাই দের জন্য অনেক কষ্ট করেছেন
আমি যখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি তখন আমার মা আমাদের জন্য বিদেশ ত্যাগ করে দেশে চলে আসেন।
দেশে এসে তারপর আমার মেজ বোন কে বিয়ে দিয়ে দেন।
আমার ছোটবেলা থেকেই অনেক ইচ্ছে ছিল আমি একজন শিক্ষক এবং তার পাশাপাশি ছোটখাটো একজন ব্যবসায়ী হবো। সেই জন্য ভালোভাবে লেখাপড়ার প্রতি নজর দিলাম,
এমনি ভাবেই কেটে গেল আমার জীবন থেকে দশটি বছর পড়াশোনা নিয়ে।
এস. এস. সি ভালভাবেই পাশ করলাম।
তারপর এইচ. এস.সি তে ভর্তী হলাম, লেখাপড়া ভালই চলছিলো, হঠাৎ আসলো ঝর সেই ঝর ছিলো আমার বড় ভাই বিদেশ সফর, কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস আমার বড় ভাই বিদেশ যেতে পারেননি। তারপর চেষ্টা ছোট ভাইকে বিদেশে পাঠানো কিন্তু তাও হলো না, ছোট ভাই বিদেশের জন্য আনফিট হয়ে গেলো।
এখন সবার নজর আমার দিকে আমি কি করবো লেখাপড়া করব নাকি বিদেশে যাব সবার মধ্যে একটা প্রশ্ন।
তখন সবাই আমাকে বলছে যে লেখাপড়া করার দরকার নাই আর এখন পরিবারকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য তোকে বিদেশ যেতে হবে, যেই কথা সেই কাজ লেখাপড়া কে কোরবানি দিয়ে চলে গেলাম বিদেশ নামক প্রবাসে। প্রবাসে এসে এইচ. এস.সির ফলাফল শুনতে পাই খুবই ভালো ভাবে পাশ করেছিলাম।
সেই থেকে শুরু হয়ে গেল প্রবাস নামক জেলখানায় জীবনযাপন।
সম্মানিত প্রিয় বন্ধুগন আপনাদের মধ্যে যাদের বাবা মা এখনো পৃথিবীতে বেচে আছে আমি আপনাদের প্রতি অনুরোধ করছি মা বাবার প্রতি খেয়াল রাখুন মা বাবার প্রতি আরো বেশি যত্নবান হোন।
বাবা মা সন্তানের জন্য বেহেশত।
যাদের বাবা বেঁচে নেই তারাই একমাত্র বুঝে আসলে তাদের জীবনের ঘাটতি টা কতো খানি।
আমি আমার জীবনের গল্প প্রথম পর্বটি পেশ করলাম। আমার লেখায় কোন ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। এতক্ষণ ধরে আপনারা যারা সময় নিয়ে আমার বাস্তব জীবনের গল্পটি পড়েছেন আপনাদের সকলের প্রতি অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি
প্রিয় বন্ধুগণ আপনারা সকলেই ভালো থাকবেন আপনাদের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করে আজকের গল্পের ইতি টানছি, আল্লাহ হাফেজ।
ইনশাআল্লাহ গল্পের পরবর্তী পার্ট ধারাবাহিক ভাবে লিখে যাবো, ইনশাআল্লাহ। সবাই আমার পরিবারের জন্য মন থেকে দোয়া করবেন।
📌"স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৬৯৯
Date:- ১৭/১২/২০২১ ইং
মোঃ মোহাসীন হানিফ
ব্যাচ:১৫
রেজিস্ট্রেশন নাম্বার ৭২৮৫৭
জেলা : গাজীপুর
উপজেলা :কালীগঞ্জ
রক্তের গ্রুপ এ পজেটিভ
🇱🇷 প্রবাসী:লাইবেরিয়া(পশ্চিম আফ্রিকা