২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারী,, সকাল ৭.০০ টায় ঘর থেকে  বের হওয়ার সময় মায়ের  গলা জড়িয়ে  ধরে  কেঁদেছিল। বলেছিল,  " আম্মু,  তোমাকে অনেক  জ্বালিয়েছি,,,,  আমাকে মাফ করে দিও।  মা ছিল  নির্বাক,,,,  সেদিন  শুধু চোখ  মুছেছিল  আসিফের  মা।  মনে মনে মা ভাবছিলেন,,,,  ঋণি তো আমি তোমার  কাছে  বাবা,,,  "এতো কম বয়সে  আমাকে রক্ত দিয়ে  বাঁচিয়ে  এনেছো।"

আসিফের বাবা দেশের  বাইরে  থাকতন।  সংসারে  মা আর একটা  ছোট  ভাই ।  ভাই' টা  আসিফের ১৬ বছরের ছোট ।  

যে প্রসঙ্গে  কথা বলছিলাম,,,,  

২০১৩ সালের  ৫ জানুয়ারী,,, আসিফ  স্টুডেন্ট  ভিসা নিয়ে  পারি জমায় জামার্নীর  ফ্রাঙ্কফুট। ওখানে  গিয়ে  একবছর  তার লেগে  যায়  ভাষা ইন্সটিটিউটে ভাষা শিখতে।  পাশাপাশি  কাজ করতে হয় বিভিন্ন  রেস্টুরেন্টে,  কখনো  কারো বাসায় কাপড় লন্ড্রি  করা,  কখনো  ক্লিনার,,,,,  

জীবনের  পথটা,,,,  খুব  কম বয়সেই  আসিফের জন্য ,,,,,  দূর্গম হয়ে যায় ।  ইউরোপে ১২/১৪ ঘন্টা  একাধারে  কাজ  না করলে,,,  প্রতিমাসের খরচটা ওঠে  আসে না ।  নতুন  মানুষ  হিসেবে কাজ পাওয়াটাও ছিল  দুর্সাধ্য।  

 চেষ্টা  করে  মিউনিখ শহরের " ইউনিভার্সিটি  অফ ডেগেনডর্ফ" এর ইন্টারন্যাশনাল ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে  তার অনার্স  এ্যডমিশন হয়ে যায়।  যেতে হবে  ফ্রাঙ্কফুর্ট  ছেড়ে  মিউনিখের ডেগেনডর্ফ,,,,, 

এরই মধ্যে  ওখানে  বাসা ঠিক  হয়ে গেছে ।  আসিফের বাবার পক্ষে  আসিফের পড়াশুনার  খরচ  চালানো কঠিন  হয় পড়ায়,,,,  আসিফ জার্মানী  ভাষায় পড়তে  চায় ঐ  ইউনিভার্সিটিতে,,,,  

জামার্নী ভাষায়  পড়লে টিউশন ফী লাগবে না ।  

যাই হোক,,,,  যা বলছিলাম,,,,,  ডেগেনডর্ফে যাওয়ায়  কয়েকদিন  আগে ,,,,,,  ভারী কাজ করতে  গিয়ে,,,,, হঠাৎ  তার এ্যবডোমেনে প্রচুর  ব্যাথা শুরু  হয়,,,,, তার রেস্টুরেন্ট মালিক  তাকে হাসপাতালে নেয়ার  ব্যবস্হা না করে  তাকে বাসায় চলে যেতে বলে।  

বাসায় ফিরবে,,,  ততক্ষনে  সেই  সামর্থ্যও তার শরীরে  ছিল  না ।  ব্যাথায় কাতর হয়ে প্রায় অচেতন অবস্থায়  পরে থাকে রাস্তার উপর ,,,,,,,  

একটা  কথা  আছে,  যার কেউ  নাই ,,,  তার জন্য  আল্লাহ  আছে ।   একজন টেক্সিড্রাইভার সেদিন  আসিফকে নিয়ে  যায় একটি হাসপাতালে!  সেখানে  তার একটা  অপারেশন  হয়!  মাত্র  ২১বছর বয়সের একটি  ছেলে,  যে একটা  ইনজেকশন  পুশ করতেও ভয় পেতো,,,,  এদিকে  তার মা,,,  ছেলের  কোন খবর না পেয়ে পাগল প্রায়,,,,  যে ছেলে মাকে ফোন  না দিয়ে  খাবার  খায় না,,,, 

 আজ দুই  দিন পার হয়ে গেলো,,,  কোন ফোন  নেই ।  মায়ের  মন,,,,  সন্তান  যত দূরেই থাকুক,,,,  সন্তানের কষ্ট  মায়ের  মনকে নাড়া  দেয়।  আসিফের ফোনটাও বন্ধ  আসছিল,,,, 

মা, আল্লাহর  কাছে  হাত তুলে ছেলের  জন্য  কান্না করে ,,,  দোয়া  করে,,,,  আল্লাহ  যেনো তার সন্তানকে দীর্ঘ  নেক  হায়াত  দান  করে ,,,,  

এরই মধ্যে  এক বিদেশির ফোন ,,,  যার কোন ভাষাই আসিফের  মা  বোঝে নি,,,  শুধু  বুঝতে  পেরেছে,,,  আসিফ ,,,,,  হসপিটাল,,,, এই দুইট শব্দ। 

চারদিন  পর হাসপাতাল  থেকে  ফিরে ,,,,  আসিফের তৈরি  হতে হয় ডেগেনডর্ফের পথে ,,,  যেখানে  তার ইউনিভার্সিটির ক্লাস শুরু  হওয়ার  আগে  গিয়ে  পৌঁছাতে  হবে,,,,,  

ভালো  একজন মানুষ Walter Ludwig Gaiger,,,  আসিফের বাড়িওয়ালা ,,,,  গাড়ি  নিয়ে  স্টেশনে  আসে আসিফকে এগিয়ে  নিতে ।  আসিফের সুটকেসটাও ঐ বয়স্ক ভদ্রলোক  হাতে নিয়েছেন ,,,  আসিফ হাসপাতাল  থেকে  ফিরেছে  জেনে।  যত দিন যায় আসিফের  আচরণ, সততা,  বিনয় ও ধর্মানুরাগী মনোভাব  আকৃষ্ট  করে  ক্যাথলিক খ্রিষ্টান গাইগার' কে,,,,  যিনি  ছিলেন সন্তান হীন,,,,  আসিফের  আগমন,,, তার জীবনে  সন্তানের  চাহিদা  পূরণ  করে ।  পরবাসে  এমন একজন মানুষের  সান্বিধ্য আসিফের মরুভূমির মতো জীবনে ছিল  অনাকাঙ্ক্ষিত  বৃষ্টির মতো! 

একটা  কথা  বলা হয়নি,  আসিফ  একটু ইগোয়েস্টিক! কেউ  তাকে কোন প্রকার  অবহেলা  করলে,  তার কাছে   কোনদিন  আর যেতো না,,,  আসিফ। 

আধুনিকতার  এই সময়েও কোন এলাকায় বর্ণবাদ  এখনো মানুষের  মধ্যে  আছে ,,,  সেটা প্রথম  জানতে পারে আসিফ  যখন  ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস  করতে  যায়!  

যাই হোক,,,  ক্লাস  করছিলো আসিফ ,,,  কিন্তু  কোনভাবে  সেখানে  নিজেকে  মানিয়ে  নিতে পারছিলো না।  আসিফের বাড়িওয়ালা  গাইগার ততদিনে  আসিফের,  ভালো একজন বন্ধু  হয়ে যায়!  জানতে চায়,,  কি করতে চায় আসিফ?  

আসিফ  জানায়,  একে তো আমার শরীররটা ভালো যাচ্ছে  না , ,,,  তার উপর  জার্মানী ভাষায়  পড়াশোনা  চালিয়ে  যাওয়া,,, যত দিন যাচ্ছে  ততই  কঠিন  হয়ে যাচ্ছে ।  

গাইগার বললেন,  "যদি  তোর  বাব-মা’র  কোন আপত্তি  না থাকে,,,,  আমি তোকে আমার সন্তান  হিসেবে  এখানে  রেখে  দিতে চাই । "

আমরা সবাই  রাজী। কিন্তু  দেশের  আইন অনুযায়ী  তো কাজ করতে  হবে ।  কোর্টে  কেস ফইল হলো,,,, এসব প্রসেসিং  করতে আরো প্রায় এক থেকে  দেড় বছর  কেটে গেলো।  

===== মাঝে অনেক  সময় গেলো শুধু  হতাশা আর হতাশা ==== 

ভিসা লিগেল রাখার  জন্য ,,,,  তাকে দেশে ফিরে  আসতে  হয়,,,,,  

আসিফের বাবা  বললেন, "এখানে  আপাতত  অনার্স  ভর্তি  হয়ে  যাও। " 

সময় নষ্ট  না করে ,,,,,  ২০১৭ সালে ভর্তি হলো Journalism & mass media সাবজেক্ট  নিয়ে  স্টামফোর্ড  ইউনিভার্সিটিতে।  ইন্টারমেডিয়েট পাশ করার পর প্রথম  ভর্তি হয়ছিলো ইস্ট -ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে।  ব্রেক অফ স্টাডির জন্য  যে কোন ইউভার্সিটি তাকে নিচ্ছিল না।  

ভর্তি  হয়ে মন দিয়ে  ক্লাশ করছিল। আর অপেক্ষা  করছিলো জামার্নীর সেই  এ্যাডাপ্সন কেসের রায়ের জন্য,,,,, 

আসিফকে হতাশ  করে  দিল,,,,  সেই  এ্যাডাপ্সনের রায় ; হেরে গেলো আসিফ ও গাইগার।  কোর্টের রায় ছিল,,,, আসিফের ২১' বছর বয়স হয়ে যাওয়ায় তার এ্যাডাপ্সন হবে না।  

মন থেকে  ভেঙ্গে পড়লো আসিফ! শুধু  যে জার্মানীতে ফিরে  যাওয়া হবে না সেটাই  নয় ; গাইগার,,,,  যে তাকে পিতৃতুল্য  স্নেহ দিয়েছিলো,,,,  শেষবার দেশে আসার সময়,,,,,  আসিফের জন্য গাইগারের কান্না!  

আসিফ নিজেও অনেক  কেঁদেছিল  সেদিন।  

গতকাল  আসিফের  অনার্সের ফাইনাল রেজাল্ট  দিল,,,, 

অতি মাত্রায়  ইনট্রোভার্ট ছেলেটি,,,,  তার সুখ-দুঃখের  সব কথা  মা'কে  আগে শেয়ার করে,,,, 

আমি মোবাইলে  আমার নিজের  কাজে একটু ব্যস্ত ছিলাম,,,,,  

আসিফ এসে হেসে বললো,  "আম্মু,  আমি ৩.৯৯ গ্রেড পেয়ে পাশ করেছি ।  

তার  বাবা এখন  দেশে।  বাবা খুব  খুশী  হয়ে  নানান কথা  জিজ্ঞেস  করছিলেন,,,, 

একটা  কথায়  আসিফ তার পড়াশোনার কথা  বলতে গিয়ে  বলেছে, প্রথম  দুই  বছর  যখন ক্লাস করতাম ,,,  বুঝতেই পারতাম  না ,,  কখন সময় পার হয়ে গেছে! 

এতোকিছুর পরও আসিফের  পড়াশুনার  প্রতি একাগ্রতা,,,,,,,  হেরে গিয়েও জীবনে  জিতকে ছিনিয়ে  আনার বাসনা আসিফকে এই রেজাল্ট  করতে সাহায্য  করেছে ,,,,  

মানুষের  জীবনে  ঘটে  যাওয়া কোন ঘটনা,,,,  মানুষকে কোন কিছু  অবশ্যই শিখিয়ে  দিয়ে  যায় ।  আসিফ,  তার অনার্সের  পড়াশোনার খরচ নিজই যুগিয়েছে।  এক বন্ধুর কাছ থেকে  ফ্রিল্যান্সিং -এর   কাজ এনে এনে করে  দিত,,,  আর  ইউনিভার্সিটির একটা ছাত্রকে পড়াতো,,,, 

জি,,  আজ,,  আমি  গর্ব  করেই বলবো,,,,  আসিফ অন্য কেউ  নয় ; আমারই ছেলে,,,,,  যে কিনা ব্যর্থতার  আঘাতকে হাতিয়ার  বানিয়ছিল,,,  হেরে গিয়েও  যে হাল ছাড়েনি,,,,বার বার পড়ে গিয়েও যে ওঠে  দাঁড়িয়েছে,,,,,  

🙏 আপনারা  যারা এতক্ষণ ,,,  ধৈর্য  ধরে  আমার লেখাটা পড়লেন,,,  তারা সবাই  আসিফের ভবিষ্যৎ  উন্নতির জন্য  দোয়া  করবেন ।  🙏🙏🙏🙏

📌"স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৬৮৫

Date:- ২৯/১১/২০২১ ইং

💜 Rahima Akhter  

ব্যাচ#১৫

রেজিষ্ট্রেশন #৭৪৪৩২

পেজের  নামঃ Rahima Collections.

ব্লাডগ্রুপঃ O+