ঘুম থেকে জেগেই দেখি আমি এম্বুলেন্স এ।
আসসালামু আলাইকুম, প্রিয় প্লাটফর্মের সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
আমাদের মেন্টর ইকবাল বাহার জাহিদ স্যারের একটা কথা দিয়েই শুরু করছি আমি।
আমাদের জীবনের মিরাকল গুলো আমাদের মা বাবা দোয়ার জন্যই পেয়ে থাকি আমরা।তারই জলজ্যান্ত একটা উদাহরণ হচ্ছি আমি নিজে।আজ আমার জীবনের একটা মিরাকলের ঘটনা সেয়ার করবো সবার সাথে;
সময়টা ছিলো ৪ই এপ্রিল ২০১৯।বৃহস্পতিবার ছিলো সেদিন।আমার ৯ম ডায়ালাইটেশন এর দিন ছিলো সেটা।
যথারীতি সকাল থেকে অপেক্ষাকৃত অবস্থায় রইলাম কখন O.T থেকে আমার ডাক পরবে।১২টার পর আমার ডাক পরলো,যথারীতি আম্মু সব লিগ্যাল ফর্মে সাইন করার পরই আমাকে O.T নিয়ে যাওয়া হলো।
O.Tটা তখন আমার কাছে বেডরুমের মতই ছিলো।প্রতিমাসেই ২বার যাওয়া লাগতো সেখানে।যাই হোক,মূল আলোচনায় আসি।
সব ডাঃ রা তৈরী ডায়ালাইট করার জন্য।আমাকে নির্দিস্ট টেবিলে শুইয়ে দেওয়া হলো।তারপর শুরু হলো একটা যুদ্ধ প্রায়।সেদিনই সবথেকে বেশী পরিমান চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিলো ডায়ালাইটেশনে।প্রচুর ব্লিডিং হওয়ার আমি প্রায় সেন্সলেছ হওয়ার মত অবস্থা। অবশ্য ডায়ালাইট করার পর কেউই কথা বলতে পারে না কয়েক ঘন্টার মধ্যে।আমার সেইম অবস্থা।
ডায়ালাইটেশন নিয়ে কিছু বলিঃ
(এই ডায়ালাইটেশন হলো সরু খাদ্যনালী স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসার একটা বৃথা চেস্টা মাত্র।এটা করতে বেশ কয়েকজন এক্সপার্ট ডাঃ এর সহযোগিতা প্রয়োজন হয়।কেননা এটা করার সময় রোগীকে সজ্ঞানে রাখা হয়।
শুরুতে খালি পেটে থেকে রোগীকে এই থেরাপি দেয়া হয়।শুরুতে অপারেশন টেবিলে শুইয়ে গলার ভিতর এন্ডোসকপি করানোর নলটি প্রবেশ করানো হয়,তবে বেশিরভাগ রোগির ক্ষেত্রেই সেই নলটি পুরোপুরোভাবে প্রবেশ করাতে পারেনা।মাঝপথেই আটকে যায় সেটা।তখন সেই নলের ভিতর গাইড ওয়ার নামক একটি চিকন সিলভার তার প্রবেশ করানো হয়।এটা তারটা এতটাই সরু থাকে যে একটু ভুল হলেই তা খাদ্যনালী ফুটো করে দিতে সক্ষম। তাই সেটাকে এন্ডোসকপি নলের ভিতর দিয়েই প্রবেশ করায়।তারপর সেই সরু চিকন তারটি মানে গাইড ওয়ারটি রেখে এন্ডোসকপির নলটা বের করে নেওয়া হয়।
তারপর সেই সরু তারের ভিতর দিয়ে রাবার জাতীয় কিছু নল গলায় প্রবেশ করানো হয়।প্রথমে সেই গাইড ওয়ারের থেকে সামান্য মোটা একটা নল গলা দিয়ে প্রবেশ করায় যা একেবারে পাকস্থলী অবধি পৌছায়।তারপর সেই নলটি ধরে ইচ্ছামত রাব করা হয়।একবার বের করে আবার ডুকায়।আর এটা খুব তাড়াতাড়ি করে।সেকেন্ড প্রতি ডুকানো বের করা হয়।মিনিমান ১মিনিট অবধি।তারপর সেই নলটা বের করে তার থেকে আরেকটু মোটা একটা প্রবেশ করানো হয়।তারপর একই কাজ করে প্রথমবারের মত।আর এই রাব করার সময় যে পরিমান ব্যাথা অনুভুত হয় তা বলার ভাষা জানা নেই আমার।প্রচন্ড ব্যাথায় চোখের জল আর নাকের জল একাকার হয়ে যায়।যন্ত্রনায় কাতরাতে চাইলেও সেটা পারে না,কেননা ৫জন নার্স মিলে এতটাই চেপে ধরে তখন নরাচরা করার উপায় থাকেনা।২জন ২হাত,২জন ২পা আর ১জন মাথা চেপে টেবিলে শুইয়ে রাখে।অনেকটা কোরবানীর পশুর মতই।সবাই মিলে ধরে জবাই করার মত।অবস্থা যন্ত্রনাটা জবাই করার মতই।
এইভাবে একটার পর একটা নল ডুকিয়ে রাব করানো হয় যতসময় না খাদ্যনালী ক্ষত-বিক্ষত হয়ে রক্ত না আসে।যখন সেই নল ভর্তি করে রক্ত আসে,নাক মুখে রক্ত ঝরতে থাকে তখন সেটা বন্ধ করা হয়।তারপর একটা লিকুইড গলায় দিয়ে ওয়াশ করা হয় যাতে রক্তঝরা বন্ধ হয়।তারপর আবার এন্ডোসকপির নল ডোকানো হয়।আর মজার বিসয় হল তখন অনায়াসেই সেই নলটা প্রবেশ করে।তখন খাদ্যনালীর অভ্যন্তরিন অবস্থা পরিক্ষা করে।রাবারের নলের মাপ অনুযায়ী বুঝে কতটা সরু থেকে মোটা হয়েছে খাদ্যনালীটা।)
যখন O.Tথেকে বের করা হয় তখন ডাঃ এসে আম্মুকে জানায় আজ একটু বেশি প্রেসার দিয়া হইছে গলায়,একটু সাবধানে রাখতে আমায়।
যথারীতি বেডে আনা হলো আমায়।আম্মু আমায় শুধু বলে গেল,ডাঃ দের থেকে আমার মেডিক্যাল ফাইল আর ঔসুধ নিয়ে এখনি আসবে,আমি যেন একটু ঘুমিয়ে পরি।
আমি সওিই ঘুমিয়ে পরলাম তখন।সম্ভবত তখন ২টা বাজে।
আর ঘুম থেকে উঠেছিলাম পরদিন সকাল ১১টায়।ঘুম থেকে জেগেই দেখি আমি এম্বুলেন্স এ।আম্মু আব্বু,ভাইয়া,আরো অনেক লোকের ভিড়।হয়তো সবেমাত্রই আমাকে গাড়ীতে তোলা হয়েছিলো,তখনই ঘুমটা ভেঙে গেছে।যখন আমি ওঠে বসলাম আম্মু তো আমায় এসে জাপটে ধরে আরো কান্না করে দিলো,আব্বুও দেখি এসে আমার হাত ধরেই কান্না শুরু করে দিছে।আমিতো পুরোই অবাক।সবাই এত কান্না করছে কেন?কই আগে তো আরো ৮ বার ডায়ালাইটেশন করা হইছে,আব্বু তো কখনো হসপিটালে আসেনি,আজওতো আমার ডায়ালাইটেশন এর সময় আব্বু বাসায় ছিলো।কখন আসলো তাহলে আব্বু আর ভাইয়া?বুঝতে পারছিলাম না কিছুই?
মুহুর্তেই শোরগোল পরে গেল!সবার একটাই কথা,আমি জেগে গেছি,আমি জেগে গেছি।তৎক্ষনাৎ দেখি ৩-৪জন ডাঃ দৌড়ে আমার কাছেই আসছে।হ্যা ওরা আমার গাড়িতেই বসে আমার পালস চেক করলো।আমায় বললো কেমন আছি আমি?আমি বললাম ভাল।তখনই একজন ডাঃ ঠাস করে একটা চড় মেরে দিলো গালে আমার,আমি আরো বোকা বনে গেলাম।স্যারের কথা শুনেতো আরো অবাক হলাম।স্যার বললো"এত ঘুম কেউ ঘুমায় পাগলি,আমাদের সবার ঘুম কেড়ে নিয়ে নিজে আরামে ঘুমালি কেমনে"।।
আমার মাথায় তখনও কিছুই ডুকছিলো না।একটু নাহয় ঘুমিয়েছিলাম, তাই বলে মারতে হবে আমায়?আর ডায়ালাইটের পর সবসময়ই তো ঘুমাতাম কেননা পেইন আর উইকনেসের জন্য ঘুম চলে আসতো।তাহলে আজ হলো টা কি?
আমাকে আবারও বেডে আনা হলো।চারপায়ে লোকজনে ভিড় করে আমাকেই দেখছে শুধু।ডাঃ রা আছে বলে আস্তে আস্তে কি যেন বলছে,তবে আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না,তখন স্যার আবার আমার চেকআপ করলো,আমার সমস্যাগুলো বললাম,স্যার ঔসুধ লিখে দিলো,তখনই যেই স্যার টা আমার থাপ্পর দিয়েছিলো সে একটা কাগজ হাতে দিয়ে বললো"নে এটা ছিরে ফেল,সব প্রশ্নের উওর পেয়ে যাবি"।
কাগজটা হাতে নিতে দেখতেই আমার মাথায় বজ্রপাত হলো মনেহলো।কি দেখছি এরা আমি।এটা কি করে সম্ভব?এটা যে আমারই Death Certificate
তখন আমার সবচেয়ে প্রিয় নার্স দিদিমনি বলা শুরু করলো"
কাল আমাকে বেডে আনার পরপরই আমি নাকি ঘুমিয়ে যাই।সবাই ভাবে আমি ঘুমিয়ে আছি তাই আর কেউ ডাকেনি,সন্ধায় স্যালাইন চেঞ্জ করতে এসে নার্স দেখে আমার শরীর বরফের মত ঠান্ডা।পালস ও পাওয়া না যাওয়াতে আম্মুকে বলে,আম্মুতো ভয়ে শেষ তখন।সবাই অনেক ডাকাডাকি করেও লাভ হয়নি,আমি কোন সারা দেইনি।পরে ডাঃ দের ফোন করে জানানো হয় যারা ডায়ালাইটেশন করেছিলো।তারা সাথে সাথে হাসপাতালে থাকা বাকি ডাঃ দের ইনফর্ম করে আমার বিষয়ে,তারা তখনই চলে আসে,অনেক চেষ্টা চালায় তারা,ইনফাক্ট ওটিতে নিয়ে নাকি ইলেক্টট্রিক্যাল শক ও দেওয়া হইছিলো আমায়।তারপরও কাজ হয়নি।পরে রাত ১২ টার পর ডাঃ রা জানায় আমি আর নেই।মারা গেছি অনেক আগেই।
আম্মু তখন একা ছিলো হসপিটালে।মা নাকি তখন থেকেই নামাজে বসছিলো,সকাল অবধি আমার কাছে না থেকে অনেকটা দুরে বসে নামাজ পরছিলো আর কান্না করছিলো।আমি ২বছর যাবত হাসপাতালে থাকার জন্য মোটামুটি সবার সাথে পরিচয় ভাল ছিলো।সারারাত নাকি ২জন ডাঃ আমার সাথেই ছিলো,নার্স ছিলো,আয়া খালারা,অন্যান্য রোগীর সাথে আগত লোকজন।সেখান থেকে ২জন আন্টি তো কোরআন তিলাওয়াত ও করেছে নাকি আমার পাশে বসেই।
রাতে এতকিছু হয়ে গেল,আমি ঘুমিয়েই রইলাম কি করে কিছুতেই মাথায় আসছিলোনা।কেননা তখনও বিশ্বাস করে ওঠতে পারিনি আমি মারা গেছিলাম।
সকালে গ্রাম থেকে আব্বু ভাইয়া আরো কয়েকজন আসে। হাসপাতালের ফর্মালিটি পূরন করেই আমাকে গাড়িতে তোলা হয় আমার লাশ বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য।তখনই জেগে উঠি আমি।
পুরো গল্পটা নার্সদিদিমনির থেকে শোনার পর দেখি নিজের চোখেই জল।চোখের জল মুছে পাশে তাকিয়ে দেখি সেই ডাঃ ও কাদছে।আমায় শুধু একটা কথাই বলে গেল"আর যদি এরকম ঘুম ঘুমাই তাহলে আমার খবর আছে"এই বলে শাসিয়ে চলে গেল।তবে তার এই শাসিয়ে যাওয়া কথায় আমি অদ্ভুত স্নেহময় আদর অনুভব করেছিলাম।
সেদিন সারাদিনই মাকে জরিয়ে ছিলাম।একটুও ছারিনি ভয়ে।যদি সওিই আমি মারা গিয়ে থাকতাম, আমাকে তো বাসায় নিয়ে কবর দিয়া হত।যদি তখন আমার ঘুম ভাঙতো তখন কি হতো?এই একটাই ভয় ছিলো তখন আমার।
২দিন পর বাসায় আসি।এলাকায় লোকজন সবাই দেখতে আসে আমায়।কেননা সবাই জেনে গিয়েছিল আমি আর বেচে নেই।মসজিদের ইমাম এসে বলেছিলো কথাটা আমায়"আজ আমি বেচে আছি শুধুমাত্র আমার বাবার দোয়ার জন্য।আব্বু নাকি সারারাত মসজিদে নামাজরত অবস্থায় ছিলো।
সওিই বুঝতে পারলাম তখন,আব্বু আম্মুর এই দোয়াটাই আল্লাহ শুনেছিলেন হয়তো।তাই আবার তাদের কাছেই আমায় ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাদের চোখের জলের মূল্য পেয়েছেন তারা।
আজ আমার পাওয়া এই মিরাকল জীবনটা তাদেরই দান।তাই বললো কখনো কোন পিতামাতাকে কস্ট দিয়া উচিত নয়।তাদের সাথে রূঢ় আচরন তো দুর কখনো জোর গলায় তাদের সাথে কথা বলাও উচিত নয়।তারা আমাদের জন্য আশির্বাদ সরুপ।সম্ভব হলে তাদের মাথায় তুলে রাখা উচিত।বুকে আগলে রাখা উচিত যেমনটা ছোটবেলার তারা আমাদের রেখেছেন।
সকল পিতামাতার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালবাসা রইলো।সকল মা বাবাকে আল্লাহ ভাল রাখুক।সুস্থ রাখুক।সুখি রাখুক।
তবে নিজেকে মাঝে মাঝে খুব lucky মনে হয় এখন।আমিই সেই মানুষ যে কিনা নিজের Death Certificate নিজ হাতে বসে বসে কুটিকুটি করে ছিরেছে।
তবে আলহামদুলিল্লাহ, আমি নতুন জীবনে বেশ ভাল আছি।আর চেষ্টা করছি একজন ভাল মানুষ হওয়ার জন্য।জীবনে কিছু করে নিজের জন্য একটা পরিচয় তৈরী করতে ইচ্ছে আছে।চেষ্টা করছি সেই মোতাবেক।
সবাই দোয়া করবেন যেন আমার স্বপ্নগুলো পূরন করতে পারি আমি।সকলের দোয়াপ্রার্থি
"স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৫০২
Date:- ০৪/০৪/২০২১
সোনিয়া সালমান
ব্যাচ নংঃ১৩
রেজিষ্ট্রেশন নংঃ৫৭২১৪