এই পৃথিবীর আলো-বাতাস আমাকে দেখালো আমার মা,
🔴আজ আমি আপনাদের আমার জীবনের বাস্তব সত্য গল্প শোনাব।
আমার এই জীবনের গল্পটা সবাইকে পড়ার অনুরোধ করছি।
শুরুটা ছিলো নব্বই দশকে,আমার মা থাকতো ঢাকার টংগীতে আমার নানার বাড়িতে, আমার নানার গ্রামের বাড়ি ছিলো দক্ষিন অঞ্চলে বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ থানায়।আর আমার দাদার বাড়ি ছিলো উত্তরাঞ্চলে গাইবান্ধা জেলায়। আমার বাবা ছিলো একজন শিক্ষিত সেই সময়ের এস,এস,সি পাশ করা যুবক। দাদার জায়গা জমি অনেক ছিল এবং অনেক টাকা ছিলো । আমার বাবা ছিলেন একা কিন্তু তার ছিল চার বোন মানে আমার চার ফুফু, তারা থাকতো গ্রামের বাড়িতে,এবং সবার বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো। আর আমার বাবা চলে গেলেন ঢাকাতে চাকরীর খোজে।ভাগ্যক্রমে আমার মায়ের সাথে দেখা হয়, এবং আমার মাকে পছন্দ করে ফেলে এবং আমার মাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়,আমার মা নাকচ করে এবং নানা অমত জানায়, তারপর আমার নানি আমার মাকে বুঝায়, কারন আমার বাবা একটু কালো কিন্তু সুন্দর এবং লম্বা।তাই আমার মা পরে রাজি হয়ে যায় এবং আমার দাদা কে না জানিয়েই বাবা বিয়ে করে ফেলে ।আমার দাদার একটাই মাত্র ছেলে ছিল আমার বাবা , তাই তার আদর একটু বেশীই ছিল, কিন্তু যখন তারা শুনল যে আমার বাবা মানে তাদের একমাত্র ছেলে বিয়ে করেছে, তাও আবার তাদের কে না জানিয়ে তারা রাগ করবে এটাই স্বাভাবিক এবং তাই করল।আমার দাদি একটু অখুশী এবং রাগ করেছিলেন, কিন্তু আমার দাদা আর থাকতে পারলেন না চলে আসলেন ঢাকায় আমার মাকে দেখতে। তিনি আমার মাকে দেখে পছন্দ করলেন এবং দোয়া করে চলে গেলেন। তারপরে সব ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু সমস্যা তখন দাঁড়ালো। যখন তারা দেখল যে আমার মায়ের কোন সন্তান হচ্ছে না। লোকে সবাই বলাবলি করতে লাগলো ভাষাগুলো ছিল এইরকম, গাইবান্ধার ভাষায়,>তুই তো একটা বাঞ্জি, তোর তো বাচ্চা হয়না, তোরে তালাক দিয়ে ওরে আরেকটা বিয়ে করামু,হামাগোরে ছোল চাই, তোর মুখ দেখলে হামাগোরে দিন ভালো যাবা নয়,
বুঝতেই পারছেন আসলে এই ভাষাগুলো কোন মেয়ের পক্ষে শোনা বা ধৈর্য্য ধরা সম্ভব নয়, তখন আমার দরদী মা শুধু কান্না করতো।আর আল্লাহর কাছে বলতো আল্লাহ তুমি আমাকে একটা সন্তান দান করো। আমাকে এদের কথা থেকে মুক্তি দাও। আল্লাহর কাছে সন্তান ভিক্ষা চাইতো সবসময়। এদিকে তার ওপরে অত্যাচার শুরু হল। কিন্তু কি করবে আমার মা নিরুপায় হয়ে সহ্য করে গেলেন সব অত্যাচার। আমার পাশের বাড়ির এক দাদি ছিলো।উনি সবসময় আমার মায়ের পাশে থাকতেন, মায়ের মনে সাহস যোগাতেন এবং সান্তনা দিতেন, একদিন ঘটল এক বিশাল ঝগড়া, মা কান্না করতে লাগলো। তখন আমার ওই পাশের বাড়ির দাদি এসে কাপড়ের আঁচল বিছিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন, এবং আমার মায়ের জন্য একটা সন্তান ভিক্ষা চাইলেন। সেদিন মনে হয় কবুল হয়েছিল তার প্রার্থনা। আল্লাহর রহমত হয়েছিল আমার মায়ের উপর। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে আমার মা অসুস্থ হচ্ছে এমনকি চার-পাচ মাস পরে আমার মায়ের জবান বন্ধ হয়ে গেল তিনি আর কোন কথা বলতে পারতেন না। তার মুখ দিয়ে পড়তে লাগলো রক্ত এবং তিনি শুধুমাত্র ইশারা দিয়ে বোঝাতেন, আমার বাবা তখন আমার মাকে অনেক ভালবাসতো,এক মুহুর্ত তাকে ছেড়ে থাকতে পারতো না কাজে গেলে ও দৌড়ে বাড়িতে চলে আসতো তাকে দেখতে। ঢাকাতে তখন অনেক বড় বড় ডাক্তার দেখিয়ে কোন লাভ হয়নি। এক প্রকারের বাচার আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন আমার মা এবং আমার বাবা, আমার দাদা-দাদির পরিবার থেকে চাপ আসলো আমার মাকে তালাক দেওয়ার জন্য। কারণ তিনি বাঁচবে না। কিন্তু আমার বাবা নাছোড় বান্দা। তিনি আশা ছাড়েননি। একদিন আমার বাবা আমার মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো হাতের উপরে করে, কারন আমার মায়ের চলার ক্ষমতা ছিল না। ডাক্তার সব পরীক্ষা করে বললেন।সেখান থেকে ফিরে এসে অন্য একটা লোকের কথায় তখনকার দিনে ঢাকা পি.জি হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং সেখানকার এক চাকমা ডাক্তার মাকে পরিক্ষা করে বলেন যে তিনি গর্ভবতী, কিন্তু অবস্থা খারাপ দেখে একদিনেই ১০ হাজার টাকার ওষুধ লিখে দেন।সবাই ভেবেছিলেন তিনি বাঁচবেন না। তখনো আমার মার মুখে কোনো কথা বলার ক্ষমতা ছিলো না। তখন আমার বাবা আমার মাকে হাতের উপর নিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে বললেন হে আল্লাহ তুমি যদি তাকে আমার কাছে থেকে নিয়ে যাও তাহলে আমার হাতের ওপর থেকে নিয়ে যেও, আমি তার থেকে কখনোই দূরে থাকতে চাই না, শেষ মুহূর্তেও আমি তার সাথে থাকতে চাই। আমার বাবা আমার মাকে এত ভালবাসতো।
✅ এভাবে ৯ মাস পেরিয়ে গেল , হঠাৎ একদিন আমার মা কথা বলে উঠলো. এবং পানি চাইলো,আমার বাবা তো অনেক খুশি, কারন আমার মা কথা বলছে, আমার বাবা আমার মাকে জিজ্ঞেস করল কি খেতে মন চায় আমার মা বলল আমার বাবাকে,আমারে একটু লইট্টা মাছের শুটকি দিয়ে ভাত খাওয়াবা?
আমার বাবা তখন তাই করলেন এবং নিজের হাতে ভাত খাওয়ালেন, ধীরে ধীরে সুস্থ হতে লাগলো আমার মা, তারপর হঠাৎ একদিন আমার জন্ম হলো , এই পৃথিবীর আলো-বাতাস আমাকে দেখালো আমার মা, আমার বাবা জানতে পারলো যে তার পুত্র সন্তান হয়েছে। আমার দাদা-দাদীকে জানানো হলো সবাই অনেক খুশি।
আমার দাদা রাস্তা দিয়ে হাটতো আর হাসতো, কেউ কেউ দাদাকে জিজ্ঞেস করতো এভাবে, আমাদের গাইবান্ধার ভাষায়,
কি হছে বাহে প্রধান এতো খুশি ক্যা?এতো হাসো ক্যা, আমার দাদা বলতো, তোমরা জানো? হামার মনে হচ্ছে হামি হাটে থেকে ফটকা কিনে আনে হামি রাস্তাত ফুটাই কারন হামার নাতি হছে হামার যে কি আনন্দ তোমাগরে ক্যাংকা করে বোজাই যে হামি কতো খুশি।বলে নেই আমাদের গোষ্ঠীর উপাধি ছিলো প্রধান,মানে আমাদের বংশগত নাম।
✅আমার বয়স যখন ৩ দিন, তখন আমার বাবা মা আমাকে নিয়ে মাদারটেক এর মসজিদে গেলেন, সেখানকার ইমাম আমাকে কোলে নিয়ে মসজিদের ভিতর থেকে এক চিমটি মাটি আমার মুখে দিলেন খাওয়ার জন্য, আর আমাকে দোয়া করে দিলেন,আমার বাবা অনেক খুশি, সবসময় আমার মার পাশে থাকে কাজ থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসে আমাকে নিয়ে আনন্দ করে, কিন্তু কিছুদিন পরে অশুভ আর গায়েবী জিনিসের প্রভাব বেড়ে গেলো আমাকে নিতে আসতো, আমার ফুপার চেহারা ধরে দিনে দুপুরে আসতো আমাকে নিতে, রাতে জানালা দিয়ে হাত দিতো আমাকে নেওয়ার জন্য, আমার বাবাকে রাতে জালাতন করতো, আবার এক ইমাম ডেকে আনা হলো, এবং সে বাড়ি মন্ত্র দিয়ে আটকিয়ে দিলো আর বলে গেলো ৪৫ দিনের আগে বাহিরে যাওয়া যাবে না, তাই করা হলো,এবং আমাকে নিয়ে সবাই সুখে হাসতে লাগলো।
✅এভাবে কেটে গেলো আরোও কয়েক দিন, তার পরে আমার মা নানার বাড়িতে বেড়াতে গেলো। আমার মা তখনো অসুস্থ ছিলো, তখন আমার নানির গ্রামে অনেক লোক ছিলো গরিব যারা দিন আনতো দিন খেতো, তো আমার নানির বাড়ি থেকে ১০ মিনিট দূরে এক মহিলার মেয়ে ছিলো তারা এসে আমার মায়ের কাছে বললো মা তুমিতো ঢাকা থাকো তাই আমার মাইয়াডারে ঢাকা নিয়ে যাও আর একটা কাজ যোগাড় করে দিও, তো আমার মা আর না করতে পারলেন না,,তাকে আমাদের বাসায় ঢাকা নিয়ে এলেন, এবং একটা বাসায় কাজের মেয়ে হিসাবে কাজ করতে দিলেন, সে কাজ করতে লাগলো, আর আমার মাকে সে বোন ডাকতো,, এভাবেই চলতে লাগল কখনও কাজ করে কখনো আমাদের বাসায় ঘুরতে আসে, আমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়, তখন আমার বয়স ৩ বছরের একটু বেশি হবে অল্প অল্প বুঝি, তখন আমার দাদি আমাদের বাসায় থাকতো।
✅ইতিমধ্যে আমার আরোও ২ ভাইয়ের জন্ম হলো, এবং আমার সবছোট ভাইয়ের বয়স ছিলো তখন ২ মাস ১২ দিন। এবং হঠাৎ আমার মা লক্ষ্য করল, কেন জানি আমার বাবার ব্যবহারে পরিবর্তন হচ্ছে, ঠিকমতো কাজে যায় না, বাসায় থাকে এবং অন্যমনস্ক হয়ে থাকে,অবহেলা করতে থাকে আমার মাকে, একদিন আমি বসে টিভি দেখতেছিলাম, মাগরিবের পর সন্ধ্যার আজান হয়ে গেছে, আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে সেদিন ইলিশ মাছ রান্না হচ্ছে আমাদের ঘরে, আমি রুম থেকে বের হয়ে দরজার কাছে যেতেই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কা খাই সেখানেই, কোনো কিছু বোঝার আগেই পুড়ে যায় আমার পেট এবং নাভীর চারপাশ, রক্ত পরতে থাকে, আমার মা চিৎকার দিয়ে আমার কাছে আসে, আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি,পরে জানতে পারি আমি যখন দরজা দিয়ে বের হতে যাই তখন তার হাতে রান্না করে আনা ইলিশ মাছের তরকারি পড়ে যায় আমার পেটে,কি আর করার হয়তো এটাই লেখা ছিলো কপালে,শুরু হলো আমার আমার মায়ের এবং ছোট দুইটা ভাইয়ের কস্টের দিন, যে বাবা এক নজর না দেখলে থাকতে পারতো না আর সেই বাবা দেখার পরেও না দেখার ভান করে চলে যায়।
✅একদিকে আমার মা তিনি ছিলেন অসুস্থ এবং অন্য দিকে তার উপর এই মানষিক অত্যাচার। এবং সেখানে তার প্রিয় ছেলের পেট পুড়ে গেছে, আমার মা তখন সদ্য সন্তান প্রসব করা এক নাড়ী। তাই তিনি ছিলেন ভীষন অসুস্থ, তখন আমার মা জানতে পারে অবৈধ সম্পর্ক আছে আমার বাবা এবং ওই মহিলার ভিতর, এদিকে মার সামনে চলতো তাদের আনন্দ উল্লাস, আর অন্য দিকে আমি হতভাগার কপালে জুটতো না ঔষধ, আর অন্য দিকে খাবার পেতো না আমার মা এবং ছোট দুই ভাই যাদের বয়স, ৩ বছর এবং ২ মাস ১২ দিন, একদিকে পুড়ে যাওয়া ছেলে আর অন্য দিকে নিজের ঘরের মধ্যে নিজের স্বামীর সাথে অন্য একটি মহিলার সাথে উঠাবসা এবং অনৈতিক সম্পর্ক পৃথিবীতে কোন মহিলা মেনে নিতে পারবে তা আমি জানিনা,
✅ আমার মাকে খাবার দিলে খাবার পায় না , আমার সবচেয়ে ছোট ভাইটি শুধু কান্না করতো পেটের খুধায়, কারন দুধ পেতো না আমার মায়ের কাছে থেকে, আর পাবেই কিভাবে, যেখানে মা আমার নিজেই খেতে পায়না, তার দুধ কেনার ক্ষমতাটুকুও ছিলো না আমাদের, এদিকে আমার পোড়া ক্ষত ২০ দিন পার হতে চলেছে একটি টাকার ওষুধও জোটেনি আমার কপালে। তাই বাধ্য হয়ে আমার মামা এসে রীতিমত বাবাকে না বলেই আমাদের নিয়ে চলে গেলেন।নানার বাড়িতে গিয়ে অনেক চিকিৎসার পরে আমি কিছুটা সুস্থ হই।প্রায় ১ মাস পরে আমরা ঢাকায় চলে আসি বাবার কাছে, এসে দেখি আমার বাবা সেই মহিলাকে মানে আমাদের বাসায় কাজ করা মহিলাটিকে নিকাহ করেছে।আমার মা তখন অনেক কস্ট পেলেন। তার উপর দিয়ে আরেকটা ঝড় বয়ে গেলো। আমার মা আমার বাবাকে শুধু এই কথাটাই জিজ্ঞেস করেছিলো যে, কি এমন ওর মাঝে আছে যা আমার ভিতর নাই।আর বিয়ে যদি করতেই হয় তাহলে আমার চাইতে সুন্দর দেখে করতে তাহলে মনেরে বুঝ দিতাম যে আমার চেয়ে সুন্দর। কি দেখে করলে তাকে বিয়ে। আমার বাবা কোনো উত্তর দেয়না।এদিকে আমার দাদি আমাকে পছন্দ করতো সেই সুবাদে আমাকে গ্রামে নিয়ে যাওয়ার বায়না ধরে, এবং আমাকে নিয়ে যায়, কারন মা ভাবে যে এখানে থাকলে আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার, পাবে না পেট ভরে খেতে, পাবে না শিক্ষা, তাই আমাকে দিয়ে দেয় দাদা দাদির কাছে,আমি ঢাকার মায়া ত্যাগ করে চলে যাই গ্রামে, কিন্তু যাওয়ার সময় মাকে বলে যাই মা তুমি চিন্তা করিও না, আমি বড় হয়ে তোমাকে অনেক টাকা দিবো খাবার দিবো, মা আমাকে বুকে নিয়ে বলে বাবা সেই আশায় আমি বেচে থাকবো বাবা, দোয়া করি তুমি অনেক বড় হয়ে আমার কস্ট দূর করে দিবে।
✅কিছুদিন পরে পূর্বের চাইতে আরো বেশি খারাপ হতে থাকে আমার বাবার ব্যবহার, আর আমার মাকে এবং ছোট ভাইকে সহ পাঠিয়ে দেয় আমাদের গ্রামে আমার কাছে, অনেক খুশি হয়েছিলাম পরিবারকে কাছে পেয়ে, কিছুদিন পর ঘটতে থাকলো আরো খারাপ অবনতি, একে তো আমার মা গ্রামের ভাষা বুঝতো না বিশেষ করে গাইবান্ধার ভাষা, এবং অন্যদিকে তিনি কখনো এসব কাজ করেননি যা গ্রামে করানো হয়, তিনি বড় হয়েছেন শহরে, তাই গ্রামের সাথে ছিল না তার কোনো সম্পর্ক।
তাই তিনি নিজেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না গ্রামের সাথে, কিন্তু কিছু করার নেই বাধ্য হয়ে তার ছেলেদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হলো সেই গ্রামেই, আমি দেখতাম তাকে দিয়ে ধান ভাঙ্গাতো পাট কাটাতো, তাকে মাটি আনতে হতো, জীবনে যা কখনো সে ভাবেনি তাই তাকে করতে হতো, আমি দেখতাম তিনি শুধু কান্না করতেন, আর আমি বোবার মতো দাড়িয়ে শুধু দেখতাম, তখন আমার ফুপুরা সবাই মিলে আমার মাকে আবার অত্যাচার শুরু করলো আমার দাদা বাড়িতে থাকলে আমার একটু সুবিধা হত, তিনি না থাকলে আবার আগের মতোই তার ওপর অত্যাচার শুরু হতো, ধান ভাঙতে ভাঙতে আমার মায়ের পা ফুলে গেছিল, তখন আমার ফুপুরা হাসাহাসি করতো আর বলতো এইসব ঢং বাদ দিয়া কাজ করো,তারপর আবার তাকে ধান ভানতে ডাকে আমার মা অনীহা জানালে তাকে আমার ফুপুরা লাঠি দিয়ে হাতে মারে এবং,এভাবে বলে জমিদারের বেটি আইছে
খাবার পারে, কাম করতে পারেনা, তোর বাপ ভাইরে ক আসতে আর ধান ভাঙিয়ে দিয়ে যাইতে।
✅ তখন আমার মা শুধু কাদতো কারণ আমার নানার বাড়ি ছিল সুদূর বরিশালে, তারপরে একদিন আমার মামা আসলো আমাদের বাড়িতে, এসে দেখলো তার বোনের এই দুরবস্থা, তখন তিনি আমাদের গ্রাম্য ভাষায় সেটাকে কলার ভেলা বলে। ওটাতে করে ধান নিয়ে গিয়ে অনেক দূর থেকে ভাংগিয়ে এনে দিলেন, কারণ তার বোন যেন সুখে থাকে এটাই তিনি চান। এভাবে চলতে থাকলে তার দিন এবং আমরা বড় হতে লাগলাম, এর মধ্যে আমার দাদা মারা গেলেন।তারপর যথাক্রমে ২০০৪ সালে আমার ছোট বোনের জন্ম হলো, আর এদিকে পাল্লা দিয়ে আমার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীর চারটি সন্তান হল, ওরা তখন ছোট ছিল কিন্তু আমি বড় ছিলাম, আমি বুঝতাম সবকিছুই আমার কষ্ট হতো কিন্তু আমি কাউকে বলতে পারতাম না। শুধু বুক চেপে কষ্ট সহ্য করতাম। আর আল্লাহর কাছে বলতাম আল্লাহ আমাকে তুমি মানুষের মত মানুষ বানিয়ে দাও।
✅তার কিছুদিন পরে আবার আমার মা বাবার সাথে ঝগড়া লাগে এবং আমার মা নানার বাড়িতে চলে যায়।কেটে যায় আরোও কয়েক বছর। তারপর আমিও চলে যাই মার কাছে, সেখানে ৫ম শ্রেণিতে ভর্তি হই।ছোট দুইটা ভাইকেও ভর্তি করানো হয় স্কুলে। কিন্তু পড়ার খরচ জোগানোর ক্ষমতা আমার মায়ের ছিলো না।আমার মা কাজ নেয় বেকারিতে রান্নার কাজ। একবার আমার কয়েকটা নোটবুক কেনার দরকার হয় দাম ছিলো মাত্র ১৮০ টাকা। আমার কেনার সাধ্য ছিলো না। কারন এই ১৮০ টাকা ছিলো আমার মার কাছে লাখ টাকার সমান। কারন আমার মায়ের বেতন ছিল ১২০০ টাকা,আর মা কাজে যাওয়ার সময় যেই টিফিন কারির বাটি নিয়ে যেত ওটাতে করে যে খাবার আনতো সেই এক বাটি খাবার দিয়ে আমাদের চারজনের খাবার হয়ে যেত। কারণ তারা চুক্তি করেছিল ১ বাটির বেশি খাবার দেবে না। আমি যদি কখনো মার কাছ থেকে টাকা টাকা চাইতাম, তখন মা আমাকে হাসিমুখে টাকা বের করে দিত তার কাপড়ের আচল থেকে, খুলে দেখতাম ৮ / ১০ টাকা, তখন আমি জিজ্ঞেস করতাম মা তুমি এগুলো টাকা কোথায় পাও, মা উত্তর দিত তার কাছে ছিল। কিন্তু আমি নিজে আমার নিজের মনকে মানাতে পারতাম না, একদিন আমি আমার লাঞ্চের সময় মার কাছে গেলাম। আর সেখানে যাওয়ার পর আমি যা দেখলাম তাতে আমি যেন আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে গেলাম,কান্নায় আমার দু'চোখ ভারী হয়ে এলো, আর নিজেকে মনে হতে লাগলো অপরাধী। কারণ আমি দেখলাম আমার মা আমাকে টাকা দেওয়ার জন্য অন্যের কাপড় কেচে দিচ্ছে। নিজেকে সামলাতে পারলাম না। তারপর মা আমাকে দেখে ফেলল এবং আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি এখানে কেন এসেছি। বললাম এমনি এসেছি।তারপর নিজে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, আমাকে যেভাবেই হোক বড় হতেই হবে এবং আমি আর এখানে থাকবো না। আর বারবার মনে পড়তে লাগলো সেই বাবার কথা যার কারনে আমাদের এই অবস্থা , আমাকে নোট কিনে দেওয়া হলো কিন্তু সেটাও অন্য জনের টাকা দিয়ে। দাম ছিলো মাত্র ১৮০ টাকা।কিন্তু স্কুল ড্রেস কোনো ভাবেই জোগাড় করতে পারিনি, খালাতো বোন অন্য স্কলে পড়তো সে ছিলো আমার চাইতে বড়ো।সে এসে আমাকে ড্রেস্টা দিতো এবং আমি লাঞ্চের সময় সেটা পরিধান করে স্কুলে যেতাম।আর ভাবতাম কবে এই কস্ট দূর হবে। তাই মার উপর নিজের বুঝা কমানোর জন্য আমি আবার চলে গেলাম আমার দাদার বাড়িতে,আবার লেখাপড়া শুরু করলাম, কারন আমাকে বড় হতেই হবে। আমার দাদি আমাকে প্রচন্ড আদর করতো, কিন্তু আমার বাবা তখন আমাকে পড়ার খরচ দিতো। কেন দিতো জানিনা, বাবার সাথে কথা বলতে আমার মন চাইত না বললেও অনেক কম কথা বলতাম। এভাবেই কেটে গেল আরো ৫ বছর, এসএসসি পরীক্ষা দিলাম তারপর রেজাল্টে জন্য যে ফাঁকা সময় টা পাওয়া যায়, তখন আমি চলে গেলাম আমার মাকে এবং ভাই বোনকে দেখতে, গিয়ে আমি যা দেখলাম তাতে আমি শিহরিয়ে উঠলাম, আমার দুই ভাই কে দেওয়া হয়েছে বেকারিতে কাজের জন্য, আর ছোট বোন থাকতো বাড়িতে, মা তখনো অন্য মানুষের বাড়িতে কাজ করতো, বেকারিতে রান্নার কাজ করতো, কখনো জীবিকার তাগিদে রাস্তার মাটি কাটতো,কখনো নারকেলের মিলে কাজ করতো, সকাল থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত কাজ করতে এবং তার বিনিময়ে পেতো মাত্র ১০০ টাকা, কান্না করতাম লুকিয়ে কিন্তু কাউকে বুঝতে দিতাম না. তারপরে রেজাল্টের দিনে আমার মা আমার সামনে আমাকে চিন্তিত দেখে আমাকে অভয় দিতে লাগলো,আর আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলো, তখন ২০১০/১১ শিক্ষার্বষ, আলহামদুলিল্লাহ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাশ করলাম, আমার মাকে যখন খবরটা দিলাম, আমার এতো খুশি হলো যেনো সারা পৃথিবী হাসতে লাগল আমার মায়ের হাসি এবং খুশিতে, আমিও অনেক খুশি হলাম, বাবাকে জানালাম, দাদিকে জানালাম, সবাই শুনে অনেক খুশি হলো, তারপরে মাকে সান্তনা দিয়ে চলে গেলাম দাদার বাড়িতে। ভর্তি হলাম আমাদের গ্রামের একটা কলেজে। কারন আমার সাধ আছে কিন্তু সাধ্য নাই,কারন কে আমাকে উচ্চ নামিদামি কলেজে পড়াবে, আবারো বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলাম। ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষার সময় আমি জীব বিজ্ঞানে বিজ্ঞানে ৭৫ এর মধ্যে ৬৮ নাম্বার পেলাম, বরাবর আমি জীববিজ্ঞান অনেক ভালো রেজাল্ট করতাম, স্বাদ জাগলো মেডিকেলে পড়ার, বাবাকে বলা মাত্রই সোজা সোজা না করে দিলেন, বললো আমার কাছে টাকা নাই, মনের ভিতরেই স্বপ্নটা মরে গেলো।
অথচ আমার বাবা যদি চাইতেন, তাহলে আমাকে ভর্তি করাতে পারতেন,কারন আমার আত্মীয় স্বজনেরা অনেক বড় বড় সরকারী কর্মকর্তা হিসাবে কাজ করতেছিলেন। মেডিকেলের স্বপ্ন দেখা ভেঙ্গে গেলো। তারপর সেই কলেজেই এইচ এস সি শেষ হলো এবং অর্নাস ২য় বছর পর্যন্ত সুযোগ পেলাম লেখাপড়া করার জন্য।
✅ এভাবে চলতে থাকলো আমাদের সংসার।কিন্তু আবারো বড় সমস্যার সম্মুখীন হলাম, কারন আমার আদরের ছোটো বোন অনেক বড়ো একটা সমস্যায় ভুগতেছিলো।আশা করি সবাই বুঝে নিবেন।অনেক ডাক্তার দেখালাম।কিন্তু কোনো সমাধান পেলাম না।তারপরে ঢাকায় টংগিতে ফ্রেন্ডস হাসপাতালে নিয়ে গেলাম এবং ডাক্তার বললো অপারেশন করলে ভালো হবে কিন্তু সময় লাগবে। তার বয়স হতে হবে, এবং অনেক টাকাও লাগবে। আর এটা নিয়ে আমার বাবার কোন মাথা ব্যাথাই ছিলনা। কারন তিনি তখন সে মহিলাকে নিয়ে ঢাকায় থাকতেন। আর এদিকে আমার মা পাগল হয়ে যাচ্ছেন কিভাবে বড় হলে তার মেয়েকে তিনি বিয়ে দিবেন। মনে আশার আলো ফুটলো কিন্তু টাকার অভাবে দেরি করতে হলো। এদিকে আমার বাবা আমার ২ সৎ ভাইকে আমার মায়ের কাছে রাখলেন মানে আমাদের কাছে, কথায় আছে ভাগির ভাগ তাই রেখেছে।
✅ আমি গেলাম ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করতে, এবং মায়ের কস্ট দুর করার জন্য। তারপর সবার একটু সুখের জন্য চলে এলাম প্রবাস নামের কারাগার মরিশাসে। এখন আপনাদের দোয়ায় এবং আল্লাহর রহমতে কিছুটা সুখে আছি। কিন্তু আমার ভিতরে লুকানো কস্ট গুলো এবং আমার মায়ের হারানো দিন গুলো এবং তার কস্ট গুলো আমি কিভাবে দূর করবো তা আমি জানি না, সেটা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানে। কিন্তু সবসময় ভাবতাম কিভাবে নিজেকে সফল করা যায়, সমাজে কিভাবে নিজেকে কাজের মাধ্যমে পরিচিত করা যায়।কিন্তু কোনো সঠিক কোনো দিক নির্দেশনা পাইতেছিলাম না। তখন ভাগ্যের জোরে কান্ট্রি এম্বাসেডর (মরিশাস)মোঃহাফিজ ভাই এবং আল মামুন ভাইয়ের সহযোগিতায়, আমাদের প্রিয় স্যার ইকবাল বাহার জাহিদ স্যারের অবদান, "নিজের বলাম মতো একটা গল্প ফাউন্ডেশন এর আজীবন সদস্য পদ লাভ করি এবং তারপরে বুঝতে পারি যে এবার আমার জীবনের উন্নতি হবে এটা নিশ্চিত যদি আল্লাহ রহমত করে।কারন স্যারের শিক্ষা থেকে অনেক কিছু শিখছি।
💟 অন্য একদিন শোনাবো আমার প্রবাস জীবনের গল্প। আজ এখন একটু হলেও মনে শান্তি পাই যে আমার লুকানো কস্ট গুলো আপনাদের মাঝে বলতে পেরেছি, এখন কিছুটা হালকা মনে হয় নিজেকে। আর এটা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র স্যারের জন্যই।আল্লাহ তাদের সবাইকে এবং আমাদের সবাইকে নেক হায়াত বাড়িয়ে দিন। সবাই দোয়া করবেন আমার মায়ের জন্য এবং আমার পরিবারের জন্য এবং আমার জন্য, আমি যেন তাদের মুখে হাসি ফোটাতে পারি। এবং আমার মায়ের কস্ট লাঘব করতে পারি,সমাজে একজন ভাল মানুষ, ও একজন উদ্দোক্তা হতে পারি।
💟আমি একটা কথা সবার উদ্দেশ্যে বলতে চাই যে জীবনে আপনারা কোনদিন আমার বাবার মতো এই ভুল করবেন না। সন্তানদের অসহায় করে দিবেন না। স্ত্রীদের তার স্বামীর হক থেকে বঞ্চিত করবেন না। কারণ আজও যখন আমি আমার পেটের পোড়া দাগ দেখি তখন আমার অতীত মনে পড়ে যায় এবং দুচোখ কান্নায় ভারি হয়ে আসে এবং আমার অতীত মনে পড়ে যায়, মনে পড়ে যায় আমার এবং আমার মায়ের অসহায়ত্বের কথা। আমি প্রত্যেক বাবাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই আপনারা কখনোই আমাদের মত সন্তানদের অসহায় করে দিবেন না, তা না হলে নিজের ভুলের জন্য পরে আফসোস করতে হবে। জবাব দিতে হবে আল্লাহর কাছে।
💟আমার লেখার মধ্যে বানানগত এবং ভাষাগত যদি কোনো ভুল হয় তাহলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। এতক্ষন ধরে আমার জীবনের গল্প ধৈর্য ধারন করে পড়ার জন্য আপনাকে আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ জানাই।
"স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"-৫১১
তারিখ :- ১৮.০৪.২০২১
💕ধন্যবাদান্তে 💕
✅নাম = রিপন আহম্মেদ প্রধান
ব্যাচ নাম্বার =দশম
রেজিস্ট্রেশন নাম্বার = ১৭৪৪৭
ব্লাড গ্রুপ =AB+
পেশা =স্যাম্পল কোঅর্ডিনেটর এবং কোয়ালিটি কন্ট্রোলার।
জেলা= গাইবান্ধা
বর্তমান অবস্থান= পোর্টলুইস, মরিশাস।