এক স্বপ্নবাজ মেয়ের জীবনের গল্প
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
আসসালামু আলাইকুম
আমি সর্বপ্রথম শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে যিনি আমাকে একজন সুস্থ মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন।
হাজারো দুরুদ ও সালাম প্রেরণ করছি মানবতার মুক্তির দূত হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রতি।
আমি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি আমার জন্মদাতা মা-বাবার প্রতি যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমাকে লালন পালন করে বড় করেছেন।
আমি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি আমার প্রিয় শিক্ষক, মেন্টর, লাখো তরুণ তরুণীর স্বপ্নদ্রষ্টা, দিক হারা মানুষের পথপ্রদর্শক, হতাশাগ্রস্ত মানুষের আশার প্রদীপ "জনাব ইকবাল বাহার জাহিদ" স্যারের প্রতি.।যিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমাদের জন্য" নিজের বলার মতো একটা গল্প" ফাউন্ডেশন উপহার দিয়েছেন। এটা এরকম একটা প্লাটফর্ম যেখানে শুধু কর্মের শিক্ষা দেওয়া হয় না সাথে সাথে একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে আমাদের সাহায্য করেন। তিনি একমাত্র ব্যক্তি যিনি আমাদের জন্য নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন যা আজ অবধি পৃথিবীর আর কোন লোক করে দেখাতে পারে নি।
আমার পরিচয়
আমি সেতারা আক্তার, আমার জন্ম ফরিদপুর জেলার ভাংগা উপজেলার কালামৃধা ইউনিয়নের এক অজপাড়া গাঁয়ে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। আমরা ৪ বোন ও ১ ভাই। আমার বাবা একজন দিনমজুর আর আমার মা একজন গৃহিণী। আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত পরিবারের কষ্ট সব থেকে বেশি। তারা মান সম্মানের ভয়ে কারো কাছে কিছু চাইতে পারে না আবার কিছু কাউকে বলতেও পারে না। ফলে মাঝে মাঝে তাদের ঘরে খাবার না থাকলেও কারো কাছে কিছু চাইতে পারেে না। তাদের দুঃখ কষ্টের ভাগিদার কেউ হয় না তাদেরকেই বহন করতে হয়।
আমার শৈশব
আমার গাঁয়ের রং কালো বলে আমার প্রতিবেশীরা আমাকে নিয়ে নানা ধরনের হাসি ঠাট্টা করতো। এর মাঝেও ছাত্রী হিসেবে মোটামুটি ভালো থাকার কারণে সেই হাসি ঠাট্টা আমার লেখাপড়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাড়াতে পারে নি। শত বিদ্রুপের মাঝে প্রাইমারি শিক্ষা শেষ করি আমার গ্রামের মিয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে।তখন আমি বুঝতাম না যে এটা আমার প্রবল ইচ্ছা শক্তি। আর আমি এখন এও বিশ্বাস করি যে সাহস আর ইচ্ছা শক্তি দিয়ে সব জয় করা যায়।
আমার কৈশোর
প্রাইমারি শিক্ষা শেষ করে জাঙ্গাল পাশা হাজী আব্দুল মজিদ একাডেমিতে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই।আলহামদুলিল্লাহ সেখানে আমার আর কোন ধরনের হেয় প্রতিপন্ন হতে হয় নি।আমার শিক্ষক ও আমার বন্ধু বান্ধবীরা আমাকে অনেক ভালবাসতেন। সেখানে আমার ভালবাসার কোন কমতি ছিল না।তবে সেই সাথে শুরু হয় টিকে থাকার যুদ্ধ। আমার পরিবার মধ্যবিত্ত পরিবার। আর বাংলাদেশে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারকে টিকে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয়।আর আমার বাবা আমাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি। আমার বড় কোন ভাই না থাকার কারণে আমাকে বাবার কাজে সাহায্য করার জন্য ক্লাস শেষ করে বাড়ি এসে মাঠে চলে যেতে হয়েছে আর কোন কোন দিন অনেক রাত করে বাসায় আসতে হয়েছে কাজ শেষ করে। এভাবেই জীবনে টিকে থাকার যুদ্ধটা বাবা-মার কাছে শিক্ষা হয়ে যায়। আমার মাকে আমাদের পরিবারটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য বাবার থেকে বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছে। আমার মায়ের পরিশ্রম আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবোনা না আমার হাত থমকে গেছে।আমি ২০১৩সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তির্ন হই।
আমার কলেজ জীবন
২০১৩ সালে আমি ভাঙ্গা মহিলা কলেজে ভর্তি হই। তখন মাঠের কাজে আর বাবাকে সাহায্য করতে হয় নি।তবে লেখাপড়া চালানোর মত সামর্থ্য আমার বাবা- মার নেই। আমাদের পড়াশোনা চালানোর জন্য আমার বড় ২ বোন ঢাকা চলে আসেন।আর আমার ইগো বেশি কাজ করতো তার জন্য আমি আমার পরিবারের কাছ থেকে টাকা নিতে মন চাইতো না।তখন থেকেই নিজে কিছু করবো এই মনোভাব পোষণ করতাম। তখন আমি আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় ১কিলোমিটার দূরে আমি ২টো ছেলেমেয়েকে টিউশনি করাতে শুরু করলাম। সেখান থেকেই আমার লেখাপড়ার খরচ জোগাড় করার চেষ্টা করি। আমি ছোটবেলা থেকেই একটু কিপ্টে টাইপের ছিলাম। যার জন্য আমাকে টিফিন খাওয়ার জন্য যে টাকা বাড়ি থেকে দিত আমি তার প্রায় সব টাকাই জমানোর চেষ্টা করে আমার টিউশনির টাকা জোগাড় করতাম।এভাবেই আমি ২০১৫সালে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ন হই।
আমার জীবনের দুঃখের সূচনা
আমি এইচএসসি পাসের পরই আমার জীবনে নেমে আসে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত সময়টা। আমার মা আমাকে আর লেখা পড়া করাবে না বলে সরাসরি বারণ করে দেন।কিন্তু আমিও থেমে যাওয়ার মেয়ে নয়। যে মেয়েটা ছোট থেকে পরিশ্রম করতে ভালবাসে সে কি পড়ালেখা বাদ দিতে পারে অর্থের অভাবে। তাইতো আমি আমার পড়াশোনা চালানোর জন্য ঢাকায় পাড়ি জমাই। সেখানে আমি গার্মেন্টসে চাকরি করি।কিন্তু সেটাও আমি ১বছরের বেশি করতে পারি নি। আমার বড় ধরনের একটা রোগ দেখা দেয়। গ্রামে ফিরে আসলে আমার বড় ধরনের একটা অপারেশন করানো হয়।এরপর আমাকে আর ঢাকাতে পাড়ি জমাতে দেন নি। তবে আমি ও থেমে যাওয়ার মেয়ে না যে আমি শুধু শুধু ঘরে বসে থাকবো।তাই আমি আবার আমার এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিউশনি করাতে শুরু করি।এভাবেই আমার দিন চলতে থাকে। তবে আমার সব থেকে কষ্টের দিন হলো আমার মায়ের যখন একটা বড় রোগ দেখা দেয় তখনই। আমার মাকে চিকিৎসকের কাছে নেওয়ার জন্য তখন আমার কোন আত্মীয় আমার মায়ের পাশে আসেনি। আমি আর আমার ছোট ভাই হাসপাতালে যাই।আমার মাকে যখন ওটিতে নেয় তখনের সেই রাতের কথা আমি কোন দিন ভুলতে পারবোনা। আমার মাকে ডাক্তার যখন বেডে দেন তার অনেক পর আমার মায়ের জ্ঞান ফিরে। আমার ভাই তেমন কিছুই বুজতো না।আপনারাই ভেবে দেখেন সেই রাতে আমার কি অবস্থা হয়েছে। এখানেই শেষ নয় আমার মাকে যখন অপারেশন করানো হয় সেই মাসে আমার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়। একদিকে এক্সাম, মা অসুস্থ, অন্য দিকে পরিবারের কাজ । এসব সামলাতে সামলাতে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। আর তখনই করোনার প্রভাব শুরু হয় এবং আমার ৫টা এক্সাম হয়ে পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়। আস্তে আস্তে আমার মা ও সুস্থ হয়ে যান। তবে করোনার কারণে সব স্কুল কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। আর আমার ও কষ্টের দিন শুরু হয়। আমি যাদের পড়াতাম সব বন্ধ হয়ে যায় আর আমার ইনকামের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়।
প্রিয় ফাউন্ডেশনের সাথে পরিচিত
আমি এক পর্যায়ে অনেক হতাশা তথা মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। এর মাঝে আমরা অনার্সের ভাইভা পরীক্ষার ডেট আসে। কিন্তু আমার হাতে কোন ফোন ছিল না। পরীক্ষা অনলাইনে হবে এর জন্য একটা ফোনের খুব দরকার। আমার পরিবারের ফোন কিনে দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না তাই আমি টিউশনির জমানো টাকা আর কিছু টাকা ধার করে একটা ফোন কিনি। ১৬তারিখে আমার পরীক্ষা হয়। এরপর আমি ফোনে বিভিন্ন মোটিভেশনাল গল্প শুনতে থাকি। আমার আগে থেকেই একটা স্বপ্ন ছিল আমি নিজে কিছু একটা করবো এবং মানুষের জন্য কাজ করবো।মূল কথা আমি চাকরি করবো না আমি চাকরি দিব। কিন্তু তখনও জানতাম না আমি কিভাবে আমার স্বপ্ন পূরণ করবো? সম্ভবত অক্টোবরের ১০ তারিখে আমি আমার প্রিয় শিক্ষকের একটা ইউটিউব লাইভ দেখি।সেখানে আমার প্রিয় ভাইয়া ও আপুর কষ্টের কথা শুনে নিজের কষ্ট ভুলে যাই এবং তাদের সফলতার গল্প শুনে অনেক অনুপ্রাণিত হই।আর আমার স্বপ্ন পূরণের রাস্তা খুঁজে পাই।আমি স্যারের লাইভে কমেন্ট করি কিভাবে রেজিষ্ট্রেশন করতে হয়? প্রিয় স্যার আমার কমেন্টে রেজিষ্ট্রেশন করার লিংক দেন। আমি সেখানে গিয়ে গ্রুপে যুক্ত হই কিন্তু কিভাবে রেজিষ্ট্রেশন করবো সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম না।আমার এই গ্রুপের কিছু বড় আপু ও ভাইয়ারা আমাকে অনেক সাহায্য করেন এবং আমি প্রাণের গ্রুপে এড হই। এখানে এসে আমার স্বপ্ন পূরণ করার পথ খুজে পাই।
আমি এখনো কোন কাজ করে সফল হইনি তবে আমার ধীর বিশ্বাস আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবো আমার সততা আর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে।
আমার একটা স্বপ্ন আমি নিজের উপার্জনের টাকা দিয়ে আমার বাবা মাকে পবিত্র কাবাঘর তাওয়াফ করাবো, একটা মহিলা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করবো ও গরীব দুঃখিদের সাহায্য করবো।
আপনারা সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন যেন আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারি।
📌"স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৭০৪
Date:- ২৩/১২/২০২১ইং
নামঃ সেতারা আক্তার
ব্যাচঃ১৫
রেজিষ্ট্রেশনঃ ৭৪৮০৬
জেলাঃ ফরিদপুর
বর্তমান অবস্থানঃ গাজীপুর
আমি কাজ করছি খেজুরের গুড়, সব বয়সি ছেলেমেয়েদের শীতের কালেকশন ও মেয়েদের থ্রি পিছ নিয়ে। তবে আমার আশা দই নিয়ে কাজ করার।
আমার পেজের নামঃ setara's dream
পেজ লিংকঃhttps://www. facebook.com/setarsdream/