বাবাও দেহ ত্যাগ করলো গভীর সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে
আসসালামু আলাইকুম। আপনারা কেমন আছেন? আশা রাখছি,মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ মেহেরবানিতেই সবাই স্ব-শরীরেই পরিবার-পরিজন নিয়েই ভালো ও সুস্থ আছেন।
আপনাদের দোয়ায় আলহামদুলিল্লাহ স্বরেই জানাচ্ছি আমিও ভালো আছি।
আমার জন্ম হয় চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া উপজেলার কাঞ্চনা গ্রামের এক জেলে পরিবারে।বাবার পেশা ছিল গভীর সমুদ্রে গিয়ে মাছ ধরা।তিনি যেই মালিকের মাধ্যমে সাগরে যেত উনার বাড়ি ছিল বাঁশখালীতে।কাজের সুবাদে বাবা,চাচা, দাদুর আনাগোনা বাঁশখালীতে বেশি ছিল।আমার তিন ফুফুর শ্বাশুড় বাড়ি ছিল বাঁশখালী।
মায়ের বাড়ি ছিল আনোয়ারা উপজেলার পরৈকোড়া গ্রামেই।
আমার বাবার পরিবারের আটানব্বই ভাগ আত্নীয় ছিল বাঁশখালীর।আমার মেজ চাচী ও সেজ চাচীর বাবার বাড়িও বাঁশখালী।আমার বাবারা চার ভাই ও তিন বোন ছিল।বাবা সবার বড়।
বাবা-মায়ের বিয়ে হয়েছিল সম্ভবত ১৯৭৭-৭৮ইং এর দিকে।বাবা-মায়ের খুব ভালোই দিন যাচ্ছে।
২৭শে ডিসেম্বর ১৯৭৯ ইং তাদের পরিবারে আলো করেই আসে আমার বড় ভাই। তার ঠিক চার-পাঁচ বছর পরেই জন্ম হয়েছিল আমার বড় বোন।
বড় বোনের বয়স যখন দেড় দুই বছর বোন একটু হামাগুড়ি দেই,একটু একটু হাঁটার অভ্যাস করতেছে।একদিন বাবার পরিচিত বাঁশখালীর এক লোক আমাদের পাড়ার অন্য একটি পরিবারে বেড়াতে এসেছিল।তখন বাবা মাকেই বলেই ছিল অন্য পরিবারে আগত মেহমানের জন্য দুপুরের খাবারের আয়োজন করতেই।এ কথা বলেই বাবা চলেই গিয়েছিল বাজারে। আর বাবার বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই মা গিয়েছিল মেহমান আগত পরিবারেই কারণ তাদের মেহমানের দুপুরের খাবার আমাদের বাড়িতে রান্না করবেন তা জানানোর জন্যেই।
আমাদের বাড়ির সামনেই একটা ছোট পুকুর (কুয়া বা পুশকুনি) ছিল। কুপের পশ্চিমেই বাড়িতেই মেহমান এসেছিল।আর আমাদের বাড়ি ছিল কুপের পূর্বেই। এই সুযোগেই আমার মেজ চাচী আমার বড় বোনকে বাড়ির সামনের উঠান থেকেই কূপের পানির দ্বারেই বসিয়ে দিয়েই এসেছেন।আপু কূপের পানিতেই খেলতেছে।আর বড় ভাই কূপের চারদিকেই হাঁটতেছে।তখন ভাইয়ের বয়স ছয় সাত হবে আর কি!সেইও বা সেই বয়সেই কি বাই বুঝে!এদিকে চাচী বোনকে কূপে বসিয়ে দিয়েই আমার ছোট চাচার বাসা থেকেই ছোট চাচাকে ডেকে নিয়েই বোন যে পানিতে নেমে গেলো তা সুন্দরভাবে দেখাচ্ছে।এদিকে মাও মেহমানকে দাওয়াত করেই চলে আসল।এসে দেখে আপু কূপের পানিতেই খেলতেছে।মা আপুকে নিয়ে আমাদের বড় পুকুরে নিয়ে যাচ্ছে পরিস্কার করাবে বলেই।এদিকে বাবাও বাজার থেকেই চলেই আসলো।বাবা মার থেকে আপু ময়লা হওয়ার কথা জানতেই চাই???তখন চাচা,চাচী,নানু সবাই উত্তর দিলো বোন পানিতেই পড়ে গিয়েছিল!বাবা মাকে ইচ্ছে মত মারধর করলো।এখানে কিন্তু মার বিন্দুমাত্র দোষ নেই।এরপর মার সামনেই শপথ করেই রাগ করেই বাঁশখালী চলে যাচ্ছে আরেকটা বিয়ে করবে বলেই।মা একটু পর দৌঁড়ে গিয়েই বাবার পথ আটকে ধরে।এভাবে বাবার পথ আটকায় ও পা জড়ায় ধরে।তখন বাবার হাতে ছাতা ছিল। হঠাৎ বাবা মাকে গাছের ঠাটের লম্বা ছাতা দিয়ে মুখেই আঘাত করেই।আঘাতটি লাগে মায়ের নাখের ডগায়।এতে মায়ের নাখ থেকে রক্ত যেতে যেতে কাপড় ভরেই গেলো রক্তে!!!মা আর বাবাকে ধরেই রাখতে ব্যর্থ হয়ে পড়েই ছিল।বাবার পথযাত্রী ছিল আগত ভদ্র মেহমানটি।সেই বাবার কথায় সাঁই দিয়েই বলেছিল বাঁশখালী চলো তোমারে আমি বিয়ে করাবো।যেই কথা সেই কাজ।কিছু দিন পর বাবা নতুন এক অবিবাহিত মহিলাকে হাতে শাঁখা,মাথায় সিঁন্দুর পড়িয়েই বাড়িতেই নিয়ে আসলো।পাড়ার এক মুরব্বিকে ডেকেই বাবা কিছু টাকা দিয়েছিল।যেন তারা এসে ঢোল-বাঁশি বাঁজিয়ে নতুন মহিলাটিকে আমাদের ঘরেই পৌঁছাই দেই।আমাদের বাড়ির সামনেই বড় উঠান।বাবার কান্ড দেখেই মা উঠানে কান্নার স্বরেই এই প্রান্ত থেকে গড়াগড়ি করেই ঐ প্রান্তে। আর ঐ প্রান্ত থেকে এই প্রান্ত গড়াগড়ি করতেই লাগল!!!তখন বাবা মাকে এসেই স্বান্ত্বনা দিয়েছিল।এই মেয়েকে আনছি তোমাকে কাজে সহযোগিতা করতে।পাড়ার সর্দ্দার এসেই আমাদের পরিবারকে একঘরেই করে দিলো সমাজ থেকেই।
বাবা কিছু দিন পরেই মাকে আর সাংসারিক খরচ দিচ্ছে না।তখন আমিও মায়ের শরীরেই।কোনো রকম তো বাঁচতে হবে।তখন মা আশে পার্শের হিন্দু বাড়ি গুলোতেই গিয়ে গৃহস্থালি কাজগুলো করত টাকার বিনিময়ে। সেই টাকা দিয়ে মায়ের সংসার মোটামুটি চলত।একটা পর্যায়ে আমি দুনিয়ার আলো দেখতে পায়।আমি যখন দুয়িয়াতে আসি তখন আমি দুধ খেতে পারতাম না কারণ আমার পুরো ঠোঁট ও জিহ্বা জুড়েই ঘাঁ আর ঘাঁ।আমার মেজ চাচা থেকে মা পাঁচ টাকা নিয়েই মধু কিনেই আনে।মা একটু একটু মধু খাওয়াতো।এভাবে ঘাঁ শুকিয়ে এসেছিল।অন্য দশজন ছেলের মত আমার বাকশক্তি ছিলো না।মা ভাবতো, আমার ছেলে বোবা! মা আমাকে নিয়েই খুবই দুচিন্তাগ্রস্থ।ছেলের বয়স ছয় সাত বছর হয়েই যাচ্ছে অথচ কোনো কথায় বলতেই পারে না! মায়ের চিন্তার শেষ নেই!!!
সেজ চাচীর নতুন বিয়ে হয়েছে। বিয়ের দশদিন পর চাচী উনাদের বাপের বাড়িতে বেড়াতে যাই।বেড়ানো শেষে চাচীকে আনতে গিয়ে ছিল আমার বাবার জেঠী মা
(আমার দাদী)।বাড়িতে আসার সময় উনারা একটা পুকুরে বড় বড় পদ্ম পাতা দেখতে পেলো।নানু চাচীকে পুকুরে নামিয়ে দিয়েই দুটি পদ্ম পাতা তুলেই বাড়িতে এনে আমার মাকে দিয়েছিল।নানু আমাকে পদ্ম পাতাকে ভাত খাওয়াতে বলেছিল মাকে।যেমন কথা, তেমন কাজ।আমি পদ্ম পাতাতে ভাত খাওয়ার পর থেকে একটু একটু কথা বলতে পারতেছি।এর কিছুদিন পর থেকেই বড় ভাই আমাকে উনার সাথে করেই স্কুলেই নিয়ে যেত। আমি স্কুলে যেতে পছন্দ করতাম দাদার সাথেই।মা কাজে চলে যেত তাই।দাদা সন্ধ্যায় বাসায় আমাকে পড়াত।স্কুলে ভর্তির সময় আমার নাম কি রাখবে....???মা আমাকে বোবা বলেই ডাকতো!!!তাই স্যাররা ঠিক করলো....
বোবা থেকে বাবু নামটি রাখবেই।
মা-বাবা কেউ বেঁচে নেই....আছে শুধু তাদের তিক্তময় স্মৃতি গুলো। বাবার পরিবারের এমন কোনো জন্তু-জানোয়ার নেই যে তারা কেউ মায়ের শরীরে হাত তুলে নিই!!!সবাই কিছু হতে না হতে মাকে পিঠাতো!!!কারণ তারা একান্নবর্তী পরিবার।মা পরিবারের থেকে প্রচুর নির্যাতিত হয়েছে।বাবার প্রতি আমার প্রচুর ঘৃণা জন্মত।যাক তোমরা যেখানে আছো,ভালো থেকো।মাকে খুব মিস করি কারণ আমার দুঃখগুলো মাকেই মন খুলেই বলতে পারতাম।মায়ের প্রতি আমার ভালোবাসা ও সম্মান স্পেশাল ছিলো।মা জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ নয় মাস চমেক হাসপাতালে ভর্তি ছিলো।অবশেষ ১৬ ই অক্টোবর ২০১২ ইং পৃথিবীর মায়া ভুলেই অজানার উদ্দেশ্যেই চলেই যাই। যেই মানুষটি অনেক কষ্ট করেই আমাকে লেখাপড়া শিখিয়ে সেই মানুষটি আজ নেই আমার ভাবতে অবাক লাগে।পৃথিবীর সবচেয়ে হতভাগা আমি কারণ আমার ইনকামের এক পয়সাও মায়ের জন্য খরচ করতে পারিনি!!!
বাবাও দেহ ত্যাগ করলো গভীর সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে।বাবা অনেক আগেই সাগরে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।বাবার দ্বিতীয় পরিবারের মেয়ে দিয়েছে কিন্তু যৌতুকের ফার্নিচারের টাকা দিতে পারছে না।তাই বৃদ্ধ বয়সে টাকার জন্য সাগরে যেতে হলো।কারণ আমরা শহরে থাকি, বাড়িতেও তেমন যায় না।সৎ মা ও সৎ ভাই বুদ্ধি করেই বাবাকে সাগরে পাঠাই।ফলাফল মৃত্যু।৩ অক্টোবর ২০১৩ ইং।
সবাই আমার জন্য দোয়া রাখবেন।যেন একজন ভালো মানুষ হতে পারি।
মন্তব্যঃ
চাচীর সামান্য ভুলেই আমার পুরো পরিবার নিমিষেই শেষ!!!বাবার পরিবারে বুঝার মত আশির দশকে কোনো মানুষ ছিলো না???তারা বাবাকে স্বান্ত্বনা দিতে পারতো দ্বিতীয় বিয়ে না করার জন্যে। আপনি বা আমার সামান্য ভালো একটি পরামর্শে একজন মানুষ বড় কোনো সমস্যা থেকেই রেহাই পেতে পারে!!!
ভালো থাকুন পৃথিবীর সকল মানুষ।
📌"স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৬৭১
Date:- ১১/১১/২০২১ইং
বাবু দাশ
দ্বাদশ ব্যাচ
রেজি ৩৮৬৯৮
চট্টগ্রাম।