দীর্ঘ ২০ বছর ধরে মা হারানোর গল্প
বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম
আসসালামু আলাইকুম
প্রথমেই শুকরিয়া আদায় করিতেছি মহান আল্লাহ তায়া' লা র প্রতি যিনি দয়া করে এ পেন্ডামিক অবস্থার মধ্যে ও আমাদের ভালো রেখেছেন। আলহামদুলিল্লাহ ______
শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা এবং আন্তরিক ভালোবাসা জ্ঞাপন করছি,নিজের বলার মতো একটা গল্প ফাউন্ডেশনের সম্মানিত ফাউন্ডার জনাব ইকবাল বাহার জাহিদ স্যারের প্রতি।স্যারের কাছে আমি ঋনী।যার নিরলস পরিশ্রমের কারনে আজ এই বিশাল ভাল মানুষের পরিবার পেয়েছি, পেয়েছি ভাল মানুষ হওয়ার শিক্ষা। যার মানবিক কাজ গুলো করেছে আমায় মুগ্ধ, স্যালুট এই মহামানবকে।সৃষ্টিকর্তার কাছে সবসময় দোয়া করি তাকে যেন সব সময়ে সুস্থ রাখেন এবং দীর্ঘায়ু দান করেন।
প্রিয় ফাউন্ডেশনে অনেকের জীবনী পড়ে অনেক অনুপ্রাণীত হয়ে আমি ও আজ আমার জীবনের গল্প লেখার চেষ্টা করলাম
""দীর্ঘ ২০ বছর ধরে মা হারানোর গল্প""
সবাই অনুগ্রহ করে পরবেন প্লিজ।
আমি আসমা আক্তার তিন্নি। গ্রামের মধ্যবিও পরিবারে আমার জন্ম।আমার ছোট বেলা আর পাঁচটি বাচ্চার মতো ছিল না।আমি যখন বুঝতে শিখেছি, দেখেছি আমার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আমার মা নামক শব্দটি অনুপস্থিত। সাধারণত একটি ছোট বাচ্চা মায়ের কাছ থেকে যে আদর,স্নেহ, ভালোবাসা পায় তা আমি কখনোই পাই নি।
দুই ভাইয়ের পরে আমার জন্ম।দাদির মুখ থেকে শুনেছি, দাদি বলত আমার বাবার মেয়ে নেই,মেয়ে না থাকলে নাকি বাবার কষ্ট কেউ বোঝেনা, তাই আমার দাদী আল্লাহর কাছে দুই হাত পেতে দোয়া করতো যেন আমার বাবার একটি মেয়ে হয়।আল্লাহ হয়তো আমার দাদির দোয়া কবুল করে আমাকে এই সুন্দর পৃথিবীর বুকে পাঠিয়েছে।আমার জন্মের পরে আমার পেটের ভিতরের নাড়িভুড়ি সব দেখা যেত।এলাকার সবাই বলত এ মেয়ে বেশিদিন আর বাঁচবে না।কিন্তুু একমাত্র আমার বাবা বলত অনেক চাওয়ার পরে আল্লাহ আমাকে একটি মেয়ে দিয়েছে,আমার মেয়ের কিছু হবে না ইনশাআল্লাহ। আস্তে আস্তে চিকিৎসা দ্বারা আমি সুস্থ হয়ে উঠি।
♥♥♥♥♥♥♦♥♥♥♥♥♥
➤➤কষ্টের অধ্যায় শুরু➤➤
আমার বাবা, কাকা মিলে চার ভাই ছিলেন আমার বাবা একজন কৃষক ছিলেন। আর তিন কাকাই সরকারি চাকরি করতেন।তাই তারা শহরে থাকতেন।আমার বাবা একাই সব জমিজমা দেখাশুনা এবং আমার দাদি একটানা ১০ বছর প্যারালাইজড ছিলেন,তাই আমার বাবাও মা আমার দাদি কে দেখতেন।আমাদের জমিজমা থাকায় অনেক ধান চাষ করত। তাই আমার মা রোজ সোমবার সারাদিন ধানের কাজকর্ম সব শেষ করে এবং আমার ছোট ভাইয়ের জন্য রাতের ভাত প্লেটে রেখে স্বাভাবিক ভাবে ঘুমাতে যায়। আমার ছোট্ট থেকেই বাবার উপর বেশি টান ছিল। হয়ত মা য়ের আদর পাব না তাই এমনটা ছিলাম।২০০১সাল,২২ ডিসেম্বর,রাত যখন ১২ টা বাজে তখন মা বাবাকে ডেকে বলল যে আমাকে এক পাশে ঘুমাতে আর মা মাঝখানে ঘুমাবে। কিন্তুু আমার তখন ৩ বছর বয়স তখন কিছু বুঝতাম না,তাই রাজি হলাম না।আমি মাকে বললাম আমি বাবার কাছে ঘুমাবো।তাই মা একপাশে ই ঘুমালেন। রাত যখন ১ টা বাজে,হঠাৎ মা চিৎকার করে উঠে ওরে মা ওরে বাবা।এ শব্দ শুনে ঘরের সবাই ঘুম উঠে মায়ের কাছে আসল। সবাই মাকে ডাকাডাকি শুরু করল, কোনো সাড়া দেয় না,এ অবস্থায় আমার ছোট ভাই ডাক্তার ডেকে আনল।ডাক্তার এসে ঘোষণা দেয় যে আমার মা আর বেচে নেই।মা মারা যাওয়ার পর এক অন্ধকার জীবনে প্রবেশ করলাম। জীবনে নেমে এলো চরম হতাশা।আমার বড় ভায়ের ২০০০ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে জব হয়, তাই সে ঢাকায় ছিলেন যখন মা মারা যায়।যেহেতু আমার দাদি প্যারালাইজড ছিল তাই আমার ভাই কে বলা হয়েছিল যে, আমার দাদি মারা গেছে।ভাই মনে করছে এটা স্বাভাবিক দাদি অনেক দিন যাবত অসুস্থ, তাই বিশ্বাস করলেন। কিন্তু আমার ছোট কাকা আমার ভাইকে বলে যে তুমি যাও আমি পরে আসবো। আমার ভাই বলতেছিলো, যে তার ( আমার কাকা) মা মারা গেছে সে বাড়ি যাবে না অথচ আমাকে যেতে বলতেছে।তো আমার এক ফুকু আর আমার ভাই ঢাকা থেকে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিল।গাড়িতে বসে আমার ফুফু কান্না করতেছে এই ছেলেকে আমি কিভাবে বোঝাবো যে, বাবা তোমার মা মারা গেছে, আমার মা নয়।( মানে আমার দাদি)। ফুফুর কান্না দেখে আমার ভাই ফুফুকে সান্তনা দেয় আর বলতেছে ফুফু বাবা মা চিরদিন কার ও বেঁচে থাকে না।যাই হোক আমার ভাই বাড়িতে এসে পৌছায় তখন আমার মাকে শেষ গোসল করিয়ে খাটিয়ায় শোয়ানো, তখন আমার ভাই মাকে দেখে বলল, আমার দাদি কালো হইছে ক্যানো সে তো অনেক ফর্সা। মানে আমার দাদি অনেক সুন্দরি ছিল, ১০ বছর বিছানায় ছিল তারপরে অনেক সুন্দর ছিল।আর মাএকটু শ্যাম বর্নের ছিল।তাই আমার ভাই এই রকম কথা বলতেছিল, হঠাৎ আমার ফুফু বলে উঠলো বাবা এ তো তোমার দাদি নয়, এ যে তোমার আদরের মা।এ কথা শোনার সাথে সাথে মা মা বলে চিৎকার করে আমার ভাই অজ্ঞান হয়ে যায়।অনেক সময় পরে জ্ঞান ফিরার পরে আমার ছোট ভাই আর আমাকে কোলে তুলে নেয়। সে যে দৃশ্য ছিল সেদিন তা বোঝানোর ভাষা আমার জানা নেই।পরে বড় ভাই শক্ত হলো যে আমি যদি এত ভেঙে পরি তাহলে আমার ছোট ভাই আর বোন তো আর ও ভেঙে পরবে।আসলে আমি কিছুই বুঝি না তখন, আমার বাবার কাছ থেকে সব শুনছিলাম বড় হয়ে এই অবস্থার কথা,মা হারানোর গল্প।মা কি জিনিস যার নেই সে বোঝে,কাউকে বোঝানো যাবেনা। এখন আমাদের কে দেখার এবং আমার দাদির সেবা যত্ন করার লোক নাই।তাই আমার বড় ভাইকে বিয়ে করার জন্য সবাই প্রস্তাব দেয়। ভাই রাজি হয়ে যায়। কিন্তু সবাই ভাবছিল বড় ভাবি সে হয়তো মায়েরঅভাব পূরণ করবে আসলে সবার ভাবনা ছিল ভুল,সে বিয়ের কয়েক মাস পরই ভায়ের সাথে ঢাকা চলে আসে।এখন আবার হতাস আমার বাবা। পরে সবাই বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। নিরুপয় হয়ে বাবা এ প্রস্তাব মেনে নেয়। ঘরে এলো সৎ মা,সৎ মা তো সৎ মা ই সে কি আর কখনো আপন মা হয়। তারপরে ও যুগের তুলনায় খারাপ ছিল না। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, অল্প কয়েক বছর পরেই সৎ মা ও মারা গেল।এখন কি হবে!এর পরে আমার ছোট ভাই মানে আমার বড়( বড় ভাইয়ের ছোট)ভাই বিয়ে করল। কিন্তুু আমাদের গ্রামের একটি প্রবাদে বলে " আগের হাল যে দিকে যায় পিছনের টা ও সেদিকে যায়"।ছোটভাবি ও ভাইয়ের সাথে চলে গেল। এ অবস্থায় বাবাকে আবার আত্নীয় স্বজন মিলে ৩য় বিয়ে করায়। যাক এখন আমার বাবা ভালো আছে।সবাই দোয়া করবেন আমার বাবার জন্য আর যেন আমার বাবা এই রকম কষ্ট না পায়। আমার মায়ের জন্য সবাই দোয়া করবেন যেন মাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করেন।
♦♦♦আমার শিক্ষা জীবন ♦♦♦
যেহেতু আমার মা আমাকে ছোট রেখেই মারা গেছে তাই আমার হাতে খড়ির শুরু এবং শেষ দুটোই বাবার কাছে।এরপর একাডেমিক লেখাপড়া শুরু হয়।বরাবরই আমি ভালো ছাত্রী ছিলাম।কোনোদিন কোনো শিক্ষক এর মাইর খাই নি,পড়ার জন্য। আমার পড়াশোনার দুর্দান্ত প্রতিভা দেখে আমার বাবা আমাকে বলত, তুমি যতদূর পড়তে চাও আমি তোমাকে সে পর্যন্ত পড়াবো ইনশাআল্লাহ যদি আমি বেচেঁ থাকি।ক্লাস ওয়ান থেকে ফাইভ পর্যন্ত সবসময় এক রোল ছিল।মাএ হাফ মার্কের জন্য বৃত্তি পেলাম না।সেখান থেকেই জিদ ধরি যেভাবে হোক অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পেতেই হবে।যেই ভাবনা সেই কাজ, আলহামদুলিল্লাহ টেলেন্ট পুলে বৃত্তি পেয়ে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলাম।নবম শ্রেণিতে সাইন্স গ্রুপ নিলাম।সাইন্স গ্রুপ থেকে এস, এস, সি পরীক্ষা দিলাম।কপাল মন্দ সিজিপিএ পেলাম ৪.৯৬। আবার এক হতাশায় ভূগলাম।বাবা আমাকে সাহস দিয়েছে কিছু হবে না,তুমি সামনে আর ও ভালো করবে।আবার ও সাইন্স গ্রুদপ থেকে এইচ,এস,সি পরীক্ষা দিলাম।আবারো ও সিজিপিএ ৪.৯৪ পেলাম।আমি একেবারে দিশেহারা হয়ে পরি, আমার বাবা আমাকে সাহস দিছে, উৎসাহ দিছে এই রেজাল্ট দিয়ে ও ভালো কিছু করা যাবে।আশা ছিল ভার্সিটি তে চান্স পাব,কপাল খারাপ চান্স হলো না।আবার ও হতাশ হয়ে ভেঙ্গে পরি, এ অবস্থায় ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য আবেদন করি, এতে ফাস্ট চয়েজে বি এম,কলেজ বরিশাল এ আমি ম্যাথ এ চান্স পাই। আলহামদুলিল্লাহ ফাস্ট,সেকেন্ড,ও থার্ড ইয়ারে সিজিপিএ ফাস্ট ক্লাস পাই।কিন্তু মহামারি করোনার কারনে আজ প্রায় ২ বছর ফোর্থ ইয়ারে সেশন জটে আটকে আছি। তাই আর অনার্স কমপ্লিট করতে পারলাম না।
♥♥♦♦♦♥♥♦♦♦
""রঙিন স্বপ্ন""
আমার ছোট বেলা থেকেই ইচ্ছা ছিল একজন ডাক্তার হবো। কিন্তু এস,এসসি এবং এইচ,এসসি তে এ+ না পাওয়ায় আর মেডিকেল এ ট্রাই করি নি।আমার দুই ভাবি শিক্ষক।তারা নিজেদের ভাবে নিজেরা থাকে। আমার মা নেই এতে যে তাদের একটা দায়িত্ব আছে এটা তাদের কাছে দায়িত্বহীন।তাই তাদের থেকে আমি জিদ ধরি আমি একজন শিক্ষক হয়ে তাদের সামনে দাড়াবো।প্রাইমারী পরীক্ষা দিয়েছি একবার, কিন্তু পরীক্ষা ভালো হলেও রেজাল্ট আসেনি।আমি আবার ভেঙ্গে পরি।এখন স্নাতক ছাড়া প্রাইমারি আবেদন করা যাবে না।তাই আমি আর ও মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পরি।
উদ্দ্যোক্তা জীবন শুরুঃ আমার মানষিক অবস্থা দেখে আমার স্বামী আমাকে নিজের বলার মতো একটা গল্প ফাউন্ডেশন এ রেজিষ্ট্রেশন করালো।সে আগে থেকেই এই প্লাটফর্ম এ যুক্ত।আমি এতটা গর্বিত যে,এমন একটি প্লাটফর্মের আজিবন সদস্য হয়ে।
"স্বপ্ন দেখুন
সাহস করুন
শুরু করুন
লেগে থাকুন
সফলতা আসবে "
শ্রদ্ধেয় ইকবাল বাহার জাহিদ স্যারের কালজয়ী বাণী বুকে ধারন করে আমি বর্তমানে বেশি বেশি স্বপ্ন দেখতে শুরু করছি প্রিয় প্লাটফর্মে যুক্ত হওয়ার পর থেকে।আমি এই প্লাট ফর্মের প্রেমে পরে গেছি,আমি আবার ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি জনাব ইকবাল বাহার জাহিদ স্যার কে।যার শিক্ষায় শিক্ষা গ্রহন করে নিজের ছোট ছোট অপূর্ণ স্বপ্ন গুলো বাস্তবায়ন করার সাহস করছি। আমি এখনো কোনো বিজনেস শুরু করি নি, রিসেন্টলি করবো ইনশাআল্লাহ। সবাই দোয়া করবেন, ভালোবেসে পাশে থাকবেন।
সবাইকে আবারও অসংখ্য ধন্যবাদ যারা ধৈর্য ধরে আমার লেখাটা পরেছেন।সবার সহযোগিতার কামনা করছি,আপনাদের সবার সুখি,সুন্দর জীবন কামনা করছি, সুন্দর হোক আপনাদের আগামির পথচলা।সবার জন্য শুভ কামনা।আজকের মতো এখানেই বিদায় নিচ্ছি।
ভালোবাসা অবিরাম........
♦♥♦♥♦♥♦
📌"স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৬১৩
Date:- ০৩/০৯/২০২১
আসমা আক্তার তিন্নি
ব্যাচ নংঃ ১৫
রেজিষ্ট্রেশন নংঃ ৬৭৪০০
উপজেলাঃ বাকেরগন্জ
জেলাঃ বরিশাল
শশুর বাড়িঃ পটুয়াখালী
বর্তমান অবস্থানঃ সাভার, ঢাকা
।