সিজারের একদিন পর আমার জ্ঞান ফিরে আসে।
"বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম"
____আসসালামু ওয়ালাইকুম ওরাহমাতুল্লাহ্____
সকল প্রশংসা মহান রাব্বুল আল-আমিনের প্রতি যার দয়ার বরকতে বিশ্বের এই সংকটময় মুহূর্তে আজও আমরা সুস্থ আছি এবং ভালোভাবে বেঁচে আছি। লাখ লাখ শুকরিয়া মহান আল্লাহর দরবারে।
আলহামদুলিল্লাহ্।
শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই প্রিয় শিক্ষক, মেন্টর, ভালো মানুষ গড়ার কারিগর, এই শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম সন্তান জনাব, ইকবাল_বাহার_জাহিদ স্যারকে যার অক্লান্ত পরিশ্রম, একাগ্রতা, সততা ও নিষ্ঠার ফসল হিসেবে আমরা পেয়েছি 'নিজের বলার মত একটি গল্প" ফাউন্ডেশন।
আজ আমি আমার প্রিয় ফাউন্ডেশন তথা আমার পরিবারের সকল ভাই বোনদের মাঝে শেয়ার করবো আমার এই ছোট্ট জীবনের কিছু কথা, কিছু গল্প। __________________________________________________________________________________________
আমি জানতামই না যে জীবনের ছোট ছোট গল্প লিখে সকলের সাথে সেয়ার করা যায়। সারাজীবন গল্পের বই পড়েছি, তাতে বিশ্বাস জন্মেছিল যে যারা ভালবেসে লেখার ভার কাধে তুলে নিয়েছেন, দায়িত্ব তাদেরই। আমরা শুধুমাত্র পড়ুয়াদের দলভুক্ত। প্রিয় ফাউন্ডেশনে যুক্ত হয়ে একটু একটু করে অনুধাবন করতে পারলাম চাইলে আমিও লিখতে পারি আমারও জীবনের ছোট ছোট গল্পগুলো লেখা সম্ভব। তারই ধারাবাহিকতায় আজকের এই প্রচেষ্টা।
আমি খুলনার মেয়ে। খুলনা বিদ্যুৎ কেন্দ্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, বি এল কলেজ থেকে এইচএসসি, অনার্স এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স কমপ্লিট করি। লেখাপড়ায় মোটামুটি ভালো ছিলাম। এ কারনে বাবা আমাকে একটু আলাদা রকম ভালবাসতেন। তাছাড়া অন্য সকলের ভালোবাসাও যথেষ্ট পরিমাণে পেয়েছি। সময়টা বেশ ভালই যাচ্ছিলো, স্বপ্ন বুনে সময় কাটছিল।
কিছু দিনের মধ্যে একটা এনজিওতে চাকরী শুরু করি। চাকরিরত অবস্থায় আমার বিয়ে হয়। আমার স্বামী একজন অসম্ভব ভাল মানুষ। শ্বশুর বাড়ির সকলেও অনেক ভালো। আমাকে খুব ভালোবাসেন। সুখের পায়রার মতো সময় কাটছিল আমার।
এরমধ্যে আমি সন্তান সম্ভবা হই। দুই বাড়ীর সবাই অনেক খুশি। আমি এবং আমার স্বামী দুজনের কর্মস্থল দুই জেলায়। বাবার বাড়ি, শ্বশুর বাড়িও আলাদা আলাদা জেলায়। এমতাবস্থায় আমার কর্মস্থলে একা থাকাটা কেউই নিরাপদ মনে করছিল না। অগত্যা চাকরী ছেড়ে দেই। কিছুদিন শ্বশুর বাড়িতে থেকে খুলনায় চলে আসি। সার্বক্ষণিক ডাক্তারের কেয়ারে থাকি। তারপরও বিধি বাম। আমার অগ্নিপরীক্ষা শুরু।
প্রেগনেন্সির সাত মাসের সময়ে হঠাৎ করে আমার ব্লাড প্রেসার বাড়তে শুরু করে। ডাক্তার ঔষধ দেয়ার পর প্রতিদিন দুইবেলা প্রেসার চেক করে রেকর্ড রাখতে বলেন। তদনুযায়ী ঔষধ এবং পরামর্শ দেন।কিন্তু কোনো পজেটিভ চেন্জ হয় না। এক সপ্তাহের মধ্যে আমার শরীরে প্রচুর পরিমাণে পানি এসে যায়। সাথে সাথে ডাক্তার আমাকে খুলনা মেডিকেল এ রেফার করেন। আমার অবস্থা ক্রমশঃ খারাপ হতে থাকে। এক পর্যায়ে কয়েকজন ডাক্তার মিলে বোর্ড গঠন করে ( বাচ্চা যদিও প্রিম্যাচিউর) তাৎক্ষনিক সিজারের সিদ্ধান্ত নেন। আমাকে ওটিতে নেয়া হয় ।আমি যখন ওটিতে তখন ডাক্তার আমাকে বলেন, আমি যেন মানষিক ভাবে প্রস্তুত থাকি যে আমার সন্তান বাঁচবে না।
সিজারের একদিন পর আমার জ্ঞান ফিরে আসে। জ্ঞান ফিরে আসার পর আমাকে গাইনী ওয়ার্ডে এবং আমার ছেলেকে শিশু ওয়ার্ডে দেয়া হয়। বাবু ছিল আন্ডার ওয়েট আর সবাই ধরে নিয়েছিল যে ও বাঁচবে না। সবার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে মহান আল্লাহর অসীম কৃপায় আমার বাবু বেঁচে যায়। হসপিটালে আমার ভাই বোনেরা পালাক্রমে আমার কাছে আর বাবুর কাছে থাকতো। দুদিন পর লক্ষ্য করি বড় আপা আমার আড়ালে লুকিয়ে কাঁদে। আমার মনে সংশয়, বাবু বেঁচে আছে তো? জিজ্ঞাসা করলে বলে কোনো সমস্যা নেই। অনেক পরে জেনেছিলাম বাবুর খিঁচুনী হয়ে অনেক খারাপ অবস্থা হয়ে গিয়েছিলো।
আমরা হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরে আসি। আস্তে আস্তে বাবু বড় হতে থাকে। প্রিম্যাচিউর বেবি বলে ওর এক্সট্রা কেয়ার নেয়া হতো। তারপরও ওর যখন ৮-৯ মাস বয়স তখনো মাথা সোজা করে রাখতে পারতোনা, বসতে পারতোনা, কথা বলতে পারতোনা। আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। ডাক্তারের পরামর্শ মতো চলতে থাকলাম। এরপর মহান আল্লাহর কৃপায় ১৪ মাস বয়সে বাবু বসতে শেখে। আমরা লক্ষ্য করলাম ওর হাত পা অনেক শক্ত। পায়ের পাতা সোজা করে দাড়াতে পারেনা রগে টান লাগে। জোর করে দাড় করালে চিৎকার করে কাঁদে। ডাক্তার বললেন মায়ের মমতা দেখালে ছেলে কখনোই দাঁড়াতে পারবেনা, কঠোর হতে হবে। বাবুকে বেলকনির গ্রীল ধরে দাড় করিয়ে দিতাম আর চারপাশে বালিশ দিয়ে রাখতাম যাতে পড়ে গেলেও মাথায় আঘাত না পায়। ও চিৎকার করে কাঁদতো। আমি "মা নাকি জল্লাদ" এ কথা শুনেও আমার বাবু নিজের পায়ে দাড়াতে পারবে এ আশায় কঠোর হয়েছি।
চিকিৎসা চলছিলো কিন্তু বুঝতে পারছিলাম আরো উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন। এজন্য অনেক টাকা দরকার। সিদ্ধান্ত নিলাম কিছু একটা করব। একটা এনজিওতে জয়েন করলাম। পোস্টিং হলো চুয়াডাঙ্গায়। বাবু বড় হতে থাকলো। কিছু টাকা পয়সা জমিয়ে ওকে নিয়ে ভারতে গেলাম। পর পর তিনবার গেলাম ভারতে। পেড্রিটিশিয়ান, নিউরোলজিস্ট, নিউরো পেড্রিটিশিয়ান, ফিজিওথেরাপিস্ট সবধরণের ডাক্তার দেখানো হলো। ব্রেনের এমআরআই সহ সাজেস্টেড সব রকমের টেষ্ট করানো হলো। তদনুযায়ী চিকিৎসা চলল। আমার বাবু পা পেতে মাটিতে দাড়াতে শিখলো, ৪ বছর বয়সে হাটতে পারলো কিন্তু কয়েকটি শব্দ ছাড়া কোনো কথা বলতে পারলোনা।
ওকে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদায় একটা স্পেশাল চাইল্ডদের জন্য পরিচালিত স্কুলে ভর্তি করা হয়। এক বছরের মধ্যে তেমন কোনো পজেটিভ পরিবর্তন হয় না। ওখানে আর কোনো স্পেশাল স্কুল ছিল না। চেষ্টা করলাম ঢাকা অথবা খুলনায় বদলী হওয়ার কিন্তু বদলী হলোনা। চাকরী ছেড়ে দিয়ে খুলনায় এলজিআরডি মিনিস্ট্রির ৫ বছর মেয়াদী একটি প্রজেক্টে জয়েন করলাম। খুলনার বসুপাড়ার একটি স্পেশাল স্কুলে বাবুকে ভর্তি করে দেই। ওকে স্পিচ থেরাপি দেয়া হয়। আল্লাহর রহমতে পূর্বের তুলনায় বাবু এখন অনেকটা ভাল। তবে ও এখনো কয়েকটি শব্দ বলতে পারে, কোনো বাক্য তৈরি করতে পারেনা। করোনার কারনে এই দুই বছর ও বাড়িতেই আছে। সারাদিন আমার পেছনে পেছনে থাকে আর মা, আম্মু, আম্মুনী বলে ডাকতে থাকে। ও কথা বলতে না পারলেও ওর ভালোবাসার ডাক আমাকে ভরিয়ে রাখে। আলহামদুলিল্লাহ্!!
সবাই আমার বাবুর জন্য দোয়া করবেন।
ধন্যবাদ সবাইকে।
"স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৬২০
Date:- ১২/০৯/২০২১
নাসরীন আক্তার (নয়ন)
ব্যাচ নং-১৫
রেজিঃ- ৬৬২২২
রক্তের গ্রুপ- A+
জেলা- খুলনা
বিভাগ-খুলনা
মোবাইল নাম্বার- 01712651784