হতাশার গ্লানি নিয়ে অনেকের সাথেই কথা বলতাম
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
আসসালামু আলাইকুম
🌹প্রিয় ফাউন্ডেশনের ভাই ও বোনেরা আপনারা সবাই কেমন আছেন? আলহামদুলিল্লাহ আমি চমৎকার ভালো আছি।
🌹শুরুতেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি মহান আল্লাহ পাকের প্রতি যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং এখনো পর্যন্ত সুস্থ রেখেছেন।
🌹কৃতজ্ঞতা জানাই প্রিয় মেন্টর জনাব ইকবাল বাহার জাহিদ স্যার এর প্রতি,যার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে "নিজের বলার মতো একটা গল্প ফাউন্ডেশন" এর মত প্লাটফর্ম পেয়েছি। যেখান থেকে আমার মত হাজারো তরুণ - তরুনী হতাশা থেকে মুক্তি পেয়ে জীবনটাকে সুন্দর করে সাজাতে পেরেছেন।আমি সেই মহান মানুষ প্রিয় স্যার এর প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ।
👉প্রতিটি মানুষের জীবনেই কোন না কোন গল্প থাকে, কারো হতাশার আবার কারো সফলতার।জীবন মানেই উত্থান - পতন, আনন্দ - বেদনা।
আজ তেমনি এক স্বপ্নবাজ তরুণীর গল্প শোনাতে যাচ্ছি। এ গল্প আমার জীবনের গল্প।যে হাজারো প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে আশাহত না হয়ে স্বপ্নের পিছনে ছুটে চলছে।
🌹 জীবনের গল্প 🌹
আমি জান্নাতুল ফেরদৌস ঊষা
👉আমার শৈশব ও কৈশোরঃ- আমার শৈশব কেটেছে চুয়াডাঙ্গা জেলার, আলমডাঙ্গা উপজেলার, বেলগাছি ইউনিয়নের ফরিদপুর গ্রামে।আমার আব্বু ছিলেন একজন সৌখিন মানুষ।উনি নিজেদের কিছু জমি ছিলো যেগুলো দেখাশোনা করতো।কাজকর্ম একটু কমই করতো।আমার আব্বু যখন ছোট ছিলো তখন আমার দাদা মারা যায়।আর আমার আব্বু একটাই ছেলে ছিলো তাই আমার দাদী অনেক আদরে মানুষ করেছেন।
আমরা দুইবোন আর এক ভাই,দাদী,আব্বু, মা এই কয়জন নিয়ে আমাদের সুখী পরিবার।এভাবেই ভালোই দিন যাচ্ছিলো আমাদের। এরই মাঝে আব্বু একদিন সিদ্ধান্ত নিলো যে এই গ্রামে থাকবেন না। ঝিনাইদহ জেলার হরিনাকুন্ড থানার বড়াই গ্রামে চলে যাবেন।সেখানে আমাদের বংশের অনেক আত্মীয় স্বজনরা আছে।আমার দাদার কবরটাও সেখানেই ছিলো।তাই আমার দাদীও মত দিলো সেখানে যাওয়ার। সময় টা ছিলো ১৯৯৯ সাল।আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি।চলে যাবার কথা শুনে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো।কিন্তু এখানে বড়দের মতামত ছিলো,আমার কিছুই বলার নেই।
আব্বু এখানকার কিছু মাঠের জমি বিক্রি করে ওখানে জমি কিনে বাড়ি করলো।পাশাপাশি ব্যবসা শুরু করলো।আমার মা আর ছোট ভাইটা ওখানে মাঝেমধ্যে যেয়ে থাকতো আব্বুর কাছে।আমি তখন দাদাীর কাছে থাকতাম,যেহেতু আমার পড়ালেখা ছিলো।আর ছোট বোনটা প্রায় সময়ই নানীর বাড়ি থাকতো।
এভাবেই কয়েকমাস চললো।মা তখন আমাদের ফরিদপুরেই।আব্বু ওখানে একাই আছে।
একদিন আমাদের পাশের বাড়ির আব্বুর এক বন্ধু মারা যায়,আমরা পরিবারের সবাই মিলে আলোচনা করছিলাম আর আব্বুর কথা খুব মনে পড়ছিলো।আব্বু তার বন্ধুকে দেখতে পেলোনা।
হঠাৎ সেই সময় বাইরে থেকে কারা যেনো আমাদের ডাক দেই।রাত তখন নটা।দাদী বলছে এত রাতে কে ডাকছে? বাইরে এসে দেখে সেই বড়াই গ্রামের দুজন মানুষ।দাদী বলে এত রাতে তোমরা,,,ওরা তখন বলে আমার আব্বু নাকি আর এই পৃথিবীতে নাই,,,,,,,,😪
কথাটা শোনার পর আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।অনেক সময় পর জ্ঞান আসলো।কোন ভাষায় আর তখন নেই।চেয়ে আছি সবার দিকে।এইটে পড়া একটা কিশোরী মেয়ে এক মূহুর্তে বড় হয়ে গেলাম।চেয়ে আছি অপলকে বৃদ্ধ দাদাীর দিকে যে তার সন্তানকে হারালো,মায়ের দিকে তাকাচ্ছি যে এই বয়সে তার স্বামীকে হারালো।আর আমার দেড় বছরের ছোট্ট ভাইটা যে কিছুই বুঝতে শিখেনি সে সহ আমরা তিন ভাইবোন হারালাম আমাদের পিতাকে।
কৈশোর বয়সে বাবাকে হারানো যে কতটা কষ্টের তা প্রতিটিক্ষণ উপলব্ধি করেছি।বাবা ছাড়া পৃথিবীটাই অন্ধকার লাগছিলো।
আব্বু চলে যাওয়াতে আমরা খুব অসহায় হয়ে পড়ি।এতগুলো মানুষ কিভাবে সংসার চলবে।
ঠিক এই সময় সব শোক বুকে চেপে ধরে পরিবারের হাল ধরলো দাদাী।আমার দেখা বড় উদ্দোক্তা। অনেক আগে থেকেই দাদাী ব্যবসা করতেন।দাদা মারা যাওয়ায় আব্বুকে যেভাবে মানুষ করেছেন, আমাদেরকেও সেই একই ভাবে মানুষ করতে লাগলেন।দাদী একটি মুদিখানার দোকান দিলেন, আর কিছু জমি ছিলো এই দিয়ে সংসার চলতে লাগলো।
🌹শিক্ষাজীবনঃ ফরিদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে আমার লেখাপড়া শুরু।লেখাপড়াই ভালোই ছিলাম।কিন্তু আব্বু মারা যাবার পর সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেলো।
নবম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণিতে উঠলাম ওই সময় আমাদের গ্রামেরই একটা ছেলে আমাকে খুব পছন্দ করতো।বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দেই।ছেলেকে দেখে দাদাীর খুব পছন্দ। কিন্তু মা রাজি ছিলোনা।যেহেতু পরিবারের অভিভাবক তখন দাদাী,তাই তার মতেই বিয়ে হয়ে গেলো।
👉 বিবাহিত জীবনঃভালোই চলছিলো বিবাহিত জীবন।সাধারণ পরিবার,পরিবারের লোক গুলোও অনেক ভালো।কিন্তু সমস্যা একটাই আমার স্বামী তেমন কিছুই কাজকর্ম করতোনা।যদিও বিয়ের আগে একটা দোকান ছিলো।আসলে বরের বয়স তখন ১৯/২০ এমন।এই বয়সে সংসারে মন নেই শুধু ঘুরে বেড়ানো।
এভাবেই একটা বছর পার হয়ে গেলো।আমি এস এস সি পাশ করলাম।এবার কলেজে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন জাগলো।খুব সাধারণ একটি পরিবার হওয়ায় লেখাপড়া করানোর ইচ্ছে ছিলোনা শ্বশুর বাড়ির কারো।তবুও অনেক বলে ভর্তি হয়ে গেলাম।কিন্তু ভর্তি হয়েও লেখাপড়া হলোনা।বাধ সাজলো আমার অনাগত সন্তান। ভর্তি হওয়ার পর আমি বুঝতে পারলাম আমি মা হতে যাচ্ছি। বন্ধ হয়ে গেলো আমার পড়াশোনা,জন্ম নিলো আমার বড় মেয়ে।
👉 পরিবারের সদস্য তখন শ্বশুর - শ্বাশুড়ি, দেবর এবং আমরা তিনজন।আমার স্বামী কাজকর্ম কম করাই পরিবার থেকে আমাদেরকে আলাদা করে দেই।খুব কষ্ট হয়েছিল সেদিন।বেকার স্বামী, ৬ মাসের ছোট বাচ্চা নিয়ে কেমন অসহায় লাগছিলো।ওই সময় থেকেই জীবন সংগ্রাম শুরু।তখন একটা পুরাতন সেলাই মেশিন কিনলাম।টুকটাক কাজ করি।এরই মাঝে ব্র্যাক থেকে স্কুল শিক্ষিকা হিসেবে একটা চাকরির অফার পাই।যদিও বেতন অল্প ছিলো তবুও জয়েন করি।পরবর্তীতে একই প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্য কর্মসূচিতে জয়েন করি।
👉চাকরি করি,পাশাপাশি সেলাইমেশিনের কাজ করে পরিবারের পাশে দাঁড়ায়।এভাবে মোটামুটি ভালোই চলছিলো আমার জীবন।কিন্তু বিধাতা আমাকে আবারো কষ্ট দিলো।ওই সময় আমার খুব আদরের ছোট ভাইটি ব্রেন টিউমারে মারা যায়।আমার মায়ের বেঁচে থাকার অবলম্বনটা হারিয়ে গেলো।আর আমার দাদী ছেলে ও নাতীর শোকে কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে গেলো। কয়েক বছর পরে আমার প্রিয় দাদাীও মারা যায়।
🌹 চাকুরী জীবনে ভালো দক্ষতার জন্য অফিসার আমাকে খুব ভালো জানতো।উনাদের পরামর্শে আবারো লেখাপড়া শুরু করি।আর এইচএসসি তে ভর্তি হয়।এভাবেই সংসার,লেখাপড়া, চাকরি চলতে থাকে।এর মাঝেই জন্ম নেই আমার ছোট মেয়ে।
🌹জনপ্রতিনিধি হওয়াঃ একই গ্রামে মায়ের বাড়ি ও শ্বশুর বাড়ি হওয়াতে সবাই জোর করে আমাকে ইউনিয়নের সংরক্ষিত মহিলা আসনে নির্বাচন করার জন্য। বুঝে না বুঝে আমিও রাজি হয়ে যায়।কোন খরচ ছাড়াই বিপুল ভোটে হয়ে গেলাম জনপ্রতিনিধি। তখন সংসার, লেখাপড়া, চাকরি,জনগণ সব কিছু সামলাতে আমি হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলাম।ভাবলাম আমাকে যে কোন একটা ছাড়তে হবে।সব ভেবে চাকরিটা ছেড়ে দিলাম।কিন্তু চাকরি ছাড়ার কিছুদিন বুঝতে পারলাম চাকরিটা আমার খুব প্রয়োজন ছিলো।জনপ্রতিনিধি হওয়া মানে মানুষের সেবা করা, এখানে সৎভাবে আর্থিক কোন উপার্জন নেই।শুধু মাত্র অল্প কিছু সম্মানি ছাড়া।
আবার নতুন করে ভাবতে শুরু করলাম আমাকে কিছু করতে হবে।স্বামীর একার আয় থেকে সংসার চালানো সম্ভব নয়।
👉 তাঁতী বউঃ দর্জি ছেড়ে চাকরি ছেড়ে হয়ে গেলাম তাঁতীবউ।যদিও বাবার বাড়িতে এসব কাজ নেই,কিন্তু আমার শ্বশুর বাড়িতে ছিলো।শুরু হলো তাঁত পাতা,সেই তাঁতে গামছা বুনানো।একবছর তাঁতের কাজ করলাম।সুতার দাম অনুযায়ী লাভ একেবারেই কম হতো।এরই মাঝে আবার চাকরির অফার আসে, শুরু করি চাকরি।
এর মাঝে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে পাশ করি,বি এ ভর্তি হয়।ততদিনে স্বামীরও একটা চাকরি হয়।খুলনা জুট মিলে।এভাবে ভালোই চলছিলো দিন।আমার বি. এ পাশটাও হয়ে যায়।
👉 হতাশার দিনঃ নিয়তি খুবই নিষ্ঠুর। হঠাৎ করে আমার স্বামীর মিলটি বন্ধ হয়ে যায়।কিছুদিন পরে করোনাকালীন সময়ে আমার চাকরিও শেষ হয়ে যায়।আর সেইদিন থেকেই আমাকে হতাশায় আঁকড়িয়ে ধরে।
🌹প্রিয় প্লাটফর্মের সন্ধানঃ হতাশার গ্লানি নিয়ে অনেকের সাথেই কথা বলতাম।কোন চাকরির ব্যবস্থা হয় কিনা।একদিন তারেক ভাইয়ের সাথে কথা বলি মেসেনজারে।আমাকে হতাশ হতে দেখে ভাই এই প্রিয় প্লাটফর্ম এর সন্ধান দেই।বলে এখানে রেজিষ্ট্রেশন করেন,আর দেখেন কিছু করতে পারেন কিনা।তিনি আরও বলেন এখানে একটু সময় দিলে কিছু করতে পারবেন।আমি অনেক বার চেষ্টা করার পর রেজিষ্ট্রেশন সম্পন্ন করি।তারপর স্যারের সেশনগুলো পড়ি।ভিডিওগুলো দেখি।সবার জীবনের গল্প পড়ি।মনের ভিতরে কোথায় যেনো লুকিয়ে ছিলো একটা উদ্দোক্তা মন বুঝতেই পারিনি।শুধু চাকরির কথা ভেবেছি।প্রিয় স্যার এর কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে আবার শুরু করি সেই ছোটবেলায় মায়ের থেকে শেখা কুশিকাটার কাজ।
🌹স্বপ্নঃ জীবনে অনেক কিছুই করেছি।লেগে না থাকার কারণে সফল হতে পারিনি।এখন লেগে আছি লেগে থাকবো।এখন কাজের প্রতি অনেক ভালোবাসা জন্মে গেছে, আলহামদুলিল্লাহ অনেক সাড়া পাচ্ছি। যারাই আমার কুশিপণ্য নিয়েছে তারাই রিপিট কাস্টমার হয়ে গেছে।আমি এই কুশিকাটার কাজ নিয়ে অনেক দূর যেতে চাই।আমার মেয়েদেকে ভালো মানুষ করতে চাই।স্যার এর
সেশনগুলো এখন মেয়েরাও পড়ে ওরাও উদ্দোক্তা হতে চায়।স্বপ্ন দেখি একদিন আমার মেয়েরাও এই প্লাটফর্ম এর একজন হবে।
🌹প্রিয় প্লাটফর্ম থেকে পাওয়াঃ ১৩ তম ব্যাচ থেকে আছি।আমাদের জেলাতে সেশনচর্চা হয় প্রতিদিন। এই সেশন চর্চা ক্লাসে নিয়মিত উপস্থিত থাকি।ভালো মানুষ হতে পারছি।আর সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো হলো হতাশা থেকে মুক্তি।আর ভালো মানুষের ভিড়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখা।উদ্দোক্তা হওয়ার নেশায় লেগে থাকা।
🌹পরিশেষে প্রিয় মেন্টর জনাব ইকবাল বাহার জাহিদ স্যার এর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানিয়ে বিদায় নিচ্ছি।
🌹যারা এতক্ষণ ধৈর্য ধরে আমার জীবনের গল্পটা পড়েছেন,সেই ভাই ও বোনেদের জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ। ভালো থাকুক প্রিয় প্লাটফর্ম এর ভাইও বোনগুলো।সবার জন্য রইলো শুভকামনা। আপনারা সবাই আমার, ও আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন।
স্ট্যাটাস অফ দ্যা ডে - ৬৫৪
২৪/১০/২০২১
আমি জান্নাতুল ফেরদৌস ঊষা
ব্যাচ নংঃ ১৩
রেজিষ্ট্রেশন নংঃ ৫০৫৯১
উপজেলাঃআলমডাঙ্গা
জেলাঃচুয়াডাঙ্গা
কাজ করছি নিজের হাতে তৈরি কুশিপণ্য নিয়ে।
পেজের নামঃ জান্নাতুল কুশিঘর