আমার বেচে থাকবার অনন্য উপাদান সম্পর্কে বলছি।
মানুষের জীবনে এক বা একাধিক অনুপ্ররনা থাকে। আমার ক্ষেত্রে ও ব্যাতিক্রম নয়।আজ আমার জীবনে অন্যতম অনুপ্রেরণা, আমার বেচে থাকবার অনন্য উপাদান সম্পর্কে বলছি। তিনি আর কেউ নন আমার স্বামী। আমার অর্ধাঙ্গ।
আমার মায়ের বাড়ি মারাত্মক রক্ষণশীল পরিবার। তো বাবার ব্যাপার আর মায়ের পরিবারের অতি মাত্রার রক্ষণশীল পারিবারিক বিভিন্ন ইস্যুতে আমি পুরুষ মানুষের প্রতি খুব বিরূপ মনোভাব নিয়ে বড় হই। সব সময়ই বিরক্ত থাকতাম পুরুষ সংক্রান্ত বিষয়ে।
আমি সুন্দরী না একদমই। তার পরও প্রেমের অবেদন পেয়েছি কিছু।
ছোট্ট বেলা থেকে প্রেমপত্র দেখলেই ভয় লাগত। বাসায় লোকজন তখন বাংলা সিনেমার নাইকার কঠিন নজরদারির পারিবারের লোকজনদের মত ভুমিকা পালন করত।
প্রেম বিষয়টি মত এত্ত রোমাঞ্চকর বিষয়টি প্রতি আমার ছিল ভয় এবং বিরক্তি দুটোই।
আমার এই ধারণা পালটে যিনি আমার জীবন রাঙিয়েছেন তিনি আর কেউ নন আমার স্বামী।
২০১৫ সালের কথা। বাসা থেকে ভয়াবহ বিয়ের চাপ, আম্মু টেনশড অলওয়েজ। সবাই দায়িত্ববোধ থেকে কম বেশি বিয়ের প্রস্তাব আনছে কিন্তু আমার রেসপন্স কম। নাই বল্লেই চলে।
হটাৎ করে ফেসবুকে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এল, মিউচুয়াল আমার এক্স কলিগ আরমান। আমি তখন Ogilvy & Mather, Bangladesh এ ছিলাম আর রিকোয়েস্টকারি BRAC International এ। আমাদের অফিস কাছাকাছি। আমি আমার স্বভাবমত রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করলাম না।এটি জানুয়ারির ঘটনা। আমি তাকে আরো অনেক পরে একসেপ্ট করি।
এই লোক দেখতে অসম্ভব সুন্দর, এইটা আমার বিরক্তির আরেক কারন। ভদ্রলোক ক্রমাগত নক করেই যাচ্ছেন। একদিন কি মনে করে রেসপন্স করলাম। যেহেতু এক্স কলিগের প্রেজেন্ট কলিগ তাই সৌজন্যমুলক আচরণ। ব্যাস। আর রেসপন্স করি না। কিন্তু বান্দা নক করেই যাচ্ছে।
এনজিও ASA থেকে একটা ম্যানেজেরিয়াল পোস্টে ইন্টারভিউ কল পেলাম। ওই দিন এই ভদ্র লোকের সাথে খানিকক্ষন কথা হল এনজিও নিয়ে।
প্রয়োজন থেকে বেশি ইন্টারেস্ট এই লোকের। বিরক্তির সাথে কথা শেষ করি।
যেহেতু অফিস কাছাকাছি তাই মিট করবার জন্য বারংবার রিকোয়েস্ট চলতেই থাকে।
পহেলা বৈশাখের পর দিন অফিসে নববর্ষ অনুষ্ঠান ছিল। আগে বলে রাখি আমি জব লাইফেও স্টুডেন্ট পড়াবার নেশা ছাড়তে পারি নাই। সপ্তাহে তিনদিন একটা স্ট্যান্ডার্ড এইটের স্টুডেন্ট পড়াতাম নিকেতন ১ এ।
উনার বারংবার রিকোয়েস্ট রাজি হই মিট করতে। উনার ও ওই দিন নিকেতনে ব্র্যাকের একটা সাব অফিসে সারাদিনের কাজ ছিল। তখনও তিনি আমার ফোন নম্বর জানেন না।
আমি অফিস থেকে একটু আগে বার হয়ে নিকেতনের রিক্সা নিলাম। নববর্ষের অনুষ্ঠানে অফিসে ড্রেস কোড ছিল শাড়ি- পাঞ্জাবি। চিকন মেরুন পাড়ের অফহোয়াইট শাড়িতে গোল্ডেন ব্লক আর মাঝে ডার্ক মেরুন পাতির কাজ, খোলা চুল, টিপ আর কাজল।
একটু রিক্সা থেকে নামবেন প্লিজ
actually i am in hurry now, have to go for a urgent work. কথা শেষ করতে না করতে এবং উনাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রিকশাওয়ালা মামাকে বললাম মামা চলেন।
মামা রিক্সা টানতেই বললাম মামা ঝরের গতিতে চলেন, রিক্সা ভাংলে টাকা আমি দিব।
পরে জেনেছি, সাব অফিসে কাজ তাই কোনমত বার হয়েছিলেন। আর তখনো জানতেন না যে আমাদের মিট হবে। আর দেখাও হয়েছিল।
তখনও আমার এক্স কলিগ আরমান কিছু জানে না। এই ভদ্রলোক প্রথম দিন থেকেই সরাসরি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল।
তার ক্রমাগত নক অব্যাহত থাকল মাঝে মাঝে রেসপন্স করতাম। একদিন অফিসের এক বড় ভাই বলে বসলেন,
কিরে, ইদানিং তোর ফোন ডেস্কে কম হাতে বেশি থাকে? ঘটনা কি???
মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল তার উপর।
তার অতি আগ্রহের জন্য একদিন বনানিতে মিট করবার টাইম দেই। উদেশ্য মজা বুঝানো। প্রচুর খাবার অডার্র করে তাকে হেন্ডসাম একটা বিল ধরায় দেয়া হল।
ওমা, দেখলাম তারপরও তার উৎসাহের কমতি নেই।
আস্তে আস্তে কথা বাড়তে থাকল আর একটু একটু ভালোলাগা।
একদিন আমি আরমানকে কল করে রেইলীরোড কেএফসি তে আসতে বলি। তাকেও বলি আসতে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ ক্লাস শেষ করে ঝড়ের বেগে আসল।
উপরে উঠে দেখি আরমান তার ফেবারিট জিঞ্জার বার্গার খাচ্ছে। আমাদের একসাথে দেখে বার্গারে কামড় দিতে ভুলে গেছে। অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে আছে। আরমান তখন সবে মাত্র BRAC ছেড়ে Unilever জয়েন করেছে। আরমান তাকে আর একটি বার্গারের কথা বলে, উঠে গেলে আমি বললাম ভাই এই অবস্থা। আরমান আমাকে বলল আপু চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করবার মত ছেলে। আপানাদের দুজনকে একসাথে দেখে অসম্ভব ভালো লাগছে।আপনি ভাইয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন।
ছেলে খুবই ভালো কিন্তু ছেলের ঢাকায় বাড়ি নাই এই নিয়ে আমার পরিবার খুবই হতাশ। আমার একগুয়ে ডিসিশন মানতে বাধ্য হয় তারা। ২০১৫ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর পারিবারিক ভাবে আমাদের আকদ সমন্ন হয়।
বিয়ের পর জব কন্টিনিউ করতে সব সময় সাপোর্ট দিয়েছেন আমার স্বামী। এখনো পর্যন্ত আমারা স্বামী স্ত্রী কম বন্ধু বেশি।
প্রেগন্যান্সির পুরোটা সময় আমাকে সেবা করেছে। আমার সকল আবদার রেখেছে। বেবি হবার পর আমার সাথে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে।
ম্যাটার্নিটি লিভের পর খুব হেলদি আর স্মুথ ক্যারিয়ার ছেড়ে দেই, এত্ত বড় ডিসিশিনে পাশে থেকে আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন অবিরত।
যখন পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশনে ছিলাম, সব সময় চেষ্টা করেছে আমাকে হাসিখুশি রাখতে।
আমার উদ্যোক্তা হবার পিছনে সব সময় অনুপ্রেরণা দিয়েছেন এই মানুষটি।
আমি যাতে কাজ করতে পারি তাই বেবির টেকটেয়ার করেছে সব সময়। আমাকে কাজের ব্যাপারে উৎসাহ দেয়া, ভুল হলে ধরিয়ে দেয়া এই সব তার নিত্তনৈমিত্তিক রুটিন হয়ে গেছে আজকাল।
আমার পছন্দের সব কিছু মনে করে নিয়ে আশা তার অভ্যাস হয়ে গেছে।
আমার স্বামীর জীবনের মোটো হচ্ছে তার স্ত্রী সন্তানকে খুশি রাখা। ধৈর্যের সাথে সাপোর্ট দেয়া। তিনি যে শুধু আমাদের প্রতি দায়িত্ব পালন করেছেন তা নয় খুব সুন্দর ভাবে পালন করেছেন শাশুড়ী ও একমাত্র শ্যালকের প্রতি তার দায়িত্ব।
আমি এই মানুষটিকে দেখে অনুপ্রেরণা পাই।
চাঁদপুরে আমার প্রডাক্ট ডেলিভারি করতে মানে কুরিয়ার এর ক্ষেত্রে, তিনি আমাকে সব সময় হেল্প করেন। মাঝে মাঝে সময় পেলে আমার সাথে কাজে ও সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেন স্বেচ্ছায়।
বিবাহিত জীবনে কখনো কোন কাজের জন্য চাপ পেতে হয়নি আমাকে।
যখন নিজের বলার মত একটা গল্প ফাউন্ডেশন যুক্ত হই তখন নিয়মিত সেশন ক্লাস করার সুযোগ তিনিই আমাকে করে দিয়েছেন। আমার মিট আপে যুক্ত থাকার পুরোটা সময় তিনি বেবিকে কাছে রাখেন অথবা দুইজনই আমার পাশে থাকেন।
আমাকে সুযোগ করে দেন আমার বিজনেসের জন্য কোয়ালিটি টাইম স্পেন করতে।
প্রতিটি ডিসিশনে নিতে আমাকে সব সময় হেল্প করেন।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমার মত সৌভাগ্যবতী খুব কমই আছে পৃথিবীতে।
এই মানুষটির জন্য আমি মন থেকে দোয়া করি। আমি আমার মৃত্যু পর্যন্ত তার পাশে এভাবেই সুখ উপভোগ করতে চাই। আপানাদের সবার কাছে আমাদের জন্য দোয়া চাই।
কথায় বলে একজন সফল পুরুষের পিছনে একজন নারীর হাত থাকে। আমি বলব আমার সফলতার পিছনে একজন পুরুষের হাত আছে।
আমাদের প্রিয় মেন্টর, শ্রদ্ধেয় ইকবাল বাহার জাহিদ স্যার সবসময় আমাদের বলেন পরিবারকে সময় দিতে, গুরুত্ব দিতে। প্রিয় স্যারের প্রতিটি কথাই আমার আমার কাছে আদেশদসম মনে হয়।
স্যার আপনার জন্য অনেক অনেক দোয়া আমাদের এত্ত সুন্দর একটি প্যাল্টফর্ম উপহার দেবার জন্য, আপনাকে ধন্যবাদ এত গুলো ভাইবোনকে এক সাথে করবার, ভালো মানুষিক চর্চা করবার এত্ত সুন্দর ব্যাবস্থা করে দেবার জন্য।
এত্ত গুলো কথা শেয়ার করার পেছনে একটাই কারন,
support to your partner.
কিছু দিন আগে ফাউন্ডেশনের দুই আপুর সাথে আমার ব্যাক্তিগত ভাবে কথা হয়। নাম মেনশন করলাম না। আপুদের পার্টনার এবং ইনলস/ শশুরবাড়ি ভীষণ ভাবে মানুষিকভাবে চাপ দিচ্ছেন তাদের ব্যাবসায়/ উদ্যোক্তা জীবন ছাড়তে। নানা রকম পারিবারিক সমস্যা হচ্ছে। আমার শুনে ভীষণ রকমের মন খারাপ হয়েছে।
প্রতিটি মেয়ের কাছে পরিবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মেয়েরা পরিবারের তথা কাছের মানুষের বিরূপ মনোভাব যেমন নিতে পারে না তেমনি পরিবারের সামান্য সাপোর্ট পেলে তারা পৃথিবী জয় করে ফেলতে পারে।
একটু ভাবুন তো,
আপনার স্ত্রী যদি আপনার সংসার ও সন্তানদের দেখাশোনা ঠিক রেখে নিজের একটা
আইডেনটিটি তৈরি করতে পারে সৎ উপায়ে তাতে ক্ষতি কি??
তার অর্জন কি আপনার অর্জন নয়??
তার এই উপার্জন কি আপনার জন্য সম্মানের নয়??
তার এই ভাললাগা কি আপনার ভালোলাগা নয়??
পৃথিবী অনেক বদলে গেছে, গেছে এগিয়ে। এখনো কি আমরা, "পাছে লোকে কিছু কয়" এই ভাবনায় পড়ে থাকব।
না আমরা এগিয়ে যাব। মানুষ আমাদের সাথে তার ভাবনা বদলাবে ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহ ব্যাবসায়কে করেছে হালাল, দিয়েছেন বরকত।
পর্দায় থেকেও আজ আমাদের নিজের বলার মত একটা গল্প ফাউন্ডেশনের শত শত আপা কাজ করছেন সফলতার সাথে।
আসুন আমরা আমাদের পার্টনার কে,
সম্মান করি
ভালোবাসি
সাপোর্ট করি।
বেলা শেষে কিন্তু আপনারা একে অন্যের...
"স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৬৩২
Date:- ২৯/০৯/২০২১
সাহিদা সুমি
কাজ করছি হোমমেড চকলেট নিয়ে
পেজঃ Chocolate Fiction
১৪/৬৫৮৪২
চাঁদপুর সদর