পরিবারের সকলের ছোট হওয়াতে আদরের কমতি ছিলোনা কখনও বাবা -মা, ভাই -বোন সবাইকে নিয়ে ছিলো আমার স্বপ্নের পৃথিবী।
চলুন আজ একটু ইতিহাস শুনি।
তখন এ বাংলাদেশের জন্ম হয়নি, এ দেশ ছিল ভারতবর্ষের একটি অংশ। আমি চল্লিশের দশকের প্রথম দিকের কথা বলছি।
তখন মানুষ জীবন ও জীবিকার তাগিদে ইউরোপ আমেরিকা না, পারি জমাতেন করাচি, লাহোর, দিল্লি, রেঙ্গুন । তেমনি আমার আদি পিতা মানে আমার প্রপিতামহ তার এক চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে পারি জমিয়ে ছিলেন বরিশাল বিভাগের (বর্তমান পায়রা পোর্ট) কলাপাড়া নামক এক বানিজ্যিক বন্দরে।
আমার প্রপিতামহের চাচাতো ভাই সেখানে সরকারি ভূমি অফিসের একজন চাপরাশি ছিলেন, তার মুখে সেখানকার বানিজ্যিক অবস্থার কথা শুনে তিনি ওখানে যান।
বলাবাহুল্য তখন এশিয়া মহাদেশের সর্ব বৃহৎ অটোস্টিম রাইচ মিল ছিলো কলাপাড়াতে।
কলকাতা থেকে সরাসরি নৌযোগে যাতায়াত সুবিধার কারনে এটি অন্যতম একটি বানিজ্যিক শহরে রূপ নেয়। এছাড়াও ব্রিটিশ শাসনামলে বিভিন্ন মিল কারখানা গড়ে উঠেছিল ওখানে।
আমার পিতামহ একজন কঠোর পরিশ্রমী অদম্য মানুষ ছিলেন, ভাগ্য উন্নয়নের জন্য তিনি অনেক পরিশ্রম করতেন। শুনেছি সে একটা সেকেন্ড সময় ও কখনও অপচয় করতেন না, তিনি যেমন ছিলেন পরিশ্রমী, তেমন ছিলেন ধর্মিক। কিন্তু জীবনের চাকা সচল রাখতে বহু চেষ্টার পরেও তেমন কিছু হচ্ছিল না বলেই তার এই যাএা।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে বরিশাল অঞ্চলে নৌপথে সহজ যাতায়াত সুবিধার কারনেই তখন ঐ অঞ্চল গুলো ব্যবসা বানিজ্যের ঘাঁটি হিসেবেগড়ে ওঠে।
সেখানকার ব্যবসা বানিজ্য ওখানকার সূদুর প্রসারি ভবিষ্যৎ অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করে। সেখানে নতুন করে ব্যবসা শুরু করার পরিকল্পনা করেন।
শুনেছি ব্যবসা শুরুর প্রথম দিকে তার পুজি ছিল মাএ ৪ আনা। সে প্রথমে একটা ছোট চা দোকান দিয়ে তার জীবন সংগ্রাম শুরু করেন। অদম্য ইচ্ছে বুদ্ধি আর মিষ্টি ব্যবহারের কারনে কয়েক বছর পরে সে তার ব্যবসা বড় করেন, সে এবার একটা ছোট স্টেশনারি ক্রোকারিজের দোকান শুরু করেন। দোকানের পরিধি বাড়তে থাকে সে তার পরিবার কেও তার কাছে নিয়ে যায়।
আমার প্রপিতামহের তিন সন্তান ছিল। আমার দাদা মেঝ সন্তান ছিলেন। কিছু বছর পরে আমার প্রপিতামহ নারীর টানে তার গ্রামের বাড়ি ফেনীতে ফিরে এসে পুরানো কৃষি ও খামারের কাজ শুরু করেন। বড় ছেলেও বাবার সাথে কাজে মন দেয়, ছোট ছেলে পড়ালেখা করতো।
শুনেছি তখন কয়লা দিয়ে কালি বানিয়ে তারা পাতায় লেখতো। বই না থাকলে অন্য বন্ধু থেকে বই নিয়ে পড়া শেষ করে বই ফেরত দিতো। আমার ছোট দাদা মেট্রিক পাস করেছিলেন। শুনছি তাকে দেখতে বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষ এসে আমাদের বাড়িতে ভীড় জমিয়েছিল।
কিন্তু আমার দাদা কিছুতেই এখানে তার মনমানাতে পারছিলেন না। অবশেষে তিনি আবারও ওখানে পারি জমায়।
শুরু করেন জীবন সংগ্রাম, বহু কাঠ খড় পুড়িয়ে একসময় সে তার ব্যবসা দার করায় এবং অন্য ভাইদের ও পুরো পরিবার কে সেখানে নিয়ে যায়।
এর পরে আমার বাবা, চাচারা সবাই সেখানে বড় হতে শুরু করে একটু একটু করে পরিবার ও তাদের আধিপত্য বিস্তার লাভ করে। একটা সময় মার্কেটের প্রায় একতৃতীয়াংশ আমার দাদা, বাবা এবং চাচাদের দখলে চলে আসে।
প্রকৃতি সব সময় শুধু দেয় না, কিছু নিয়েও নেয়। উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য প্রায় প্রতি বছর সেখানে বন্যা ঝড় লেগেই থাকতো। ১৯৬৯ সালের বন্যায় আমার দাদার সদ্যজাত সন্তানের মৃত্যু হলে দাদা সপরিবারে ফেনী চলে আসেন। রয়ে য়ায় আমার বাবা, তার ছোট চাচা এবং তার পরিবার।
নদীমাতৃক এলাকার কারনে ওখানকার বেশির ভাগ মানুষ ছিলো জেলে, তাই আমার বাবা ওখানে এবার নতুন করে বিভিন্ন ধরনের মাছ ধরার জাল, দড়ি এবং গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার সকল কিছু নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। তার এ বয়সা খুব অল্প সময়েই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
দেশ বদলায় স্বাধীন বাংলার উন্নয়ন শুরুর সাথে সাথে মানুষ ইঞ্জিন চালিত গাড়ি, ট্রলার, ট্রাক্টর ব্যবহার শুরু করে।
আমার আব্বু তার জালের ব্যবসায়ের পাশাপাশি বিভিন্ন মেশিনের পার্টসের ব্যবসা শুরু করেন।
আমাদের ৩ ভাইবোন কে নিয়ে আমার বাবা মায়ের সুখের জীবন চলতে থাকে।
আমার ছোটবেলা,,,,,,,,
পারিবারিক স্বচ্ছলতার কারনে আলহামদুলিল্লাহ কখনোই অভাব কি তা বুঝতে পারিনি।
যদিও চাহিদা কখনোই আকাশচুম্বী ছিলোনা তবে জীবনে যতোটুকু দরকার ছিলো তারপ্রায় সবটুকু প্রয়োজন বাবা মিটাতেন।
পরিবারের সকলের ছোট হওয়াতে আদরের কমতি ছিলোনা কখনও।
বাবা -মা, ভাই -বোন সবাইকে নিয়ে ছিলো আমার স্বপ্নের পৃথিবী।
ব্যবসায়িক একচ্ছত্র আধিপত্য,,,,
আমার বাবা তখন সেখানকার মেশিনারি পার্টসের একজন বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। পুরো ব্যবসায়িক বন্দর কলাপাড়ায় ( বর্তমান পায়রা পোর্ট) তার ই একমাএ এই মেশিনারি পার্টসের দোকান ছিলো। শুক্রবার দোকান বন্ধ থাকতো বলে,আমার বাবাকে খুজতে বিভিন্ন কাস্টমার রা বাসায় এসে ভিড় করতো। কারন প্রয়োজনীয় সামান্য একটা পার্টসের জন্য না হয় যেতে হবে পটুয়াখালী বা বরিশাল সদরে, যা কিনা ৫-৬ ঘন্টার কষ্ট সাধ্য পথ।
কিন্তু একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের ফলে আমার বাবাও তার মহামূল্যবান কাস্টমার দের অপেক্ষা করিয়ে রাখতেন ঘন্টার পর ঘন্টা। যা আমাকে সেই ছোটবেলাতেই ভাবিয়ে তুলতো।
প্রতিযোগিতা মূলক বাজারে টিকে থাকতে না পারা,,,
আমার আব্বুর কাস্টমার দের প্রতি উদাসীনতা ও বাজারে ইতিমধ্যে নতুন প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠান তৈরীর কারনে আমার আব্বু আস্তে আস্তে তার তৈরীকৃত ব্র্যান্ডভ্যালু হারাতে শুরু করে। এর পরে আব্বু নতুন করে কাস্টমার দের কদর করতে শুরু করলেও তা আর আগের মতো কাজে লাগে না।
আমার স্কুল জীবন,,আমি প্রাইমারী, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক কলাপাড়া উপজেলা থেকেই শেষ করি।
ছোটো বেলা থেকে আমি আমার সকল বন্ধু -বান্ধব ও শিক্ষক -শিক্ষীকার কাছে ভীষন পরিচিত মুখ ছিলাম। ভালো ছাত্রী যেমন ছিলাম তেমনি সকল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমার পদচারণায় খুব ছোটবেলা থেকেই আমি সকলের নয়নমণি হয়ে উঠি।
ভালোবাসা ও নীতিশিক্ষা,,,, আমরা আজকাল অনেক বাবা মা কে দেখি তারা তাদের সন্তান কে ভালোবাসলেও তাদের বোঝাতে চাননা যে তারা তাকে কতো ভালোবাসে কারন বেশি ভালোবাসার ফলে যদি তার বাচ্চা নষ্ট হয়ে যায় সে ভয়ে।
তবে আমার বেলায় ঘটেছে উল্টো আমাকে সবাই এতো বেশি ভালোবাসতেন আমার পরিবার, আত্মীয়, বন্ধু বান্ধব, শিক্ষক -শিক্ষিকা সবাই। এদের ভালোবাসা পেয়ে আমি নিজেকে ধন্য ভাবতাম। বড় বড় অফিসার দের কে মানুষ কতো সম্মান করে, তাদের দেখে মনে মনে একজন বিসিএস ক্যাডার হবার স্বপ্ন দেখতাম।সব সময় মনে হতো সবাই আমাকে এতো ভালোবাসে এতো বিশ্বাস করে আমি এমন কোনো কাজ কখনোই করবোনা যাতে তাদের এ বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়, তাদের ভালোবাসার অসম্মান হয়।
২০০৯ সাল, আমার এইচ. এস. সি পরীক্ষার ২য় দিন।
পরীক্ষার হলে আব্বুর দিয়ে আসার কথা কিন্তু তার শরীর ভালো না, আমি একাই গেলাম। পরীক্ষা শেষ করে বাসায় এসে দেখি আব্বুর বাম হাত ও পা আব্বু নাড়াতে পারছেনা কথাও অস্পষ্ট। আব্বুর ব্রেইন স্টোক হয়েছে।
এই দূর্ঘটনা আমাদের পরিবারকে তছনছ করে দিয়েছিলো, কারন পরিবারের একমাত্র আর্নিং মেম্বার ছিল আব্বু। আমরা ৩ ভাই বোনের মধ্যে বড় ভাইয়া তখন মাত্র লেখাপড়া শেষ করেছে, ও সেভাবে কিছুই করতোনা তখন। আপুর নতুন বিয়ে হয়েছে। আর আমিও স্টুডেন্ট।
আব্বুর ব্যবসা বানিজ্য বন্ধ, পরিবারের খরচ, চিকিৎসা, আমার লেখাপড়া, আর সব কিছুকে ছাপিয়ে ভবিষ্যত নিয়ে আব্বু আম্মুর মধ্যে চিন্তা। কি হবে, কিকরে সামনের দিন গুলো পার হবে? আমাকে ভালো একটা ভার্সিটিতে ভর্তি করতে পারবেতো? পারলেও খরচ চালাতে পারবেতো? আব্বু আবার কি সুস্থ হয়ে তার ব্যবসা বানিজ্য চালিয়ে যেতে পারবে?? এরকম হাজার প্রশ্ন আর চিন্তার মধ্যে কাটতে লাগলো সময়। মানসিক ভাবে এই প্রথম বার উপলব্ধি করতে পারলাম পরিবারের একমাত্র উপার্জন ক্ষম ব্যক্তিটির অক্ষমতা একটি পরিবারকে কিভাবে দূর্বল করে দেয়।
যেই আমাকে সবাই পড়ালেখা করে নিজের পরিচয় গড়তে উৎসাহ দিতো, সেই আমাকেই এবার বিয়ে দিয়ে তারা তাদের চিন্তা থেকে মুক্তি পাবার কথা ভাবতে শুরু করলো।
বাবা-মা য়ের বাধ্য সন্তান হয়ে, তাদের চিন্তা লাঘবের জন্য সকল স্বপ্ন বাদ দিয়ে বিয়েতে রাজি হয়ে গেলাম।তখনও আমার দাদা বেঁচে আছেন। তার ইচ্ছে ছিল আমার বড় বোনের মতো আমাকেও যেন ফেনীতেই বিয়ে দেয়া হয়। আল্লাহর ফয়সালা ও ছিল তাই।২০১০ সাল আমার বিয়ে হয়ে গেলো।আলহামদুলিল্লাহ একজন ভালো জীবন সঙ্গী খুজে পেলাম। তখন আমি বরিশাল ব্রজমোহন বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে ১ম বর্ষে ছিলাম। কিন্তু শ্বশুর বাড়িতো ফেনী। নতুন জীবন, নতুন ভাষা, আশেপাশে সব নতুন মানুষ , নতুন সংস্কৃতি।
জীবনের জন্য এটা ছিলো সবচেয়ে বড় যুদ্ধ।আলহামদুলিল্লাহ এ যুদ্ধেও বিজয়ী এখন।
আমি ট্রান্সফার হয়ে ফেনী কলেজে চলে আসি।সংসার জীবনে একজন মা আমি। মেয়ে, সংসার, পড়ালেখা সব কিছু সামলাতে গিয়ে অনেক সময়ই মনে হতো আর পারবোনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেরেছি।
এম. বি. এ শেষ করে চাকুরির জন্য চেষ্টা করি।কিন্তু আমি যখনই কোনো চাকুরীর পরীক্ষা দিতে দূরে যাই একদিনের জন্য হলেও আমার মেয়ে অসুস্থ হয়ে যেতো। অবশেষে এখন চাকুরি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু কিছু না কিছু তো আমাকে করতেই হবে এটা আমার জীবনের ব্রতী ( আমি একজন মা, মেয়ে, বোন, কিন্তু এর বাইরেও আমার একটা আলাদা পরিচয় থাকবে) যা আমাকে আজো তাড়া করে।
📌"স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৬২৯
Date:- ২৬/০৯/২০২১ইং
ফাতেমা জয়নাল ঊর্মি ।
ফেনী সদর
১৫ তম ব্যাচ
রেজিষ্ট্রেশন নাম্বার ৬৯১১৮