আমার অনুপ্ররনার গল্প, আমার মায়ের গল্প,
আমার অনুপ্রেরণার গল্পঃ
প্রতিটি মানুষের জিবনে তার সফলতার পিছেনে একটা বা এক ঝাঁক মানুষের অনুপ্রেরণার থাকে। আমার বেলাতেও ব্যতিক্রম নয়। আমার জীবন ও একঝাঁক মানুষের প্রেরণা, ভালবাসা, দোয়া ও অক্লান্ত পরিশ্রম রয়েছে। আর এইসবের মধ্যমনি হচ্ছেন আমার মা, আমার মা আমার কাছে একাধারে মা, বন্ধু, শিক্ষক, আমার সন্তানের মত ছিলেন।
আমার মা রাণী বেগম নানকিন এর জন্ম ঢাকার টিকাটুলিতে। বাবা পেশায় সরকারি চাকুরীজীবী। নানা ভাই পাকিস্তানের নাগরিক ছিলেন। পড়াশোনা শেষ করে সদ্য চাকুরী নিয়ে জয়েন করেন এপাড় বাংলায়। বাঙ্গালী মেয়েকে বিয়ে থা করে স্থায়ী হয়েছিলেন বাংলাদেশে। একজন ভালো মানুষ হিসেবে ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার জন্য তার অনেক সুনাম ছিল আমাদের এলাকায়। অল্প বয়সে নানু না থাকায় অনেক গুলো ভাইবোনকে দেখাশোনার দায়িত্ব পেয়ে যান অনেক ছোট বেলায় মা তাই আর স্কুল গন্ডি পেরোনো হয়নি তার। আমার নানাও ভাবতেন মেয়েরা বেশি পড়ে কি আর করবে। পড়াশোনা না করতে পাড়াটা আম্মুকে কষ্ট দিত খুব। তাই তিনি তার সাধ্যের মধ্যে সকল গুলাবলীর চর্চা ও যত্ন করতেন।
আমার মা অসামান্য রূপসী ছিলেন। ধবধবে সাদা, ডানা কাটা পরি... না না একদম তা নয়। মা ছিলেন ফর্সা থেকে এক গ্রেড নিচে। অতভুত সুন্দর তার চোখ, মুখ ও শরিরের গরন আর দীঘল কালো চুল। একবার কেউ দেখেলে আবার ফিরে তাকাবেই তবে তা রূপে জন্য কম ব্যক্তিত্বের জন্য বেশি। অসম্ভব সুন্দর করে কথা বলতেন আমার মা। খুবই গোছানো তার প্রতিটি কাজ। আর অমায়িক ব্যবহার, সহৃদয়পূর্ণ আচরণ, পরোপকারি মন সবাইকে মুগ্ধ করত।
যথারীতি তাকে বিয়ে দেয়া হয় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। প্রতিটি বাঙ্গালী মেয়ের মত এক বুক সোনালী স্বপ্ন নিয়ে আমার মা শুরু করেন তার সংসার জীবন। অল্প কিছু দিনের মধ্যে আমি চলে আসি তাদের মাঝে। কিন্তু বিধিবাম। আমার দাদু বাড়ির নানা ইস্যুতে আর বাবার সাথে নানা সমস্যা শুরু হয়। আমার অসীম ধৈর্যশীল মা'র পক্ষে সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। বাবা মা কে না জানিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। আমার আত্মসম্মানে পরিপূর্ণ মা একদম ভেংগে পরেন। যেহেতু আমি সন্তান আর মা ও বাবার দোষ বিচার বিবেচনার ক্ষমতা রাখিনা তাই আমি এই বিষয়ে কিছু না বলি।
মা চলে আসেন নানুবাড়ি আর শুরু হয় দুটি সন্তান নিয়ে তার সংগ্রামের জীবন। আমার নানু বাড়ি বিত্তশালী। তারপরও আমার মায়ের সংগ্রাম ছিল নিজের সাথে। নিজের প্রয়োজনীয় টুকটাক ভাইদের থেকে চাইতে আত্মসন্মানে লাগত আম্মুর। মা ভালো সেলাই জানতেন, শুরু করেন প্রতিবেশীদের জামা কাপড় সেলাই।
পরর্তীতে আমাদের বাসায় কাছেই এক পরিচিত মামা বাইং হাউজে জব করতে। উনি সামান্য রিজেক্ট কিছু কাপড় এনে সেল করতেন। আম্মু সেগুলো কিনে বাচ্চাদের জামা সেলাই করতেন। আশেপাশের অনেক দরিদ্র ভারাটিয়ার বউদের কাজ শিখিয়ে আম্মু একটা টিম বানান। এরপরে আম্মু কাপড় কেটে দিতেন তারা সেলাই করত। আর সেগুলো কিনে নিতেন আমাদের এলাকার এক নানাভাই। নানাভাই এই জামাকাপড় গুলো তাদের গ্রামের দোকানে দোকানে সেল করতেন।
মানে আম্মুর উদ্যোক্তা জীবনের শুরু। আর পরবর্তীতে আমার উদ্যোক্তা জীবনের গুরু।
মা এই সেলাই কাজ করবার জন্য অনেক কথা শুনেছেন তার ভাইদের থেকে। দমে যাননি তিনি। অনেক দরিদ্র মানুষকে তিনি বিনামূল্যে সেলাই শিখিয়েছেন। তিনি তার অপূর্ণ ইচ্ছে গুলো সন্তানদের দিয়ে পূর্ণ করতে চাইতেন। বিশেষত আমাকে দিয়ে।
আমি তখনো বড় হইনি, মায়ের সাথে বাইরে গেলে প্রতিনিয়ত শুনতে হত,
পড়শীঃ “আল্লাহ নানকিন আপা, আপনার মেয়েটা আপনার মত সুন্দর হয় নাই,”
“দুলাভাই ও তা মাশাল্লাহ সেই”
“ও কার মত হয়সে তাইলে”
“মাঝে দিয়া পোলাডা সুন্দর হইসে বাপের মত। আহারে পোলা সুন্দর না হইয়া মাইয়াডা সুন্দর হইয়ে ভালো বিয়া দিয়ে পারতেন""
মাঃ কি যে বলিস তোরা, “আমার সুমি দেখেতে কত সুন্দর”।
আমার কিশোরী মনে কথা গুলো যে কি প্রভাব ফেলত তা বলে বুঝাতে পারব না। একজনই শুধু বুঝতেন, মা । মা আমকে বলতেন, তুই অনেক সুন্দর, অনেক। নিজেকে নিজে সুন্দর ভাববি দেখবি মানুষ ও তোকে সুন্দর ভাববে আর মানুষের আসল সৌন্দর্য হল কাজে। ভালো কাজ তোকে অনেক আকর্ষণীয় করে তুলবে। হ্যা, আমি কাজের প্রশংসায় সুন্দর বলে বহুবার প্রশংসিত হয়েছি জীবনে।
ততদিনে মা দেখে আমি নিজের অজান্তেই শিখছি স্বনির্ভরতা। মা বলতেন সব থকে নামী সরকারি স্কুলে পড়তে হবে তোকে। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে লড়াই করে জায়গা করে নিতে হবে স্কুলটিতে। হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে পেছনে ফেলে আমি চান্স পাই কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। মা কি খুশি, নিজ হাতে ইউনিফর্ম বানিয়ে আমাকে স্কুলে নিয়ে গেলেন। আর আমাকে শিখালেন কি করে প্রতিযোগিতায় লড়াই করে নিজের অবস্থান তৈরি করে নিতে হয়।
স্কুল শেষ করেই কলেজ, কিন্তু রাজি নন আমার রক্ষণশীল মামারা। বিয়ে। প্রতিবাদ করলেন মা। আমি নিজে পড়তে পারি নাই, আমার মেয়ে পড়বে।মামা এক টাকাও দিবেননা আমার লেখাপড়ায় তারা। মা বললেন, আমি পড়াব। মা আমাকে দূরে ভালো কলেজে চান্স পাওয়া সত্ত্বেও ভর্তি করালেন এলাকার কলেজে। অনেক সনামধন্য কলেজ সেন্টাল উইমেন্স কলেজ। আমি অনেক সুদুরপ্রসারি চিন্তা ভাবনা করে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে চলে এলাম ব্যাবসায় শিক্ষা বিভাগে। বিজ্ঞান নিয়ে পড়াটা যে খরচের ব্যাপার সাথে মায়ের কষ্ট হবে তা বুঝতে পারছিলাম। ফিজিক্স, কেমেস্ট্রির মত বিষয়ে A+ পাওয়া ছাত্রী কেন বাণিজ্য শাখার? ভাইস প্রিন্সিপাল ম্যাম ডাকালেন আমায়। আমি দৃঢ়তার সাথে তাকে জানালাম আমার অবস্থান আর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। এভাবে কথা বলতে শিখি আমি আমার মায়ের কাছ থেকে। জেরিন আপা বললেন তুমি অনেক বড় হবে আমি বলে দিলাম।
জেরিন আপা, কতটা বড় হয়েছি জানি না তবে এই অল্প জীবনে অনেক অনেক সন্মানের পদ পেয়েছি অনেকবার।
বিজ্ঞান থেকে আসা আমি কিছুই বুঝি না একাউন্টটিং। অফ পিরিয়ডে আমি একাউন্টিং স্যার কে রিকোয়েস্ট করি আমাকে বুঝিয়ে দিতে। আমার আগ্রহ দেখে শ্রদ্ধেয় নিমাই স্যার আমকে কলেজের রিডিং রুমে সময় দেন। ফাস্ট সেমিস্টারে একাউন্টিং এ ৯৫ ও ইংরেজিতে ৭১ পাই। শুরু হয় বিনা বেতনের কলেজে পড়া। আর ফিরে তাকাতে হয় নি আমার ২৭০০ টাকা ইয়ারলী চার্জে পড়া শুরু করি ইডেন কলেজে মার্কেটিং বিভাগে। আমার বিত্তশালী মামারা অনেক চেষ্টা করেন আম্মুর কাছে আমার পড়াশোনার টাকা দিতে। আম্মু নেননি। আমি আমার কলেজ থেকে শুরু করে MBA করা পর্যন্ত একটি টাকাও নেননি পরিবার থেকে। এই সনির্ভরতার শিক্ষা পেয়েছি আমার মারের কাছ থেকে।
কি করে করেছি? ছাত্র পড়িয়ে।
আমি খুব ভালো এক্সপ্লেইন করতে পারি আর এই চ চর্চাটা কোথা থেকে হল জানেন? এই ছাত্র পড়িয়ে।
আমি আমার ছোট্ট জীবনে অনেক ছাত্র পড়িয়েছি। অনার্সের সময় আমার মান্থলি ইনকাম ছিল ১০০০০+ বাসা ভর্তি ছাত্র ছাত্রী।
রক্ষনশীল পরিবারে বড় হওয়া আমি কথা বলতে লজ্জা পেতাম সবার সাথে। ভাবলাম বড় হতে হলে এর থকে আমাকে বেরিয়ে আসতে হবে। জয়েন করলাম কবিতার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টি এস সি এর ঢাকা স্বরকল্পন এ। আমি অনেক ভালো আবৃত্তি করতাম। অনেক কম্পিটিশন এ গিয়েছি। বিটিভি, শিল্পকলা প্রোগ্রাম সব মা নিইয়ে গেছেন সাথে করে।
ভবলাম চাকুরি করার আগে ইংরেজি বলার চর্চা থাকা দরকার আর এর সব থেকে ভালো মাধ্যম হল ইংলিশ মিডিয়ামের স্টুডেন্ট পড়ানো। এর জন্য বাইরে যেতে হবে। মা পাশে দাড়ালেন। প্রথম অবস্থায় মা সাথে যেতেন আমাকে নিয়ে। আমাকে পৌঁছে দিয়ে বাইরে হাটাহাটি করতেন, বান্ধবিদের বাসার গল্প করতেন আর আমাকে নিয়ে বাসায় ফিরতেন। বাংলাদেশের সনামধন্য প্রায় সবকটি স্কুলের স্টুডেন্ট পড়িয়েছি আমি। এই চর্চাটা আমকে অনেক হেল্প করেছে প্রফেশনাল লাইফে স্বতস্ফুর্তভাবে ইংরেজি বলাতে।
অনার্স থাকাকালে আমি শিক্ষানবিশ হিসেবে ভালো জায়গায় কাজ করতে চাই। কিন্তু ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট তারা কেন নিবে। মা সাহস দেয়। মা বলে, অসম্ভব বলে কিছু নেই,তুই নিজে গিয়ে কথা বল। একবারে না হলে ৩ বার যাবি। লেগে থাকেলেই সফলতা আসবেই। হ্যা আমি ব্যর্থ হয়নি। কাজ করেছি মল্টিন্যাশনাল পেরেছি
Gray Bangladesh,
Ogilvy & Mather Bangladesh,
Fair Distribution (Business coordinator of Hayat kimiya). মত স্বপ্নের জায়গায় গুলোতে। সব আমার মায়ের অনুপ্রেরণা।
প্রিম্যাচ্যুর বেবি হওয়ায় আমি অবার ভেংগে পড়ি। ছাড়তে হয় চাকুরী। ভেংগে পড়ি আর সাহস দেয় মা। শুরু করি অনলাইন ব্যাবসা। লস। আবার মা আমকে সাহস দেয়। বিদেশি বন্ধুর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শুরু করি হোমমেড চকলেট নিয়ে কাজ। জন্ম হয় চকলেট ফিকশন। অল্প সময়ে পাই অনেক সফলতা। তখনও বাংলাদেশে তেমন চকলেট নিয়ে কাজ করে না।
আম্মু ক্রনিক কিডনি পেশেন্ট ছিলেন। গত বছর জানুয়ারিতে আমার আম্মুর দুটো কিডনি ডেমেজ হয়। আমি আম্মুর বাসায় গিয়ে বাচ্চাদের মত আম্মুর দেখাশোনা করি। আমার ছেলের সাথে গোসল করানো, আমার ছেলের সাথে খেতে দেয়া, সব। আমার দুই বাচ্চা। দীর্ঘ ১১ মাস কিডনি জনিত সমস্যা, ডায়ালাইসিস এর সাথে যুদ্ধ করে আমার কোলে মাথা রেখে চলে যান মা। আমার মনে হয় আমার মা নয় আমার বাচ্চাটা আমার কোল খালি করে চলে গেছে। "মা ওমা মা" আমি আর শুনিনা এ ডাক। আমাকে আর কেউ বলে না তুই পারবি, আমি দোয়া করি তুই পারবি।
হে আল্লাহ তুমি আমার বাচ্চাটাকে কবরে সব থেকে শান্তিতে রেখ। আমার মারের প্রতিবেশী কবরবাশীর আযাব মাফ করে দিও। আম্মুর আখিরাত পানির মত সহজ করে জান্নাতের উচ্চ মাকাম তাকে দান কর।
মা নেই। যেতে যেতে এই ধর্মপরায়ন পর্দাশীম নারী আমাকে শিখেয়ে দিয়ে গেছেন আল্লহ উপর সব অবস্থায় আস্থা রাখতে, মাথা উচু করে বাচতে, নির্ভিকভাবে কথা বলতে, সততার সাথে কাজ করতে, ইসলামের ফরজ কাজ যত্ন করে করতে। লেগে থাকতে, নিজেকে বিশ্বাস করতে এগিয়ে যেতে আরও আরও কত কিছু..................
"স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৬২৩
Date:- ১৭/০৯/২০২১
আমি সাহিদা সুমি
কমিউনিটি ভলান্টিয়ার
কাজ করছি হোমমেড চকলেট নিয়ে
পেজঃ Chocolate Fiction
১৪/৬৫৮৪২
চাঁদপুর সদর