অল্প দিনে যতটুকু শিখেছি সেই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যেতে চাই।
আমার জীবনের গল্প
বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।
আমি শুরুতেই শুকরিয়া এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি মহান আল্লাহুর প্রতি যিনি বর্তমানে এই মহামারির সময়ে আজও আমাদেরকে তার এই সুন্দর পৃথিবীর বুকে সুস্থ রেখে তার সমস্ত নেয়ামত ভোগ করার সুযোগ দিয়ে রেখেছেন। আলহামদুলিল্লাহ
ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা, এবং ভালোবাসার সাথে স্বরন করছি আমাদের প্রিয় মেন্টর জনাব ইকবাল বাহার জাহিদ স্যারকে। যার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় আমরা এমন একটা ভালো মানুষের পরিবার পেয়েছি, যেখানে প্রতিদিন তৈরী হচ্ছে নুতন নুতন উদ্দোক্তা, একটা সুশীল উদ্দোক্তা সমাজ ও পরিবেশ। যার অনুপ্রেরনায় আজ প্রত্যেক সদস্য মন খুলে জীবনের কঠিন সময় পার করার কথা বলছে, উদ্দোক্তা হওয়ার সংগ্রামের সমস্যা জয় করে সফল হওযার কৌশলের কথা বলছে। যাতে অন্যান্য সদস্যরা সঠিক কর্ম পরিকল্পনা গ্রহন করে সফলতা পাচ্ছে।
আমি মো: তোফাজ্জল হোসেন, ব্যাচ # ১৬, রেজি: # ৭৭১৩৯, নিজ জেলা ফরিদপুর। গত দুই বছর যাবত কাজ করছি ডেইরী ফার্ম নিয়ে, আজ জানাব আমি এই বৃদ্ধ বয়সে কি করে খামারী হলাম।
জন্ম ও বেড়ে উঠা : ঢাকা এবং ফরিদপুর জেলার সীমানা দিয়ে যৌথ ভাবে বয়ে গেছ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুই নদী পদ্মা ও যমুনা। নদীর পারের মানুষগুলো সর্বদাই অভাব এবং নদী ভাংগনের সাথে যুদ্ধ করে বাচতে হয়। যেখানে হাহাকারের প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়তই নদীর ঢেউয়ের সাথে মিশে বিলীন হয়ে যায়। তেমনি এক জনপদে নদীর চরে আমার জন্ম। বাবা গ্রামের হাটের এক ছোট ব্যবসায়ী। নদীর করাল গ্রাসে এখন বসত ভিটা ছারা আর কোন জমি নাই। গত দশ বছরে নদী ভাংগনের কারনে বসত ভিটা তিনবার পরিবর্তন করা হয়েছে। নয় ভাইবোন ও মাতা পিতা নিয়ে আমাদের পরিবার। বড় ভাই পেয়িং গেষ্ট থেকে রাজেন্দ্র কলেজে পড়ে আর আমরা সবাই গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া করি। ১৯৬৮ সনে বড় ভাই বি এস সি পাশ করে আব্বার অনুরোধে গ্রামের স্কুলেই চাকুরি নেয়। কোন ভাবে চলছিল আমাদের পরিবার। ১৯৭১ এ স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয় তখন আব্বার ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ। স্বাধীনতার পরবর্তীতে আমাদের বাজারে ডাকাতি হয় তাতে আব্বার ব্যবসার সমস্ত পুজি শেষ হয়ে যায়। তখন আব্বার শেষ সম্বল বাজারের ঘরটি বিক্রী করে আবার ব্যবসা শুরু করেন। মেঝ ভাই তখন রাজেন্দ্র কলেজে পরে। ১৯৭৩ আমরা দুই ভাই একত্রে এস এস সি পাশ করি। ততদিনে আমাদের থানায় কলেজ হয়েছে। দুই ভাই কলেজে ভর্তি হই কিন্ত পরিবারকে সাহায্যে করতে গিয়ে আমরা দুই ভাই ছোট একটা ব্যবসা শুরু করি, যার দরুন কলেজ বন্দ করে দিতে হয়। দুই বছর পর আমি একটা ডিপ্লোমা কোর্স করি এবং আমার অন্য ভাই পাচ বছর পর সৌদিআরব চলে যায়।
কর্ম জীবন : ১৯৭৮ - ১৯৮২ পর্যন্ত একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ করি। ১৯৮৩ সনে আমি একটা ভালো কোম্পানীতে জয়েন করি। এই কোম্পানীতে আমি সুদীর্ঘ ৩৬ বছর কাজ করে ২০১৯ সনে আমার চাকুরী জীবন শেষ করি। কোম্পনীতে চাকুরী কালীন সময়ে আমি ঢাকা, ময়মনসিংহ, রংপুর, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা ও সিলেটে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। চাকুরীরত অবস্থায় তিনটি ব্যবসায় জড়িত ছিলাম। রাজশাহীতে গাড়ী মেরামতের গ্যারেজ, ঢাকাতে ভুষি মালের রাখি ব্যবসা এবং সিলেটে শেয়ারের সিকিউরিটিজ এজেন্টের ব্যবসা। বদলী গত এবং অংশীদারদের কারনে কোন ব্যবসাই সফলতার মুখ দেখেনি।
পারিবারিক জীবন : ১৯৮৫ সনে আমি বিয়ে করি। ১৯৮৮ সনে আমার প্রথম ছেলে এবং ১৯৯৪ সনে আমার ২য় ছেলে জন্মগ্রহণ করে। ছোট ভাইকে লেখা পড়া করানো বৃদ্ধ পিতামাতাকে চিকিৎসা সহ তাদের দেখাশুনা করা, পারিবারীক অন্যান্য দায়িত্ব আল্লহুর রহমতে পালন করার সর্বদা চেষ্টা করি। আল্লাহুর অশেষ রহমতে অর্থনৈতিক সমস্যা থাকা স্বত্তেও আমার দুইটা ছেলেকে মোহাম্মদপুর রেসিডেন্সিয়াল এবং পরবর্তীতে চিটাগাং ইন্জিয়ারিং ইউনিভারসিটিতে (চুয়েট) পড়ার সুযোগ দান করেছন। আলহামদুলিল্লাহ। তারা এখন ঢাকাতে ভালো পদে কাজ করছে। আলহামদুলিল্লাহ। পারিবারীক দায়িত্ব এবং সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে গিয়ে আমার স্বল্প আয় দ্বারা আমার স্ত্রীর অনেক সখই পুরনে আমি ব্যর্থ হয়েছি যা এখন আমাকে মনে কষ্ট দেয়।
আমার খামারী হওয়ার স্বপ্ন : আমার অবসরে আসার তিন বছর পূর্ব থেকেই চিন্তা করতেছিলাম অবসরে গিয়ে কি করা যায়। যেহেতু আল্লাহুর অশেষ রহমতে আমি নিরোগ ছিলাম এবং কাজের প্রতি আমার প্রবল আগ্রহ ছিলো। সহকর্মী ও পরিচিত জনদের সাথে এই নিয়ে প্রায়ই আলাপ করতাম। এর মধ্যে প্রাতঃভ্রমণে গিয়ে আলাপ হয় সিলেটের পশু সম্পদ অফিসের ডি ডি'র সাথে। তিনি আমাকে ডেইরী ফার্ম করার পরামর্শ দেন। ডিডি সাহেবের সাথে গিয়ে কয়েকটা ডেইরী ফার্ম সরেজমিনে পরিদর্শন করি এবং আমি নিজে ব্যক্তিগত ভাবে ফার্ম মালিক ও কর্মচারীদের সাথে আলাপ করে এর সমস্যা ও সুবিধা জানার চেষ্টা করি। ছয় মাস এই ভাবে চেষ্টা চালানোর পর আমি সিদ্ধান্ত নেই যে অবসরে গিয়ে আমি একটা ডেইরী ফার্ম করবো। চিন্তার কথা মাথায় রেখে আমি ২০১৯ সনে অবসরে এসেই খামারের ঘড় তৈরী করার ব্যবস্থা নেই। পাশাপাশি ঘাস লাগানো, গাভীর খোজখবর নিতে থাকি। গাজীপুর থেকে পশুপালনের উপর চার দিনের একটা ট্রেনিং কোর্স ও করি। এসব বিষয় শেষ করতে আমার প্রায় নয় মাস সময় লাগে। তারপর আমি পাবনা এবং স্থানীয় ভাবে গরু সংগ্রহ করে খামার শুরু করি। খামার ভালোই চলছিলো ২০২০ করোনা আসার পর দুধের বাজার একদম নিচে নেমে আসে পাশাপাশি গোখাদ্যের মুল্য অনেক বেড়ে যায়। তার উপরে ব্ন্যায় মাঠের ঘাস গুলো নষ্ট হয়ে যায়। আয়ের চেয়ে ব্যয় তিনগুন বেড়ে যায়। কোন উপায় না পেয়ে তখন অর্ধেকের বেশী গাভী ও বাছুর বিক্রী করতে বাধ্য হই। এখন আবারো ফার্মটাকে বড় করার চেষ্টা করছি।
নিজের বলার মত একটা গল্প প্লাটফর্মের সাথে যোগাযোগ ঃ ডেইরী ফার্মের যখন করুন অবস্থা,যে গাভীগুলোকে এত যত্ন করে লালন পালন করেছি, যারা আমার স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দেবে বলে বিশ্বাস করেছি সেই গাভীগুলোকে আজ চাহিদা মোতাবেক খাবার দিতে পারছিনা, লোকের অভাবে ঠিকমত যত্ন হচ্ছেনা এই চিন্তায় মন আমার সব সময় খারাপ থাকতো। সব সময় চিন্তা করতাম কি করে এই খারাপ সময় পার করা যায়। অনেক খামারীর কাছে পরামর্শ চেয়েছি, বন্ধু/বান্ধব, আত্মীয় স্বজনের নিকট পরামর্শ চেয়েছি সবাই আমাকে খামার বন্দ করার পরামর্শ দিয়েছে। এই কঠিন সময়ে একদিন আমার স্ত্রী আমাকে বলে, অন লাইনে একটা প্লাটফর্ম আছে যেখানে উদোক্তা ও ভালো মানুষ হওয়ার ট্রেনিং দেওয়া হয়। সে আমাকে আমাদের প্রিয় মেন্টর জনাব ইকবাল বাহার জাহিদ স্যারের ২/৩ টা ভিডিও দেখায়। ভিডিও দেখে আমার আগ্রহ জন্মে এবং আমি কয়েকদিন ধরে অনেকগুলো ভিডিও দেখি। ভিডিও দেখার পর আমার ভিতরে একটা বিশ্বাস জন্ম নেয় যে, চেষ্টা করলে এবং লেগে থাকলে আমি আবার ঘুরে দাড়াতে পারবো। তখন আমি এই বিশ্বাস নিয়েই প্লাটফর্মে ১৬ নং ব্যাচে জয়েন করি। প্রতিদিন সেশন চর্চায় উপস্থিত থাকার চেষ্টা করি এবং দিন দিন আমার আগ্রহ ও বিশ্বাস বাড়তে থাকে। পরে আমি এই প্লাটফর্মের কাফেলায় ও এগ্রো ফোরামে যুক্ত হই।
এই ফোরামে যুক্ত হয়ে একটা গভীর বিশ্বাস জন্মেছে যে, একটা মানুষের সাবলম্বি হতে জীবনে যতগুলো স্কিল শেখা প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক অধিক এখানে বিদ্যমান। এখানে লেগে থাকলে জীবনের নানা জানালা খুলে যাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। যে শিক্ষা আমরা স্কুল কলেজে বই পড়ে অর্জন করতে পারি নাই সেই শিক্ষা আমরা এই ফোরামে বিনা পয়সায় পাচ্ছি। এই ফোরাম সকল অস্বস্থি দূর করে নুতন করে ভাবতে শিখায়, নিজের মধ্যে পরিবর্তনের ছোয়া লাগায় এবং আত্মবিশ্বাসে মন ভরে দেয়।
এই ফোরামে যুক্ত হয়ে জীবনের শেষ সময়ে খুজে পেয়েছি একটা ভাল মানুষের পরিবার। অল্প দিনে যতটুকু শিখেছি সেই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। সব ভালো মানুষগুলোকে সাথে নিয়ে নিজের বলার মত একটা গল্প তৈরী করতে চাই।
এই ফোরামের সবার প্রতি একটা অনুরোধ, কাজের কোন বয়স নাই। আল্লাহ আমাদেরকে যতদিন সুস্থ রাখেন ততদিন কাজের সাথে লেগে থাকা উচিত। কারন তাতে শরীর ও মন সুস্থ ও ভালো থাকবে পাশাপাশি পরিবার ও সমাজ আপনাকে বোঝা ভাবতে পারবে না।
আমাদের প্রিয় মেন্টর স্যারের একটা উক্তি দিয়ে শেষ করতে চাই "স্বপ্ন দেখুন, শুরু করুন, লেগে থাকুন, সফলতা আসবেই"।
স্ট্যাটাস অফ দ্যা ডে -৭৫২
তারিখ-২৩-০২-২০২২
মোঃ তোফাজ্জল হোসেন
ব্যাচ নং ১৬
রেজিঃ নং ৭৭১৩৯
থানা ঃ চর ভদ্রাসন
জিলা ঃ ফরিদপুর
রক্তের গ্রুপ ঃ এ+
সদস্য ঃ কাফেলা ও এগ্রো ফোরাম