পেশাদার মৌ খামারি হয়ে ওঠার গল্প
--------❤️পেশাদার মৌ খামারি হয়ে ওঠার গল্প❤️--------
------------------বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম---------------
সমস্ত প্রশংসা সেই মহান রব্বুল আলামিনের জন্য। যিনি মহামারীর মধ্যেও আমাদেরকে সুস্থ রেখেছেন এবং সুষ্ঠুভাবে বিজনেস চালিয়ে যাওয়ার তৌফিক দান করেছেন আলহামদুলিল্লাহ।
প্রথমেই আলিফ পিওর ফুডসের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাভরে সালাম জানাচ্ছি আমাদের সকলের প্রিয় মেন্টর বাংলাদেশ তথা গোটা বিশ্বের বিশেষকরে তরুণ প্রজন্মের আইকন মানবিক উদ্দোক্তা গড়ার কারিগর জনাব ইকবাল বাহার জাহিদ স্যারকে।আন্তরিক অভিনন্দন ও ভালোবাসা রইল প্রিয় ফাউন্ডেশনের সকল পর্যায়ের দায়িত্বশীলগন সহ সম্মানিত আজীবন সদস্যবৃন্দকে।
১৭ তম ব্যাচে যুক্ত হওয়া নতুন ভাই বোনদের প্রতি রইল প্রীতি ও শুভেচ্ছা।
৫২'র ভাষা সৈনিকদের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।
অন্তরের অন্তস্তল থেকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি প্রাণপ্রিয় 'নিজের বলার মতো একটা গল্প ফাউন্ডেশনের প্রতি।
এই ফাউন্ডেশনের শিক্ষা নিয়ে আমি আমার নিজের বলার মতো একটা গল্প রচনার চেষ্টা করে যাচ্ছি অনবরত।
পারিবারিক জীবনে আমি বাবা মায়ের তিন সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়।আমার বড় আমার ভাই এবং বোন ছিল ছোট।প্রাইমারী এবং হাইস্কুলে তিন ভাইবোনই ক্লাসে সবসময় প্রথম অথবা দ্বিতীয় হতাম।
বড় ভাই ইঞ্জিনিয়ার ফখরুল আলম বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী। আমার একমাত্র ছোট বোন ফরিদা আখতার খুবই ভালো ছাত্রী ছিলো। ক্লাস ফাইভে ট্যালেন্ট পুলে বৃত্তি পেয়েছিল। দীর্ঘদিন মাথার সমস্যায় ভুগে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় আকস্মিকভাবে পৃথিবীর সব মায়া ত্যাগ করে ওপারে চলে যায়।যে সবার পরে এসেছিল সেই চলে গেছে সবার আগে। আল্লাহ যেন আমার ছোট বোনটার কবর প্রসস্থ করে দেন আমিন।
আমার শিশু কাল এবং ছাত্র জীবন ডানপিটে এবং অগোছালো ভাবেই কেটেছে।পড়ালেখায় যদিও অমনোযোগী ছিলাম তবুও খুব খারাপ ছিলাম না।বৃত্তি কিংবা জিপিএ৫ সবই আল্লাহ আমাকে দান করেছেন।২০১২ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকায় আসি। ভর্তি হই এ সি সি এ তে।সেখানেও অনেক ভালো রেজাল্ট হচ্ছিলো।সর্বোচ্চ মার্কস এর রেকর্ডও ছিল আমার।
এইতো সেদিন ভার্সিটির ব্যানারে আমার ছবি দেখে আবেগে আপ্লূত হয়েছিলাম।
পড়াশোনা বিজনেস রিলেটেড ছিল বলে বিজনেসের প্রতি আগ্রহ ক্রমেই বাড়তে থাকে।
তাই বিজনেসের শুরুটা ছিলো ছাত্রজীবনেই।
২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কাজ করেছি চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম এবং বুটিক নিয়ে।
২০১৪ সালে ঢাকায় আমের বিজনেস করার জন্য মায়ের কাছ থেকে অনেক রিকুয়েষ্ট করে টাকা নিই। চার জায়গায় আমের স্টল ছিলো আমাদের তিন বন্ধুর।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষ হিসেবে অনেক আশা নিয়ে আমের বিজনেস শুরু করেছিলাম।কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! সে বছরই ফর্মালিন নামক গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল চারিদিকে।
সেটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।যদিও আমাদের আমে কোনো প্রকার মেডিসিন ব্যাবহার করতাম না। তবুও চোখের সামনে মণের মণ আম রাস্তায় ফেলে গুড়িয়ে দিচ্ছিল প্রশাসন। সেদিন শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছিলাম। আমার করার কিছুই ছিলো না😪
বিজনেসের শুরুতেই সেখানে অনেক টাকা লস করে ফেলেছি।ছাত্র অবস্থায় এটা বিশাল একটা ধাক্কা ছিল।
মাঝে অনেক কিছুই ঘটে গেছে।তবে হাল ছাড়িনি।
আবার নতুন করে নতুন কিছু শুরু করার চেষ্টা করছিলাম মনে প্রাণে।কিন্তু এবার তো আর ❣️মা❣️ টাকা দিবেনা।
আর বাবা তো আমার বিজনেস করা কোনো দিনই মেনে নেননি।আজও বাবা চাকুরির কথাই বলেন😪
তাই কম পুজির বিজনেস খুঁজছিলাম। অনেক চেষ্টার পর বুটিকের কাজের অভিজ্ঞতা পেয়েছিলাম প্রয়াত সায়েরা খালার কাছে।ঢাকার হাতিরপুল বাজারে উনার বুটিকের দোকান ছিল।আল্লাহ খালাকে বেহেশত নসিব করেন আমিন।
বুটিকের কাজের জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রায় ৫০ জনের মতো নারী শিল্পী তৈরি করেছিলাম।যাদেরকে আমি নিজ উদ্দ্যোগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিজ হাতে কাজ শিখিয়েছিলাম। কমপক্ষে ৬০ রকম সুতোর কালেকশন ছিল আমার কাছে।কিন্তু অজানা কোনো এক কারণে বুটিকের বিজনেসটাও বেশিদূর এগিয়ে নিতে পারিনি।এবারও হতাস হলাম।
এরপর আবারও অনেক কষ্ট করে কিছু টাকা ম্যানেজ করে গ্রামের একজনের সাথে পার্টনারশিপে সেখানেই গার্মেন্টস এর দোকান দিই।আমি ঢাকা থেকে মাল পাঠাতাম।সে দোকানে সেল করতো। কিন্তু বছর যেতে না যেতেই দুজনের ভুল বুঝা বুঝিতে দোকান উঠে যায়।
তবে এবার অর্থনৈতিক ক্ষতি ছাড়াও সামাজিক ভাবে অনেকটা হাস্যরসের পাত্র হয়ে উঠেছিলাম।বেশিরভাগ লোকই ঠাট্টা করা শুরু করে।এরপর অনেকদিন গ্রামের বাড়ি যাইনি।
অনেক কিছু করার চেষ্টা করেও দূর্ভাগ্যবশত অনভিজ্ঞতা এবং সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে সব ক্ষেত্রেই লস হতে থাকে।যার কারণে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কয়েক লক্ষ টাকা লস গুনতে হয়েছিল আমাকে।
সেই টাকার সিংহভাগ বহন করেছিলেন আমার
❣️মা❣️
এর পরের সময়টা বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল।আমি অনেকটা দিশেহারা অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছিলাম।পরিবারে নিজেকে খুব ছোট মনে হতো। কাছের আত্নীয় স্বজন, বন্ধুরা যারা কিছুদিন আগেও ভালোভাবে কথা বলত তারা কেমন জানি করত আমার সাথে। অনেককে বারবার ফোন দিলেও রিসিভ করতো না। একটা সময় মনে হতো গোটা পৃথিবী এক দিকে আর আমি একাই একদিকে।
তখন অনেকটা বুঝতে পারলাম নিজের যুদ্ধ নিজেকেই লড়তে হবে। এ সময় ছায়ার মতো সবসময় পাশে ছিলেন আমার মমতাময়ী ❤️মা❤️
সেসময় কিছুই ভালো লাগতো না।মায়ের সাথে প্রতিদিন ফোনে কমপক্ষে একঘন্টা কথা বলতাম। যার প্রত্যক্ষদর্শী আমার মেসের সবাই ।বিশেষ করে বন্ধু মোস্তাফিজুরের কথা না বললেই নয়।আমার মা সবসময়ই খালি একটা কথা বলতেন, ''তুই পারবি''
এভাবে দিন কেটে যাচ্ছিল হতাসা আর দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে।আমি তখনও আমার ত্রুটিগুলো মাথায় ঘুরাতাম আর চুলচেরা বিশ্লেষণ করতাম। কেন পারছিনা!কেন ব্যার্থ হচ্ছি বারবার!
তারপরও কোথায় যেন একটা গ্যাপ থেকে যাচ্ছিল।বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি করব!
ঐ সময়টায় চরম সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম।একে তো চাকরি করার মোটেও ইচ্ছে ছিলনা।তারপরও অনেক টাকা লস করে ফেলেছি।পরিবার সমাজ কেউ ভালো চোখে দেখছে না।
আমার ব্যার্থতার গল্প অনেক দীর্ঘ,,,,,
এতো ব্যার্থতার পরও মায়ের ঐ কথাটা আমাকে স্বপ্ন দেখাতো বারবার ''তুই পারবি''
সে সময়গুলোতে আলিফ পিওর ফুডসের কো-চেয়ারম্যান আঙ্গুর হোসেন সবসময়ই পাশে ছিলেন।লাভে লসে সবসময়ই উৎসাহ দিয়ে গেছেন।
শত ব্যার্থতার পরও আমি এর শেষ দেখতে চেয়েছিলাম।
জীবনে অনেক কিছুই তো করেছি।
কিন্তু উদ্দোক্তা জীবনে নিজেকে মৌ খামারি হিসেবে পরিচয় দিতেই গর্ব বোধ করি।কারণ একজন পেশাদার মৌ -খামারী হয়ে ওঠা আমার জন্য অতটা সহজ ছিলনা।ব্যার্থতা যেন বারবার হাতছানি দিত আমায়।
তবুও দীর্ঘদিন চিন্তা ভাবনার পরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পরিচিত একজন পদকপ্রাপ্ত চাষি মনিরুল ইসলাম চাচার মৌ খামার থেকে মাত্র আড়াই হাজার টাকায় ১০ কেজি মধু কিনে খুচরা সেল শুরু করলাম ঢাকায় পরিচিত জনদের মধ্যে।আমার মেস ছিল ধানমন্ডিতে।
কিন্তু তখনও বিজনেসের কোনো কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না।ফেসবুকে পোস্ট করতে লজ্জা পেতাম।গ্রামের কেউ দেখলে আবার সমালোচনার ঝড় তুলবে যে!
হঠাৎ আমার রুমমেট ছোট ভাই রাজু একদিন খেতে খেতে এই গ্রুপের কথা বললো।এখানে নাকি সন্ধ্যার পর পোস্ট করলে অনেক সেল হয়।আর গ্রামের কেউ এই পোস্ট দেখবেওনা।তখন আমি অনেকটা উৎসাহ নিয়ে শেসন গুলো পড়া শুরু করলাম।অনেক দিন গেছে একদিনে ১৫/২০ টা শেসন পড়তাম।
কিছু কিছু শেসন এতো ভালো লাগতো যে একটা শেসনই বারবার পড়তাম।আস্তে আস্তে আমার লজ্জা ভেঙে গেল।পোস্টও করা শুরু করলাম। অল্প অল্প শেলও শুরু হলো।অফলাইনেও ভালোই সেল হতো। তারপর ২০ কেজি, ৩০ কেজি,এক মন,.........
এর মধ্যেই অভিজ্ঞতা হয়েছে ঘি,সরিষার তেল,গুড়ো মসলা এবং চা নিয়ে কাজ করার।
কিন্তু আমার বরাবরই উৎপাদন করা এবং নিজে মালিক হবার প্রতি ঝোঁক ছিল প্রবল।
স্যারের শেসন গুলো যতই পড়ছিলাম ততই ইচ্ছেগুলো গতিশীল হচ্ছিল।
২০১৯ সালে মনিরুল চাচাকে খুব করে রিকুয়েষ্ট করে সেখানে আমার প্রয়োজনীয়তা কি সেটা বুঝিয়ে সেই মৌ খামারেই প্রথম ইনভেস্ট করি ২০০০০৳ এরপর লাভের টাকা নিয়ে নিজের কিছু দিয়ে ইনভেস্ট করি ৮০০০০ টাকা।
এর পর লাভের টাকা দিয়েই বাড়তে থাকে ইনভেস্ট বাড়তে থাকে খামারের আকার।মনিরুল ইসলাম চাচার উপকার কখনো ভুলার নয়।
যাইহোক, আমার সর্বোপরি প্রান্তিক পর্যায়ের উদ্দোক্তা এবং মানবিক উদ্দোক্তা হয়ে ওঠার পিছনে এই ফাউন্ডেশন কি কি ভূমিকা রেখেছে সেটা বলা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার।কারণ এই ফাউন্ডেশনের সাথে পরোক্ষভাবে আমার পুরো পরিবার জড়িত।
বাবার বড় স্বাধ ছিল আমাকে চার্টার্ড একাউন্টেন্ট আর বড় ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার বানাবে।বড় ভাই ঠিকই ইঞ্জিনিয়ার হয়ে আমেরিকায় বসবাস করছেন।
কিন্তু আমি যখন উদ্দোক্তা হয়ে শীতের রাতে মৌ খামারে মাঠের মধ্যে তাঁবুর নিচে থাকি তখন বাবার জন্য খুব কষ্ট হয়।আমি বাবাকে কথা দিয়েছি আমি একদিন অনেক লোকের জন্য চাকুরির ব্যাবস্থা করবো।
স্যারের ইউ টিভি লাইভে কখনো সুযোগ পেলে সবই বলবো ইনসা আল্লাহ।
বর্তমানে আমাদের খামারে ডিজিটাল বক্স আছে প্রায় ৪০ টি এবং কাঠের বক্স আছে ২০০ টিরও বেশি।
তাতে সরিষা, ধনে,কালোজিরে, লিচু, বরই ফুলের মধু সবমিলিয়ে উৎপাদন করি প্রায় ২৫০ মন।
উপরন্তু আমরা পোলেন,প্রোপালিস, রয়েল জেলি উৎপাদনে সক্ষম হয়েছি আলহামদুলিল্লাহ।যা বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পে ব্যাপক বিপ্লব ঘটাতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি।
২০২৩ সালে আমাদের খামারে ডিজিটাল বক্সের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যাবে এবং কাঠের বক্সের সংখ্যা ৪০০ এর অধিক হবে ইনসা আল্লাহ।
সরকারি/বেসরকারি সহযোগিতা পেলে দেশের চাহিদা পূরণ করে ২০২৫ সালের মধ্যে বিদেশে মধু রপ্তানি করতে পারবো ইনসা আল্লাহ।
এখন কাজ করছি শুধুমাত্র মৌ খামার এবং মাছের প্রোজেক্ট নিয়ে।
মৌমাছি এবং মধু উৎপাদন আমার নেশায় পরিণত হয়ে গেছে।আমাদের লাভের একটা বড় অংশ দরিদ্র শিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদানের জন্য ব্যয় হয়।
এখন আর নিজের কাজে মোটেও লজ্জা পাইনা।কাজকে ছোট মনে হয়না।লোকে কি বললো সেটা নিয়ে মাথা ব্যাথা হয়না।ইকবাল বাহার জাহিদ স্যারের শেসন গুলো পড়ে এবং চর্চা করে আমি বুঝে গেছি কাল সকালে কেউ আমার বাজার করে দিবে না।
আমি মনে প্রাণে ধারণ করি,
স্বপ্ন দেখে সাহস নিয়ে শুরু করে লেগে থাকলে সফলতা আসবেই ইনসা আল্লাহ।
দীর্ঘ ৯ বছরের অভিজ্ঞতায় বিজনেস নিয়ে আমার তিনটি উপলব্ধিঃ
১) একটা প্রতিষ্ঠিত না করেই অন্যটা শুরু করা ভুল।
২) প্রাথমিক অবস্থায় তদারকি নিজে করা, কর্মী দিয়ে নয়।
৩) শুরুটা ছোটোই ভালো।
আবারো বলছি,আমি ফেরদৌস চাঁপাইনবাবগঞ্জের ছেলে।
মধু উৎপাদন করি।
মধু খান সুস্থ থাকুন।
কথা দিচ্ছি ঠকাবো না কাউকে ইনসা আল্লাহ।
ভালো থাকবেন সবসময় এবং দোয়া করবেন আমার
জন্য।
স্ট্যাটাস অফ দ্যা ডে -৭৫৬
তারিখ -২৮/০২/২০২২
নামঃ ফেরদৌস উল আলম
ব্যাচঃ অষ্টম
রেজিঃ ৪৩২৪
জেলাঃ চাঁপাইনবাবগঞ্জ
জোনঃ ধানমণ্ডি
পেশাঃ মৌ -খামারী
মোবাঃ ০১৭২৫১০৬৮৫৭
https://www.facebook.com/purefoods07/