এটা কোন গল্প নয় এটা আমার জীবন নামক রেলগাড়ীর কু ঝিক্-ঝিক্ আওয়াজ।
শ্রদ্ধেয় স্যার আজ আহ্বান করেছেন নিজের গল্প বলতে।
তাঁরই আহ্বানে সাড়া দিয়ে রূপকথার গল্পকে ছাপিয়ে শোনাতে এলাম রাজকণ্যার উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প।
বাবার রাজকন্যা আমি।👸
কৃষ্ণচূড়া ও জারুল ফোঁটা পরিবেশে ফরিদপুর চিনিকলের প্রকৌশলী পিতার চাকুরীর সেখানেই শৈশব কাটিয়েছি। পড়াশোনার ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে মেধা তালিকার শীর্ষে স্থান নেয়া মেয়েটিও একসময় বাঁধা পড়লাম সংসার জীবনে । বিসর্জন দিলাম স্বাধীনতার সুখ, ভরিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম সকলের সুখ, বাবার সম্মান। কিন্তু কোথায় যেন, আত্মতৃপ্তির ছোঁয়াটুকু পেলাম না, তৈরি হলো না ক্যারিয়ার নামক শব্দে নিজ পরিচয়।
আমার সাধাসিধে সাজ, পরিপাটি ভাঁজ, চোখের কোণে কাজল হার মানাতে পারলো না পার্লার সাজকে। উঠতে বসতে কটূ কথা, শ্রদ্ধার অবনতি যেন মেয়ে হয়ে জন্মানোটাই পাপ। তারপরও মুখ বুজে হাসিমুখে চলি সমাজের সাথে, কোলে আসা রাজকুমারের মুখ চেয়ে সন্তানকে নিয়ে একটা ভালো স্কুলে দৌড়ি ছুটি, তবুও যেন পাপ। এসবের মাঝেই পেরিয়ে গেলো ১২ বছর। টের পেলাম নিজের ভেতর আরত্ত একটি প্রাণের অস্তিত্ব আর তারই ৬মাস পর অন্তঃস্বত্বা অবস্থায় শুরু হলো সম্পর্কের টানাপোড়েনের চরম অস্থিরতা । শপথ নিলাম,ঘুরে দাঁড়ানোর আর নিজেকে সামনে আনার।
কণ্ঠশীলন আবৃত্তি সংগঠনে নিজের নাম লেখালাম কৃতিত্বের সাথে। এরপর ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়াশোনার নতুন উদ্যম। এনালগ মেয়ের ডিজিটাল পড়াশোনার বাঁধ সাজলো পোশাক। কেঁদেছি তবে হার মানিনি। সকলকে অবাক করে তৈরি করলাম জামদানী টাই। কিন্তু টানপোড়েন বেড়েই চলল।
২০২০ লকডাউন, কোন এক রোদেলা দুপুরেও অন্ধকার হয়ে এলো আমার চারপাশ। অভিমানী আমি আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে দুই রাজকুমার নিয়ে শুন্য হাতে ১৬ বছরের সংসার ফেলে চলে আসি এক কাপড়ে। ভাবিনি, ভেঙ্গে যাবে সংসার, বিশ্বাস তখনও বাসা বেঁধে ছিলো বুকে, সে আসবে তার ভুল বুঝে। তবে সে ফিরে আসে নি, এসেছে হলুদ খামে ভরা চিরতরে সম্পর্ক ইতির চিঠি ।যেন এটাই আমার নিয়তি ঘুরে দাঁড়ানোর মঞ্চে উঠার। প্রচণ্ড ব্যাথায় মন কেঁদেছে।হতাশায় দূরে গিয়ে ভেবেছি এজন্যই মেয়েরা আত্মহত্যা করে।
তবে আমার মাথায় ছিলো বাবার দুটো হাত। তাই মরে না গিয়ে বারবার ভেবেছি সমাজকে দেখিয়ে দিব আমি নারী,আমি পারি। সম্পুর্ণ আসহায় রোজ অপেক্ষা করতাম, এই বুঝি সুন্দর মোড়কে সৃষ্টিকর্তা আমায় পাঠাবেন কোন সাফল্যের উপহার।
মোবাইল হাতে দখিন জানালায় বসে বসে সারাদিন ফেসবুকে ঘাটাঘাটি করতাম, কণ্ঠে তুলে আবৃত্তি করতাম, হঠাৎই সামনে এলো E commerce এর বিভিন্ন দিকের নানা পোস্ট।
বুঝে না বুঝে জয়েন হলাম আবৃত্তির গ্রুপ মনে করে। কারণ তখন e-commerce শব্দটার সাথে পরিচিত থাকলেও জানা ছিলো না তার কাজ নিয়ে।
সেগুলোতে জয়েন হওয়ার পর দেখতে পেলাম পরিচিত অনেক মুখ, তবুও বুঝিনি কিছুই।কাওকে কিছু জিজ্ঞেস না করে সময় দিতে শুরু করলাম, কমেন্টে জানালাম শুভকামনা, তবে মন ভরলো না। এবারে বড় আরো সুন্দর কমেন্টের জন্য তৈরী হলাম। তবে লিখতে পারতাম না বাংলা অক্ষরে শব্দ। এক এক পরিবারের নিয়ম মেনে, পরিহার করলাম ইংরেজী অক্ষরে বাংলা লিখা। পুরোপুরি রপ্ত করে নিলাম এবার বাংলা টাইপিং। সেলের চিন্তা না করে কমেন্টের পর কমেন্ট করা শুরু করলাম। এরপর পোস্ট দিলাম। বিগত দিনে যাদের পোস্টে সুন্দর সুন্দর কমেন্ট ছিলো তারাই এলো আমার পোস্টে কমেন্ট দিতে। ভালোবাসায় সিক্ত হলাম। বুঝেই নিলাম আমি শিখেছি ই কমার্সের কল্যাণে, ভালোবাসা দিলে ভালোবাসা মিলে। এনালগ এই আমি, যে কিনা চালাতাম না ইমো, হোয়াটসএ্যাপ, বিজনেস একাউন্ট, এবারে ডিজিটাল হওয়ার চেষ্টায় সব পারি।
নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জলন্ত প্রদীপের শিখা জ্বালিয়ে রেখে আমরা তার আলো হয়ে জ্বলছি। স্বতঃস্ফূর্ত কাজ করি আজ উদ্যোক্তার জানালায় দাঁড়িয়ে। আয়নায় আজ নিজের চেহারার সাথে গর্বিত নারীকে দেখি জ্বল জ্বল করে জ্বলতে। আলাহামদুলিল্লাহ,, ই কমার্সের সাথে কাজের কল্যাণে আজ শত শত নারী নিজের পরিচয় তৈরী করে সুন্দর জীবন গড়ছে। ভালোবাসি কাজ।এরই মাঝে তিনমাস চলে গেলো আমার কষ্টের দিনগুলোর তবে মনে নেই সেই কষ্টের দিন।
পথ চলতে পিছু ফিরিনি তবে সৃষ্টির নিয়তি মানতেই হলো, পৃথিবী থেকে হঠাৎ বিদায় নিলেন সুস্থ্য বাবা আমার। বিধবা মা, অবুঝ দুটো সন্তান, একমাত্র ছোট ভাই,সকলের দায়িত্ব এলো আমার উপর। আর্থিক বিষয়গুলো না দেখলেও মানসিক শান্তির নির্ভরতার জায়গা যেন আমারই নিকট। সেদিনের মনকে শক্ত করতে সাহস যোগালেন উদ্যোক্তা জীবনের ভাই বোন। সামলে নিলাম ব্যাথার পাহাড়। সৃষ্টিকর্তা নিয়েছেন অনেক কিছু আর দিয়েছেন তারও অধিক। তাই আমি পেরেছি আমার বিবির বসনের জন্ম দিতে।
বিবির বসন আমার সন্তান সমতূল্য উদ্যোগ।
সত্যি বলতে উদ্যোক্তা হয়ে কেও জন্ম নেয় না, উদ্যোক্তারা তৈরী হন নিজ প্রতিভার চাষাবাদে। আর চাষাবাদের জন্য দরকার হয় শস্যক্ষেত্র। এইসব প্লাটফর্মগুলো হলো সেই ক্ষেত। আর আমার সততার পরিশ্রম হলো তার শস্য। আপনাদের ভালোবাসা হলো শস্যের জন্য জৈবসার। তাইতো আজ জামদানীতে, মনিপুরীতে টাই, পাগড়ী, স্যাণ্ডেল, , ব্লেজার, ভেজিটেবল ডাইয়ের মতো অসাধারণ কাজগুলো ঝুঁকি সামলে করে উঠতে পারি অনায়াসে। আর সাকসেস, সেটাতো বলবেন আপনারা, বিবির বসন যদি এতোটুকু পরিচিতি পেয়ে থাকেন তাহলে সেটাই আমার সাকসেস যার এক এবং একমাত্র মঞ্চ হলো এই পরিবার। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সম্পর্কের ইতি টানতে চাই না বরং আজীবন কাজময় ভালোবাসায় আবদ্ধ থেকে বলতে চাই, বাবার রাজকণ্যারা কখনও হারতে পারে না।
আমি গর্বিত আমি নারী, আমার মহিমায় ছুটে চলে বলি - "আমরা নারী, এগিয়ে যেতে আমরাই পারি", সততার আহ্বানে সফলতাকে নিমন্ত্রণ পত্র পাঠাতে পারি, সময় আজ আমাদের, তাই জয় আমাদের সুনিশ্চিত। বিশ্ব অবাক হয়ে দেখবে বঙ্গললনার মমতাময়ী স্পর্শও এনে দিতে পারে নারীর ক্ষমতায়ন এবং অর্থনৈতিক মুক্তি।
আর ওবেলায় বাবা আমার অপেক্ষায় আছেন আমার শৈশবকে সাথে নিয়ে, আমি বাবার রাজকণ্যা চলছি দুই রাজকুমার আর এক রাজকুমারী বিবির বসনকে সাথে নিয়ে।
এটা কোন গল্প নয় এটা আমার জীবন নামক রেলগাড়ীর কু ঝিক্-ঝিক্ আওয়াজ।
শুকরিয়া মহান সৃষ্টিকর্তার নিকট, স্বাধীনতার সুখ উপহার দেয়ার জন্য।
স্ট্যাটাস অফ দ্যা ডে -৭৬২
তারিখ- ১০/০৩/২০২২
আতিয়া সিদ্দীকা
ফ্যাশন ডিজাইনার এবং আবৃত্তিকার
কাজ করছি জামদানী দেশীয় কাপড়ের ফিউশন প্রোডাক্ট
এবং "কন্ঠশীলন" আবৃত্তি সংগঠনের নিয়মিত সদস্য হিসেবে ঢাকার ওয়ারী এলাকা থেকে।
ব্যাচঃ১১
রেজিস্ট্রেশন নাম্বারঃ৫২৬০৭