প্রায় ৩৩ বছরের কর্মচঞ্চল জীবনে হটাৎ ই নেমে আসে স্থবিরতা
🌿জীবনের গল্প 🌿জীবনের গল্প🌿
🌹বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম🌹
🌹আচ্ছালামুআলাইকুম '' নিজের বলার মতো একটা গল্প'' ফাউন্ডেশনের প্রিয় ভাই ও বোনেরা।
🌹🌹শুকরিয়া অসীম করুনাময় দয়ালু দাতা আল্লাহ সুবহানু তাআলার প্রতি যিনি আমাকে দয়া করে আখেরী নবীর উম্মত ও আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে এই সুন্দর পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। না চাইতেই যিনি আমাকে দান করেছেন অপরিমিত রিজিক এবং সুন্দর এই জীবন । এই নীলাভ গোলকের চন্দ্র, সূর্য, পাহাড়, নদী, ঝর্না, সমুদ্র, বিশাল বালুকা বেলার অপরুপ সৌন্দর্য্য অবলোকনের জন্য দিয়েছেন দৃষ্টি, অনুভব করার মতো একটি অনুভুতি এবং ভালবাসা দেয়া নেয়ার মত একটি হৃদয়। সর্বোপরি দান করেছেন দরদী পিতামাতার মত নিয়ামত, ভাইবোন, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব, স্বামী ও সন্তান।🌹🌹
🌹দরুদ ও সালাম প্রিয় নবী করীম হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সঃ) এর প্রতি, যাঁর সৃষ্টি না হলে এই আসমান জমিন সৃষ্টি হতোনা, সৃষ্টি হতোনা মানবকুলের। 🌹
🌹কৃতজ্ঞতা ও ভালবাসা আমার মা, বাবা, ভাই বোন ও সতীর্থদের প্রতি যারা আমাকে সর্বক্ষণ দিয়েছেন ভালবাসা ও সমর্থন । 🌹
🌹কৃতজ্ঞতা প্রিয় মেন্টর ও শিক্ষক জনাব ইকবাল বাহার জাহিদ স্যারের প্রতি যিনি এমন একটি প্লাটফর্মে বিনা পয়সায় টানা ৯০ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং ঊদ্যোক্তা হওয়ার মনের গোপন বাসনা জাগিয়ে তুলেছেন। কৃতজ্ঞতা মিরপুর জোন এম্বাসেডার জেসমিন আক্তার জুঁই আপু যিনি সর্বক্ষণ আমাকে উৎসাহ দিচ্ছেন। কৃতজ্ঞতা সাথী আক্তার আপু, সাথী আইআর আপু, নার্গিস নাহার আপু, মিরপুর মডেল জোন এবং প্রিয় ফাউন্ডেশন এর সকল ভাইবোনের প্রতি।
🌹🌹আমার জীবনের গল্প 🌹🌹
আমার জীবনের গল্প বলতে গেলে বলতে হবে একজন বিধবা নারী ও ফিনিক্স পাখির মত একজোড়া মানব মানবীর কথা। রূপকথার গল্পে জানা যায় ফিনিক্স পাখিকে আগুনে পোড়ালে ছাই থেকে আবারো জন্ম হতো তার। তেমনি কাহিনী এই দুজন মানব মানবীর। তারা আর কেউ নন আমার বাবা মা।
🌹কেন তাদেরকে ফিনিক্স বলছি 🌹
আমার বাবার বয়স যখন মাত্র ১৮ মাস আমার দাদী তখন ১০ মাসের গর্ভবতী। দাদা দিয়ানত আলী বলতেন ১০ মাস পার হয়ে গেল এখনও বাচ্চা হচ্ছে না, জিন্নাতুন তুমি মনে হয় বাঁচবেনা। একদিন দাদা গঞ্জের হাটে গেলেন ব্যবসায়ের মালামাল কিনতে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা তারপর রাত পেরিয়ে সকাল। দাদা ফিরলেন না। পরদিন দুপুরে গঞ্জের হাট থেকে জলজ্যান্ত দিয়ানত আলীর পরিবর্তে ফিরে এলো তার লাশ। এতিম হলেন শিশু আব্দুল বারী, তার বড় তিন বোন, এবং বিবধা হলেন দিয়ানত আলীর স্ত্রী জিন্নাতুন নেছা। স্বামীর লাশের উপর আছড়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন সদ্য বিধবা জিন্নাতুন নেছা। অজ্ঞান অবস্থাতেই জন্ম হলো আমার ছোট ফুফুর।
এরপর - - শুরু হলো দিয়ানত আলীর বিধবার জীবন সংগ্রাম। একে একে কড নেওয়া জমির মালিকরা এসে বললো মেয়াদ শেষ জমি ফিরিয়ে দাও, ব্যবসা চালাতে যাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সে মাসের পর মাস দেখাতে থাকলো লোকসান। বছর শেষ না হতেই ধনাড্য দিয়ানত আলীর ব্যবসা শেষ, ধানের গোলা শুন্য। চরম দারিদ্র ঘিরে ধরলো আমার দাদার বিধবা এবং তার সন্তানদেরকে।
কিন্তু দমে যান নাই ৩০ বছরের অপূর্ব সুন্দরী দিয়ানত আলীর বিধবা স্ত্রী জিন্নাতুন নেছা। বাড়ীতে ছোট্ট মনোহারী দোকান, চরকায় সুতা কাটা আরো কত কাজ। আমার বাবা আব্দুল বারী গ্রামের মক্তবে ভর্তি হলেন। অত্যন্ত মেধাবী অল্প দিনেই আলেম পাস করলেন। পাশাপাশি গ্রামের হাটে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে ব্যবসা করতেন। এমনকি একসময় তাঁতে গামছা, লুঙ্গি বুনতেন। দাদী বলতেন তাঁতের গূদিতে আমার বাবার পা ঠেকতোনা ভালো ভাবে। তারপরেও দমে যান নাই আব্দুল বারী মুন্সি। এত কষ্টের মধ্যেও অনর্গল কোরান অর্থ সহ বলতে পারতেন। আরবী ও ফার্সিতে তার দখল ছিল উল্লেখযোগ্য। আমার শিশু আর কৈশোরের প্রতিটি ভোর এই অসাধারণ মানুষটির কোরান তেলায়ত আর আরবী ফার্সি কবিতা /গজল শুনে কেটেছে। তবে এটাই তার ইতিহাস নয়। তিনি ছিলেন সুপার একটিভ, একজন সফল ব্যবসায়ী, একজন একনিষ্ঠ উদ্যোক্তা । তিনি যেদিকে মনোযোগ দিতেন সেদিকেই সোনা ফলতো। কাঁটা গাছ জন্মানো ফুটা বালির জমিতে ধান পাট আর গম ফলিয়েছেন জিরো থেকে হিরো হওয়া আব্দুল বারী মুন্সী, আমার প্রিয় বাবা, আমার প্রথম ভালবাসা, আমার চোখে বিশ্বের সেরা হিরো।
আর একজন মানবীর কথা বলেছিলাম, অনিন্দ্য সুন্দরী, বিশাল ব্যবসা এবং শত বিঘা জমির মালিকের আদুরে কন্যা ১৪ বছর বয়সী জোহরা বেগমের সাথে পরিনয়ে
আবদ্ধ হন ২৫ বছরের আব্দুল বারী মুন্সী। তখন তার রমরমা ব্যবসা। চার সন্তানের জন্মের পর ৫ম সন্তান পেটে হটাৎ একদিন সাজানো গোছানো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বসত বাড়ী আগুনে পুড়ে ছাই। ঘর পোড়া আলু নাকি ৭ দিন কুড়িয়েছে গ্রামবাসী। আবারো নিঃস্ব হলেন সংগ্রামী এই দম্পতি। তার পরেও ভেঙে পড়েননি তারা। আবারো শুরু করেছেন নব উদ্যমে। আমার মা ছিলেন বিদ্যানুরাগী। নিজে উচ্চ শিক্ষা নিতে না পারলেও আট সন্তানের শিক্ষার উদ্যোগী ছিলেন তিনি। অসম্ভব প্রতিভাময়ী আমার মা সংসারের সকল কাজ শেষে নিজ হাতে সেলাই করতেন নকশী কাঁথা। তার ছিল গল্প, উপন্যাসের নেশা। বৈকালিক অবসরে নঁকশী কাঁথা সেলাই এর মাঝে কত যে গল্প, কবিতা পড়ে শোনাতাম। জসীম উদ্দীন এর কবর কবিতা আর নকশী কাঁথার মাঠ ছিল তার সব চাইতে প্রিয়। প্রতি রাতে রূপকথার গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াতেন আমাদের। ডালিম কুমার, আয়নামতী, সুঁচ রাজা, বেদের মেয়ে মহুয়া সুন্দরী আর পবন কুমারের গল্প শুনতে শুনতে রূপকথার রাজ্যে হারিয়ে যেতাম। সন্তানদের পড়ালেখা নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন তিনি। ছেলে মেয়েরা ডাক্তার হবে, ইন্জ্ঞিনিয়ার হবে, বিদেশে যাবে। আমার মায়ের স্বপ্ন বিফল হয়নি। তার ৮ টি সন্তান যোগ্য হয়েছে। স্কুলের শিক্ষক, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, ব্যাংকের উচ্চ পদস্থ নির্বাহী, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর জেনারেল ম্যানেজার, ডাক্তার, কলেজের প্রফেসর। প্রত্যন্ত গ্রামে মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকলেও আমার মা আর ভাইয়ের আপ্রান চেষ্টায় গ্রামের ছেলেদের স্কুলে আমিসহ আমার ৮ জন সহপাঠী মেয়ে প্রথম ভর্তি হই। তারপর একে একে কলেজ, ইউনিভার্সিটি, সে অনেক লম্বা কাহিনী। শিক্ষাজীবন শেষে যোগদান করি দেশের বৃহত্তম বানিজ্যিক ব্যাংক - জনতা ব্যাংক লিমিটেডে । প্রানপ্রিয় জনতা ব্যাংকে প্রায় ৩৩ বছরের জার্নিতে কর্মনিষ্ঠা ও সফলতার সাথে প্রায় সকল বিভাগে দায়িত্ব পালন করেছি। শেষের ১০ টি বছর ছিল কর্মজীবনের সবচেয়ে সফল অধ্যায়। এসময়ে ৭ টি দেশে ডেস্ক রিলেটেড প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন কর্মশালায় যোগদান করেছি। দেশের বিভিন্ন জেলা এবং প্রত্যন্ত এলাকায় প্রতিষ্ঠিত ৯১৪টি শাখার মধ্যে প্রায় শতাধিক শাখায় পরিদর্শনে গেছি। ২০২১ সনের জুলাইতে অবসরে যাই। ব্যক্তি জীবনে আমি বিবাহিতা। স্বামী বিসিএসআইআর এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন। আমি দুই সন্তানের গর্বিত মা। ছেলে ও ছেলের বৌ ডাক্তার, মেয়ে সিভিল এন্ড এনভায়োরমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং থার্ড ইয়ার ।
🌹কেন আমি উদ্যোক্তা হতে চাই? 🌹
প্রায় ৩৩ বছরের কর্মচঞ্চল জীবনে হটাৎ ই নেমে আসে স্থবিরতা। মেনে নিতে কষ্ট হয় শুধু শুয়ে বসে সময় কাটাবো। সকাল হলেই অস্থিরতায় ভুগতে থাকি । গভীর ডিপ্রেশনে চলে যাই। কোভিড কালীন সময়ে শখের বশে ফেসবুকে Novera's Dream নামে একটি পেজ খুলি। দুয়েকটা ড্রেসের পোস্ট ও দেই। উইতে রেজিষ্ট্রেশন করি। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে '' নিজের বলার মতো একটা গল্প'' ফাউন্ডেশনের সদস্য দক্ষিণ কোরিয়া নিবাসি মিজানুর রহমান ভাইয়ের মাধ্যমে প্রিয় ফাউন্ডেশনে ১৭ তম ব্যাচে রেজিষ্ট্রেশন করি। মিরপুর মডেল জোনে ১৭ তম ব্যাচের ১১ তম দিন থেকে নিয়মিতভাবে সেশনে যোগদান করছি । প্রিয় মেন্টর ইকবাল বাহার জাহিদ স্যারের প্রোনোদনা ও মোটিভেশনাল সেশনগুলো হতে অবসর জীবনটাকে নতুন উদ্যমে নতুন কিছু করার জন্য অনুপ্রাণিত হচ্ছি। জীবনের অবশিষ্ট সময়ের প্রতিটি সময়কে কাজে লাগানো, পরিবার, সমাজ ও দেশকে আরো কিছু দেওয়া এবং নিজের বুকে ও মানুষের মাঝে একজন ভালো মানুষ এর তকমা শুধু নয়, একজন প্রকৃত ভালো মানুষ হিসেবে এবং একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবো ইনশাআল্লাহ।
আমার শিশু, কৈশোর কেটেছে কিছু সফল উদ্যোক্তার জীবন সংগ্রাম দেখে দেখে। তাদের থেকেই উদ্যোক্তা হওয়ার বাসনা শুরু। তবে নিজের বলার মতো একটা গল্প ফাউন্ডেশন এর প্রতিষ্ঠাতা প্রিয় মেন্টর ইকবাল বাহার জাহিদ স্যারের ৯০ দিনের সেশনের ৬১ তম সেশন হতে আমি আরো বেশি দৃড়প্রতিজ্ঞ হচ্ছি নিজেকে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে । হাতের কাজের হাতে খড়ি মায়ের কাছে। এ কাজের প্রতি ভালবাসা ছোটবেলা থেকেই। কাপড়ে সুঁইসুতার আঁচরে নিখুঁত ভাবে স্বপ্ন ফুটিয়ে তুলতাম। নকশী কাঁথা, টেবিল ক্লথ, ক্রুশের কাজ, উলের সোয়েটার কতকিছু করেছি শখের বশে । চাকুরিকালীন সময়ে বিরতি ছিল। এখন অখন্ড অবসর। ফিরে যেতে চাই আগের দিনগুলোতে। আমি বিশ্বাস করি অবসর মানে এককাজ থেকে অন্য কাজে যোগ দেয়া। স্বপ্ন একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সাথে সাথে সুবিধা বঞ্চিত নারীদের কর্মসংস্থান এর সুযোগ তৈরী করা। কাজ শুরু করেছি। নিজের এলাকা সিরাজগঞ্জ এর হাট পাঙ্গাশী গ্রামের কিছু মেয়েকে সংগবদ্ধ করছি, কাজ শিখাচ্ছি।এছাড়াও আমার হাউজ কিপার যে একটা জামার বোতাম ও লাগাতে পারতোনা, সে এখন সুন্দর হাতের কাজ করছে। ওর ড্রেসটা পোস্ট করবো খুব শীঘ্রই। জীবনে অন্তত একজন মানুষের ভাগ্য বদলের সাথী হতে চাই, স্বপ্ন ছুঁতে চাই ।
আমি আলতাফুন্নেছা ডিজিএম (পিআরএল ), জনতা ব্যাংক লিমিটেড,
বর্তমানে মিরপুর ঢাকা থেকে কাজ করছি হাতে সুঁইসুতোর এমব্রয়ডারী, ব্লক, ব্লকে কাঁথা স্টিচ, এপ্লিক এর কাজ করা ওয়ান পিস, টুপিস, থ্রিপিস, শাড়ী, বিছানার চাদর নিয়ে। এছাড়াও সিরাজগঞ্জের বিখ্যাত লুঙ্গি, গামছা, টাঙ্গাইল ও শাহজাদপুরের শাড়ী এবং নকশী কাঁথাও রয়েছে আমার পণ্য তালিকায়।
কঠোর পরিশ্রম করছি, লেগে আছি, লেগে থাকবো ইনশাআল্লাহ ।
সবাই আমার পাশে থাকুন প্লিজ ।
প্রিয় ফাউন্ডেশন এর সকল ভাইবোনকে অনুরোধ করছি পোস্টটি মনোযোগ দিয়ে পড়তে এবং লাইক ও কমেন্ট করার জন্য।
স্ট্যাটাস অফ দ্যা ডে -৭৭৫
তারিখ - ৩০/০৩/২০২২
ধন্যবাদ।
আলতাফুন্নেছা
ব্যাচ নং-১৭
রেজিষ্ট্রেশন নং- ৮২৯৬২
ওনার 'Novera's Dream'.