সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না সবকিছু মিলিয়েই জীবন।
স্মৃতিঘেরা জীবনের স্মৃতিময় গল্পঃ
লেখাটি যখন শুরু করছি তখন হিমেল হাওয়া শরীরকে চমৎকারভাবে স্পর্শ করছে। সাঁ-সাঁ শব্দে বাতাস বইছে। মাথায় উপরে সাদা মেঘের সাথে চাঁদের লুকোচুরি খেলা চলছে। অবশ্য কিছু সময় পূর্বে বেশ কিছু তাঁরার দেখা পেলেও লুকোচুরি খেলার কারণে এখন সেগুলোর কয়েকটি মাত্র চোখে পড়ছে। তবে বিদঘুটে অন্ধকার না হওয়ায় জ্যোৎসনার আলোতে বাড়ির চারিপাশের গাছের ডালগুলোর চমৎকার দোল খাওয়ার দৃশ্যগুলো বেশ চোঁখে পড়ছে। মাঝে মাঝে বাড়ির ভেতর থেকে টিকটিকির টিক টিক আওয়াজও শুনতে পাচ্ছি। এখন বৈশাখ মাস, অবশ্য বর্ষাকাল না হলেও বাড়ির পেছন থেকে একটা ব্যাঙের ঘ্যাঁ ঘ্যাঁ আওয়াজও শুনতে পেলাম। অবশ্য চারিদিকে নীরব নিস্তব্ধ একটা পরিবেশ বিরাজ করছে। যেহেতু রমজান মাস, সারাদিন সিয়াম পালন করে ক্লান্ত শরীরে বেশিরভাগই হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। আর আমি উঠানে বসে চমৎকার এই পরিবেশটা উপভোগ করছি এবং জীবনের কিছু স্মৃতিময় গল্প লিখতে বসেছি।
অবশ্য এর আগে জীবনের গল্প নিয়ে অতটা কখনও ভাবাও হয়নি। 'নিজের বলার মতো একটি গল্প' ফাউন্ডেশনের বদলৌতে নিজেকে নিয়ে ভাবা এবং লেখার সেই আগ্রহটা পেলাম। ক্ষণস্থায়ী এই জীবনে একদিকে যেমন আনন্দ, হাঁসি-খুশি ও সুন্দর কিছু মূহুর্তের সাথে সাক্ষাৎ হয় ঠিক তেমনই দুঃখ, যন্ত্রণা বা হতাশারও দেখা পাওয়া যায়। অবশ্য দুঃখ আছে বলেই সুখ এতো মূল্যবান। যেমনটা আঁধার আছে বলেই আলো আমাদের কাছে অনেক মূল্যবান।
যাইহোক, কবির ভাষায় বলতে হয়-
"ছোট্ট হলেও গ্রামটি মোদের
সকল গ্রামের সেরা।
সোনা দিয়ে তৈরি এ গ্রাম
মায়া মমতায় ঘেরা।"
ঠিক তাই যান্ত্রিক শহরের বিপরীতে অজপাড়াগাঁ যেটাকে বলা চলে, ঠিক সেরকমই একটি গ্রামে আমার জন্ম। সে সময়ে বেশিরভাগ মানুষ পায়ে হেঁটে অন্যত্র যোগাযোগ করতো। প্রযুক্তির বদৌলতে বর্তমানে সবকিছু হাতের নাগালে পেলেও সে সময়ে এরকমটা ছিলো অনেকটা কল্পনার মতো। সে সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ও বাংলাদেশ - এর খুলনা বিভাগেের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে ঘটে যায় এক ভয়াবহ বন্যা।
বলছি ২০০০ সালের কথা। ঠিক সেই বছরের ২৯ - এ মার্চ আমার নানা বাড়িতে আমি জন্মগ্রহণ করি। গ্রামের নাম নীলকন্ঠপুর। অবশ্য আমার নিজ গ্রামের বসন্তপুর। গ্রাম থেকে কয়েকটা গ্রাম পেরোলেই আমার নানা বাড়ি। আমার গ্রামের নাম নিয়ে আমার মনে মাঝে মধ্যে প্রশ্ন জন্ম নেয়। গ্রামে কি বসন্ত রোগী বেশি ছিলো নাকি! কি অদ্ভুত একটা নাম। অবশ্য কারণটি এখনও আমার অজানাই রয়ে গেলো। যাক সে কথা আমার জন্মের পর আমার দাদা বেশ খুশি হয়েছিলো। তার মেঝ ছেলের একমাত্র সন্তান আমি। তখন আমি আমার চাচাতো ভাই-বোনদের তুলনায় বয়সে সবচেয়ে কনিষ্ঠ। অবশ্য বর্তমানে আরও দুইটা চাচাতো বোন রয়েছে। চাচাতো ভাই-বোন মিলে বর্তমানে আমরা মোট ৫ জন। তবে আমি আমার বাবার একমাত্র সন্তান।
জন্মের পর শারীরিকভাবে আমি খুবই অসুস্থ ছিলাম। আজকে এ ডাক্তার তো কালকে আরেক ডাক্তার! শ্বাসকষ্টের সমস্যাটা বেশ মারাত্মকভাবে দেখা দিয়েছিল। মাঝে মাঝে নাকি অসুস্থতার কারণে আমার চোখ উল্টে যাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হতো। মা-বাবার কাছ থেকে মাঝেমধ্যে শুনি রাতেও ঠিকভাবে ঘুমাতে পারতাম না। সেই সাথে মা-বাবাকেও ঘুমাতে দিতাম না। ঘুমাবেই বা কি করে, সারারাত দোলনায় দোল দেয়া লাগতো। যখনই দোল দেয়া বন্ধ করে ঘুমাবে তখনই আমি আবার জেগে কান্না শুরু করবো। এই অসুস্থতার দরুণ অনেক টাকা আমার পেছনে ব্যয় হয়ে যায়। মাঝে মাঝে এমন অবস্থা তৈরি হতো যে অনেকেই মনে করতো, হয়তো আমাকে আর বাঁচানো সম্ভব হবে না। কান্নার রোল পড়ে যেতো মাঝে মধ্যে। কিন্তু কথায় আছে রাখে আল্লাহ মারে কে! তা-ই হলো আল্লাহর অশেষ কৃপায় বয়স বাড়ার সাথে সাথে সুস্থ হতে লাগলাম। এভাবেই চলছিলো আমার কয়েক বছরের সেই ছোট্ট জীবনটা।
সেই সময় ১৯ এ রমজান রাতে এরই মধ্যে আমার দাদা মৃত্যুবরণ করে। পরিবারের অনেকেই বলে আমার নাকি দাদার স্মৃতি মনে থাকার কথা না। তবে সেই সময়ের কিছু কিছু স্মৃতি আমি এখনও মনে করতে পারি। সম্ভবত একদিন বারান্দায় বসে ছিলো সেইটা যেনো আমি এখনও আঁচ করতে পারি। তাছাড়া একজোড়া লাল জুতা আমাকে কিনে দিয়েছিলো। হাঁটলে পিঁক পিঁক আওয়াজ হতো সেটা আমার স্পষ্টই মনে পড়ে। পরিবারের অনেকের মুখে শুনেছি দাদার মৃত্যুর পর আমি দাদার কবরের উপর চলে যেতাম এবং বলতাম আমার দাদা এখানে ঘুমিয়ে আছে। বরবার নাকি সেখানে চলে যেতাম। হয়তো দাদাকে আমি খুব ভালোবাসতাম সে কারণেই তার কবরের কাছে বারবার ছুটে যেতাম। মা-বাবার মুখে শুনেছি আমি কান্না করলে আমার মাকে দাদা ধমক দিয়ে বলতো এতো কাজ কিসের! অবশ্য আমার মা সংসারের দিকে অনেক খেয়াল রাখে। আমার দাদা আমাকে অনেক ভালোবাসতো। মাঝে মাঝে আমি নাকি তার দাঁড়ি ধরেও টান মারতাম। দাদা বলতো দাদুভাই আর টান দিও না।
হয়তো ভালোবাসার জিনিসগুলো বেশিদিন স্থায়ী হয় না। তাই হয়তো অল্প বয়সেই দাদাকে হারিয়ে ফেললাম। বঞ্চিত হলাম দাদার সেই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা থেকে। আশেপাাশের বয়স্ক মানুষের কাছ থেকে মাঝে মধ্যে দাদার বেশ প্রশংসা শুনতে পাই। ভালো মনের একজন মানুষ ছিলেন। যাক সে কথা।
আমার গ্রাম সহ প্রায় সবখানেই আমি সোহাগ নামেই পরিচিত। তবে নানা বাড়িতে এবং নানা বাড়ির আত্মীয়-স্বজন আমাকে অন্য একটি নামে ডাকে। হয়তো ছোটোবেলায় খুব শান্ত স্বভাবের ছিলাম! তাই হয়তো আমার নানা নামটা দিয়েছিলো শান্ত। আবার, শান্ত কেনো মাস্তান কথাটা এখন না শুনলেও অল্প বয়সে সেখানে অনেকের কাছেই শুনেছি। আমার দাদা বলতো সোহাগ বড় হয়ে ডাক্তার হবে। কথাটা নানা বাড়িতে ছড়ানোর পর এক মামা-তো আমাকে ডাক্তারই বানিয়ে দিলো। তবে এটা এমবিবিএস বা হাতুড়ি কোনো ডাক্তার না। নাম দিলো মুরগির ডাক্তার! পেয়ে গেলাম অল্প বয়েসে ডাক্তারি খেতাব।
যাই হোক, আমার নামটা নিয়ে একটু কথা বলি। সোহাগ নামটা দিয়েছিলো আমার ছোট-চাচা। জীবিকার তাগিদে দেশের অন্য এক অঞ্চলে গিয়েছিলো কয়েকদিনের জন্য। সেখানে কোনো এক জনের নাম ছিলো সোহাগ। নামটা সম্ভবত তার মনে ধরেছিলো তারই পরিপ্রেক্ষিতে শখ করে নাম রাখলো সোহাগ। পরবর্তীতে আমরা গাজী গোত্রের সদস্য হওয়ার আমার বাবা নামের আগে যুক্ত করলেন জি.এম., তারপর যুক্ত হলো মাহমুদুল হাসান। নাম হয়ে গেলো জি.এম. মাহমুদুল হাসান সোহাগ। পরবর্তীতে বড় নাম নিয়ে যেনো কোনো ঝামেলায় পড়তে না হয় সেজন্য আমার সচেতন বাবা শুধুমাত্র সোহাগ হাসান নামটিই বহাল রেখেছিলেন। যাক সে কথা ধীরে ধীরে বয়স বাড়তে থাকলো। এবার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের পালা। তবে আমার লেখাপড়ার হাতেখড়ি আমার বাবার হাত থেকেই। হাতের লেখা কেমন হওয়া দরকার, কোথায় কিভাবে লিখতে হবে, বা কিভাবে পড়তে হবে সবকিছুই আমার বাবার কাছ থেকেই শিখেছি এবং তারই কৃতিত্ব বেশি।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনে প্রথমেই ভর্তি হলাম ব্র্যাক স্কুলে। যেখানে সাধারণত প্রথম শ্রেণির আগে পড়ানো হয়। আমার এখনো মনে আছে প্রতিষ্ঠানটি তখন মাটির ঘরে নির্মিত ছিলো এবং গ্রামের একজন ম্যাম সেখানে পড়াতো। খুব অল্প বয়সে সেখান থেকেই পড়াশোনার যাত্রা শুরু হয়।
প্রাথমিক শিক্ষা জীবনঃ—
প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনে ১ম শ্রেণিতে ভর্তি হলাম গ্রামের স্কুল বসন্তপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এদিকে বাড়িতে নিয়মিত গাইড করতে থাকলেন আমার বাবা। নতুন নতুন বিষয় তিনি আমাকে তখন থেকেই শেখাচ্ছেন এবং এখনো পর্যন্ত। এভাবেই পড়াশোনা ভালোভাবেই চালাতে থাকলাম। ফলস্বরূপ প্রথম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় ১ম স্থান অর্জন করে চারিদিকে বেশ আলোচনা সৃষ্টি করলাম। সবাই একটু অন্যভাবে দেখা শুরু করলো। ধীরে ধীরে আমার আত্নবিশ্বাসটাও বাড়তে থাকলো। এভাবে দ্বিতীয় শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় ১ম স্থান, তৃতীয় শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় ১ম স্থান এভাবে করে চতুর্থ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায়ও ১ম স্থান অর্জন করে পঞ্চম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলাম। ততোদিনে মেধাবী এবং ভালো ছাত্র হিসেবে আত্নীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি সহ গ্রামবাসীর কাছে বেশ সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হলাম। পরবর্তীতে বাবা এবং আমার ইচ্ছায় পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষা না দিয়ে ১ বছর গ্যাপ দিয়ে পুনরায় পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া শুরু করি। পরীক্ষার প্রস্তুতি যে খারাপ ছিলো তা কিন্তু নয়! যেহেতু ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হলে গ্রাম পেরিয়ে অন্য এলাকার স্কুলে ভর্তি হতে হবে এবং তখন বয়সটাও অল্প তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ২ বছর পড়াশোনা করি। ফলাফল আলহামদুলিল্লাহ PSC তে রেজাল্ট আসলো গোল্ডেন (A+)। এবার সুনামটা আরও ছড়িয়ে পড়লো তখনও বৃত্তির খবরটা জানা যায়নি। কারণ রেজাল্ট পর্যালোচনা করে কয়েকমাস সময় নিয়ে বৃত্তির রেজাল্ট ঘোষণা করা হয়। আলহামদুলিল্লাহ বৃত্তি পাওয়ার সৌভাগ্যটাও আমার হলো। মাধ্যমিকে ভর্তির প্রথম দিকে কামরুল নামের এক স্যার আমাকে সংবাদ পাঠালো যে আমি বৃত্তি পেয়েছি। তখনকার সেই অনুভূতিটা আমি আসলে বলে বোঝাতে পারবো না তবে আমি ছিলাম মহা খুশি!
অপরিপক্ক বয়স থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত স্কুল আমাদের জীবনে সর্বাধিক গুরুত্ব বহন করে থাকে। সেই শেষ দিনের বিদায় বেলায় সব অনুভুতিগুলো যেন সব বর্ণহীন হয়ে যেতে থাকে। মনে পড়ে যায় পুরনো সেই সময়গুলোকে এবং বন্ধুদের সাথে কাটানো সেই মূহুর্তগুলোকে। বন্ধুদের সাথে ঝগড়া, খুনসুটি, টিফিন ভাগ করে খাওয়া, লুকিয়ে বন্ধুর টিফিন খেয়ে ফেলা, শিক্ষকের সেই মায়াভরা বকুনি আরও কত্ত রকম। ছেলেবেলার সেই দিনগুলো আর কখনও ফিরে আসবে না। তবে পুরনো সেই ছেলেবেলার স্মৃতিগুলোকে আঁকড়ে ধরে মূহুর্তগুলোকে সজীব করে তুলতে চাই।
মাধ্যমিক শিক্ষা জীবনঃ—
গ্রাম থেকে মাত্র কয়েক গ্রাম পেরোলেই স্কুল। ভর্তি হলাম সাতক্ষীরা জেলাধীন কলারোয়া উপজেলার বামনখালি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। মোট মিলিয়ে সম্ভবত প্রায় ১২০ জনের উপরে আশেপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে ছাত্র ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হলাম। ইতিমধ্যে আমি যেদিন ভর্তি হতে গেলাম তার পূর্বেই বেশ কয়েকজন ভর্তি হয়ে গেছে। তবে স্কুল কর্তৃপক্ষ উপরের দিকে বেশ কয়েকটি রোলের পাশে খালি রেখেছে। অবশ্য তখন ভর্তি পরীক্ষা নেয়নি। যাইহোক বাবা রাশেদুল স্যারকে অনুরোধ করলেন ভর্তি রোল প্রথমদিকে করা যায় কিনা। অবশেষে আমার ভর্তি রোল দেয়া হলো ৫। এরপর ক্লাস শুরু হলো নিয়মিত ক্লাস করতে থাকলাম। অবশ্য বেশিরভাগই তখন কেউ কাউকে চিনি না একদমই নতুন মুখ। সবার সাথে সবাই ধীরে ধীরে পরিচিত হতে লাগলাম এবং বন্ধুত্ব তৈরি করতে লাগলাম। নতুন স্কুল, নতুন ছাত্রছাত্রী। শ্রদ্ধেয় স্যারেরা এসে প্রথমদিকে আমাদের পরিচয় নিতেন। নাম, ঠিকানা ইত্যাদি প্রথমদিকে স্যারেরা জিজ্ঞেস করতেন। সবাই সবার পরিচয় দিতাম। স্যারও নিজের পরিচয় সবাইকে উদ্দেশ্য করে জানাতেন। তারপর প্রশ্ন করতেন আমাদের মধ্যে কে কে A+ পেয়েছি। সংখ্যাটা ঠিক মনে নেই তবে সবমিলিয়ে আমরা প্রায় ৮ থেকে ১০ জনের মতো এই ফলাফল করেছিলাম। তবে এর মধ্যে মাত্র কয়েকজন আমরা বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী ছিলাম। স্যার যখন এসব প্রশ্ন করতো সত্যি অনেক বেশি ভালো লাগতো। অবশ্য ভালো ছাত্র হিসেবে পরিচিতি সেই সময়েই বাড়তে থাকলো। যাইহোক, নিয়মিত স্কুলে যাওয়া, ক্লাস করা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া সবকিছুই চলছিলো। অবশেষে বার্ষিক পরীক্ষা চলে এলো। মাধ্যমিক জীবনে ষষ্ঠ শ্রেণির প্রথম বার্ষিক পরীক্ষা। খুব ভালোভাবেই স্যারের দেয়া সাজেশানগুলো অনুসরণ করে পড়তে থাকলাম এবং পরীক্ষা দিলাম। তবে এবার ঘটলো ভিন্ন মাত্র কয়েক নাম্বারের জন্য ১ম স্থান অর্জন করতে ব্যর্থ হলাম। ২য় হয়ে সপ্তম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলাম। এরপর আমাদের ১ম, ২য় ও ৩য় স্থান অর্জনকারীকে আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কৃতও করা হলো। অবশ্য তখন আমার একটু মন খারাপ। যেহেতু মাত্র কয়েক নাম্বারের জন্য রেজাল্টটা ১ম হওয়াটা হাতছাড়া হয়ে গেলো। এদিকে পরিবার, স্কুলের শিক্ষক সবাই আমাকে শান্তনা দিতে লাগলেন সেই সাথে আগামীবার ১ম হওয়াটা সবাই দেখতে চান। সবার প্রত্যাশা এবার আগের তুলনায় আরও যেনো ভালো পড়াশোনা করি। বিভিন্নভাবে সবাই সাপোর্ট দিতে লাগলো। সবার ভালোবাসা এবং সাপোর্ট পেয়ে আত্নবিশ্বাসটা যেন তীব্র হতে শুরু করলো। এবার একটু নড়েচড়ে বসলাম। পড়াশোনায় আগের তুলনায় মনোযোগ বাড়াতে থাকলাম। নিয়মিত পড়াশোনা এবং ক্লাসে স্যারের কোনো টপিক বুঝতে অসুবিধা হলে স্যারকে তাৎক্ষণিক প্রশ্ন করা এবং সেটাকে নোট করা এভাবেই পড়াশোনা চালাতে থাকলাম। অবশেষে সপ্তম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা দিলাম এবং সবাইকে তাক লাগিয়ে বেশ ভালো নাম্বারের ব্যবধানে ১ম স্থান অর্জন করে অষ্টম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলাম। আমি তো মহাখুশি! স্যারকে ফলো করা এবং নিয়মমেনে পড়াশোনা করার ফলেই আলহামদুলিল্লাহ এটি সম্ভব হয়েছিলো।
এরপর আসলো জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (JSC) পরীক্ষা। কলারোয়া উপজেলাধীন কলারোয়া গার্লস পাইলট হাইস্কুলে আমাদের পরীক্ষার কেন্দ্র হিসেবে নির্ধারিত হলো। পরীক্ষা দিলাম রেজাল্টও আলহামদুলিল্লাহ গোল্ডেন A+। স্কুল থেকে আমরা মোট দুই জন গোল্ডেন A+ অর্জন করি। বাকী কয়েকজন বন্ধু এবং বান্ধবী কৃতিত্বের সহিত আলহামদুলিল্লাহ A+ অর্জন করে। এরই মধ্যে সবার মাঝেই সাড়া ফেলে দিলাম। শুধু স্কুল নয় গ্রাম, আত্নীয়-স্বজন সবাই বাহবা দিতে থাকলো। সেই সময়গুলো এখন অনেক বেশিই মনে পড়ছে।
এবার সেকেন্ডারী স্কুল সার্টিফিকেট (SSC) পরীক্ষার পালা। বাবা এবং আমি দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত করলাম স্কুল পরিবর্তন করে অন্য স্কুলে ভর্তি হবো। পার্শ্ববর্তী আরেকটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় 'ধানদিয়া ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশান' - এ ভর্তি হলাম। নতুন পরিবেশ নতুন সব মুখ সবকিছু যেনো অন্যরকম লাগা শুরু হলো। মোটেও ভালো লাগছিলো না। এদিকে পুরনো সব বন্ধু এবং শিক্ষক সহ সবাইকে খুবই মিস করতে থাকলাম। বেশ কয়েকদিন ক্লাসও করেছিলাম। তবে সবকিছু যেনো মনের বিরুদ্ধে চলছে।
যা হবার তাই হলো চলে আসলাম আমার প্রিয় সেই প্রতিষ্ঠানে। যাই হোক ভর্তি হলাম বিজ্ঞান বিভাগে। এবার বিভিন্ন সমস্যা, বাধা, উপেক্ষা সবকিছু পেরিয়ে আসলো সেকেন্ডারী স্কুল সার্টিফিকেট (SSC) পরীক্ষা। ফলাফল আশানুরূপ পেলাম না। অবশ্য পড়াশোনার প্রতি অনেকটা মনোযোগ হারিয়ে গিয়েছিলো যেটা আমি নিজেই স্বীকার করি। কারণ আমি আত্মসমালোচনাকেই বেশ পছন্দ করি। রেজাল্ট খারাপ হওয়ার ব্যাপারে কাউকে কোনো দোষ আমি দিতে চাই না। বলতে পারেন সেটা আমার নিজেরই ব্যর্থতা ছিলো। তবে আশানুরূপ না হলেও A গ্রেড পেয়ে উত্তীর্ণ হলাম। এবার সবাই একটু ভিন্ন চোখে দেখা শুরু করলো। আসলে করাটাই স্বাভাবিক। পরিবার, আত্নীয়-স্বজন, শিক্ষক এমনকি নিজের ক্লাসের সেই সকল বন্ধুরাও আর আগের মতো সেই দৃষ্টিতে দেখলো না। কারণ হিসেবে ঐ যে রেজাল্ট খুব একটা ভালো হয়নি! আসলে খারাপ সময়গুলোতে মানুষের আসল রূপগুলো ফুটে ওঠে। আমরা যখনই সফল তখন সবাই আমাদেরকে বাহবা দিবে কিন্তু বেশিরভাগই খারাপ সময়ে আমাদের পাশে থাকবে না। এটাই বাস্তবতা। মানুষগুলোর শান্তনা সেই সময়ের দিকে খুবই দরকার ছিলো। দরকার ছিলো একটু সাপোর্ট। তবে আমার মা-বাবা সবসময়ই আমাকে সাপোর্ট দিয়ে গেছেন এবং এখনও দিয়ে যাচ্ছেন।
কলেজ জীবনঃ—
মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করার পর এবার কলেজে ভর্তি হবার পালা। সাতক্ষীরা জেলাধীন কলারোয়া উপজেলার, কলারোয়া সরকারি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলাম। পরবর্তীতে কয়েক মাস ক্লাস করার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হলো কলেজ পরিবর্তন করে অন্য একটি কলেজ ভর্তি হবো। এবার চলে গেলাম কলারোয়া উপজেলাধীন 'বেগম খালেদা জিয়া' কলেজে। যাই-হোক সেখানে ক্লাস করলাম প্রায় ২ মাস মতো। নিজেই আবার সিদ্ধান্ত নিলাম আগের কলেজেই ফিরে যাবো। তাই-ই করলাম। পুনরায় চলে গেলাম আগের কলেজে। তখনও আমি কিন্তু বিজ্ঞান বিভাগেরই অধ্যয়নরত ছাত্র। পরবর্তীতে পরীক্ষা আসার সম্ভাব্য হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৩ মাস আগে বিজ্ঞান বিভাগ পরিবর্তন করে মানবিক বিভাগে চলে আসি। অবশ্য অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে অনেক ঝামেলা উপেক্ষা করে কলেজের পিওন মনির ভায়ের মাধ্যমে বেশ কিছু টাকা খরচ করে বোর্ড থেকে বিভাগ পরিবর্তন সম্ভব হয়েছিলো। অবশ্য এখানে বলে রাখা ভালো সেই সময়গুলোতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করার কারণে অনেকটা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিলাম।। আর এ কারণেই অনেক ঝামেলাও আমাকে ভীষণভাবে পীড়া দিয়েছিলো।
যাইহোক, HSC পরীক্ষা হওয়ার মাত্র কয়েকমাস আগেই সবার সামনে চলে আসলো Covid - 19 করোনা ভাইরাস। এদিকে চিন্তায় আছি পরীক্ষা কবে হবে! অনেক বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হতে শুরু করলো। স্কুল-কলেজ সবকিছুই ধীরে ধীরে বন্ধ হতে শুরু করলো। চারিদিকে মানুষের আহাজারী আর আর্তনাদে আকাশ বাতাস ভারী হতে লাগলো। ধীরে ধীরে করোনার থাঁবা ছড়িয়ে পড়লো অনেক জেলায়। প্রতিদিনই অনেক মানুষ আক্রান্ত হতে শুরু করলো সেই সাথে করোনায় আক্রান্তে মৃত্যুর সংখ্যাটাও বাড়তে থাকলো। অবশেষে সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দিপু মনি ঘোষণা দিলেন HSC পরীক্ষা হবে না সেই সাথে JSC ও SSC পরীক্ষার রেজাল্টের উপর ভিত্তি করে সেটা মূল্যয়ন করে রেজাল্ট ঘোষণা করা হবে। তাই-ই হলো। রেজাল্ট প্রকাশের পর অনলাইন থেকে নিজের রেজাল্ট দেখলাম। অবশ্য আশানুরূপ ফল না আসলেও A গ্রেড পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলাম।
B.A অনার্সঃ—
কোন সাবজেক্ট নিয়ে পড়াশোনা করবো সেটা নিয়ে এবার একটু চিন্তাভাবনা শুরু হলো। বাংলা, ইতিহাস নাকি রাষ্ট্রবিজ্ঞান। অবশ্য প্রথম দিকে ইংরেজি নিয়ে পড়াশোনার প্ল্যান ছিলো কিন্তু পরবর্তীতে সে চিন্তা মাথা থেকে বিদায় হলো। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে আমি এবং আমার বাবা জানাশোনা করতে লাগলাম। কোন সাবজেক্ট নিয়ে কার কেমন ধারণা সেইটা জানার জন্য। আমি এদিকে অনলাইনের বিভিন্ন ওয়েবসাইট এবং ইউটিউবে খোঁজ খবর নিতে লাগলাম। অবশেষে বাবার এবং আমার সিদ্ধান্তমতে বাংলা বিভাগে ভর্তির প্রস্তুতি নিলাম। সাবজেক্ট নির্বাচনে প্রথমে বাংলাকেই নির্বাচন করলাম। রেজাল্টেও প্রথমবারেই বাংলা চলে আসলো। ভর্তি হলাম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আমার সেই প্রিয় প্রতিষ্ঠান কলারোয়া সরকারি কলেজে। এইতো এভাবেই চলছে। বাংলা বিভাগের একজন ছাত্র বর্তমানে অধ্যয়নরত আছি।
জীবনের লক্ষ্যঃ—
'যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, বিশ্বাস হৃদয়ে,
হবেই হবে দেখা, দেখা হবে বিজয়ে।'
জীবনের লক্ষ্যটা লিখে লেখাটার সমাপ্তি দিতে চাই। জীবনে লক্ষ্য স্থির করা ও সেই লক্ষ্য পূরণে সঠিক পথে এগিয়ে চলা আমাদের সবার জন্যই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক মানুষের জীবনে কোনো না কোনো স্বপ্ন থাকে। স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন হয়। নির্দিষ্ট লক্ষ্য না থাকলে সফল হওয়া অনেক কষ্টের বিষয়।
জীবনের এই কঠিন রঙ্গমঞ্চে ছোট্ট একটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগিয়ে যেতে চাই। কাজ করতে চাই সমাজ দেশ বা রাষ্ট্রের জন্য। বেঁচে থাকতে চাই কাজের মাধ্যমে এবং সৃষ্টির মাধ্যমে। দেশকে রিপ্রেজেন্ট করার জন্য একজন কর্মী হিসেবে কাজ করতে চাই। মানুষের মনে স্থান করে নিতে চাই যুগ যুগ ধরে। সবাইকে-ই এই পৃথিবী ছেড়ে পরকালে পাড়ি জমাতে হবে। হয়তো যেদিন পৃথিবীতে আর থাকব না সুন্দর এই দেহ থেকে প্রাণটা চলে যাবে তখন যেনো মানুষ আমার জন্য একটু প্রাণখুলে দোয়া করে।
জানিনা সেটা সম্ভব হবে কিনা। আশা নিয়েই তো মানুষের এই পদচারণা। আশা নিয়েই বেঁচে আছি।
সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না সবকিছু মিলিয়েই জীবন। ক্ষুদ্র এই জীবনে অনেক কিছুরই সম্মুখীন হয়েছি। তবে সবসময়ই চেষ্টা করে যাচ্ছি নিজেকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং চেষ্টা করে যাচ্ছি নিজেকে সবার মাঝে বাঁচিয়ে রাখতে।
আমার লেখাটি 'নিজের বলার মতো একটি গল্প' ফাউন্ডেশনের প্রিয় ভাই ও বোনদের মনোরঞ্জন করতে সক্ষম হয়েছে কিনা জানিনা। তবে চেষ্টা করেছি নিজের জীবনের বেশ কিছু স্মৃতিময় ঘটনা তুলে ধরার।
আপনাদের কাছে আমার একটাই চাওয়া–
আমার এবং আমার মা-বাবা জন্য সবাই প্রাণখুলে দোয়া করবেন।
সেই সাথে, আশা করি ফাউন্ডেশনের সবার ভালোবাসা এবং সাপোর্ট সবসময় পাবো। সবার কাছে সেই প্রত্যাশা রেখে আমার লেখাটি এখানেই সমাপ্ত করলাম।
সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
📌📌স্ট্যাটাস অফ দ্যা ডে ৭৮৯
তারিখ ২২-০৪-২০২২
Shohagh Hasan
জেলাঃ সাতক্ষীরা ;
উপজেলাঃ কলারোয়া;
ব্যাচ নং ১৭ এবং রেজিষ্ট্রেশন নং ৯০১০৭;
shohaghofficialbd@gmail.com;
01624035373 (Whats app)।