প্রত্যেকেরই নিজের বলার মত একটা গল্প রচনা করা দরকার।
আসসালামু আলাইকুম।
পরম করুণাময় মহান আল্লাহর নামে শুরু করছি।
প্রথমে শোকরিয়া জানাই মহান আল্লার দরবারে যিনি তাঁর অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে আমাকে আশরাফুল মাখলুকাত হিসাবে সৃষ্টি করছেন।একজন সক্ষম মানুষ হিসাবে সৃষ্টি করছেন।
লাখো কোটি দুরদ দুরদ ও সালাম পেশ করছি আখেরী নবি,দয়ার নবীমায়ার নবী হযরত মুহাম্মদ (স:)এর প্রতি।
অসংখ্য শ্রদ্ধা ওকৃতজ্ঞতা পোষণ করছি আমার পিতৃতুল্য শিক্ষক ও লাখো তরুণ -তরুনীর স্বপ্নদ্রষ্টা জনিব ইকবাল বাহার জাহিদ স্যারের প্রতি।আমার মতো হীনমন্যতায় ভুগে ধুকে ধুকে মৃত্যুর প্রহর গোনা স্বপ্নহীন মানুষেরজন্য তিনি আলোর দিশারী।
সত্যিই আজকে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। প্রিয় মেন্টরের মাধ্যমে আমার মত একটি সাধারণ মেয়ের জীবনী আপনাদের সাথে শেয়ার করতে পারছি।
প্রিয় স্যারকে এই সুযোগ করে দেয়ার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।
জীবন নাটকের চেয়েও নাটকীয়।তবে সবার জীবন যেজটিল হয় তা নয়।জীবন ধারা যে গতিতেই চলুক না কেন প্রতিটি মানুষের জীবনে কিছু না কিছু শিক্ষা মূলক ঘটনা রয়েছে।
আমার জন্মের কিছু দিন আগের ঘটনা:
আগের দিনে গ্রামগঞ্জে মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেয়া হতো। আমার আম্মুকেও বিয়ে দিয়ে দেয়। আম্মা এতিম ছিলো বলে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে নানাকারনে অপমানিত করতে ভাবতো না বিয়ের অর্ধযগ পরেও সন্তানের মুখ দেখাতে পারেনি বলে রসংসারে চূড়ান্তভাবে অশান্তি হয়েছিলো।
মহান আল্লাহর রহমতে আমার মা সন্তান সম্ভবা হন।
আমার জন্ম:
আমার জন্ম নিয়ে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিলো জন্মের পরে আমাকে রাজকন্যা করে রাখা উচিত ছিলো।
আমার ভাগ্যে রাজকন্যার আদর দূরের কথা পরিধানের কাপড় জোটেনি। অন্যান্য স্বাভাবিক বাচ্চাদের মতো হাটতে ও কথা বলতে পারতাম না। অনেক চেষ্টার পরে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে আমাকে ভর্তি করানো হয়। ডাক্তার হাটার সম্ভাবনা খবু কম বলে দিলেন। আম্মা প্রতিদিন সকালে ব্যায়াম করাতেন। একদিন হঠাৎ করে উঠে দুই কদম হেটে আবারও পরে গেলাম। এর পর দেরিতে হলেও ধীরে ধীরে হাটতে শিখেছি।
শৈশবের কয়েকটি দূর্ঘটনা :
নতুন হাটা শিখেছি মাত্র। একটু হাটলেই পরে যেতাম।
তখন উঠানের কোণায় একটি নতুন কাঠের চেয়ার ছিলো। দৌড়াতে গিয়ে চেয়ার নিয়ে পিছলে পড়ে ডান চোখের ভ্রু কেটে গিয়েছিলো।অনেক রক্ত ঝরেছিলো।
কিছু দিন পরে পাশের বাসার কাজিন দা দিয়ে তালের বিচি কাটছিলো। আমি কৌতুহলবশত সামনে গিয়ে বসেছিলাম।দা তালের বিচিতে না লেগে আমার বাম ভ্রুতে লেগেছিলো।আল্লাহর অশেষ রহমতে একবারও চোখের ক্ষতি হ য়নি।
যৌথ পরিবার ত্যাগ:
আমার জন্ম যৌথ পরিবারে হয়েছে। আমি অসুস্থ হয়ে জন্ম নিয়েছিলাম। সহজে কোন খাবার হজম করতে পারতাম না। ডাক্তারের পরামর্শে কিছু বিশেষ খাবার খেতে দেয়া হতো। কাজিনরা এটা নিয়েও ঝামেলা করতো। তখন আমার আব্বা ছাত্র ও বেকার ছিলেন।
আরো নানা সমস্যা ছিলো। আব্বাকে কিছুই শুনানো হতো না। আমার দাদি ছেলের ক্যারিয়ার নষ্ট হবে বলে সবাইকে চুপ করিয়ে রাখতেন।
কথা চাপা থাকেনা। এক এক করে আব্বাও সবাই জেনে যায়। তখন দাদির পরামর্শে আব্বা আমাদের নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন।
প্রাক স্কুল গামী সময়:
সবার মতো স্বাভাবিক ছিলাম না। কোন কিছু মনে রাখতে পারতাম না। আম্মা অনেক চেষ্টা আমাকে সাহসী করে তুলেছিলো। লেখা পড়ার হাতে খড়ি আমার মায়ের হাতে য়েছিলো। এই পড়তাম এই ভুলতাম। কলম স্থির ভাবে ধরতে পারতাম না। আমার মায়ের মতো ধৈর্যশীল মা থাকার কারণে আমি স্কুলে ভর্তিহ ওয়ার আগেই প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছিলাম।
স্কুলগামী সময়:
অন্যসব বাচ্চারা ক্লাসের ফাকে মজা করতো, খেলাধূলা করতো আমি চুপ চাপ বসে থাকতাম। কথা বলতাম না বলে ক্লাসমেটরাও কথা বলতো না। অহংকারী ভাবতো।আমাকে টিচারদের কাছে মার খাওয়ানোর চেষ্টা করতো। একবার অন্য ক্লাসের মেয়ে এসে আমার পাশে বসা মেয়ের রং পেন্সিল চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলো। থখন আমি ছাড়া কেউই সেখানে ছিলোনা। ক্লাস শেষে টিচার আমাকে মারেন।আমি বলেছিলাম আমি নেইনি।সেই চুন্নি মেয়েটি আমার ব্যাগ থেকে ভাঙ্গা পেন্সিল বের করে দিয়ে অকারনে মাইর খাইয়েছিলো। আব্বা আম্মার কাছে বিচার দিয়ে তাদের কাছেও মাইর খাইয়েছিলো।
দুরন্ত কৈশর:
সব বাচ্চারই কৈশরে দুরন্ত স্বভাবের হয়। আমিও তাই ছিলাম। একা থাকা অভ্যাসে পরিনত হয়ে গিয়েছিল। লেখা পড়ার পাশাপাশি মাছ ধরতাম,আম্মাকে সাহায্য করতাম,ছাগল চ ড়াতাম,হ্যান্ডি ক্রাফটের কাজ শিখতাম।
হাতের কাজের প্রতি প্রবল নেশা ছিলো। যেখানে যা দেখতে পেতাম সেটি আবারো বাসায় এসে চর্চা করতাম।
হ্যান্ডি ক্রাফটের কাজের প্রতি ভালোবাসা :
ছোট বেলা থেকেই টাকা জমানোর অভ্যাস ছিলো। অন্যেরা দোকানের মজা খাওয়ার জন্য বাবা মায়ের কাছে অন্যায় আবদার ধরতো। অনেকে আমি টাকা চুরি করতেও শুনেছিলাম। আমাকে তত টাকা দেয়া হতো না। যতটুকুই দিতো দোকানে গিয়ে কোন খাবার নিবার্চন করতে পারতাম না। আবারো টাকা নিয়ে বাসায় চলে আসতাম। সেই টাকার কিছু দিয়ে ক্রাফটের জিনিস কিনতাম। নিজের একান্ত চেষ্টায় টেইলারিং,ক্রুসেরকাজ,সূইসুতার এম্বয়ডারি সহ অন্যন্য কাজ শিখেছিলাম।
মাছ ধরা:
আব্বা পেশায় একজন কলেজের প্রফেসর ছিলেন। কিন্তু শখে ছিলেন একজন জেলে ও কৃষক।
সেই আচঁ আমাকেও স্পর্শ করেছিলো। কখনো বাবার সাথে আবার কখনো নিজেই রা বিরাতে মাছ ধরতে যেতাম। একবার মাছ ধরতে গিয়ে ডুবে গিয়েছিলাম। পাশের বাসার আংকেল দূর থেখে দেখে বাঁচিয়েছিলেন।
আব্বার অসুস্থতা ও অর্থনৈতিক সংকট:
আমি,আমার ভাই,বাবা -মা কে নিয়ে আমাদের সময় ভালো কাটছিলো। হঠাৎ করেই আব্বা শ্বাস কষ্টে অসুস্থ হলেন। তখন শিক্ষকদের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেক খারাপ ছিলো। তাদের বেতন প্রায় সময় আটকে যেতো। আমাকে বিয়ে দেয়ার সিধান্ত দেয়া হয়। বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে নিজেই লড়াই করেছিলাম। নিজের লেখা পড়া ও ভরণ পোষনের দায়িত্ব নিজেই নেই । টিউশনি করা, টেইলারিং করা,অর্ডারে ক্রশের কাজ করে পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। যেকাজ গুলো শখে করতে করতাম। পরে তাই জীবিকার অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছিলো।।যখন যেই হাতের কাজ শিখতাম তাই করতাম।
কলেজ জীবন:
অদম্য আকাক্ষা নিয়ে স্কুল পেরিয়ে কলেজ জীবনে পা রাখি। একটি কোচিং সেন্টার চালু করেছিলাম। দিন রাত এক করে শ্বাস ফেলানোর মতো সম য় ছিলোনা।
পরীক্ষার কয়েকমাস আগে আম্মা মাইগ্রেনের ব্যথায় হাসপাতালে ভর্তি হলেন। সব কাজ, লেখা লেখা পড়া বন্ধ করে মায়ের সেবার ব্রত হলাম।
আম্মাকে সুস্থ করে তুলতে তুলতে পরীক্ষার রুটিন দিয়ে দিয়েছে। বিনা প্রস্তুতিতে পরীক্ষা দিয়ে ইংরেজী প্রথম পত্রে ফেল করেছি।
এর পরের বছর আবারো পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এবারো ভাগ্য আমাকে নিয়ে পরিহাস করলো। আমি নিজেই টাইফয়ড জ্বরে আক্রান্ত হয়েছি। তবুও ভালো রেজাল্ট করতে না পারলেও পাশ করেছিলাম।
উচ্চ শি ক্ষা :
অনার্স করার ইচ্ছা থাকলেও আব্বা রাজি না হওয়ায় বাধ্য হয়ে ডিগ্রীতেই ভর্তি হতে হলো। আব্বার সিধান্ত মেনে নিয়ে আবারো মন দিয়ে লেখা প ড়া শুরু করেছিলাম। প্রথম বর্ষের রেজাল্ট ভালো হয়েছিলো। দ্বিতীয় বর্ষে উঠার কয়েক মাস পরে পারিবারিক ভাবে আমার বিয়ে হয়ে যায়। পড়া লেখার সুবাদে আমি বাবার বাড়িতে থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম।
বিয়ের এক বছর পরে আমার কোল জুড়ে একটি পুত্র সন্তান আসে। এর কিছুদিন পরে আমার দাদি মারা যান। চোখের সামনে প্রিয় মানুষের মৃত্যু আমাকে দূর্বল করে দিয়েছিলো।
সম য় কারো জন্য থেমে থাকে না।
বি,এ শেষ করেএম,এতে ভর্তি হলাম। এম,এ তে রেজাল্ট ভালো হয়েছিলো। লেখা -পড়া আমার আত্মার ছিলো। রাস্তায় একটা কাগজ প রে থাকতে দেখলেও সেটা উঠিয়ে পড়তাম। ল 'নিয়ে আগ্রহ থাকাতে ল'তেও র্ভতি হ য়েছিলাম।
এক ই দিনে সকাল সাড়ে আটটায় ইডেন মহিলা কলেজে মাষ্টার্স পরিক্ষা দিয়েছিলাম। বিকাল দুইটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত তূলারাম কলেজে ল'পরীক্ষা দিয়েছি।
ক্যারিয়ার নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম। জরায়ুর সমস্যা ও হরমোনের সমস্যা আমার ক্যারিয়ার একে বারেই শেষ করে দিয়েছলো। আবারও নতুন করে নিজেকে গুছিয়েছি। সব বির্সজন দিয়ে আমি পুরোদস্তুর গৃহিণী। স্বপ্ন ভঙ্গের জ্বালা আমার আমার থাকার কথা। আমার চেয়ে আমার স্বামীর বেশী ছিলো।
নানা ভাবে সে আমাকে যোগ্যতাহীন প্রমাণ করতে চাইতো অপমান করতো।
আব্বার মৃতু:
ছাদ ছাড়া গৃহ যেমন বাবা ছাড়া সন্তান তেমন। আব্বার মৃত্যুতে আমি একেবারেই নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলাম। আব্বার মৃত্যুর এক বছর পরে শ্বশুর মারা গেছেন।
বিধবা মাকে একা ফেলে বাধ্য হয়েই শ্বশুরবাড়িতে উঠাছিলাম।জীবন যেন কোথায়ও থমকে গেছে। সেখানে গিয়ে নিজের একটা পরিচয় দরকার উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম।
ফাউন্ডেশনের সাথে পরিচ য়:
অনাকাঙ্খিত একটি ঘটনায় কষ্টে অনেকসময় ধরে কান্নাকাটি করছিলাম কান্নাভেজা চোখ মুছে ইউটিউবে ভিডিও দেখছিলাম আর ভাবছিলাম ভালো কিছু করার পরামর্শ দেয়ার মতো যদি কাউকে পেতাম!
হঠাৎ করেই চোখের সামনে জনপ্রিয় সেই সেশন টি ভেসে উঠলো।"স্বপ্ন দেখুন,সাহস করুন,শুরু করুন,লেগে থাকুন,সাফল্য আসবেই। সেশনটি আমার অনেক ভালো লাগে।সবগুলো সেশন দ্রুত শেষ করি।
রেজিষ্ট্রেশন করে প্রিয় স্যারের আজীবন শিক্ষার্থী হয়ে যাই।
ফাউন্ডেশন থেকে শিক্ষা লাভ:
সারা জীবন পরিশ্রম করে আমি যা শিখেছি। টানা নব্বই দিনের প্রশিক্ষণে আমি এরচেয়েও অনেক বেশি শিখতে পেরেছি।আমার অর্জিত শিক্ষার মধ্যে কিছু নিন্মে বর্ণনা করলাম।
1) সবার আগে একজন ভালো মানুষ হতে হবে।
2)বাবা-মায়ের সেবা যত্ন করতে হবে।
3)ছাত্র জীবন ঝুঁকি নেয়ার উপযুক্ত সম য়।
4)কোন উদ্যোগ প্রথমেই লোন নিয়ে শুরু করা যাবেনা। ব্যক্তিগত সঞ্চয় দিয়ে শুরু করতে হবে।
5)নির্দিষ্ট একটা কাজের জন্য আমাদের জন্ম হয়নি। সময়কে সঠিক ব্যবহার করে আমারা একাধিক কাজ করতে পারি।
6) হেরে যাওয়া মানে থেমে যাওয়া নয়। বরং সেই হার থেকে শিক্ষা গ্র হণ করে আবারো নতুন করে শুরু করা।
7)নতুন কিছু শুরু করতে গেলে লোকোরা নানাভাবে অপমান করে। অপমানের জবাব কথায় নয় কাজে প্রমাণ করতে হবে।
8)আমাদের সম্পদে কেবল আমাদের অধিকার নেই। কাছের দূরের,চেনা অচেনা অনেকেরই অধিকার আছে।
9)প্রত্যেকটি মেয়ের সাবলম্বি হওয়া ও নিজের একটি পরিচয় থাকা দরকার। বিপদের সময় সেটি তার অবলম্বন হবে।
10)প্রত্যেকেরই নিজের বলার মত একটা গল্প রচনা করা দরকার।
ধন্যবাদান্তে
আমার মতো একজন সাধারণ মেয়ের জীবনী এতক্ষণ ধৈর্য্য ধরে শোনার জন্য সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
আমিও যেনো নিজের বলার মতো একটি গল্প তৈরী করতে পারি সেজন্য আপনাদের কাছে দোয়া প্রার্থী।
কাজ করছি
হ্যান্ড পেইন্টের সকল পন্য,
ব্লক প্রিন্ট
হাতের কাজের ওয়ান পিছও টু পিছ
ও হাতের বানানো গয়না নিয়ে।
📌স্ট্যাটাস অফ দ্যা ডে ৮৬৫
তারিখ ০৫-০৯-২০২২ইং
রোমানা আক্তার
ব্যাচ:15
রেজিনং:67858
জেলা: নারায়ণগঞ্জ
উপজেলা রুপ গঞ্জ