বাবার ছেলে নেই বলে অনেক ধরনের সমস্যা ছোটবেলা থেকেই দেখে বড় হয়েছি।
আমার জীবনের গল্প
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু মহান আল্লাহর নামে শুরু করছি। বিশেষ কৃতজ্ঞতা ও দোয়া জনাব Iqbal Bahar Zahid স্যারের প্রতি যিনি এতো সুন্দর একটি প্লাটফর্ম তৈরি করে দিয়েছেন আমাদের সবার জন্য।যেখানে তৈরি করা যায় #নিজের_বলার_মত_একটা_গল্প
আমার পরিচয় ও পরিবার:
আমি পাপিয়া সুলতানা। গাজীপুরের মেয়ে এবং গাজীপুরের বৌ। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।পরিবারে চারবোনের মধ্যে আমি দ্বিতীয়। ছোটবেলায় এই অবস্থানের জন্য অনেকে আবার আমাকে পরিবারের দুই নাম্বার সন্তান বলেও ক্ষেপাতো
কিন্তু বড়বেলায় সবাই আমাকে পরিবারের দায়ীত্বশীল মেলে বলে সম্মানিত করে আলহামদুলিল্লাহ
বাবার ছেলে নেই বলে অনেক ধরনের সমস্যা ছোটবেলা থেকেই দেখে বড় হয়েছি। এবং এমনও বলতে শুনেছি মেয়েমানুষের নাকি কোনো ভবিষ্যৎ নাই।যেমনটা একজন ছেলের থাকে
আমার শৈশব :
অসাধারন সুন্দর ও দুরন্ত এক শৈশব জীবন কাটিয়েছি আমি
শৈশবের প্রতিটা স্মৃতি যেনো সোনা দিয়ে মোড়ানো। ভালোবাসায় ভরপুর এক স্বপ্নীল জগত
আমার শৈশবের সিংহভাগ সময়টা কেটেছে গ্রামে।
গ্রামের নির্মল পরিবেশ, গ্রামের মানুষের সরল জীবনযাপন,বিল ভরা শাপলার ঝাঁক, বিল থেকে মাছ ধরা,গাছের মগডালে বসে ফল খাওয়া, কচুরিপানা ফুলের বড়া খাওয়ার বায়না ধরা,সব বাচ্চারা মিলে রোজ চড়াইভাতির আবদার, পুকুরের পানিতে ঝাঁপাঝাঁপি, বৃষ্টির পানিতে বিরামহীন ছুটাছুটি আর মজা, কচুরিপানা ফুলের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য সবচেয়ে কাছ থেকে দেখা।
এসবকিছু মিলিয়ে এক রঙিন শৈশব
আমি স্বভাবের দিক দিয়ে অনেক বেশি ভদ্র হওয়ায় পরিবার ও পরিবারের বাইরের সবাই আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসতো।
এতোটাই আদুরে ছিলাম নিজের হাতে কখনোই ভাত খেতে চাইতাম না।আম্মু অথবা নানু এই দুজনের মধ্যে একজনকে খাইয়ে দিতে হতো।
সোনা রোপোয় মোড়ানো আমার শৈশব সাড়াজীবন আমার মনের মনীকোঠায় থাকবে
আমার কৈশোর:
ক্লাস থ্রী তে পড়া অবস্থায় পারিবারিক কারণে আমার ৩ টা স্কুল পরিবর্তন করতে হয়েছে। প্রথম দুইটা স্কুল গ্রামে হলেও তৃতীয়টা ছিলো মফস্বলে। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় একটু ভালো থাকায় সবসময়ই ক্লাসে ১ম,২য়,৩য় এর মধ্যে থাকতাম।
কিন্তু মফস্বলের স্কুলে যে বছর ভর্তি হলাম সে বছর আমি একই ক্লাস দুই স্কুলে পড়েছি।
মানে গ্রামের স্কুলে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা দিয়েছি।আর বাকি দুই পরীক্ষা মফস্বলের স্কুলে দিয়েছি
বছর শেষে যখন রেজাল্ট দিলো।দুই স্কুলেই আমি পাশ করেছি ।
মফস্বলের স্কুলে ২ টা টার্ম পরীক্ষা দিয়ে রোল হয়েছে ২০
আর গ্রামের স্কুলে ১ টা টার্ম পরীক্ষা দিয়ে হয়েছে ০২
আমার জীবনে এটা একটা স্মরণীয় ঘটনা
আমার শিক্ষাজীবন:
ছোটবেলা থেকেই মোটামুটি ১০ এর মধ্যে রোল রেখেই মানসম্মত একটা রেজাল্ট নিয়ে সাইন্স থেকে এস এস সি সম্পন্ন করেছিলাম। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিলো।
কিন্তু ঝড় শুরু হলো এইচ এস সি থেকে
হঠাৎ করেই পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে গাজীপুরের একটা সরকারি কলেজে ভর্তি করে দিলো এবং কলেজের হোস্টেলে থাকার ব্যাবস্থা করলো
যা একদমই আমার ইচ্ছার বাইরে ছিলো
হোস্টেলে আমার রুমমেট সহ সবাই অনেক ভালো ও আন্তরিক ছিলো।আর সবাই আমাকে খুব স্নেহ করতো।
কিন্তু আমার মন পড়ে থাকতো বাড়িতে।ভয়ে কখনো বলতেও পাড়তাম না যে আমি হোস্টেলে থাকতে চাই না
সবসময়ই আমার মন খারাপ থাকতো আর আমার স্কুলের বন্ধুদের কথা মনে পড়তো
সবাই তখন পাল্লা দিয়ে পড়াশোনা করলেও আমি একদমই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।
পড়াশোনার গতিও অনেক কমে গেলো।
আমি অনেক বেশী জেদী প্রকৃতির ছিলাম বলে তখন ভাবতাম আমি ইচ্ছা করেই রেজাল্ট খারাপ করবো।কারণ আমি সেখানে একা থাকতে চাইনি।
সবসময় খালি কান্না পেতো
এভাবে চলতে চলতে একদিন টেস্ট পরীক্ষার সময় এসে গেলো। এদিকে আমি কিছুই পড়ি নাই।
তখন আমাদের ফিজিক্স, কেমিস্ট্রির শিক্ষকরা কিছু শর্টকাট শিখিয়ে দিলেন।সেই ফর্মুলায় পাশ করে গেলাম আলহামদুলিল্লাহ।
আর পড়াশোনার একটা গতিও ফিরে পেলাম।
ঠিক তখনই হঠাৎ বাসা থেকে বললো আমি যেনো বাসায় ফিরে যাই।
কথাটা শুনে এক অদ্ভুত আবেগে পড়ে গেলাম আর টেস্ট পরীক্ষার পর বাসায় ফিরে আসলাম।
কিন্তু অজানা এক ঝামেলা জীবন বিষিয়ে তুললো। পড়াশোনার গতি ঠিক রাখা অনেক বেশি মুশকিল হয়ে পড়লো। এদিকে পরীক্ষারও খুব বেশি বাকি নেই। বুঝতে পারলাম হোস্টেল ছাড়ার সিদ্ধান্তটা জীবনের চরম বোকামি ছিলো
পরীক্ষা দিলাম মোটামুটি ভালোই।এখন রেজাল্ট এর অপেক্ষা।তখন আমি আমার ছোট বোনকে পড়াতাম আর সাথে তার এক বান্ধবী কে।
রেজাল্ট এর দিন সব ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো।
কারণ আমি ফেইল
বাসা থেকে বললো আর পড়াশোনা করাবে না। এদিকে আমি ভাবছি আমি ফেইল করলাম কিভাবে
দেখতে দেখতে আমার পরীক্ষা দেয়ার সময় চলে এলো। পরীক্ষা দিলাম।পাশ করলাম। কিন্তু রেজাল্ট ভালো হলো না
মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা আর দেয়া হলোনা
এই মাঝের সময়টাতে আমি কম্পিউটার অফিস প্রোগ্রামিং এর কোর্স করি। এবং বাসায় বেশ কয়েকটি বাচ্চা পড়াই।সেখানে কিছু এস এস সি পরীক্ষার্থীও ছিলো। এক বান্ধবীর মাধ্যমে তখন জানতে পারলাম মহাখালীতে একটি সরকারি মেডিকেল টেকনোলজি ইনস্টিটিউট আছে(আই এইচ টি)। প্রতিষ্ঠান টি বাঁকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত।সেখানে সে ভর্তি পরীক্ষা দেবে।আর সে একা তাই আমাদেরও তার সাথে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে বললো।আমি চট করেই রাজি হয়ে গেলাম।আমি সহ আমার আরো ৩ জন বান্ধবী পরীক্ষা দিলো। কয়েকদিন পর মোবাইলে মেসেজ আসলো।ডেন্টাল বিভাগে ১২ টি আসন ছিলো।২০০ নাম্বারের মধ্যে আমি ১৫৮ পেয়ে ৯ম হয়েছি
রেজাল্ট আমার ছোট মামা দেখলো আর অনেক খুশি হলো।আর আমিও
খুশিমনে আমাকে সেখানে ভর্তি করে দিলো। কিন্তু কিছুদিন পর অনার্স এর ভর্তি পরীক্ষা শুরু হলো।আমি পরীক্ষা দিলাম চান্সও পেলাম। কিন্তু ইংরেজি বিষয় পেলাম না।তাই আর ভর্তিও হলাম না। এদিকে পারিপার্শ্বিক সমস্যার কারণে ডেন্টালের পড়াও চালিয়ে যেতে পারছিলাম না
আমার বৈবাহিক জীবন:
পড়াশোনার এই টানাপোড়েন এর এই সময়টাতে যখন আমি আমার ভর্তি আর ভবিষ্যত নিয়ে ভাবনায় মহাব্যাস্তো।
তখনই আমার কাছে একটা ফোন আসে।
ফোনের ওপার থেকে কথা বলে আমার পরিচিত একটা ছেলে।তার প্রেমের প্রস্তাবে আমি রাজি ছিলাম না।
সে আমাকে জানায় পারিবারিকভাবে তার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।আর এ বিষয়ে একদমই কিছু না জানা আমি
হঠাৎ করেই আমার বিয়ে হয়ে গেলো
বিয়ের পর হানিমুনে কক্সবাজার ঘুরার পুরুটা সময় আমি পড়লাম।আর পরীক্ষার ঠিক আগের দিন শ্রীপুর আমার বাবার বাড়ি পৌঁছলাম। সাকাল ৯টায় বনানী গিয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম।আর ইংলিশে চান্স পেলাম আলহামদুলিল্লাহ
তখন সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু সংসার আর পড়াশোনা। এভাবে ফার্স্ট ইয়ার পরীক্ষা দিলাম। রেজাল্ট অনেক ভালো হলেও ফার্স্ট ক্লাস পেলাম না। খুব কান্না করেছিলাম সেদিন
আমার হাজব্যান্ড আমাকে অনেক বোঝালো আর শান্তনা দিলো। কিন্তু জীবনের আসল যুদ্ধ শুরু হলো ঠিক তখন থেকেই।
আমার শশুর বাড়ি থেকে বললো আমার পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে।তারা চায় না আমি পড়াশোনা করি
তখন আমার হাজব্যান্ড এগিয়ে আসলো আর পড়াশোনার ব্যবস্থা করলো।
তখন থেকেই জীবনের এক অন্য মানে আবিষ্কার করলাম।আর বুঝতে পারলাম প্রতিনিয়ত নানামুখী বাধা আসছে আমার শিক্ষাজীবনকে অচল করে দিতে।
সংসারের সব কাজ আমাকে একা করতে হতো।বুয়া বিদায় করে দেয়া হলো
একদম একা হাতে সকালে ধোয়া,মুছা ,রান্না শেষ করে নিজের ক্লাসে দৌড়।আবার ক্লাস শেষ করেই আবার দৌড়।বাসার সব কাজ শেষ করে সবার খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘরে যেতে যেতে ১০.৩০ টা
তখন থেকে আমার পড়ার সময় শুরু
সকালে ৫.৩০- ৬.০০ টায় উঠে আবার সেই দৌড়
এভাবে সেকেন্ড ইয়ার পরীক্ষা দিলাম।আর আমি বেশ ভালো নাম্বার সহ ফার্স্ট ক্লাস পেলাম আলহামদুলিল্লাহ
তারপর থেকে আর সেকেন্ড ক্লাস পাইনি আলহামদুলিল্লাহ
এরমধ্যেই আমার ছেলে দুনিয়াতে এলো
তারপর মাস্টার্স কমপ্লিট করলাম।আর এখন এল এল বি প্রফেশনাল কোর্সে পড়াশোনা করছি
আমার কর্মজীবন:
ছোটবেলা থেকেই একটা জিনিস খুব ভাবতাম।
জীবনে এমন একটা কিছু করতে হবে যাতে করে আমার বাবা মা কোনোদিন ছেলের অভাব বোধ না করে।
তাই এসব এস সির পর থেকেই টিউশনি করাতাম।আর কিছু একটা করার জন্য লিংক খুঁজতাম। সংসারের সবকিছু মিলিয়ে যখন আমি ডিপ্রেশনের চরম পর্যায়ে তখন খালি মরে যেতে চাইতাম
এক বান্ধবী তখন পরামর্শ দিলো ব্যাস্ত থাকতে।রাতজেগে গান না শুনে ইকবাল বাহার জাহিদ স্যারের ভিডিও দেখতাম আর মোটিভেট হতাম।
সেকেন্ড ইয়ার এ পড়া অবস্থায় একটা পার্ট টাইম জব নিলাম। কিছুদিন পর সাথে টিউশনি। এদিকে আমার পড়াশোনা ও সংসারের কাজ চলমান।আরো ব্যাস্ত থাকাতে ফুল টাইম জব নিলাম।সাথে টিউশনিও। খুবই ভালো একটা প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেলাম।
সবকিছু ঠিকঠাক চলছে।পরিস্থিতিও আগের চেয়ে অনেক ভালো।কারণ মাস শেষ হলেও একটা ভালো এমাউন্ট আসে।
কিন্তু মহামারী করোনায় অন্ধকার হয়ে গেলো পুরো পৃথিবী। আমার ছেলেটা তখন পাঁচ মাসের পেটে স্কুল বন্ধ হয়ে গেলো সরকারি নির্দেশনায়।
আমিও মোটামুটি রেস্ট এর সময় পেলাম। কিন্তু চাকরিতে আর জয়েন করা হলোনা আমার
আমার হাজব্যান্ড এর উত্তরায় জব শিফট হলো আর আমাকেও ৮ মাসের একটা ছোট্ট বাচ্চাকে নিয়ে চলে আসতে হলো
নতুন বাসা, ছোট্ট একটা বাচ্চাকে নিয়ে একা হাতে সামলাতে গিয়ে আমার নাজেহাল অবস্থা
একদম বেকার হয়ে গেলাম না
কারণ চাকরির সেভিংস এর টাকা দিয়ে শুরু করেছিলাম উদ্যোগ।
যার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব আমাদের প্রিয় মেন্টর এর
সব ঝামেলার মধ্যে উদ্যোগ থমকে গেলো
আর এখন আমি একজন যুদ্ধরত সৈনিক।ছুটছি সাফল্যের সন্ধানে
সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন ও আমার পাশে থাকবেন।
আপনাদের ভালোবাসায় আমি এগিয়ে যেতে চাই সাফল্যের চূড়ায়
হতে চাই একজন সফল উদ্যোক্তা
গল্পটা একটু বেশি লম্বা হয়ে যাওয়ায় সকলের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
দয়া করে ধৈর্য্য ধরে পড়বেন
"স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৯১৩
Date:- ১২/১২/২০২২ইং
পাপিয়া সুলতানা
১২ তম ব্যাচ
রেজিঃ নং:৪৬৬৯৫
নিজ জেলা গাজীপুর
বর্তমান অবস্থান
উত্তরা মডেল জোন