এক রাজকন্যা ও তার বাবার গল্প |
"বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম"
"এক রাজকন্যা ও তার বাবার গল্প"
"আসসালামুয়ালাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ ওয়া রাহমাতুল্লাহ্।"
প্রথমেই শুকরিয়া আদায় করছি মহান রব্বুল আলামিনের প্রতি যিনি আমাদের সুস্থ রেখেছেন।
শুরুতেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাই আমাদের সকলের প্রিয় মেন্টর জনাব Iqbal Bahar Zahid স্যারের প্রতি যার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আমরা পেয়েছি আমাদের সকলের ভালোবাসার প্রিয় "নিজের বলার মতো একটা গল্প ফাউন্ডেশন " নামক একটি পরিবার।
প্রিয় ফাউন্ডেশনে এসে তো আপনারা অনেকের জীবনের গল্প শুনেছেন। আজকে আমি আপনাদের শুনাবো এক রাজ্যহীন রাজকন্যার গল্প।
#রাজকন্যার_জন্ম:
রাজকন্যার জন্ম হয় তার বাবা মায়ের বিয়ের দীর্ঘ ১১ বছর পর। অনেক প্রতিক্ষা ও সাধনার ফসল সেটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। বংশের বড় সন্তান তার উপরে আবার কন্যা সন্তান। যেই পরিবারে আগের প্রজন্মে কন্যা সন্তানের মুখ দেখার সৌভাগ্য হয়নি শুধুমাত্র সেই পরিবারই এই খুশী অনুধাবন করতে পারবে।
চারিদিকে খুশীর রব, আদর যত্ন, ভালোবাসার অন্ত নেই। প্রতিটা সন্তান তার বাবা মায়ের প্রিয় হলেও এই রকম সন্তানগুলো একটু বেশীই আদরের হয় তাই তাদের রাগ অভিমানও একটু বেশী থাকে।
বাবা ছিলেন একজন ব্যাংক কর্মকর্তা এবং মা গৃহিনী। বাবা মায়ের সম্পর্কটা এতোটাই মধুর ছিলো যে কোনোদিন তাদের মনোমালিন্য রাজকন্যার চোখে পড়েনি। মধ্যবিত্ত পরিবার হলেও ঐশ্বর্য্যের অভাব ছিলো না। এই ঐশ্বর্য্য হচ্ছে সুখ, শান্তি আর ভালোবাসার। তার পরিবারে না পাওয়া বলতে কিছুই ছিলো না।
ভালোবাসা, মান অভিমান আর খুঁনসুঁটির মিশ্রনে এক অনন্য সম্পর্ক ভাইবোনের। বাবা মায়ের পরে পৃথিবীতে একমাএ ভালোবাসার মানুষ ছোটভাই। কখনো ছোট ছোট আবদার আবার কখনো বড় ভাইয়ের মতো কঠোর শাসন সবকিছু মিলিয়ে অসাধারন এই ভালোবাসার বন্ধন।
বাবার চাকরিসূত্রে কয়েক বছর পরপর শহর পরিবর্তন হওয়ায় অনেকগুলো স্কুলে পড়ার সুযোগ হয়েছে। প্রথম স্কুল পাবনা শহরে তারপর নাটোরে গ্রীন একাডেমী, মনিষা ভবন, নাটোর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং সবশেষে রাজশাহী শহীদ নজমুল হক বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। স্থায়ীভাবে কারো সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি কখনোই।
স্কুলজীবনের উল্লেখযোগ্য সময় ছিলো নাটোর গার্লস স্কুল। চুরি করে স্কুলের ছাদে উঠে কদমফুল ছেড়া, বকুল ফুল কুড়ানো, জাম, আমলকি আর জামরুল চুরি, বাড়ির পেছনে নাটোরের বিখ্যাত বাবুর পুকুরের ঘাটে লুকিয়ে বসে বসে পুতুলের বিয়ে আরো কত নাম ভুলে যাওয়া খেলা। দিনগুলো মনে পড়লে আবার শৈশবে ফিরে যেতে মন চায়।
পড়াশোনায় সবসময়ই ফাঁকিবাজ কিন্তু মনোযোগী। শিক্ষকরা ফাঁকিবাজকে ধরে যখন শাস্তি দিতে বেত নিয়ে হাজির সেইসময় রাজকন্যার একটা কথায় যথেষ্ট শিক্ষকসহ পুরো ক্লাসকে হাসানোর জন্য। এভাবে সবসময়ই শাস্তি থেকে বেঁচে যেত।
বরাবরই শান্ত স্বভাবের হলেও মন সবসময় অশান্তই থাকতো তার। স্বেচ্ছায় সবসময় ক্লাস মনিটরের দ্বায়িত্বটা অন্য কাউকে ছেড়ে দিলেও পুরো ক্লাসের কন্ট্রোল থাকতো তার উপর। দুই এক সময় মনিটর বান্ধবীদের সাথে মতোবিরোধ হলেই পুরো ক্লাস হয়ে যেতো অশান্ত। এত সব দুষ্টুমির পরেও সবসময়ই শিক্ষকদের পছন্দের তালিকায় নাম থাকতো তার।
কোনো কিছুইতে পারদর্শী হোক বা না হোক যেকোন প্রতিযোগিতার কথা শুনলেই তার অংশগ্রহন করতেই হবে। স্কুল কলেজ জীবনে চিত্রাঙ্কন, কবিতা লেখা, রচনা প্রতিযোগিতা, খেলাধুলা সব কিছুতেই তার নামের একটা পুরস্কার থাকতোই।
ছোটবেলা থেকেই বাবার ভক্ত, বাবাই তার সবকিছু। শুধুমাত্র বাবার কষ্টই সে অনুধাবন করতে পারে। রাজকন্যার বয়স যখন ৬/৭ বছর তখন একবার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে, জন্ডিসের জন্য ১৫ দিনের বেডরেষ্ট। মায়ের কাছে তখন তার একটাই প্রশ্ন "আবার কবে বেড়াতে যাবো??"
কারন প্রতি শুক্রবার বিকেল ছিলো তাদের বেড়ানোর দিন। এখনো মনে পরে মা বলেছিলো "বেড়াতে না যাওয়ায় তুমি যেমন কষ্ট পাচ্ছ, তোমার বাবা তার চেয়েও বেশী কষ্ট পাচ্ছে। তুমি যেমন তোমার বাবাকে ভালোবাসো তেমনি তোমার বাবাও তোমাকে অনেক ভালোবাসে।
তোমার বাবা তো তোমার অনেক যত্ন নেয়, তুমি কি বাবার যত্ন নাও?? " তুমি যত্ন নিলেই বাবা সুস্থ হয়ে যাবে আবার তোমাকে নিয়ে বেড়াতে যাবে।
সেই ছোট্ট রাজকন্যা সেইদিন কি বুঝেছিলো জানা নেই কিন্তু সেই দিন থেকে শেষ দিন পযর্ন্ত নিয়ম করে বাবার যত্ন নিতো সে। বাইরে যাবার সময় বাবার জুতো পরিয়ে দেওয়া, খুলে দেওয়া, প্রতিসপ্তাহে নখ কেটে দেওয়া ঠিক যেমন তার বাবা তার জন্য করতো।
বাবার সব কথা সে বলার আগেই বুঝে ফেলত ঠিক যেমন তার কথাগুলো বাবা বুঝত।
বাবার সাথে তার সম্পর্ক এমন ছিলো যে নিদ্বির্ধায় সবকিছু বলে ফেলা যেত। অবসরে তার কত অবাস্তব বায়না থাকত বাবার কাছে। সে জানত সে যা চায় সেইগুলো পাবেনা, আবার বাবাও জানত সে এসব কিছুই মন থেকে চায় না। যতদিন বাবা ছিলো রাজকন্যা ছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী কারন সে মন খুলে পুরো পৃথিবীটাই চাইতে পারতো।
একদিন সকালে হঠাৎ করেই বাবা তার স্বপ্নের পৃথিবীটাকে সাথে নিয়ে চলে গেলো না ফেরার দেশে।
বাবাকে ছাড়া যে কোনোদিন রাস্তা পাড় হয়নি, প্রতিবেলায় ১ মিনিট হলেও বাবার সাথে কথা না হলে যে অস্থির হয়ে যায়, প্রতিদিনের গল্পটা বাবাকে না বলা পর্যন্ত যার ঘুম হয়না বাবাকে ছাড়া তার জীবন কি কল্পনা করা যায়????
সবাই অস্বাভাবিক আচরন করলেও সে খুব স্বাভাবিক, তার মুখে হাসিটা আগের মতোই আছে। সবাই ভেবেছিলো সে বাস্তবতা কত সহজেই মেনে নিয়েছে। সেই হাসির কারনটা সবাই বুঝেছিলো কয়েক মাস পরে। সে হাসতো কারন সে বিশ্বাসই করতো না বাবা আর ফিরবেনা। ধিরে ধিরে মায়ের সাথে তৈরি হলো দূরত্ব কারন মা সবসময় তাকে বুঝাতে চায় তার বাবা সত্যিই আর ফিরতে পারবে না। সে কারো কথাই বিশ্বাস করতো না।
কলিংবেল বেজে উঠলে দৌড়ে যেতো বাবা এসেছে ভেবে। ৬ মাস বাড়ির বাইরে সূর্যের আলো দেখেনি যদি সে বাহিরে যায় আর বাবা বাসায় ফিরে তাকে দেখতে না পায়। জীবনে প্রথম বুঝতে শিখলো সত্যিই মৃত্যুর পরে আর কেউ ফিরে আসেনা।
যেই মেয়েটা জীবনে কোনোদিন একা বাড়ি থেকে বের হয়নি সে ধিরে ধিরে বুঝতে শিখলো এখন থেকে তার সবকিছুই একা করতে হবে। কিভাবে যেনো হঠাৎ করেই সে বড় হয়ে গেলো, যে কোনোদিন কারো সাথে তেমন একটা কথা বলতো না সে প্রতিবাদ করতে শিখে গেলো। যার ঘুম সহজে ভাঙতোনা বলে বাবা তাকে ঘুমের রানী বলে ডাকতো সে নাকি এখন খুব কম ঘুমায়।
জীবনের লক্ষ্য ও স্বপ্ন যাদের বিসিএস তাদেরকে সাধারণত অন্য কিছু সহজে আকৃষ্ট করতে পারে না। ২০১৬ সালে শখের বসে অবসরে শুরু করা একটা উদ্যোগ থাকলেও সেটা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী কোনো পরিকল্পনা কখনোই ছিলো না। তারপরেও লকডাইনে সব পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হওয়ায় যখন হতাশায় নিমজ্জিত ঠিক সেই মূহুর্তে ফ্রেন্ডলিষ্টের কারো একজনের প্রোফাইল পিকচারের একটা ব্যানারে চোখ আটকে গেলো। সেখানে লেখা ছিলো.....
"কিছুটা মেনে ও খানিকটা মানিয়ে চলতে পারা বিরাট যোগ্যতা।"
কথাটা বারবার ভাবিয়েছিলো। ব্যানারটা আবার ভালো করে দেখার পর চোখে পড়লো একপাশে লেখা "নিজের বলার মতো একটা গল্প" লোগো ও নামটা আমার পরিচিত কারন গ্রুপটায় আমি ২০১৯ এ কোনোভাবে যুক্ত হয়েছিলাম। কিন্তু বিসিএস প্রেমের কারনে কখনো আবার লিভও নিয়ে নিয়েছি। আবারও নতুন করে যুক্ত হয়ে প্রথমেই এ্যাডমিনের পোষ্টগুলো পড়তে শুরু করলাম।
একটা সেশন পেলাম সেখানে বলা হয়েছে রেগে গেলে ১০ মিনিট ভেবে উত্তর দেওয়া উচিত। এই সেশনটি আবারও আমাকে ভাবালো কারন আমি অল্পতেই খুব বেশী রেগে যাই। আর তখন না ভেবেই উত্তর দিয়ে দেই। সেইদিন থেকেই শুরু প্রিয় স্যারের কথা মেনে চলার চেষ্টা।
স্যারের সেশনগুলো আমাকে সবসময় আমার বাবার কথা মনে করিয়ে দেয়। যখন থেকে মানিয়ে নেওয়া এবং রেগে গেলে বিষয়টা নিয়ে আবারও ভাবতে শুরু করেছি তখন থেকে আমার মানসিক চাপ কমতে শুরু করেছে।
#আমি নিজেকে সবসময় রাজকন্যা ভাবতেই ভালোবাসি। রাজপ্রাসাদ থাকুক বা নাই থাকুক প্রতিটা মেয়েই তার বাবার রাজকন্যা। বাকি সবার কাছে আমি কে সেটা জরুরি না, বাবা না থাকলেও তার রাজ্যে আমি তো এখনও রাজকন্যাই আছি।
#নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মনে করি। কারন ২ জন ভালো বন্ধু পেয়েছি। আর সেই দুইজন বন্ধু হচ্ছেন আমার বাবা মা। অন্যান্য বন্ধুরা শুধুমাত্র বন্ধুই ছিলো কিন্তু এই দুইজন বন্ধুর সাথে সাথে আমার সবচেয়ে বড় সমালোচক ছিলেন যা প্রতি মূহুর্তে আমাকে সহায়তা করেছে নিজেকে শুধরাতে। তাই বাহিরের অন্য কোনো সমালোচকের সমালোচনায় আমার কখনোই কিছু যায় আসেনা।
#যখন আশেপাশের মানুষগুলোকে দেখি তাদের পুরো পৃথিবীটাই তাদের কাছে আছে তখন মাঝে মাঝে নিজেকে খুব দুর্ভাগ্যবান মনে হয়। কারন সৃষ্টিকর্তা তো অনেক আগেই আমার অর্ধেক পৃথিবীটা ফেরত নিয়েছেন। স্বান্তনা পাই এই ভেবে যে কারো কারো তো পুরো পৃথিবীটাই থাকে না আমার তো এখনও অর্ধেক আছে।
( বাবা+ মা= পুরো পৃথিবী )
#বাবা না থাকায় যেই প্রশ্নটা প্রতিনিয়ত শুনতে হয় সংসার খরচ চলে কিভাবে?? এই লেইম প্রশ্ন করা মানুষ গুলোকে সবসময়ই জীবন থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করি। কারন বাবার অবর্তমানে যেই সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হতে হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে ছোট সমস্যা হচ্ছে অর্থনৈতিক সমস্যা। আর এই ছোট সমস্যা নিয়েই সবার এতো প্রশ্ন কেনো সেই উত্তরটা খুঁজে পাইনা।
#বাবার মৃত্যু অভিমানী রাজকন্যাকে শিখিয়েছে পৃথিবীতে রাগ অভিমান করা মানে শুধুই সময়ের অপচয়। আমরা যাদের উপর অভিমান করি তারা একবার না ফেরার দেশে চলে গেলে আফসোস করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।
#রাজকুমারের সাথে দেখা এখনো হয়নি জন্য তার ব্যাপারে কিছু বললাম না। যে বাবার রাজ্যে রাজত্ব করবে না, নিজের রাজ্য নিজেই গড়বে এমন রাজকুমারের সাথে যদি কখনো দেখা হয় আরেকদিন আপনাদের সেই রাজকুমারের গল্প শুনাতে আসবো।
"স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৯১৪
Date:- ২০/১২/২০২২ইং
এতক্ষন যেই রাজকন্যার গল্প পড়লেন তার পরিচয়টা জেনে নিন:
তামান্না রাবেয়া হক
ব্যাচ: ১৩
রেজিষ্ট্রেশন: ৫৭৫২৬
জেলা : নওগাঁ
বর্তমান অবস্থান : রাজশাহী
থানা : বোয়ালিয়া
সোশ্যাল মিডিয়া ফিডব্যাক টিম মেম্বার।
প্রমোশন টিম মেম্বার।
রাজশাহী ব্লাড ম্যানেজমেন্ট টিম মেম্বার।
24/7 লাইভ সাপোর্ট টিম মেম্বার।
পেইজ লিংক: https://www.facebook.com/hoimonty100/