জীবনের গল্প
বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম।🌿
আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু। আমি সর্বপ্রথম প্রশংসা করছি মহান রাব্বুল আলামিনের; যিনি আমাকে দিয়েছেন সুস্থ একটি জীবন, দিয়েছেন ধৈর্য শক্তি ও রক্ষা করে যাচ্ছেন সমস্থ পরিস্থিতিতে। দুরুদ ও সালাম বিশ্বমানবতার আইডল নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রতি। কৃতজ্ঞতা ও ভালবাসা আমার মা-বাবা ও নানা নানুর জন্য। যারা আমার নিরন্তন পথচলায় অক্সিজেনের মতো শক্তি ও সাহস জোগিয়ে থাকেন এবং ধন্যবাদ জানাই ভালোবাসার ফেরিওয়ালা, লাখো মানুষের শিক্ষক/মেন্টর জনাব ইকবাল বাহার জাহিদ স্যারকে; যিনি এতো বড় একটা সুন্দর পরিবার তৈরি করেছেন যেখানে আছে কেবল সবাই এক সাথে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা ও ভালো কাজ করার সুযোগ।
📣 আমি উম্মে সালমা।
নিজজেলাঃ ময়মনসিংহ।
বর্তমান অবস্থানঃ ময়মনসিংহ সদর।
শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ স্নাতোকোত্তর(রাষ্ট্রবিজ্ঞান), এল এল বি (অধ্যয়নরত)।
পেশাঃ প্রফেশনাল ফ্রিল্যাসিং।
শখঃ বইপড়া, নতুন কিছু শেখা, হাতের কাজ শেখা, রান্নাকরা, বাগানকরা , ভ্রমণ করা ।
👩আমার আমিঃ আমি একদম ঘরকোনো স্বভাবের মেয়ে। প্রয়োজন না হলে ঘর ছেড়ে বের হতে ইচ্ছা করেনা তাই বাসাটাকেই কাজের ক্ষেত্র বানিয়ে নিয়েছি ২০১৯ থেকে এবং সেইসাথে নিজের আশপাশটাকে সুন্দর রাখার প্রতিনিয়ত প্রচেষ্টা করে যাই ।
👨👩👧👧যেভাবে এই প্লাটফর্মে যুক্ত হওয়াঃ বিগত প্রায় ৭ বছরের পরিক্রমায় দেখেছি সম্পর্কের উঠানামা, শিখেছি নিজের সিদ্ধান্তে দৃঢ় হয়ে প্রয়োজনে একাই লড়ে যাওয়া, টিকে থাকব বলে প্রচেষ্টা করে যাওয়া। সময়ের সাথে সাথে জীবনের অদল বদল আমাকে যেমন পরিবর্তন করেছে তেমনি পরিণত হতে সাহায্য করছে। তাই প্রতিনিয়ত কিছু না কিছু শিখার জন্য প্রচেষ্টা করে যাই। এমনি এক প্রয়োজনের তাগিদে অনুভব করলাম নিজেকে প্রকাশ করার জড়তা কাটানো ও নেটওয়ার্কিং জরুরী । তাই যুক্ত হয়ে গেলাম একঝাঁক ভালমানুষের এত বিশাল পরিবারে 🙂
🌳🌳জীবনের গল্পঃ চাকুরীসূত্রে বাবা মাকে নিয়ে ঢাকায় থাকতেন। তাই আমার জন্ম ঢাকাতে হলেও জন্মস্থান আমার নানার বাড়ি ইশ্বরগঞ্জ। আমি আমার মা-বাবার প্রথম সন্তান। আমার জন্মের পর আমার মা প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং আমার দাদা-দাদী কেউ জীবিত ছিলেন না যার দরুন আমার ও মায়ের প্রায় দেড় বছর নানাবাড়ীতেই কাটে; তারপর আমরা আবার ঢাকায় চলে যাই।
একদিন কি হয় আমার বড় মামা মাকে না বলে আমাকে নিয়ে বাড়ী চলে আসে। নানার খুব আদরের নাতনি ও সবাই আমাকে পেয়ে খুবই খুশি কিন্তু আমার মা আমাকে না পেয়ে পাগলপ্রায় অবস্থায় ঢাকা থেকে বাড়ী আসে। মায়ের মুখে এই গল্প শুনেছি...তারপর যতবার মা বাবার কাছে যেতে চেয়েছে আমাকে ততবারই কেউনা না কেউ লুকিয়ে ফেলতো তাই মা ও আমার আর ঢাকা যাওয়া হয়নি।
মা বলেন- আমি ছিলাম বাবার কলিজা। তখনকার সময়ে যোগাযোগ মাধ্যম ছিল টেলিফোন আর চিঠিপত্র। আমি খুব করে যেদিনই বাবা আসবে বলে প্রতিক্ষায় থাকতাম সেদিনই বাবা চলে আসত। আমার বয়স যখন চার কি পাঁচ তখন আমাদের সংসারে আসে নতুন অথিতি। সবাই খুশি হলেও বাবার ছিল আমাকে নিয়ে শত চিন্তার সমাহার। আমার যত্ন ঠিক মতো হবে তো? আমি বড় হচ্ছি;গ্রামে আমার পড়ালেখা ঠিকমত হবে কি ইত্যাদি ইত্যাদি... তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে তার সাথে রাখবেন। মা ও সবাই প্রথমে আপত্তি করলেও শেষমেষ রাজী হয়। আর আমিও বাবাপাগল মেয়ে বলে কথা...
যাত্রা শুরু নতুন গন্তব্যে। উদ্দেশ্য ঢাকা হলেও যাত্রা বিরতিতে আমরা শেরপুর গেলাম। সেখানে আজকে রাতটা থেকে পরের দিন ঢাকায় যাব কিন্তু পরের দিন আমাকে তারা ছাড়তে চাইলেন না; বাবা আমাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রেখে ঢাকা গেল এবং কথামত সপ্তাখানেকের মধ্যে ফিরেও আসল কিন্তু তবুও বাবার সাথে যাওয়া আর হলো না। এবারও বাধা দিল- অত ছোট মেয়ে তুমি অফিস করবে নাকি মেয়ে সামলাবে তার থেকে ভাল এখানে থেকে প্রাইমারি টা শেষ করুক তারপর ঢাকা নিও ইত্যাদি, ইত্যাদি। যেহেতু তারা সম্পর্কে ছিলেন আমার মায়ের মামা তাই বাবা তাদের খুব সম্মান করতেন এজন্য এবারও তাদের আবদার ফেলতে পারেননি এবং সিদ্ধান্ত হলো প্রাইমারি শেষ করেই বাবার সাথে ঢাকা যাব। বাবা মায়ের অভাব যাতে না হয় তার জন্য সবরকম প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল। বলতে গেলে এক বিশাল পরিবার আমার।
বছরের শেষের কয়েক মাস আমার এভাবেই কেটে গেল । আম্মু ও সবাই বাসায় পড়ানোর সুবাদে আমাকে প্রাইমারী স্কুলের শুরুতেই স্যার ক্লাস টুতে ভর্তি করিয়ে নিল। বাবা তো অনেক খুশি- তার মেয়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছে। আমাকে প্রমিস করল আমি ভালভাবে ক্লাস ফাইভ পাশ করলে আমাকে একটা ঘড়ি এবং এস এসসি পাশ করলে একটা টিকলি উপহার দিবে 🙂 যথারীতি চার বছরের মধ্যেই ক্লাস রোল-২ নিয়ে আমি পঞ্চম শ্রেনীতে উঠে যাই।
ক্লাস ফাইভের প্রথম সাময়িক এর আগের কথা। এবার বাবার যাওয়ার মাসখানেক সময় পার হয়ে গেল তবুও আমাকে দেখতে আসছে না। অবশ্য তখন দেশের পরিস্থিতিও খুব একটা ভাল যেত না....ক’দিন পর পরই হরতাল অবরোধ- কিযে একটা অবস্থা। আচ্ছা যাই হোক- পরীক্ষার পর তো এমনিই দেখা হবে তাই মনযোগ দিয়ে পড়ছিলাম।
আমি স্কুলে যাওয়ার জন্য এমনিতেই প্রায় তৈরি হয়ে গেছি মাত্র চুলের একটা বিনুনি বাকি। হঠাৎ আমার ছোট মামা এসে আমাকে বলে- সালমা রেডি হ!
আমি মামাকে দেখে তো খুব খুশি কিন্তু মামার চোখেমুখে কেমন যেন মলিন ভাব। আমি বললাম আমি তো রেডিই; স্কুলে যাচ্ছি। বাধা দিয়ে বলে স্কুলে যেতে হবে না, বাড়ি যাবি। এমন কথা শুনে সবাই তো অবাক।
সপ্তাখানেক আগে পিজি হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ করে বাবাকে বাড়ি আনা হলেও টানা হরতাল থাকার কারণে আমাকে নিতে কেউই আসতে পারেনি। আমি বাড়ি গেলাম ঠিকই কিন্তু বাবার মৃত্যুর তিনদিন পর । বাবাকে আর দেখা হলো না শুধু তার কবর দেখতে যাওয়ার ভাগ্য হয়।
ধীরে ধীরে পটপরিবর্তন শুরু হলো। আমি শেরপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। মামারা আমাকে মাঝে মাঝে নিতে আসলেও প্রায় সময়ই আমাকে রেখে চলে যেত। অনেক উৎসাহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকলেও আমাদের মা-মেয়ের মধ্যের সাঁকোটা একসময় প্রায় ভেঙে গেল। বাবার শূন্যতা দখল করে নিল আমার নানা। আমাকে আদর করে ডাকত-বুড়িমা। আমিও বরাবরই বজায় রেখে চলেছি তাদের সম্মান, শিক্ষা, সংস্কার আদেশ-নিষেধ ও মর্যাদা। তবুও সময় বদলায়, জীবনের প্রয়োজনে জীবন বদলে যায়।
২০১৫ সালের অক্টোবর কি নভেম্বর মাস। প্রথমবার একা একা ৭০ মাইলের একটা জার্নি দিতে চলেছি...মিশন বাড়ী_ মায়ের উপর প্রচন্ড অভিমানের পাহাড় নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি, সেই সাথে মাকে দেখার ও একসাথে বেশকিছুদিন সময়কাটানোর তীব্র অভিপ্রায়। আমাকে দেখে মা তো খুব খুশি। মামারবাড়ী ও দাদারবাড়ী খুব দূরে না থাকায়- বাড়ীর সবার সাথে ও এতগুলো ভাইবোনদের সাথে বেশ আনন্দেই মুহূর্তগুলো কাটছে...সপ্তাখানেকের মধ্যে একটা আজব বিষয় খেয়াল করলাম; সবাই আমাকে যতটা কদর করছে ঠিক ততটাই মাকে অবহেলা করছে...কেন করছে ঠিক বুঝতে না পারলেও আরও কিছুদিন পর আবিস্কার করলাম –আমার আপনজনেরাই আমার মায়ের কড়া বিচারক। উঠতে বসতে চুন থেকে পান খসলেই বিচার আর বিচার। এমনকি আমার কাছেও নালিশ করার বাকি রইল না। এতদিনে মায়ের প্রতি জমে থাকা আমার সমস্থ ভুল গুলো ভাঙতে শুরু হলো...আগে যখন মাঝে মাঝে ২/৪ দিনের জন্য বাড়ী আসতাম তখন এতকিছু দেখার ও বোঝার ক্ষমতা আমার ছিলনা। আমি নিরপেক্ষ হয়ে বিষয়টা বুঝার চেষ্টা করলাম এবং শেষমেষ দেখলাম কোন দোষ না করেও মা দোষী। সত্যি বলতে আমার মা একঅর্থে দোষীই বটে--কারণ প্রয়োজনে যে প্রতিবাদ করা দরকার সেট প্রয়োগ করতো না ; সব দোষ নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিত আর তারাও বারবার খারাপ আচরণ করার শক্তি পেত। বিষয়টা আমি ঠিক মানতে পারছিলাম না আবার কি করব সেটাও বুঝে উঠতে পারছিলাম না। প্রায় তিন মাস বাড়ি থাকার পর শেরপুর গেলাম এবং সেখানে এই পরিস্থিতির কথা তুলে ধরলাম কিন্তু তারা কেউই আমার কথা মানতে রাজি না। বুঝলাম আমার জানা সত্য-মিথ্যার কোন মূল্য এখানে নেই; সেই সাথে আরও বুঝলাম স্বামীছাড়া মেয়েদের মূল্য নেই। নিজের সংসারে থেকেও যৌথ পরিবারের সমস্থ দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে বিনিময় দোষ না করেও দায়গ্রহণ করে নিতে হবে,নিজেকে প্রকাশ করা তো বহুদূরের কথা।
আনন্দমোহনে মাস্টার্সে ভর্তি হলাম এবং ময়মনসিংহে চলে আসলাম। বাড়ী,শেরপুর আর ময়মনসিংহে একযোগে যোগাযোগ ও যাতায়াত করা শিখলাম একা একাই। তখন ভাবতে অবাক লাগত যে মেয়েটা অনার্সে পড়া অবধি রাস্তা পাড় হওয়ার জন্য তার বাবাই এর হাতটা ধরে চলত আজ সে একা একা চলতে শিখে গেছে।
১৫ মার্চ ২০১৬। প্রতি সপ্তাহে বাড়ি টু শেরপুর যাতায়াত করাটা বেশ কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল তাই সবার সম্মতিতে পুরোপুরিভাবে ময়মনসিংহে চলে আসলাম। তার দুই মাস পর আমার বোন আমার সাথে চলে আসল এবং নভেম্বরের দিকে মাকেও নিয়ে আসলাম। আমাদের খরচবাবদ মা আমাকে তখন প্রায় ছয় লক্ষ টাকা তুলে দিলেন । এখন আমরা সবাই ময়মনসিংহে তবুও আমার শূণ্যতা আর ঘুচল না। যাতায়াত দূরত্ব এখন আগের থেকে কমেছে তাই প্রতি সপ্তাহে শেরপুর যাই ২-৩দিনের জন্য আর ময়মনসিংহে থাকি ৪-৫দিন। সাথে আমার শখের গ্রাফিক্স ডিজাইন শেখা, জব কোচিং এবং পড়ালেখা। সবদিক ব্যালেন্স করতে গিয়ে দেখা দিল আমার হরমোনাল ডিজব্যালেন্স। লাখে একজনের এমন সমস্যা হয় তাই ডাঃ এর কড়া নির্দেশ কোন অবস্থাতেই শারিরীক ও মানসিক স্টেস নেওয়া যাবে না। তখন মনে হয়েছিল—কি দরকার এতকিছু করে বেঁচে থাকাটাই তো বড় কথা। প্রায় বছরদুই চিকিৎসা করার পর আলহামদুলিল্লাহ আমি সুস্থ্য হলাম। সেই সাথে নিজের ভাললাগা ও না লাগা গুলোও আরও ভালভাবে বুঝতে পারলাম। নিজের শখটাকেই ক্যারিয়ার হিসেবে স্থির করলাম। আর এভাবেই জীবনের পথে হেটে হেটে নিজেকে ও প্রয়োজনগুলোকে চিনতে ও জানতে শিখছি প্রতিনিয়ত। আর একদম শূণ্য থেকে শুরু করা এই মেয়েটার জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি- মায়ের দোয়া ও বাবার ভালবাসা। এতক্ষণ ধৈর্য নিয়ে আমার গল্প পড়ার জন্য সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশাকরি আমার ভাষাগত ও শব্দগত ভুলত্রুটি গুলো সবাই ক্ষমাসুন্দর ভাবে নিবেন।