ধাপে ধাপে বার বার ব্যর্থ হয়ে অবশেষে আমার উদ্যোক্তা জীবন থেকে ফিরে আশার গল্প।
আমার জীবনের গল্প
মৃত্যুর সামনে থেকে আল্লাহর রহমতে ফিরে আসার গল্প
উদ্যোক্তা জীবন শুরু করে ব্যর্থ হওয়ার গল্প
প্রিয় প্লাটফর্মে যুক্ত হয়ে স্বপ্ন সাজানোর গল্প
পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া কাহিনির নামই "জীবনের গল্প" আর এই জীবনের গল্প নামক বইটা বড়ই অদ্ভুত।
আপনি পৃথিবীর যে কোনো লাইব্রেরিতে কোনো বই কিনতে গেলে শুধু বইয়ের নাম টা বললেই আপনাকে বইটা দিয়ে দিবে কিন্তু যখন আপনি " জীবনের গল্প"নামের কোনো বই কিনতে যাবেন তখনই আপনাকে নাম মেনশন করে বলতে হবে যে অমকের জীবনের গল্পের বইটা দেন, তাইনা? কারণ বইয়ের নাম এক হলেও গল্প গুলা ভিন্ন ভিন্ন, একটা বইয়ের গল্পের সাথে আরেকটা বইয়ের গল্প কখনোই মিলবেনা। বইয়ের নাম এক কিন্তু গল্প গুলা ভিন্ন ভিন্ন কি অদ্ভুত,তাইনা?
আমার কাছে মনে হয়,"জীবনের গল্প" একটা অদ্ভুত বইয়ের নাম।
তো আজকে আমার জীবনের গল্প নামক অসমাপ্ত বইটা থেকে কিছু অংশ আপনাদের সাথে শেয়ার করছি.......
----------- বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম -----------
আসসালামু আলাইকুম!
আশা করছি মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে সকলেই ভালো আছেন।আমিও ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ।
শুরুতেই মহান আল্লাহর প্রতি হাজারো শুকরিয়া এবং কৃতজ্ঞতা,যিনি আমাদেরকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন দান করেছেন এবং এখনো সুস্থ রেখেছেন আলহামদুলিল্লাহ।
এরপর শ্রদ্ধা ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা আমার বাবা মায়ের প্রতি যারা আমাকে খুব যত্নে বড় করেছেন এবং এখনো তাদের মায়া মমতার ছায়াতলে আগলে রেখেছেন। সবার কাছে আমার বাবা মায়ের জন্য দোয়া চাই,আল্লাহ যেন আমার বাবা মাকে নেক হায়াত দান করেন এবং সুস্থ রাখেন।
তারপর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি আমাদের সকলের প্রিয় মেন্টর জনাব Iqbal Bahar Zahid স্যারের প্রতি।যার জন্য আমরা পেয়েছি একটা ভালো মানুষের পরিবার এবং ভালো মানুষ হয়ে সুন্দর জীবন গড়ে তোলার বিশাল পাঠশালা।
আরও কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই এই পরিবারের সকল দ্বায়িত্বশীল এবং আজীবন সদস্যদের প্রতি।
যারা আমার ভিতরের আমিটাকে প্রতিনিয়ত বাহিরে বের করে নিয়ে আসছে। আজকে আপনাদের সাথে আমি আমার জীবনের গল্প শেয়ার করছি।
আমার পরিচয়:
আমার নাম মো:শিহাব উদ্দিন। আমার জন্ম নব্বই দশকের একেবারেই শেষ দিকে টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার নবগ্রাম গ্রামে নানার বাড়িতে। তিন ভাই বোনের মধ্যে আমি ২য় এবং বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে।আমার বাবা একজন মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং মা একজন গৃহিণী।
শৈশবকাল:
জন্মের পর থেকেই আমার বেড়ে উঠা গ্রামে। আমাদের গ্রামের নাম চানপুর গ্রাম। এটা টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার নগদা শিমলা ইউনিয়নে অবস্থিত। আমাদের গ্রামের গঠন হলো, পুরো গ্রামেই পাশাপাশি সবার বাড়ি, গ্রামের রাস্তার পাশে সবারই গরুর গোয়াল ঘর,তার সামনে সবার বাহির বাড়ি, তার সামনে সবারই থাকার ঘর, তার সামনে সবারই উঠোন, তার সামনেই সবারই বাঁশ ঝার এবং তার পরেই পুরো গ্রাম জুড়ে ছোট নদী।এই নদী এবং সামনের রাস্তা আমাদের পুরো গ্রামটাকে রেললাইনের মত ধরে রেখেছে।
আমার গ্রামে আমার সমবয়সী অনেক ছেলেরা রয়েছে।সবার পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় ঘুম থেকে উঠেই সকলের সাথে দেখা হতো।আমরা সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত বিভিন্ন খেলাধূলার মাধ্যমেই হাসি ঠাট্টায় দিন কাটাতাম।
রোজার দিনে ইফতার নিয়ে বাহিরবাড়ি এসে সবাই মিলে আড্ডা দিতে দিতে ইফতার করা আমার শৈশব কালের এক সেরা স্মৃতি।
এভাবেই হাসি খুশি ভাবেই কেটেছে আমার শৈশব।পরিবারে অভাব তেমন ছিল না।কিন্তু তারপরও চাচাদের সাথে যৌথ পরিবারে থাকায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে কষ্ট করতে হয়েছে।যেমন: ঈদে নতুন কাপড় কেনা,স্কুলে নতুন ব্যাগ, নতুন ড্রেস নেয়া ইত্যাদি।
তারপরও শৈশব জীবনের জন্য আলহামদুলিল্লাহ।
শিক্ষাজীবন:
আমার মা একজন মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ছিলেন এবং ধার্মীক একজন মানুষ। তাই আমার মা আমার জন্মের পর আমার নাড়ি (অমরা বা গর্ভফুল) মাদ্রাসার মাঠে পুঁতে ছিলেন যাতে আমি মাদ্রাসায় পড়তে পারি এই ভেবে।(যদিও এটা কুসংস্কার)
যখন আমার ৫ বছর বয়স হলো তখন স্কুলে ভর্তি করাবে।আমার আশে পাশের চাচাত ভাইয়েরা তখন কিন্ডার গার্টেনে ভর্তি হয়।আর ঐ সময় কিন্ডার গার্টেন আমাদের উপজেলায় অনেকটা নতুন। তাই সবার পরামর্শে কিন্ডার গার্টেনের পড়া শুনার মান অনেক ভালো শুনে আমাকেও কিন্ডার গার্টেনে প্লে গ্রুপে ভর্তি করিয়ে দেয়।
আমাদের গ্রাম থেকে স্কুলে স্কুল ভ্যান যেত।খুব ভোরে উঠে টিফিন রেডি করে দিতে হতো। একটু দেরি হলেই ভ্যান চলে যেত। কোন দিন যদি দেরির কারণে স্কুল মিস করতাম সেইদিন অনেক কান্নাকাটি করতাম স্কুলে যেতে না পারার কারণে।
কখনো যদি নানু বাড়ি যেতাম তখনও স্কুলে না যেতে পারার কারণে কান্নাকাটি করতাম।তাই আমার মামা আমার নানুবাড়ি এলাকার স্কুল ভ্যানে তুলে দিয়ে আসত।
এভাবেই আমার কিন্ডার গার্টেন থেকে প্রাইমারী জীবন শেষ হয়।
তারপর ৫ম শ্রেণি পাশ করে ২০১১ সালে ভর্তি হই আমাদের গোপালপুরের সবচেয়ে বড় এবং নামকরা হাইস্কুল, সূতী ভি. এম. পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে আমরা প্রায় ৩৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হই।সেকশন নির্ধারণের জন্য আমাদের সেখানে একটা পরীক্ষা নেওয়া হয়।পরীক্ষায় আমার পজিশন হয় ১১৯. আর আমি খ সেকশনে পড়ার সুযোগ পাই।(প্রতি সেকশনে ৬০ জন করে স্টুডেন্ট ছিল)। তারপর বিভিন্ন উত্থান পতনের মাধ্যমে ২০১৬ সালে ঐ স্কুল থেকেই এসএসসি পাশ করি।
এসএসসি পাশ করার পর আমাদের স্কুলের মেক্সিমাম স্টুডেন্টই ইন্টারমিডিয়েট পড়ার জন্য উপজেলার বাহিরে বিভিন্ন জেলা শহর,বিভাগীয় শহরে চলে যেতে থাকে। তাদের সাথে সাথে আমিও আমার বেশ কিছু বন্ধুদের সাথে ভর্তি হই নটরডেম কলেজ ময়মনসিংহে। এসএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া তেমন জোর দিয়ে করতাম না। মুটামুটি হোমওয়ার্ক গুলো করার চেষ্ঠা করতাম।কিন্তু কলেজে ভর্তি হওয়ার পর দেখলাম লেখাপড়ার অনেক প্রেশার। কলেজে ৮ টা থেকে ক্লাস। ক্লাসের পর আবার ল্যাব ক্লাস।সপ্তাহে ২ দিন কুইজ পরীক্ষা। বিকালে আবার প্রাইভেট।সব মিলিয়ে সারাদিন অনেক ব্যাস্ত সময় যেত। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে যখন ক্লান্ত শরীর নিয়ে পড়তে বসতাম।টেবিলেই ঘুমিয়ে যেতাম।কলেজ লাইফের ২ বছরে যে কত রাত টেবিলে ঘুমিয়েছি তার হিসাব নেই।
এভাবেই অনেক কষ্ট করে ২০১৮ সালে নটরডেম কলেজ ময়মনসিংহ থেকে এইচ এস সি পাশ করি।
তারপর এডমিশন টাইমে বিভিন্ন চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ভর্তি হই বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ব বিদ্যালয় অধিভুক্ত শেখ কামাল টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ঝিনাইদহে ।যেখানে বর্তমানে অধ্যয়নরত আছি।
একাডেমিক রেজাল্ট:
আমি তেমন ভালো ছাত্র ছিলাম না কখনোই।
সব সময়ই মধ্যম ক্যাটাগরির ছাত্র ছিলাম।
PSC: GPA-5 (সাধারণ গ্রেড বৃত্তি)
JSC: GPA-5 ( গোল্ডেন প্লাস, টেলেন্টপুলে বৃত্তি + উপজেলায় ৬ষ্ঠ পজিশন)
SSC: GPA-5 ( গোল্ডেন প্লাস,সাধারণ গ্রেড বৃত্তি)
HSC:GPA-4.58
JSC এবং SSC তে বেশি ভালো করার কারণ ছিল পাবলিক পরীক্ষায় স্যারদের কিছুটা সহযোগিতা।ঐ সময়ে ছাত্রদেরকে স্কুলের স্যাররা পরীক্ষায় সহযোগিতা করত।
মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে আসার গল্প:
আমি যখন ৪র্থ শ্রেণীতে পড়ি, তখন কিন্ডার গার্টেনে পড়তাম।সকালে ৮-১ টা পর্যন্ত ক্লাস আবার বিকালে ৩ টা থেকে সন্ধা পর্যন্ত কোচিং।বাড়ি থেকে স্কুলে তখন সাইকেল দিয়ে যাতায়াত করতাম।আমার একটা লাল হিরো সাইকেল ছিল।আমি আগেই বলেছি আমাদের গ্রামের পিছনের দিক দিয়ে বয়ে গেছে ছোট একটি নদী।তখন বর্ষা কাল। নদীতে অথৈ পানি।আর গ্রামের সবাই নদীতে ঐ সময় জাল পেতে মাছ ধরতো। আমিও বাড়ির পিছনে ছোট একটা জাল পেতেছি। যেটাকে গ্রামের ভাষায় আমরা বলি ছিপজাল।মাছ ধরার সময় সেটাকে পানিতে ফেলতে হয়।কিছুক্ষণ পর জাল উঠালেই মাছ উঠে।
যাই হোক, আমাদের গ্রামে তখন কারেন্ট ছিল না।নদীর ঐপারে আমাদের জমিতে সেচ দেওয়ার মোটর ছিল।সেই মোটর এর মিটার থেকে নদীর উপর দিয়ে বাশেঁর খুটিতে তার বেঁধে বেঁধে বাড়িতে কারেন্টের লাইন আনা হয়েছিল। আর সেই লাইন আমরা সহ বাড়ির আশেপাশের কয়েকটি বাড়ির লোকজন চালাইতাম।
নদীর উপর দিয়ে আনা লাইনের কারেন্টের তারের সাপোর্ট /আর্থিং হিসেবে ব্যাবহার করা হয়েছিল জিয়াই তার /গুনা।যেটার উপরে কোন অন্তরক প্রলেপ ছিল না।যদিও কারেন্টের তারের উপর রাবারের প্রলেপ আছে।
প্রায় বছর খানিক হওয়ায় এবং বর্ষাকাল হওয়ায় ঐ জিয়াই তার মরিচা ধরে মাঝে মাঝে ভেঙ্গে যায় এবং এর একটা অংশ তারের সাথে পেচিয়ে কারেন্ট হয়ে নদীর পানির উপর ঝুলে থাকে। কিন্তু পানিতে স্পর্শ করে নাই। আর যেটা ছিল আমার বসানো জালের একটু সামনেই।
আমি স্কুল শেষ করে ১ টার দিকে বাড়িতে আসি। আর সাথে সাথে গোসল করার করার জন্য দৌড়ে চলে যাই নদীতে। গোসল করতে যেয়ে আমার ছোট জাল টা ফেলি।কিন্তু কোন মাছ উঠতে ছিল না।আমাদের একটা ধারণা ছিল জালের সামনে গাছের ডাল, বাঁশের কঞ্চি এগুলো দিয়ে একটু ঝোপের মত করে দিলে সেখানে মাছ আসে। তাই আমি কয়েকটি ডাল নিয়ে জালের সামনে চলে যাই।যখনি লম্বা একটা ডাল নিয়ে পানিতে পুঁততে গেছি সাথে সাথে ঝুলে থাকা সেই কারেন্টের তার আমার শরীরে লেগে যায়।আর আমি পানিতে পড়ে যাই। আমাকে যখন কারেন্ট ধরে ফেলে তখন আমি বুঝতে পারি।ঐ মুহুর্তে আমার অনুভূতি হয়েছিল আমি আজকে মারা যাব।আর স্কুলে যেতে পারব না।খেলা ধূলা করতে পারব না।মনে হচ্ছিল আমি যেন নিচের দিকে ডুবে যাচ্ছি।কিছুক্ষণ পরেই আমি পানিতে অজ্ঞান হয়ে যাই। যেহেতু দুপুর বেলা, তাই নদীতে তেমন কোন লোকজন ছিল না।আমার বাবা মাও তখন বাড়িতে ছিল না। আব্বা স্কুলে ছিলো,আর আম্মা তখন আনন্দ স্কুলে চাকরী করত।তাই আম্মাও স্কুলে চলে গেছে।
একটু দূরেই আমার এক প্রতিবেশি মাছ ধরতেছিল।সে বিষয় টা খেয়াল করে। আমি গোসল করতে এসে আর পানি থেকে উঠতেছি না।আমাকে আর দেখা যাচ্ছে না।তাই সে ডাকাডাকি করে। ডাক শুনে আমার এক চাচাত ভাই দৌঁড়ে আসে। হাতের কাছে কিছু না পেয়ে সে কাঁচা একটি গাছের ডাল দিয়ে কারেন্টের তার ছাড়াতে যায়।সাথে সাথে সেও বিদ্যুতায়িত হয়ে পানিতে পড়ে যায় এবং অজ্ঞান হয়ে যায়।
পরে আরো লোকজন আসে।ডাকা ডাকির এক পর্যায়ে নদীর ঐ পাড় থেকে একজন গিয়ে মেইন সুইচ খুলে দেয়।আমাকে বাঁচাতে গিয়ে আমার দুই চাচাত ভাই সহ আমরা তিনজন বিদ্যুতায়িত হই।
যেহেতু কারেন্টের তার ঝুলে ছিল।তাই বেশি সময় শরীরে লেগে থাকতে পারে নাই।বাতাসে নড়াচড়া করেছে এবং আমার শরীরে পুড়েছে।বুকে, পেটে এবং হাতে মোট তিন জায়গায় আমার পুড়ে যায়।
গ্রামের লোকেরা আমাকে এবং আমার চাচাত ভাইকে পানি থেকে তুলে এবং যার যার ঘরে সরিষার তেল আছে তা এনে শরীর ডলতে ডলতে হাসপাতালে নিয়ে যায়।গ্রামের মানুষের ভাষ্যমতে যখন শরীর ডলতে ছিল তখন পুড়া স্থান থেকে চামড়া উঠে আসতেছিল।
হাসপাতালে নেওয়ার পর সেলাইন দেওয়া হয় এবং রাতে আমার জ্ঞান ফিরে।জ্ঞান ফেরার পর আমি তাকিয়ে দেখি আমি হাসপাতালে। আমার চারদিকে আত্বীয় স্বজন সহ অনেক মানুষ এবং পাশে আম্মা কান্না করতেছে।
ঐ মুহুর্তটা আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কখনোই ভুলতে পারব না।
গ্রামের সকলেই সহযোগিতায় এবং আল্লাহর রহমতে আমি জীবন ফিরে পেয়েছি।তাই ঐ মূহুর্তে আমি প্রতিজ্ঞা করি যতদিন বেঁচে থাকব মানুষের জন্য কাজ করব, মানুষের উপকারে নিজেকে বিলিয়ে দিব।
পরবর্তীতে ২০১৮ সালে আমি গ্রামের তরুণদের নিয়ে একটি সামাজিক সেবামূলক সংগঠন সূচনা করি।যার মাধ্যমে এখনো গ্রামের মানুষের সেবা করে যাচ্ছি।
উদ্যোক্তা জীবন শুরু করে ব্যার্থ হওয়ার গল্প:
ছোট বেলায় যখন খেলারছলে কলাপাতার ছাওনি দিয়ে ছোট দোকান বানিয়ে ১ টাকা ২ টাকা দিয়ে চকলেট,চানাচুর আচার বিক্রি করতাম,তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতাম আমি বড় হয়ে একজন উদ্যোক্তা হবো। যদিও তখন উদ্যোক্তা শব্দটার সাথে পরিচিত ছিলাম না।
আমার হাতে যখন মোবাইল আসে তখন থেকেই আমি ইউটিউবে সার্চ করে করে বিভিন্ন উদ্যোক্তাদের গল্প শুনতাম।তাদের সফলতার গল্প শুনতাম।তখন আমার উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নটা আরও প্রবল হতে থাকে।
২০১৪/১৫ সালের দিকে অনলাইন বিজনেস এতটা জনপ্রিয় ছিল না।তখন অফলাইন উদ্যোক্তাদের গল্পই বেশি শুনতাম।সেই সময়ে মুরগীর খামার, পুকুর লিজ নিয়ে মাছ চাষ করার পরিকল্পনা করেছি।কিন্তু বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। সর্বশেষ যখন ২০২০ সালে করোনা মহামারী আসে, তখন কলেজ বন্ধ হয়ে যায়।তখন আমি টেক্সটাইল কলেজ পড়ি( বর্তমানেও পড়ছি)। বাড়িতে গিয়ে কিছু ছাত্র পড়ানো শুরু করি।কিন্তু স্কুল বন্ধ থাকায় সেটা কিছুদিন পর বন্ধ হয়ে যায়।
আমার কোন মতেই বাড়িতে বসে থাকতে ভালো লাগছিল না।তখন ফেইসবুকে দেখতাম অনেকে অনলাইনে বিজনেস করছে। আমার এক বন্ধুও শাড়ি, চাদর নিয়ে বিজনেস করছিলো। তখন ওর কাছ থেকে কিছুটা পরামর্শ নেই।
আমার কাছে টিউশনির ৭-৮ হাজার টাকা ছিল।আমি সেই টাকা নিয়ে সাথে সাথে ঢাকা চলে যাই।ঢাকায় সদরঘাট,গুলিস্থান ঘুরে ঘুরে কিছু কাপড় কিনি।কাপড় কিনে এনে সেগুলো বাড়ির আশে পাশে দুই একটি করে বিক্রি করতে থাকি।অনলাইনে কোথায় সেল করব সেটা তখন আমি জানতাম না।ফেইসবুকে এক দুইটা পোস্ট করলাম।কিন্তু কোন সেল হচ্ছে না।তাই সেই কাপড় নিয়ে শহরে/ বিভিন্ন হাটে ফুটপাতে নিয়ে যাই।কিন্তু যেই এক দুইটা সেল হয় তা দিয়ে রিকশা ভাড়ার টাকাই হয় না। ফুটপাতে বসে থাকতে অনেক লজ্জা লাগতো।কারণ শহরে অনেক মানুষ আমাকে চিনত।যখন কোন পরিচিত মানুষ, স্যার,বন্ধু,বান্ধব আসতো সাথে সাথে আমি দৌঁড়িয়ে লুকানোর চেষ্ঠা করতাম।
এইভাবে কয়েকদিন ফুটপাতে বসলাম। কিন্তু তেমন সেল হলো না।সর্বশেষ কাপড়গুলো নিয়ে একটা ওয়াজ মাহফিলের মেলায় দোকান দিলাম।সেখানে অল্প কিছু সেল হলো।মেক্সিমাম কাপড়ই রয়ে গেল।প্রায় পুরেটাই লস হলো।আমার কাপড়ের আইটেম গুলো ছিল শীতের কিছু হুডি,বাচ্চাদের গেঞ্জি, পায়জামা, জগার্স,মেয়েদের প্লাজু,টপস,কিছু গেঞ্জি এই টাইপের।
বাড়িতে কোন ক্রমেই আমার ভালো লাগছিলো না।বাবা মায়ের সাথে স্বাভাবিক বিষয় নিয়ে রাগারাগি করতাম।
তখন আমার কিছু বন্ধু কলেজ বন্ধ থাকা অবস্থায়ও ঝিনাইদহ শহরে (যেহেতু আমি ঝিনাইদহ পড়াশুনা করি) মেস ভাড়া নিয়ে থাকত।তখন মনে মনে স্থির করলাম আমি ঝিনাইদহ চলে আসব এবং মেসে থেকে টাঙ্গাইলের শাড়ি নিয়ে আবার বিজনেস শুরু করব।কিন্তু কলেজ বন্ধ থাকায় আব্বা কোন ক্রমেই আমাকে ঝিনাইদহ আসতে দিবে না।আর ঐ সময়ে আমাদের সাংসারিক কিছু কাজের চাপ ছিল।
কিন্তু আমার ত বাড়িতে বসে থেকে আর ভালো লাগছে না।আমি আব্বা আম্মার সাথে ঝগড়া করতে লাগলাম।সর্বশেষ ঝগড়া করে বাড়ি থেকে ঝিনাইদহ চলে আসি। আসার সময় আম্মাকে বলে আম্মার ব্যাংক থেকে উঠানো টাকা থেকে ৮ হাজার টাকা নিয়ে আসি টাঙ্গাইলের শাড়ি কিনার জন্য।
ফেইসবুকের মাধ্যমে এক লোকের সাথে পরিচিত হয়ে আমি টাঙ্গাইলের বল্লা যাই শাড়ি কিনার জন্য। সেখানে তাঁতিরা ৬ পিস ছাড়া পাইকারি দেয় না।তাই আমি ৬ পিস করেই নেই। কিন্তু ৬ পিসের মধ্যে ২ -৩ টা কালার এমন থাকে যেগুলো অনলাইনে বিক্রি করার মত না। সেখান থেকে ৮ হাজার টাকার শাড়ি কিনি। আমার শাড়ি গুলো ছিল একটু বয়স্ক মানুষের জন্য এই টাইপের। এই শাড়িগুলো নিয়ে ঝিনাইদহ চলে আসি।
ঝিনাইদহে এসে আমি ফেইসবুক হতে আমাদের এই প্রিয় "নিজের বলার মত একটা গল্প ফাউন্ডেশনের" দেখা পাই।
তখন ১৩ তম ব্যাচ চলতেছিল। সাথে সাথে রেজিস্ট্রেশন করে ফেলি। ১ টা ব্যাচ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেল পোস্ট দেওয়া যাচ্ছিল না।তাই শাড়ি গুলো পোস্ট করতে পারতেছিলাম না। যেহেতু বাড়ি থেকে রাগ করে চলে এসেছিলাম তাই বাড়ি থেকে টাকাও চাইতে পারতেছিলাম না।করোনার মধ্যে টিউশনিও পাচ্ছিলাম না। শাড়ি গুলো বিক্রি করতে পারছিলাম দেখে ইনস্ট্যান্ট লাভের আশায় তখন প্লান করলাম ফুটপাতে টি-শার্ট বিক্রি করব।
দুইজন বন্ধুর কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা ধার করে চলে গেলাম কুষ্টিয়ার পোড়াদহ টি-শার্ট কিনার জন্য।সেখান থেকে টি-শার্ট কিনলাম। কিন্তু ফুটপাতে বিক্রি করতে গিয়ে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারি না।লজ্জা লাগে।আবার করোনার সময় তাই মানুষ জনও কম। ২-২:৩০ ঘন্টা বসে থেকে চলে আসি।কোনদিন ২-৩ টা বিক্রি হয়। কোন দিন একটাও বিক্রি হয় না।লাভের টাকা দিয়ে রিকশা ভাড়াও হয় না। এখানেও মাঝে মাঝে পরিচিত মানুষজন, স্যাররা চলে আসে।তাদের দেখে দৌঁড়ে পিছনে চলে আসি আমি।এই ভাবে কয়েকদিন ফুটপাতে যাওয়ার পর সেটাও বাদ দেই।এখানেও প্রায় পুরোটাই লস।
কিছুদিন পর রমজানের ঈদের সামনে আমরা ৩ জন বন্ধু মিলে প্লান করি পার্টনারশীপে বিজনেস করব।
কিন্তু আমাদের হাতে কোন টাকা ছিল না।তখন আমরা বিভিন্ন ব্যাংকে ঘুরতে থাকি স্টুডেন্ট লোন করার জন্য।কিন্তু কোন ব্যাংকই আমাদের টাকা দেয় না।তখন আমি আমার গ্রাম থেকে একজনের কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা ধার নিয়ে আসি।আরেক বন্ধু নিয়ে আসে ১০ হাজার টাকা। এই মোট ২৫ হাজার টাকা আমাদের নতুন বিজনেসের মূলধন।আমরা গুগল ঘাটাঘাটি করে একটা নাম ঠিক করি, পেইজ খুলি,পেইজ বুস্ট করি, শপিং ব্যাগ বানাই।আমরা প্রথমদিকে পাঞ্জাবী দিয়ে শুরু করি।যেহেতু ঈদের আগে এবং ঢাকা থেকে ঝিনাইদহের দূরত্ব অনেক বেশি। তাই যাতায়াত খরচ বেশি পড়ে যাবে বিধায় আমরা ইউটিউবে বিভিন্ন প্রমোটিং ভিডিও দেখে, সরাসরি না গিয়ে কুরিয়ারে প্রোডাক্ট সংগ্রহ করি।যেটা ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল।
আমরা পেইজে প্রচার চালাতে থাকি। ফাউন্ডেশনে সেল পোস্ট করি।কিন্তু এক্টিভিটি কম থাকায় পোস্ট তেমন রিচ হয় না।তাই সেল ও তেমন আসে না।আমাদের আরেকটি বড় সমস্যা ছিল, না দেখে প্রোডাক্ট নেওয়ার কারণে প্রোডাক্টের মান যেমনটা আশা করেছিলাম তেমন হয় না।আর দামও অনেক বেশি পড়ে যায়।সব মিলিয়ে অল্প কিছু প্রোডাক্ট সেল করতে পারি।আর পুনরায় ঢাকায় যেয়ে নতুন প্রোডাক্ট আনা হয় না। এখানেও বড় ধরনের একটা লস হয়।
তারপর চিন্তা করি এভাবে আর বিজনেস হবে না।ফ্রিল্যান্সিং শিখে ঘরে বসে ফ্রিল্যান্সিং করব। ফ্রিল্যান্সিংয়ের ব্যাপারে ততদিনে অনেকটাই ঘাঁটাঘাঁটি করে ফেলেছিলাম। তাই আবারও টাকা ধার এনে ১২ হাজার টাকা দিয়ে ভর্তি হয়ে যাই ওয়েব ডেভেলপমেন্ট এর একটা কোর্সে।বেশ কিছুদিন সেখানে কন্টিনিউ করি।কিন্তু কেন যেন সেখানে আমার প্যাশন খুঁজে পাই না।সারাদিন বসে বসে অ্যাসাইনমেন্ট করা,ভিডিও দেখা, ক্লাস করা এগুলো ভালো লাগতেছিলো না।কোর্সটি অনেক লম্বা সময়ের হওয়ায় শেষ পর্যন্ত মোটিভেশন ধরে রাখতে না পেরে এটাও ছেড়ে দেই।
ধাপে ধাপে প্রায় ৫০ হাজার টাকা লস করে বার বার ব্যর্থ হয়ে অবশেষে আমার উদ্যোক্তা জীবন থেকে ফিরে আসি।
নিজের বলার মত একটা গল্প ফাউন্ডেশনে এসে আমার পরিবর্তন:
আমি প্রিয় প্লাটফর্মে রেজিস্ট্রেশন করেছিলাম ১৩ তম ব্যাচে।কিন্তু তখন বিজনেসে ব্যর্থ হয়ে বিভিন্ন কারণে হতাশ হয়ে ফাউন্ডেশনে কন্টিনিউ করা হয়নি।মেসেঞ্জার গ্রুপে যুক্ত ছিলাম, সেশন চর্চা ক্লাসের লিংক দেওয়া হতো, গ্রুপে বিভিন্ন পোস্টের নোটিফিকেশন আসত।কিন্তু সব সময় শুধু অ্যাভোয়েড করতাম। কখনো গুরুত্ব দিতাম না।কিন্তু ১৯ তম ব্যাচের শেষের দিকে হঠাৎ করে একদিন সেশন চর্চা ক্লাসে যুক্ত হই।যুক্ত হয়ে সবার কথা শুনে, স্যারের দেওয়া সেশন পড়ে আমার খুবই ভালো লাগে।এক কথায় আমি ফাউন্ডেশনের প্রেমে পড়ে যাই।
আমি তারপর থেকে প্রতিনিয়তই সেশন চর্চা ক্লাসে যুক্ত হতে থাকি। অনলাইন, অফলাইন মিটআপ গুলোতে যুক্ত হওয়ার চেষ্ঠা করি।আমার ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্ন আবার জোড়া লাগতে থাকে।আমি বার বার হেরে যাওয়ার কারণ গুলো প্রতিটি সেশনের মাধ্যমে খুঁজে পেতে থাকি।আমার পূর্বের উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার বড় কারণ ছিল, না বুঝে,না শিখে বিজনেস শুরু করা,প্রোডাক্ট নির্বাচনে ভুল করা,মূলধন কালেক্ট করতে ভুল করা, নেটওয়ার্কিং এর অভাব,পণ্য সোর্সিংয়ের অভাব, লেগে থাকতে না পারা ইত্যাদি।ব্যাপার গুলো প্রতিটি সেশনের মাধ্যমে আমার কাছে ক্লিয়ার হতে থাকে।আমি মানসিক ভাবে শক্তি পেতে থাকি।নতুন করে আবার স্বপ্ন সাজাতে থাকি। সব থেকে বড় কথা আমি আমার প্যাশন টাকে খুঁজে পাই।
আমি বার বার হোঁচট খেয়েও স্যারের অসাধারণ সব সেশন পড়ে উঠে দাঁড়ানোর সাহস পাই।
সবার সামনে বক্তব্য দেওয়া আমার প্রিয় শখের মধ্যে একটি।তাই প্রতিনিয়ত সেশন চর্চা ক্লাসে কথা বলে আমার কথা বলার জড়তা কাটাতে পারি এবং গ্যালারি ভর্তি অডিয়েন্সের সামনে বক্তব্য দেওয়ার সাাহস পাই।
আমি একজন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এর স্টুডেন্ট।তাই আমার স্বপ্ন ভবিষ্যতে আমি রেডিমেট গার্মেন্টস নিয়ে কাজ করব।আমার বড় বায়িং হাউজ থাকবে। দেশের ৬৪ জেলা সহ দেশের বাহিরে আমার পণ্য চলে যাবে।কিন্তু স্বপ্ন দেখলেও তা কেন যেন কাল্পনিক মনে হতো/বেশি অস্পষ্ট মনে হতো।কিন্তু প্রিয় ফাউন্ডেশনে এসে, এবারের ৫ম প্রতিষ্ঠাবার্ষীকি ও উদ্যোক্তা মহাসম্মেলনে গিয়ে আমার সেই স্বপ্ন অনেক বেশি স্পষ্ট হয়েছে।অনেক কাছ থেকে দেখতে পাচ্ছি সে স্বপ্ন।
সম্মেলনে গিয়ে সফল উদ্যোক্তাদের কথা শুনে, সকলের সাথে কথা বলে,ম্যাগাজিনে উদ্যোক্তাদের গল্প পড়ে অনেক বেশি মোটিভেটেড হয়েছি।সব চেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছি এবারের সেরা উদ্যোক্তা, ফেব্রিকন ফ্যাশনের ওনার Rabiul Islam ভাই এবং গ্র্যাজুয়েট বায়িং হাউজের ওনার GM Baharul Islam ভাইয়ের গল্প শুনে।তারা দুজনেই রেডিমেট গার্মেন্টস ব্যাবসায়ী।
স্যারের একটি বিখ্যাত উক্তি - " সময় নিন, সময় দিন,সময় বদলাবে, সময়ই সব ঠিক করে দিবে "
আমি এখন সময় নিচ্ছি এবং প্রিয় প্লাটফর্মে সময় দিচ্ছি। ইনশাআল্লাহ আমার সময় একদিন ঠিকই বদলাবে এবং আমি আমার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারব বলে বিশ্বাস করি।
আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন যাতে আমার স্বপ্ন গুলো পূরণ হয় এবং সারাটা জীবন মানুষের জন্য কাজ করে যেতে পারি।
গল্পটা অনেক লম্বা হয়ে গেছে সেই জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। যারা এতোটা ধৈর্য্য নিয়ে শেষ পর্যন্ত পড়েছেন সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই!
"স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৯১৯
Date:- ২৩/০১/২০২৩ইং
আমি -
শিহাব উদ্দিন
ব্যাচঃ ১৩
রেজিষ্ট্রেশনঃ৫৬৯১৯
জেলাঃ টাঙ্গাইল
বর্তমান অবস্থান: ঝিনাইদহ সদর
পড়াশুনা করছি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, (শেখ কামাল টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ,ঝিনাইদহ)
রক্তের গ্রুপ : B+
ব্যাক্তিগত রক্তদান : ৭ বার
মোবাইল নং: 01772-219348