এটা ঠিক গল্প নয় জীবনের সত্য ঘটনা অবলম্বনে জাকিয়া তানিয়ার গল্প।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
💘"আমার জীবনের গল্প"💘
🏵️প্রথমে শুরু করছি মহান সৃষ্টিকর্তা পরম করুণাময় আল্লাহর নামে যার অপার কৃপায় এই পৃথিবীতে এসেছি। সকল প্রশংসা মহান রাব্বুল আলামীনের জন্য। লাখো কোটি দরুদ ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ) এর প্রতি ।
🏵️কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি আমার মা ও বাবার প্রতি, যারা আমাকে জন্ম দিয়েছেন, লালন পালন করেছেন এবং শিক্ষিত করে পৃথিবীর বুকে বড় করে তুলেছেন।
🏵️ সেই সাথে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি এই শতাব্দীর অন্যতম সেরা মানুষ, লাখো তরুণ তরুণীর আইডল প্রিয় মেন্টর, প্রিয় শিক্ষক জনাব ইকবাল বাহার জাহিদ স্যারের প্রতি, যার অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে উঠেছে "নিজের বলার মতো একটা গল্প" ফাউন্ডেশনের মতো একটা সুবিশাল প্লাটফর্ম ।
আসসালামুয়ালাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহী ওয়া বারকাতুহু
🌷 আজ একটা গল্প শোনাব। আশা করি সময় করে সবাই ধৈর্য্য ধরে শুনবেন ও পড়বেন।
🌷 এটা ঠিক গল্প নয় আমার জীবনের সত্য ঘটনা অবলম্বনে।
🙇ছেলেবেলাঃ
আমরা ৫ ভাই বোন। ৪ বোন এক ভাইয়ের মধ্যে আমিই সবার ছোট।বাবা ছিলেন খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলস এর কাগজ কল ডিপার্টমেন্ট এর ডিপার্টমেন্টাল হেড।বাবার চাকরীর সুবাদে খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলস হসপিটালে আমার জন্ম। ছোট বেলাটা নিউজপ্রিন্ট কলোনীতেই কেটেছে।অত্যন্ত মধুর ছিলো সময়গুলো।আমার যখন ১ বছর বয়স তখন হঠাৎ করে একদিন বাসায় খবর এলো বাবা তার অফিসে ডিউটিরত অবস্থায় এক্সিডেন্ট করেছেন।অন্য একজনের ভুলের কারণে বাবার বাম হাত পুরোটাই কাগজের রোলারের মধ্যে ঢুকে যায় এবং বাবার পুরো হাতের হাড়গুলো ভেংগে যায়।বাবার এক্সিডেন্টের পরে আমাদের পরিবারে এক অনিশ্চয়তা নেমে আসে।বাবাকে নিয়ে মা ট্রিটমেন্ট এর জন্য দীর্ঘ ৬ মাস ঢাকা পংগু হাসপাতালে ছিলেন। তারপর আল্লাহর অশেষ রহমতে বাবা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে আসেন।
🌷 শিক্ষা জীবনঃ
খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলস স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেনী অবদি পড়েছি।তারপর বাবার রিটায়ার্ড এর পরে বরিশালে এসে ৭ম শ্রেনী থেকে এস এস সি অবদি স্বরস্বতী স্কুলে পড়েছি।এইচ এস সি তে এডমিশনে বরিশাল মহিলা কলেজে এলাউ হলাম।কিন্তু ভাগ্য অনুকূলে না থাকায় ভালো পাত্র হাতছাড়া না করতে ফাস্ট ইয়ার এ বসেই বিয়ে দিয়ে দিলেন বাবা।বিয়ের পরেই বাচ্চা হলো এক বছর না ঘুড়তেই।বাচ্চা আর সংসার সামলাতে গিয়ে জীবনে থেকে কখন যে ৩ টা বছর শেষ হলো টেরই পাইনি।স্বামী বিদেশে থাকায় একা বাচ্চাকে সামলে পড়াশুনা করাটা ছিলো আমার জন্য খুবই কস্টের।বিয়ের ৩ বছর পরে আমার কলেজে ভর্তি হলাম।এইচ এস সি ও বি এ /ডিগ্রী শেষ করলাম অনেক কস্টে।ইচ্ছে ছিলো শিক্ষা জীবন শেষ করে ভালো একটা অবস্থান তৈরি করবো কিন্তু ভাগ্য অনুকূলে ছিলোনা।চাপা একটা কস্ট রয়ে গেলো আমার ভিতরে।
🌷চাকরী জীবনঃ
দীর্ঘ ৯ বছর ৩ টা স্কুলে কিন্ডার লেবেলে কাজ করেছি।বাচ্চাদের সাথে থাকতে আমার খুব ভালোলাগে।হাতেঘড়ি থেকে ৫ম শ্রেণির অবদি অত্যন্ত যত্নে সহকারে পড়িয়েছি।২০১৮ সাথে ব্যক্তিগত কারণে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়।তারপর থেকে ২০ সাল অবদি আর কিছু করা হয়নি।
🌷 আমার স্বপ্নঃ
আমার স্বপ্ন ছিলো লেখাপড়া শেষ করে একজন টপ লেবেলের বিউটিশিয়ান হবো।কিন্তু অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় ও হাজবেন্ড বিদেশে থাকায় সেই সুযোগ আর হয়ে ওঠেনি। হাজবেন্ড সবসময়ই সাপোর্ট করেছেন কিন্তু শ্বশুরবাড়ি উপজেলায় থাকায় স্বপ্নটাকে সত্যি করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি।যখন মনে হলো আমাকে দিয়ে কিছুই হবেনা তখন হাজবেন্ড এর সাথে বিদেশে চলে গেলাম।সেখানে গিয়ে নতুন করে আবার একটা স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম।যেহেতু সৌদিতে ফ্যামিলি ভিসায় গিয়েছিলাম সেহেতু সেখানে কোন কাজ করার সুযোগ ছিলোনা।একদিন আমি বাসায় বসে আমার পড়ার জন্য ড্রেস বানাচ্ছিলাম।ঠিক সেই সময় এক বাংগালী ভাবী আমার বাসায় আসে।এসে দেখেন আমি ড্রেস তৈরি করছি।তখন সে আমাকে খুব রিকোয়েস্ট করে তার একটা ড্রেস বানিয়ে দিতে কিন্তু আমি লজ্জায় না করে দেই।কিন্তু সে নাছোর বান্দা তাকে বানিয়েই দিতে হবে।অবশেষ বাধ্য হলাম ভাবীর ড্রেস বানিয়ে দিতে।ড্রেস তৈরি করার পরে যখন সে সেটা পড়লো তখন সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমি কার কাছে থেকে সেলাই কাজ শিখেছি।তখন আমি বললাম আমি কোনদিনই হাতেকলমে শিখিনি তবে আইডিয়া করে বানিয়েছি সব।তখন সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো তুমিতো একদম প্রফেশনালদের মত ড্রেস বানাও।তুমি এটা নিয়ে কাজ করোনা কেন?আমি বললাম আমিতো শুধু নিজের ড্রেস বানাই।আমার হাজবেন্ড শুনলে রাগ করবে।তখন ভাবী আমাকে বললো বিদেশে এসে ইন্ডিয়ান,পাকিস্তানি অনেকের কাছেই ড্রেস বানিয়েছি কিন্তু তোমার মত এত সুন্দর কেউ বানাতে পারেনি।এখন থেকে আমার সব ড্রেস তুমি বানিয়ে দিবে।বিদেশের মাটিতে সুযোগ থাকলে কেউ হাতছাড়া করেনা।তোমার সামনে একটা বড় সুযোগ তুমি এটাকে ইগনোর করোনা।তারপর আর আমাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।বাংগালী, ইন্ডিয়ান,পাকিস্থানী সব দেশের মানুষ ভাবীর সুবাদে সব জায়গা থেকে order আশা শুরু করলো।একটা বাসায় পড়া নরমাল ত্রিপিচ যেটার মজুরী আমাদের দেশে ২০০/- সৌদিতে সেটার মজুরী ছিলো ৭০০/- । আলহামদুলিল্লাহ আমি ইনকামের ভালো একটা পথ পেয়েছিলাম।ইনকামের পুরো টাকাটাই আমার নিজের শখ পূরণে খরচ করেছি।কেন যেন সব কিছু পরিপূর্ণ থাকর পরও দেশে আসার জন্য অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম।বাবা,মা,বাই বোন,আত্নীয় -স্বজন এর জন্য মন ছটফট করতে লাগলো।দীর্ঘ ৭ বছর পরে দেশে চলে আসি।
🤴👸হৃদয় ভেংগে যখন আমি নিস্বঃ
২০০০ সালে আমি এসএস সি দেই।২০০১ এ আমার বিয়ে হয়।২০০২ এ আমার একটা ছেলে সন্তান হয়।তারপর শত চেস্টার পরেও আর কোন সন্তান আল্লাহ আমাকে দেননি।২০২০ সালে হাজবেন্ড দেশে আসলে দীর্ঘ ১৭ বছর পরে আল্লাহর ইচ্ছায় আমি আবার কন্সিপ করি।কনসিপ করার পরে পরিবারের প্রত্যেকের খুশি দেখে মনে হচ্ছিলো আমি এই দুনিয়ার সব চেয়ে সুখী মানুষ।অনেক ভালো সময় মন্দ সময়কে অতিক্রম করে ৯ মাস পরে ফুটফুটে একটা মেয়ে সন্তান আসলো ৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ আমার ঘর আলো করে।আমাদের ভাই বোনদের মধ্যে সবারই ছেলে সন্তান শুধু আমার ঘরেই একটা মেয়ে সন্তান আল্লাহ দিয়েছিলেন। আমার মেয়েকে পেয়ে সবার আনন্দ উল্লাস দেখে আল্লাহ পাক মনে হয় আমাদের উপর নারাজ হয়ে গেছেন।আল্লাহ আমার মেয়েটা কে দীর্ঘ ১৮ বছর পরে আমাকে দিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখিয়ে আবার ১ মাস ৫ দিন পরে চিরদিনের জন্য আমার কাছ থেকে তুলে নিয়ে গেছেন।আমি শেষ হয়ে গেছি,নিঃশ্বেস হয়ে গেছি।এ কি হলো আমার সাথে?আমি তো ১৭ বছর আল্লাহর কাছে প্রতি নামাজে হাত তুলে আমার সন্তাকে চেয়েছিলাম।আল্লাহ আমার দোয়া কবুলও কররেছিলেন তবে কেন আবার আমাকে নিঃস্ব করে দিলেন?সব শেষ হয়ে গেলো আমার।সিজারে আমার বেবিটা হয়েছিলো।৪ টা এনেস্থেসিয়া দিয়ে অবস করা হয়েছিলো আমাকে।সেই এনেস্থেসিয়ার কারণে ২ মাস একা হাটতে পারিনি।যার জন্য এত কস্ট সহ্য করেছি চারদিকে তাকিয়ে কোথাও তাকে খুজে পাইনা।তাকে নিয়ে সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেলো আমার।আমি অচল হয়ে গেলাম পুরোপুরি।করোনার কারণে আমার হাজবেন্ড দশ মাস দেশে ছিলো।সন্তানের মুখ দেখবে বলে দিন রাত আমার সেবা করেছেন।সেই সন্তানকে বুকে পেয়েও আবার হারিয়ে ফেললেন।নিজের হাতে আবার সন্তানের দাফন করলেন।শুণ্য বুকে আবার ফিরে গেলেন প্রবাসে।
🌷 উদ্দ্যোক্তা জীবন শুরু:
সন্তানকে হারিয়ে পাগল প্রায় অবস্থা হয়েছিলো আমার।তখন কাছের সবাই আমাকে বলতে লাগলো তুমি এভাবে বসে থাকলে পাগল হয়ে যাবে একটা কাজ শুরু করো।বাসার মানুষ,আত্নীয় স্বজন সবাই আমার রান্না করা খাবার পছন্দ করতো।তাই ভাবলাম খাবার নিয়েই কাজ শুরু করি।ছেলেকে বললাম একটা পেইজ খুলে দিতে।ছেলে আমার নামের সাথে মিল রেখে Tania's Kitchen পেইজটি খুলে দিলো।২০২১ সালে শুরু হলো নতুন করে আমার উদ্যোক্তা জীবন।পেইজ খোলার পর প্রথম order টা ছিলো এক সরকারী কর্মকর্তার।পর পর সাত দিন সে আমার কাছে থেকে বাংলা খাবার নিয়েছিলেন এবং অনেক ভালো রিভিউ দিয়েছিলেন।তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি আমাকে।আমার তৈরি আইটেমস গুলো হলো-ফ্রোজেন আইটেম,ডেজার্ট আইটেম,পিঠা-পুলি,রসমালাই,টকমিস্টি দই,চাইনিজ আইটেম,খিচুড়ি, বিরিয়ানী,তেহেরী ইত্যাদি।আলহামদুলিল্লাহ আমি এখন নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছি।
🌷এ গ্রুপের সাথে জয়েন করি ২০তম ব্যাচে। সেই থেকে নিয়মিত সেশন ক্লাস করে যাচ্ছি।এখানে আসার পর থেকে আমার মধ্যে হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলো যেনো আমি ফিরে পাচ্ছি। আগে যে ভয়টা পেতাম পারবো কিনা এখন আর সেটা পাই না আমার সকল ভাই বোনেরা আমার এক একটা উদাহরণ তারা পারলে আমিও পারবো ইনশাআল্লাহ।
🌷 অনেকক্ষন আমার কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শোনার জন্য আপনাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ।
🌷 পরিশেষে আপনাদের সকলকে অনেক অনেক শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আপনারা যারা এতক্ষণ পর্যন্ত ধৈর্য ধরে আমার লেখাটা পড়েছেন, প্রিয় ভাই ও বোনেরা আমি স্বপ্ন দেখি আমার পাশের মানুষ গুলোকে নিয়ে, যারা আমার সুখে দুঃখে পাশে ছিলো।
🌻আমার জীবন চলার পথে আপনাদের দোয়া, ভালোবাসা এবং সহযোগিতা আমার ভীষণ প্রয়োজন, আশা করছি ভালোবেসে পাশে থাকবেন সবসময়, সবশেষে আপনাদের সবার সুখি ও সুন্দর জীবন কামনা করি, সুন্দর হোক আপনাদের সবার আগামী জীবনের প্রতিটি দিনের প্রতিটি ক্ষণ, শুভ কামনায় আজকের মত এখানেই বিদায় নিচ্ছি, ভালোবাসা অবিরাম...