সিরাজগঞ্জ জেলার মেয়ে নাছিমা ইসলাম নিশির উদ্যোক্তা হয়ে উঠার গল্প।
আসসালামু আলাইকুম সবাইকে।
আমার উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প।
আমি নাছিমা ইসলাম নিশি।
আমি একজন ছোট উদ্যোক্তা।
এমন একটা গ্রাম বা পাড়া থেকে আমার উঠে আসা যেখানে শিক্ষার আলো ছিল না বললেই চলে।
একেবারে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। যখন আমি ক্লাস সেভেনে পরি তখন আমার বাবা মারা যায়। আমরা ছয় ভাই বোন, ভাইয়ারা বড় তারা বিয়ে করে তাদের সংসার নিয়ে ব্যাস্ত ছিল। বড় আপুরও বিয়ে হয়ে গেছে। অভাব অনটনের সংসার ছিল। বাবার অবর্তমানে মায়ের উপর পড়ে অনেক চাপ। ভাইয়ারা আমাদের খাওয়া পড়ার খরচ চালাতে পারলেও পড়ালেখা করানোর কোন সামর্থ্য তাদের ছিলনা। আমাদের তিন বোনের পড়ালেখা চালানো মায়ের পক্ষে অনেক কষ্টের ছিল। এখানে আরেকটা কথা বলি যেহেতু আমার গ্রামে শিক্ষিত সে রকম কোন লোক ছিলনা তাই আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন থেকেই টিউশনি করাইতাম যা দিয়ে নিজেদের খাতা কলম কেনার কিছুটা টাকাটা হতো।আমরা দেখতাম মা অন্যের বাসায় কাজ করেও আমাদের পড়ালেখার খরচ চালাতো। অনেকেই মা কে বলতো মেয়েদের পড়ালেখা করিয়ে কি করবে। যে টাকা দিয়ে পড়া লেখা করাবে সেই টাকা জমিয়ে বিয়ে দিয়ে দিও। কিন্তু মা কখনও কারও কথায় কান দেয়নি। চলছিল আমাদের সংগ্রামের জীবন!এভাবেই চার বছর কেটে গেল। তার পর আমার এস,এস,সি পরিক্ষা শুরু হল শেষ করে চলে আসলাম গাজীপুর বড় আপুর বাসায়। নিজেকে কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু কি করবো? অনেক গার্মেন্টস ফ্যাক্টোরিতে জবের ট্রাই করলাম কিন্তু কোথাও জব হয়না ছোট বলে। তার পর কয়েকটা টিউশনি খুজে পেলাম।আপুর বাসা থেকে সেটাই করতে লাগলাম।কিন্তু সেটা দিয়ে আমি কিছুই করতে পারছিলাম না। নিজের খরচও চলতো না পরিবারকেও কিছু দিতে পারছিনা। তার পরও অন্যজনের কাগজ পত্র দিয়ে একজনের রেফারেন্সে একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টোরিতে জব হয়। শুরু হলো আরেকটা সংগ্রামের জীবন। এর মধ্যে আমার রেজাল্টও হয়ে যায়। তার পর এডমিশন নেওয়ার পালা। গাজীপুরেই একটা কলেজে, সাইন্স থেকেই এডমিশন নেই। দিনে গার্মেন্টসের অতিরিক্ত কাজের চাপ রাতে পড়ালেখা।নিজের খরচ চালানো আবার ফ্যামেলিকে সাপোর্ট দেওয়া। এভাবেই কাটছে আমাদের জীবন। তার পর এইস, এস,সি এক্সাম দেই। কিন্তু রেজাল্ট ভালো হয়না।এতো দিনেও আমি আমার জবটা বহাল রাখি। কারণ আমি জানি আমি কিছু না করলে ফ্যামিলিকে সাপোর্ট দিতে পারবোনা। আমি সব সময় চাই সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে। এর মধ্যে আমাদের একটা ভালো ঘরও ছিল না। মাকে ঘরও দিয়ে দেই। তার পর শুরু হলো বোনের বিয়ে! এতো দিনে যা টাকা জমিয়ে ছিলাম বোনের বিয়েতে সব টাকা শেষ! এবার আমি আবারও শুন্য। সম্ভল বলতে একটা জিনিস ছিল, সেটা আমার জবটা। যাচ্ছে কোন ভাবে দিন! চলে আসলো আমাদের মাঝে ভয়াবহ করোনা। জব টাও চলে যায়।সব কিছু নিয়ে চলে গেলাম বাড়িতে।কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। তখন ইউটিউবে অনেক ভিডিও দেখতাম। হঠাৎ একটা লাইন আমার চোখের সামনে পড়ে। চাকরি করবোনা চাকরি দিবো। এই লাইনটা যেন আমাকে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করলো। তার পর স্যারের অনেক ভিডিও দেখতাম যেটা আমার মধ্যের আমিটাকে বের করে আনতে অনেক সাহায্য করেছে। কিন্তু তখন আমি গ্রুপে যুক্ত হতে পারিনি। এমন কি আমি জানতামও না এতো সুন্দর একটা প্ল্যাটফর্ম আছে! তার পর আমিও শুরু করলাম! আমার একটা সেলাই মেশিন ছিল,কাছে ছিল ১০ হাজার টাকা। কিছু গজ কাপড় এনে কাজ শুরু করে দিলাম। তিন মাসে আমার পুজি দাড়ালো ৩০ হাজার টাকা। কিন্তু তখন আমার ফ্যামিলিতে আবার অনেক খারাপ সময় যাচ্ছে। ভাইয়া তার বিজনেসে অনেক টাকা লস খেয়ে যায়। আমার ছোট বিজনেসের টাকাটা সংসারে দিতে হচ্ছে! এতে আমার পুঁজি টাও কমে যাচ্ছে। এর মধ্যে আমাকে আমার অফিস থেকে ডাকে যে আবার অফিস খুলবে তুমি চাইলে আসতে পারো। যদিও ভাইয়া আর আসতে দিতে রাজি হলোনা।কিন্তু এবার আমার কিছু একটা করার চেষ্টা চলছে। তাই ফ্যামেলিকে ম্যানেজ করে চলে আসলাম। অফিসে জয়েন করলাম,সাথে একটা বিউটিশিয়ান কোর্স করে ফেললাম। কিন্তু সেটা করে তখন কিছু করতে পারলাম না। হঠাৎ আরেকটা আইডিয়া মাথায় আসলো। গায়ে হলুদের গহনা নিয়ে একটা কৌতুহল জাগলো মনে। এর পর ইউটিউব দেখে দেখে অনেক টা ধারণা নিয়ে ফেললাম। তার পর সাত হাজার টাকার ফুল ম্যাটারিয়ালস দিয়ে ২০২১সালে জানুয়ারির ২৫ তারিখ থেকে শুরু করলাম। অফিসে একটা দুইটা প্রোডাক্ট নিয়ে সবাইকে দেখাইতাম। সবাই ভালোই রেসপন্স করলো। সারা দিন অফিস করে এসে রাতে সব প্রোডাক্ট নিজেই তৈরী করতাম। পরদিন সব প্রোডাক্ট নিয়ে অফিসে লুকিয়ে লুকিয়ে সেল করতাম। প্রথম মাসে সেল হলো ৭ হাজার টাকা পরের মাসে ৮ হাজার তার পরের মাসে ১৫ হাজার তার পরের মাসে ৩০ হাজার টাকা। এর পড় আর আমাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।আমার আইটেমও বাড়তে থাকলো।আবার ইউটিউব দেখে দেখে ব্লক প্রিন্ট, হ্যান্ডপেইন্টের কাজ টাও শুরু করে দিলাম। কিন্তু এবার শুরু হলো অনেক রকমের টর্চার অফিসের অনেক লোক আমাকে অনেক ভাবে অপমান করতে শুরু করলো।কিছু লোক সামনে উৎসাহ দিতো আর পিছনে অনেক তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতো। অনেক রকমের কটুকথা শুনাইতো,কিন্তু আমি কোন কিছু বলতাম না। আমার কাজ আমি করে যেতাম।এভাবে দেড় বছরের মত কেটে গেল।অফ লাইনে অনেক কাস্টমারও হয়ে গেল।
এবার একটা শো-রুম নেওয়ার পরিকল্পনা করলাম। ফ্যামেলিকে অনেক কষ্টে রাজি করাইলাম। কিন্তু অফিসের কিছু লোক শোনার পর আবার আমাকে অনেক কথা বলতে শুরু করলো। দুইডা টাকা হইছে সেগুলো শেষ করার ধান্দা। বিজনেস করে ধরা খাইবে আবার গার্মেন্টসের চাকরিই করা লাগবে।কারোও কথা শুনলাম না, নিজের মন যা চাইলো তাই করলাম। একটা শো-রুম নিয়ে নিলাম ২০২২ সালে আগস্ট মাসে।বাড়ি থেকে নিয়ে আসলাম ছোট বোন কে। ছোট বোন শো-রুমে থাকতো আমি অফিস করতে শুরু করলাম। এর মধ্যে অফিস ও পাচটায় ছুটি হতে শুরু করলো। তার পর পাঁচটা পর্যন্ত অফিস আর রাত দশটা পর্যন্ত নিজের শপ সামলাতে শুরু করলাম। এভাবেই ১ বছর কেটে গেল। যুক্ত হলাম আমাদের ভালোবাসার প্লাটফর্মে ২৩ তম ব্যাচে যদিও আমি অনেক আগে থেকেই স্যারের ভিডিও গুলো দেখি, আর সেই অনুপ্রেরণায় অনেক কাঁটাযুক্ত পথ পারি দিতে শিখে গেছি।অনেক কিছু শিখছি! আমার মাঝে অনেক কিছুর ঘাটতি ছিল সেগুলো পূরণ করছি। লেগে আছি আর লেগে থাকবো ইনশাআল্লাহ। এরপর ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরের ১ তারিখে আমার আরেকটা শপ চালু হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। সেটা একটা বিউটি পার্লার। এখন আমি আমার দুইটা শপ চালাচ্ছি। আর জবটাও ছেড়ে দিয়েছি । শুরুর দিকে আমার শপটা খুব একটা ভালো চলতো না। আসতে আসতে কাস্টমারের চাহিদা অনুযায়ী প্রোডাক্ট উঠাতে শুরু করলাম। ফাউন্ডেশনে যুক্ত হয়ার পর আমি অনেক কিছুই শিখতে পারছি। এমন কি আমার সেলটাও এখন অনেক বেড়েছে আলহামদুলিল্লাহ। আর এটা সম্ভব হচ্ছে স্যারের দেওয়া প্রতিটা সেশন থেকে আমি অনেক কিছু শিখছি এবং আমার মাঝে অনেক পরিবর্তন দরকার ছিল। সেটা করছি। যার কারনে আমার মনে হচ্ছে আমার সেলটা বাড়ছে। এখন যারা আমাকে অবহেলা করতো তারাই এসে বলে জানতাম তুমি পারবা।আর আমি একটা সময় এই কথাটাই শুনতে চাইতাম। তারাই আমাকে বলুক তুমি পারবা যারা আমাকে অবহেলা করেছিল। আমি নিজেকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে চাই, আমাকে আর কেউ অবহেলা করতে না পারুক। আমি এখনও নিজেকে সফল মনে করিনা! আমি মানুষের জন্য কিছু করতে চাই। বিশেষ করে মেয়েদের নিয়ে কাজ করতে চাই।আমি একজন ভালো মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে চাই।এবং নিজের বলার মত একটা গল্প তৈরী করতে চাই।
সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।
নাছিমা ইসলাম নিশি।
নিজ জেলা সিরাজগঞ্জ বর্তমান অবস্থান করছি গাজীপুর।
ব্যাচ :২৩
রেজিষ্ট্রেশন নং :১২৩১১৯
স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে-৯৬৭
তাং -১৯-১০-২৩ ইং