রাজবাড়ি জেলায় শাওন মনি এর জীবনের গল্প।
জীবনের গল্প ঃ
"আমি পারবো" হয়তো সবাই ভাবছেন আমি হঠাৎ করে এই কথাটি কেন বলছি?
আসসালামুয়ালাইকুম সবাইকে। সর্বপ্রথম আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই আলহামদুলিল্লাহ আমাকে একজন ভালো মানুষ হিসাবে সৃষ্টি করার জন্য। এবং আমাকে একটা ভালো পরিবারে জন্ম গ্রহণ করানোর জন্য। আমার মা বাবার কৃতজ্ঞতা তো বলে শেষ করা যাবে না।
আমি আমার বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে আর এটাই হয়তো আমার জীবনের কাল হয়েছিলো।ছোটবেলায় অনেক আদর যত্নে বড় হয়েছি। নানু আর মামাদের আমাকে নিয়ে আল্লাদের শেষ ছিলো না।
কিন্তু নিজের কপাল নিজেই নষ্ট করে ফেললাম ভালোবেসে বিয়ে করলাম। সবার মত না থাকার একটাই কারণ ছিলো আমার সৎ শাশুড়ি। সবার অনুমানই ঠিক হলো।আমি যেহেতু এক মাত্র সন্তান তাই খাবার টাও নিজে হাতে খাই নাই, আর কোন কাজ করা তো দূরের কথা।কিন্তু যখন শ্বশুর বাড়িতে গেলাম তখন শুরু হলো শাশুড়ি অমানুসিক নির্যাতন। উঠান ঝাড়ু দেয়া, ঘর লেপা, খড়ি কাটা, প্রতিদিন ২/৩ বালতি কাপড় ধোয়া, রান্নার সব কাজ আর ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য ভোর চারটা থেকে শুরু হতো আমার ঘরের দরজায় জোরে জোরে লাথি।
আমার প্রথম সন্তান যখন পেটে আসলো আমাকে খেতে দিতো না। কাজ শেষ না করে খেতে বসলে খাবার প্লেট সামনে থেকে সরিয়ে নিতো। আব্বু মুরগি, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ সবকিছু ঝুড়ি কে ঝুড়ি বাজার করে পাঠাতো। আমার শশুর শাশুড়ি সেগুলো আমাকে দিত না।তারা তাদের ছেলের সমনে ভালো আচরণ করতো।ছেলেও মায়ে উপর কোন কথা বলতে না কারণ সে ছোট বেলায় তার মাকে হারিয়েছে, তারপর আবার সে বেকার।
আমার শ্বশুর বিয়ের রাতেই আমাকে বললো তোমার স্বামী তো বেকার তাহলে তোমার খাওয়ার খরচ কে দিবে? আমি ছোট একটা মানুষ, কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না তারপরও বললাম আমি দিবো। তিনি আরো বললেন বাজার দিবা নাকি চাউল দিবা? আমি বুদ্ধি করে বলেছিলাম এক বস্তা চাউল দিবো। কিন্তু কি করে দিবো? আমি তো আব্বুর কাছে বলতে পারবো না। তাই এলাকার কতো গুলো বাচ্চা কে পড়াতে শুরু করলাম। সারাদিন কাজের ফাঁকে হাতের কাজের জামা কাপড় সেলাই করা শুরু করলাম।আমার বাচ্চাটা হওয়ার পর একটু দুধ ও কিনে দেয় নাই তারা।আমি টাকা দিলে তারপর দুধ কিনতো। স্বামী বেকার তাই ওর ও কিছু করার নাই।
আব্বু আম্মুর যেহেতু রাগ তারা আমাকে দেখতেও কম আসতো হঠাৎ আব্বু আমার কথা কারো কাছে শুনে আমাকে নিয়ে আসলো।আমার বাচ্চাটাকে পেয়ে মনে হল আমার বাবা মা একটা খেলনা পেয়েছে। আমার বাচ্চার যখন ছয় মাস একটু একটু হাটা শিখেছে তখন ওর বাবা কে দেখে।
আমি একটু জেদি তাই বাবার কাছে থেকেও কিছু নিতে চাইতাম না। যাতে কেও না বলতে পারে বাবার ঘাড়ে বসে আছি।তাই একটা এনজিও তে চাকরি নেই।তারপর হঠাৎ ঢাকাতে আসি এটাও একটা ইতিহাস। যাই হোক আম্মু আমার চিন্তায় অল্প বয়সেই স্ট্রোক করে মারা যায়।শুরু হয় আমার জীবনের নতুন আর একটা জার্নি। মা বেঁচে থাকতে বুঝি নাই বাচ্চা কিভাবে মানুষ করতে হয়। রান্না তেমন পরতাম না।পরে সবকিছু নিজের চেষ্টায় একা একা শিখেছি।
আমি পাগলের মত হয়ে গেলাম আম্মুর বন্ধ থাকা ফোন নাম্বারটাতে প্রতি রাতে ফোন দিয়ে আম্মুর সাথে কথা বলতাম ঠিক আগের মতোই। আমার কষ্ট হাহাকার করা কান্না, যে কথাগুলো কাওকে বলতে পারতাম না সেগুলো বলতাম। মনে হতো আম্মু আমার পাশে বসে আছে। কিন্তু ওপাশ থেকে আমাকে সান্তনা দেয়ার সেই কণ্ঠস্বরটা আর ভেসে আসতো না
একটা নাট্য দলে যোগ হলাম।তারপর পরাপর নাটকের কাজ করতে লাগলাম পাশাপাশি ঘরে বসে ব্যাবসা। এর মধ্যে আমার হাজবেন্ড যায় আসে ২/৪/৬ মাস এক বছর থাকে আবার চলে যায় কোন দায়িত্ব পালন করে না।আমাদের কোন খোঁজও নেয় না একটা ফোন ও দেয় না মায়ের কথা মতো।যেহেতু সে আমাকে ভালোবাসে তাই তাকে বেশি দিন আটকেও রাখতে পারতো না। সুযোগ পেলেই চলে আসতো আমার কাছে।
ওকে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জব নিয়ে দেই। ভালোই চলছিলো কিছুদিন। আবার মার কথা শুনে জব ছেড়ে আমাদের ছেড়ে চলে যায় এর মধ্যে আমাদের আরেকটা বাবু হয় মেয়ে বাবু।ওর যখন তিন মাস তখন আমাদের ফেলে চাকরি ছেড়ে সে আবার নিরুদ্দেশ।অনেক টাকা দেনা করে আমার উপর সেগুলো চাপিয়ে চলে যায়।
আমি একা দুইটা বাচ্চাকে নিয়ে কষ্ট করে যাচ্ছি।হাতে কোন টাকাও নাই।তারপর আমার পরিচিত বোন /ভাবি এদের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করি।সেগুলো দিয়ে কিছু জামাকাপড় আর কিছু জুয়েলারি কিনি। সেগুলো বাচ্চার স্কুলে নিয়ে যেতাম। স্কুলের ভাবিরা আমার কাছ থেকে সেগুলো কিনে নিতো।এক হাতে ছেলে কে নিতাম ছোট্ট মেয়ে বাবু আমার কোলে আর কাধে নিতাম কাপড়ের ব্যাগ। এভাবে পায়ে হেটে আমি আমার প্রডাক্ট গুলো বিক্রি করতে লাগলাম।অনেক চড়াই উতরাই পার করে দুইটা বাচ্চাকে পড়াশোনা করাচ্ছি ছোট একটা জব করি পাশাপাশি ঘরোয়া ভাবে মেয়েদের শাড়ি থ্রি পিস জুয়েলারি নিয়ে অফ লাইনে বিজনেস করছি।
এখন আমার হাজবেন্ড নিজের ভূল বুঝতে পারে কিন্তু আমার জীবন থেকে সুন্দর দিন গুলো তো চলে গেছে।আমি ওকে বারে বারে মাফ করে দিই কারণ আমার আম্মুর একটাই কথা ছিলো মেয়েদের বিয়ে একবারই হয় আমি সেটা মাথায় রেখেই এতোটা বছর একা লড়ে যাচ্ছি।
অনলাইন বিজনেস সম্পর্কে আসলে তেমন ভালো জানি না। ভাবতাম এটা করতে গেলে অনেক সময় দিতে হয় আমার তো এতো সময় নাই। একা মানুষ আমি, সব কাজ আমাকে একা করতে হয়। কিছুদিন আগেও আমার হাজবেন্ড কে আমার সর্ব শেষ পুজিটাও ওর হাতে তুলে দেই ব্যবসা করার জন্য।চিন্তা করি ও কিছু একটা করুক। কিন্তু দুঃখের বিষয় ও সেই টাকাটাও লস করে এখন সে ঘরে বসে আছে।
হঠাৎ করে আমার হাজবেন্ড আমাদের সবার প্রাণপ্রিয় "ইকবাল বাহার জাহিদ " স্যারের ভিডিও আমাকে দেখালো। আমি ওকে বল্লাম এই গ্রুপে জয়েন হও ঘরে বসেই আছো দেখো এইখান থেকে কিছু শিখতে পারো কিনা। আমি তো সময় পাই না তুমি কাজটা শিখো।
একদিন আমাদের সবার ভালোবাসার "জেয়াসমিন আক্তার জুই '"আপুর সাথে ফোনে কথা বল্লাম। তারপর আপু আমার ভাইবোন নাই শুনে বললো আপনি এখন থেকে নিজেকে একা ভাববেন না আমি আপনার বোন আমাদের এই ভালোবাসার প্ল্যাটফর্মে জয়েন হন দেখবেন আমার মতো হাজারো ভাই বোন আপনার পাশে দাঁড়িয়ে গেছে।আপুর কথায় মনে হলো আমি প্রাণ ফিরে পেলাম। জয়েন হলাম ভালোবাসার প্ল্যাটফর্মে। সেশন চর্চার ক্লাসে সবার সাথে কথা বলে মনে সাহস পাই নিজের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন একটু একটু করে বাড়তে থাকে।
অল্প কিছুদিন হল আমি একটা অনলাইন পেজ খুলেছি। জামা জুয়েলারি আর কিছু কসমেটিকস নিয়ে আপাতত কাজ শুরু করেছি।
সারাদিন তেমন একটা সময় পাইনা তাই প্রিয় স্যারের ভিডিও গুলো রাত জেগে দেখি।স্যারের বলা প্রতিটি কথায় মনে অনেক সাহস পাই।আর মনে মনে ভাবি আমার কষ্টের দিনগুলো একদিন হয়তো "নিজের বলার মত একটি গল্পের" প্লাটফর্মে আমাকে নিয়ে যাবে, ইনশাল্লাহ।
তাই এখন আমার হাজারো মানুষের মধ্যে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে " হ্যাঁ আমি পারবো "।সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন ভালোবেসে পাশে থাকবেন। আমিও আমার সাধ্যমত আপনাদের পাশে থাকার চেষ্টা করব ইনশাল্লাহ। ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে -৯৮২
তারিখ-০৫-০৬-২০২৪ইং
আমি শাওন মনি
ওনার অফ : Shawon Rokomari's
জেলা ঃ রাজবাড়ি সদর
বর্তমান অবস্থানঃ মিরপুর ২
ব্যাচ-২৫
রেজিস্ট্রেশন ঃ ১২৯৩৭২