জীবনের গল্প থেকে শিক্ষা
#নিজের_বলার_মত_একটা_গল্প_ফাউন্ডেশন।
🎄জীবনের গল্পে থেকে শিক্ষা নিতে হয়। মনে করেছিলাম, অতিত যা চলে গেছে তা ভুলে যেতে চাই।
কিন্তু এই গ্রুপে এসে শিখলাম, অতিত কে ভুলে যাওয়া নয়, বরং অতিত থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে চল।
🎄এত সুন্দর একটা প্লাটফর্ম এর জন্য প্রিয় ইকবাল বাহার জাহিদ স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞ। আল্লাহ স্যার কে নেক হায়াত দান করুন,আমিন।
আমার শৈশব ঃ-
ফেনী জেলার সোনাগাজী তে জন্ম। আমার বাবার ২ সংসার, আমি পরের সংসারের। বড় আম্মুর মৃত্যুর পরই আমার আম্মা কে বিয়ে করিয়ে আনেন, দাদা ভাই। আমরা ২ ভাই ৪ বোন। পরের সংসারে আমরা ১ভাই ১ বোন। বাবা কৃষি কাজ করতেন। এর পাশাপাশি কাঠ মিস্ত্রি করতেন। বাবা ফজর নামাজ পড়ে মাঠে চলে যেতেন। সকালের খাবার নিয়ে আমি প্রায় যেতাম। বাবা হাল চাষ বন্ধ করে খাওয়ার খেতেন।
একদিন বাবা বললেন, এই দিকে আয়, হালচাষ কিভাবে করতে হয়, শিখিয়ে দেই। বাবা শিখালেন গরু সোজা চলার জন্য কি বলতে হয়, বাঁক ঘুরতে কি বলতে হয়। কি সাবধানতা, গরু পায়ের দিকে লাঙ্গল যাতে কোন ভাবে না লাগে। এই হলো এক ক্ষুদে কৃষকের গল্প,।
বাবার সাথে প্রায়ই আমাদের উৎপাদিত ফসল বিক্রি করতে হাটে যেতাম। একদিন বাবা আমাকে কচুর চারা বিক্রি করতে পাঠালেন, দুই আঁটিতে একশটি চারা বলে দিলেন ১০ টাকা হলে বিক্রি করতে। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা , কেউ ৫,৬ টাকার উপরে বলে না , তাই আমি নিয়ে বসে আছি। একটু পর বাবা আসলেন, দেখে আমি বসে আছি, মুচকি হাসি দিয়ে বললেন কি বিক্রি হয়নি? আমি মুখ কালো করে বললাম ৫,৬,টাকার বেশি কেউ বলে নাই, বাবা বললেন দিয়ে দিতা, এইটাতো আমাদের খেতের জিনিস। একটু পর একজন মধ্যে বয়সী লোক এলেন, বাবা ডাক দিলেন, ভাই কিছু কচুর চারা আছে নিবেন?
রোদের উপরের চারা, রাতে পানিতে ভিজিশে রেখে দিবেন বিকালে রোপন করে একটু পানি দিয়েন, আবার পর দিন সকাল বিকাল পানি দিয়েন, সব গুলি চারা টিকে যাবে। মাশাল্লাহ কচুর জাত ভাল, লতিও বেশি পাবেন।
চাচা বললেন কত দিব? বাবা ১৫ টাকা চাইলেন, বললেন দিনে হলে ২০ টাকা বললাম, এখন যেহেতু চলে যাবো ১৫ টাকয় দিয়ে দিব, চাচা বললেন ভাই ১০ টাকাই রাখেন। বাবা বললেন আচ্ছা যান আর ২ টাকা দিয়ে, আজকে আমার ছেলে রোদে বসে চারা গুলি তুলেছে।
চাচা ১২ টাকা দিয়ে কিনে নিলেন। বাবার থেকে শিখলাম আমার কি কি ভুল ছিল, আমি কাষ্টমারের কাছে আমার পন্যের গুনাবলি বলিনি। এটাই ছিল আমার ভুল।
বড় ভাইয়া কে, ওলামা বাজার মাদ্রায় ভর্তি করানো হয়, ভাইয়া মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে যায়। এর পর কদমতলা মাদ্রাসায়, এর পর ভাদাদিয়া মাদ্রাসায়, সব মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে যেতেন, ভাইয়া কেন পালাতো বুঝতাম না, পরে শুনেছি, পড়া না পারলে নাকি মাদ্রাসা গুলিতে খুব বেশি শাসন করতো হুজুরেরা।
বাবা অনেক চেষ্টা করেছেন। একদিন( খড়ের স্তুুপ) চিন ভিতরে বিডির প্যাকেট পেয়েছিলেন বাবা, ভাইয়াকে কি মাইর , ভাইয়া সারাদিন আর বাড়িতে আসে নাই। পরে বাবা, বাড়ির পাশে মসজিদ এর সামনে একটা দোকান বানিয়ে দেন, যেহেতু লেখা পড়া করবে না, দোকান করুক।
আমিও দোকানে মাঝে মাঝে বসতাম। আবার দোকানে মালামাল আনতে আমাকে পাঠাতেন।
একদিন টাকা শর্ট পড়ে যায়, সোনাগাজী জিরো পয়েন্ট এক দাদর থেকে মাঝে মাঝে, মালামাল আনতাম, উনাকে বললাম দাদা একটা দুধের কোটা দেন, টাকা পরে দিব। এর পর আজকে দিব কালকে দিব করে, আর দেওয়া হয় নি। এক সময় তাবলিগে গিয়ে শিখলাম, কোন গায়রে মুসলিমের হক নষ্ট করার পরিনাম আখেরাতে সব চেয়ে ভয়াবহ হবে। কারন, এক মুসলমান অপর মুসলমানের মধ্যে নেকী আদান প্রধান হবে। কি গায়রে মুসলমান নেকী দিয়ে কি করবে?
প্রায় দীর্ঘ সময়, কত বছর হবে ঠিক মনে নেই। একদিন দাদার দোকানে গেলাম, বললাম দাদা আমাকে চিনেছেন? দাদা মনে করতে পারতেছিলো না, পরে ভাইয়ার নাম বললাম, তখন চিনলেন। এর পর বললাম দাদা আমিতো একটা অপরাধ করেছি। এক কোটা দুধ নিয়েছি, কিন্তু টাকাটা দেওয়া হয়নি, আমি এখন দিতে চাই, আপনি যত টাকা বলবেন আমি দিব।
পরে দাদা বললেন, কত আর দিবেন, ঐ সময়ের দামতো মনে নাই আমার,, আমি বললাম এখন কত? দাদা বললেন আমিতো এখন কোটা দুধ বিক্রি করি না,, পরে পাশের দোকানদার কে ডাক দিয়ে জানতে চাইলেন, সে ৫০ টাকা বললো, আমি ৫০০ টাকার একটা নোট দিয়ে হাঁটা দিলাম, দাদা দেখলেন আমি চলে যাচ্ছি, দাদা বললেন বললেন এইটা কি ভাই? আমি বললাম আমি খুশি হয়ে দিতেছি।
দাদা বললেন, আরে আমাকে কেন দিবেন, দিতে হয় হয় কোন ভিক্ষারি কে দেন। সে খুশি হয়ে দোয়া করবে। দাদ ৫০ টাকাই রাখলেন।
🎄আমার লেখা পড়া ঃ-
গ্রামের প্রাইমারি স্কুল দিয়েই শিক্ষা জীবন শুরু। ৪র্থ শ্রেনী ফাইনাল পরিক্ষার পর বড় মামা হজ্জ থেকে এসে আম্মাকে বললেন, আমার ভাগিনাকে আলেম বানাও। যেই কথা সেই কাজ, আমার ৪র্থ শ্রেণীতে ভর্তি করানো হলো মাদ্রাসায়। নানার বাড়ীতে বেড়াতে গেলে মামাতো বোনেরা হুজুর বলে খেপাতো, আমার খুব খারাপ লাগতো, মনে মনে ঠিক করলাম কোন রকম দাখেল শেষ করেই কলেজে চলে যাবো।
এক সময় দাখেল ১ ম বিভাগে পাশ করলাম। কোথায় ভর্তি হবো। এমন সময় আমার এক সময়ের আমার শিক্ষক বাবা কে বললেন আমাকে কৃষি ডিপ্লোমা তে ভর্তি করানোর জন্য। বাবাও রাজি হলেন, নোয়াখালী এগ্রিকালচার ইন্সটিটিউটে ভর্তি হওয়ার জন্য বের হলাম,, ঐ দিন মহিপাল থেকে গাড়িতে উঠলাম কিছু পথ যাওয়ার পর গাড়ি এমন জ্যমে পড়ছে, না আগে না পিছে, ২ ঘন্টা বসে থাকার পর বাবা বললেন কি করা যায়, আমার মাথায় আসলো ফেনী পলিটেকনিক এর কথা, আমার ২ জন সহ পাটি এর মধ্যে ফরম নিয়ে এসেছে, আমাকে বলেছে কয়েক দিন আগে।
আমি বাবা কে ফেনী পলিটেকনিক এর কথা বললাম। বাবা বললেন, এত খরচ কি চালাতে পারবো? আমি হতাশ হয়ে গেলাম,, বাবা কে বললাম বাবা ভর্তি পরিক্ষায় অংশ গ্রহন করি। যদি টিকে যাই তখন দেখা যাবে। বাবা রাজি হলেন। আমি ঐ কলেজ থেকে ফরমের সাথে একটি ভর্তি গাইড দিয়েছিলো।
আমার প্রতিজ্ঞা করলাম, ভর্তি পরিক্ষায় আমাকে টিকতে হবেই। খবর নিলাম সোনাগাজী থেকে কে আছে? এক বড় ভাই এর সাথে দেখা করলাম ঐ গাইড নিয়ে ভাইয়া কিছু সাজেশান দিলেন কোন কোন বিষয়ে বেশি ফোকাস করতে হবে।
রাত দিন গাইডটি পড়তে থাকলাম, কোনটা না বুঝলে বড় ভাইটির কাছ থেকে বুঝে আসতাম।
আলহামদুলিল্লাহ, ভর্তি পরিক্ষা দিলাম, ৪০ জন নিবে আমার নাম আসলো ২৬ নাম্বারে। বাড়িতে এসে বাবা কে বললাম। বাবা কিছু বললেন না, আমি ও বুঝতেছিলাম, বাবা কলেজের খরচ চালাতে পারবে না।
রাতে আমি মন খারাপ করে বসে আছি। বাবা বলেন যাও ভর্তি হও, প্রয়োজনে জমি বিক্রি করবো। আমি বললাম হোষ্টেলে উঠবো না, আশে পাশে কোথাও লজিং থাকবো।
মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি হলাম। সোনাপুর লজিং নিলাম। ছাত্র ছাত্রি ৪ জন। সকালে ভাত খেতে খুব কষ্ট হতো, কারন সকালে বাড়ীতে আম্মা বিভিন্ন রকম পিঠা বানাতেন, আর কিছু না হলে রুটি বানাতেন। এখন লজিং সকালে প্রতিদিন ভাত। কলেজে কখনো দোকানে নাস্তা করতে যেতাম না,, কারন বাবা কলেজের খরচ চালাতে কষ্ট হবে।
১৯৯৮ সালে ২ রাজনৈতিক দলের মারামারিতে কলেজ বন্ধ করে দিয়েছিলো সরকার। বাড়িতে চলে আসলাম। এক বছর পর সরকার থেকে বলা হলো মেকানিক্যাল বিভাগের ছাত্রগন ভর্তি হতে ফরিদপুর পলিটেকনিকে, এর মধ্যে ঢাকাতে লবিং করে আমরা ৫ জন ভর্তি হলাম।
পরিক্ষার রেজাল্টের জন্য বাড়িতে অপেক্ষা। এর মধ্যে বাবা অসুস্থ। আমি মাগরিব নামাজ পড়ে বসে আছি, আব্বা আমাকে ডাক দিলেন। বললেন আমি মনে হয় কথা বলতে পারবো না, আমি ভয় পেয়ে গেলাম, বললাম বাবা কালেমা পড়েন। আম্মা বিকালে ছোট বোনের বাড়িতে গেছে, আম্মার দাঁতে ব্যাথা ডাক্তার দেখাতে, ঘরে আমি আর বাবা, ঘরের বাহিরে এসে চিৎকার দিলাম ফুফু এইদিকে আসেন বাবা জানি কেমন করতেছে, আমি বাজারের দিকে দৌড়াতে থাকলাম ডাক্তার নিয়ে আসতে। পায়ে সেন্ডেল থাকায় ঠিক ভাবে দৌডাতে পারিতেছিলাম না, সেন্ডেল খুলে পেলে দিলাম, যাতে জোরে দৌড়াতে পারি। ডাক্তার নিয়ে আসলাম। বাড়িতে এসে দেখি বাড়ি বর্তি মানুষ, কলিজাটা মোচড় দিয়ে উঠলো, বাবা কি আর নেই?
ডাক্তার সব দেখলেন, ছোট কাকা, ফুফাতো ভাইয়া,ছোট দুলাভাই, ডাক্তারের সাথে কথা বললেন, বললেন, মুখে পানি দিতে ,, রাত ৩টায় বাবা কে হারালাম। মাথার উপর থেকে ছাতাটা সরে গেল।
বড় ভাই তখন বিদেশ ছিলো। ভাইয়া জানালেন, আমার এবং আম্মার খরচ দিতে পারবে না। তখন পায়ের নিচের মাটিও সরে গেল। কি করবো?
তখন বন্ধুদের বললাম আমার একটা কাজ লাগবে। তখনো রেজাল্ট আসে নাই। কোর্স কম্পিলিট সার্টিফিকেট দিয়ে, একটা স্টিল ফার্নিচারের ফ্যক্টরিতে জয়েন করলাম। একটা মেসে উঠলাম, তখন চৌকি কেনার মত টাকা ছিলোনা, একজনের সাথে শেয়ারে উঠলাম।
বেশি দিন চাকরি করতে পারলাম না, আমার মালিকদের মধ্যে কি একটা সমস্যা হলো কম্পানি বন্ধ করে দিলেন। আবার বেকার হয়ে গেলাম। আম্মা চাইলেন ছোট বোনের স্বামী কুয়েত থাকে, ওর গ্যরেজ আছে, আমি ঐ খানে যাই। কিন্তু কেন জানি বেদেশ যেতে আমার মন কে মানাতেই পারতেছিলাম না।
এর পর একটি ফারনিচার শোরুমে সেলসম্যান কাজ নিলাম। আমি মনে করাম ব্যবসা আমাকে দিয়ে হবে না, এর মধ্যে ডিপ্লোমা রেজাল্ট চলে আসলো প্রথম বিভাগে পাশ করলাম।
শো রুমে বেতন পেতাম ২৬০০ টাকা। কিন্তু সেইটা আমার লেখা পড়ার সাথে যায় না। পরে কয়েটা জায়গায় বায়োডাটা জমা দিলাম,, এর মধ্যে আবুল খায়ের ষ্টিলে জয়েন করলাম, ১৮০০ টাকা বেতেনে,, যেহেতু এই খানে জবের সাথে আমার লেখা পড়ার মিল আছে।
ষ্টিল মিলে জব, তার উপর প্রডাকশনের জব, কালি আর কালি, এক এক সময় জামা পড়ে এতই কালি লাগতো মনে হতো কালির ড্রামের সাথে গডাগডি করেছি। ডিউটি থেকে এসে সাবান দিয়ে হাত পরিস্কার করতে এক ঘন্টা লাগতো।কখনো কাজে ফাঁকি দি নাই।
কালি দেখে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকি নাই। আস্তে আস্তে গায়ে কালি লাগা কমে গেল, টেকনিক শিখে গেলাম কালি না লাগিও কিভাবে কাজ করা যায়।
আরেক দিন শুনাবো আমার উদ্যোগক্তা জীবনের গল্প।
আমি মুহাম্মদ মোতাহের হোসেন।
ব্যাচ নং ১৫।
রেজিষ্ট্রেশন নং ৬৯৯২৩.
ফেনী।
সোনাগাজী।
আমি কাজ করছি, অর্গানিক পন্য কাঠের ঘানির সরিষার তেল, ও বিভিন্ন ফুলের মধু ও শীতল পাটি নিয়ে।।