অনাহারে দিন কাটানো এক প্রবাসী উদ্যোক্তার গল্প
এম,ডি মাহবুব (Md Mahbub) ছাত্র থাকা অবস্থায় এক বুক স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি জমান সৌদি আরবে। প্রবাসে বড় ভাইয়ের কাছে তার প্রথম আশ্রয়। ভাইয়ের আদর এবং ভাইয়ের বন্ধুদের ভালোবাসায় ভালোই অতিবাহিত হচ্ছিল তার প্রবাস জিবনের শুরুর দিনগুলো। কিন্তু এই ভালো আর বেশি দিন স্থায়ী হলো না।হঠাৎ এক জরুরী কাজে তার বড় ভাইয়ের দেশে যাওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। বড় ভাই তার বন্ধুদের হাতে তাকে তুলে দিয়ে দেশে চলে যান। বলে যান একটু খেয়াল রাখতে এবং ভালো একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিতে। প্রথমে কিছু দিন তারা খোঁজ খবর রাখলেও প্রবাস নামক ব্যাস্ত জিবনে পরবর্তীতে আর কেউ তেমন খোঁজ রাখেননি। সবাই চাকরির আশ্বাস দিলেও কেউ চাকরির সন্ধান দেননি।
কিছুদিন পর ভাইয়ের দিয়ে যাওয়া টাকা শেষ হয়ে যায়। ফলে তিনি চরম অর্থ সংকটে পড়ে যান।খাবার কিনে খাওয়ার মত টাকাও তার কাছে নেই, এক কথায় যাকে বলে খালি পটেক। এমডি মাহবুব বলেন তখন তাকে কোন দিন অর্ধাহারে আবার কোন দিন অনাহারে থাকতে হয়েছে । ছাত্র জিবন শেষ না হতে, প্রবাসে কর্ম জিবনে প্রবেশের আগেই তিনি বুঝতে পারেন জিবন কত কঠিন। কেউ যখন কাজের সন্ধান দিচ্ছিলো না তখন তিনি নিজেই নেমে যান অচেনা শহরে কাজের সন্ধানে। না নেমেই উপায় কি অনাহার থেকে বেঁচে থাকা কি সম্ভব? বয়স তখন কতই হবে বড় জোড় ২০/২২ বছর। এত অল্প বয়সে এভাবে জিবন যুদ্ধে নামতে হবে তা কখনো কল্পনাও করেননি তিনি। এক বেলা খাবারের টাকার জোগার করার জন্য রোজ হিসেবে তাকে বিশাল বড় বড় বিল্ডিং এর দেয়ালে "বাদর ঝোলা" হয়ে জিবনের ঝুকি নিয়ে রংয়ের কাজ করতে হয়েছে, বাদ যায়নি রাজ মিস্ত্রীর কাজও।এত কষ্টের বিনিময়েও যদি খাবারের ব্যবস্থা হয় তাই অনেক কিছু। এভাবে কিছু দিন কাজ করার পর খাবারের কষ্ট দুর হয়ে যায়। অনাহারে দিন কাটানো ব্যাক্তির জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে পারা যেন হাতে চাঁদ পাওয়ার মত খুশির বিষয়। যে অনাহারে দিন কাটিয়েছেন একমাত্র সেই বুঝবে পৃথিবিতে খাবারের মূল্য কত। এদিকে তার বড় ভাই ৬ মাস পর ছুটি থেকে ফিরে আসে এবং তাকে গাড়ি চালাতে শেখায়।তিনিও কাজের ফাঁকে মন দিয়ে গাড়ি চালানো শিখতে থাকেন এবং কিছুদিন পর ড্রাইভিং লাইসেন্সও পেয়ে যান।
এখন তিনি খুজতে থাকেন মাসিক বেতনের একটু ভালো কাজ। অনেক খোঁজাখুঁজি করে হাউজ ড্রাইভারের একটি চাকরি পেয়ে যান। বেশ কিছু দিন তিনি এই চাকরি করেন। ড্রাইভিংয়ে কিছুটা দক্ষতা অর্জনের পর বৃদ্ধি পেতে থাকে বেতন। কয়েক দফা চাকরিও বদল করেন। এক পর্যায়ে চাকরি হয় সৌদি ধনকুবের ওয়ালিদ বিন তালাল এর একটি প্রতিষ্ঠানে, সেখানে ডিউটি কম হওয়ায় ডিউটির পাশাপাশি রিয়াদে টেক্সি চালাতেন। স্বপ্ন তার অনেক বড় হওয়া তাই বসে থাকতে তার ভালো লাগে না।
তিনি যেখানেই কাজ করেছেন সেখানেই মার্জিত ব্যবহার, সততা এবং বিশ্বস্ততার কারনে সবার সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। বেশ কিছুদিন ওয়ালিদ বিন তালালের প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার পর যোগ দেন রিয়াদস্থ একটি বাংলাদেশী ফুড কোম্পানীর সেলসম্যান হিসেবে। এখানেও সুনামের সাথে কাজ করতে থাকেন।
এম,ডি মাহবুব এখন অনেক আত্মবিশ্বাসী। এই দীর্ঘ সময়ে এক একটা চাকরি বদল করে একটু একটু করে এগিয়ে গেছেন বহুদুর। বিভিন্ন মহলে চলাফেরা করে অর্জন করেছেন অনেক অভিজ্ঞতা। যেখানেই কাজ করেছেন সফল হয়েছেন। ব্যার্থতার বদনাম তাকে কখনোই স্পর্শ করতে পারেনি। তাই তিনি নতুন করে ভাবতে শুরু করেন। এভাবে অন্যের চাকরি আর কত দিন? নিজে কে নিজেই প্রশ্ন করেন।
ফুড কোম্পানীতে সেলসম্যানের কাজ করা অবস্থায়ই ভাবতে থাকেন নিজে কিছু করার। তার দৃঢ় বিশ্বাস তিনি পারবেন আর এই বিশ্বাসই তাকে নতুন নতুন স্বপ্ন দেখাতে থাকে। তিনি যেখানেই যান, যা কিছুই করেন মাথার মধ্যে একটাই ভাবনা কিছু একটা করতে হবে।কিন্তু কী করবেন তা ভেবে পান না।
একদিন তিনি একটি দোকানে দেখতে পান পেকেট করা চানাচুর বিক্রি করতে। তিনি ভাবেন এই চানাচুর তো মন হিসেবে কিনতে পাওয়া যায় তারপর পেকেট করে বিক্রি যায়। এটিও তো হতে পারে একটি বিজনেস আইডিয়া। এই বিজনেস আইডিয়া টি স্বযত্নে লালন করতে থাকেন মনের মাঝে।
অনেক চিন্তা ভাবনা করে প্যাকেজিং বিজনেস করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। কিন্তু এই বিজনেস করতে অনেক টাকার প্রয়োজন এত টাকা তিনি কোথায় পাবেন? এবার শুরু হলো নতুন চিন্তা। তবে খুব সহজে হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র তিনি নন। তাই ইনভেস্টর খুজতে শুরু করেন। অনেক খোঁজাখুজির পর এক পর্যায়ে দুইজন সৌদি ইনভেস্টর পেয়ে যান। এবার তিনি দুই সৌদি ইনভেষ্টর নিয়ে একটি প্যাকেজিং কোম্পানীর কাজ শুরু করেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই "গৃহিনী" নামে একটি কোম্পানী করতে সক্ষম হন। হলুদের গুড়া, মিক্স মশল্লা, ডাল, গরম মসল্লাসহ প্রায় ৫০ ধরনের আইটেম প্যাকেজিং করে বাজারজাত করতে থাকেন। তখনো তিনি বাংলাদেশী ফুড কোম্পানীর সেলসম্যান। এমডি মাহবুব যখন দেখতে পেলেন কোম্পানী পুরোপুরি চালু হয়ে গেছে তখন তিনি সেলসম্যানের চাকরি ছেড়ে নিজের কোম্পানীতে সম্পূর্ন রুপে আত্ম নিয়োগ করেন। মনের মাধুরী দিয়ে সাজাতে থাকেন নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান। খুব অল্প সময়ে মার্কেটে ভালো সাড়া ফেলে তার "গৃহিনী" ফুড। এরপর তাকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি।
এখন তার কোম্পানীতে ১০জন লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এরা সবাই বাংলাদেশী। এমডি মাহবুব বলেন সৌদি আরবের মত পবিত্র ভূমিতে আমি ১০জন বাংলাদেশীর কর্মসংস্থান করতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। তিনি বলেন আমি ভালো থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশী ১০টি পরিবারকে স্বচ্ছল রাখতে পেরেছি এটাই আমার অর্জন। তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানতে চাইলে তিনি বলেন আমি এখন অনেক বড় স্বপ্ন দেখি। নিজের বলার মত একটা গল্প গ্রুপে যুক্ত হওয়ার পর আমার চিন্তাধারা পুরোই পাল্টে গেছে। আমি এবংনিজের বলার মত একটা গল্প গ্রুপের আমার পাঁচজন বন্ধু মিলে বাংলাদেশে একটি গ্রুপ অফ কোম্পানী করতে চাই এবং সেখানে অনেক লোকের কর্মসংস্থান তৈরি করতে চাই। যার সার্বিক দিক নির্দেশনায় থাকবেন শ্রদ্ধেয় Iqbal Bahar Zahid স্যার। তিনি বলেন আমি অল্প সময়ের মধ্যেই দেশে যাবো এবং নতুন গ্রুপ অফ কোম্পানীর কাজ শুরু করবো। ২০২০ইং বছরে আমাদের কোম্পানীর প্রায়৫/৬টি প্রোডাক্ট মার্কেটে থাকবে ইনশাআল্লাহ। এই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
এক সময় অর্থাভাবে অনাহারে দিন কাটানো সেই এম,ডি মাহবুব এখন সৌদি আরবে একটি কোম্পানীর মালিক এবং দশজন লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে তার কোম্পানীতে। অদুর ভবিষ্যতে তিনি বাংলাদেশে গ্রুপ অফ কোম্পানীর করার চিন্তা করছেন।
সৌদি প্রবাসী এই নবীন উদ্যোক্তা যার সফলতার গল্প শুনলেন তিনি "নিজের বলার মত একটা গল্প" প্লাটফর্মের রিয়াদের একজন এক্টিভ সদস্য এবং কমিউনিটি ভলান্টিয়ার। ৬ষ্ঠ ব্যাচ থেকে তিনি এই প্লাটফর্মে যুক্ত রয়েছেন। তার পিতার নাম হাসেম আলী। ময়মনসিংহ জেলার, মুক্তাগাছা উপজেলার রঘুনাথপুর গ্রামে তার বাড়ি। তিনি ২কন্যা সন্তানের জনক।
📌"স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ১০২
Date:- ২৯/১২/২০১৯ ইং
লোকমান বিন নূর হাসেম
রেজিষ্ট্রেশন নং ১৫৪
৩য় ব্যাচ, কোর ভলান্টিয়ার,
কান্ট্রি এম্বাসেডর, সৌদি আরব।
(শিবচর, মাদারীপুর)
lokmanbd22@yahoo.com