অভাবের সংসারে একটু সচ্ছলতা আনতে ঢাকায় এসেছেন তিনি।
“বলো বাবা, ‘ঐ’ তে ঐরাবত!”
খোকনের মন নেই পড়ায়। “ড-য়ে শূন্য ড়” এমন খটোমটো জিনিস কিছুতেই শেখানো যাচ্ছে না তাকে। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করে হাঁপিয়ে পড়েন মামণি।
দাদুভাই গ্রাম থেকে এসেছেন। ঘরে পা দিয়ে দেখেন খোকন তখনো মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে সামনে বই নিয়ে।
“কিগো বৌমা! খোকন বর্ণমালা শিখছে বুঝি?”
“চেষ্টা তো করছি। কিন্তু একদম আগাচ্ছে না পড়া!”
“এটা কোন সমস্যা না। মায়ের ভাষা তো, এমনিই শিখে নেবে। দেখি আমাকে দাও একবার।”
দাদুভাই আদর্শলিপি হাতে নিলেন। বয়সের ভারে চোখে ভাল দেখতে পান না। তবু চশমাটা চোখে দিয়ে বইয়ের পাতা উল্টান।
“দাদুমণি। পড়ো তো আমার সাথে, অ আ ই ঈ!”
“এগুলো পারি তো আমি।”
“আবার পড়ো। পড়ার সময় অক্ষর গুলিতে হাত বুলাও পরম মমতায়। “
খোকন আগেও পড়েছে বর্ণমালা। তবু আজ কেমন যেন লাগছে ওর। একটা অন্যরকম অনুভূতি।
খোকনকে পড়াতে গিয়ে দাদুভাই কেমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন। অনেক স্মৃতির ডালা ভিড় করেছে মনে। বইয়ের একেকটা অক্ষর যেন একেকটা ইতিহাসের সাক্ষী।
দাদুভাই বলেন, “এই যে তুমি বর্ণমালা পড়ছো। এগুলো একদম হৃদয়ে গেঁথে নেবে। এর ইতিহাস জানতে হবে তোমায়। এ যে রক্ত ও ভালবাসার দামে কেনা একেকটা অক্ষর।”
ভাষা আন্দোলনের সৈনিক দাদুভাই খোকনকে কোলে নিয়ে শুরু করেন গল্প। যে গল্পের দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। প্রাণের বিনিময়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার এক অনন্য গল্প। বাঙালির ইতিহাসের এক হার না মানা গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের গল্প।
বাংলা মায়ের দামাল তরুণেরা
ধর্মের দ্বৈরথে ভাঙ্গলো ভারত। মুসলিম জাতিসত্তার ভিত্তিতে গড়ে উঠলো পাকিস্তান রাষ্ট্র। কিন্তু এক ধর্মের মানুষে এত বৈষম্য কেন? ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের প্রশ্নে দুই প্রান্তে আকাশ পাতাল ব্যবধান। পশ্চিম পাকিস্তানিদের অন্যায় শাসন মেনে নেওয়া যাচ্ছে না আর। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে উর্দু ভাষা।
মন ব্যথিত হয়ে ওঠে আবদুস সালামের। অভাবের সংসারে একটু সচ্ছলতা আনতে ঢাকায় এসেছেন তিনি। পড়ালেখার বড় শখ ছিল। অভাবের তাড়নায় মেট্রিক ফাইনালটা দেওয়া হলো না। শিক্ষার চেয়ে পেট বাঁচানো আগে জরুরী। এখন ছোটখাটো একটা চাকরিতে আয়েশ না হোক, পরিবারের খরচটা জুটে যায়। এই কদিন আগে গ্রাম থেকে ঘুরে এলেন। বিয়ের কথাবার্তা চলছে। মা নিজের হাতে পাত্রী পছন্দ করছেন। সামনের শীতে বিয়ে হবে। কাজের ফাঁকে সালামের বড় ভাল লাগে এসব ভাবতে।
মানিকগঞ্জের রফিক উদ্দিনের গল্পটা আবার অন্যরকম। জগন্নাথ কলেজে পড়ার পাশাপাশি বাবার সাথে প্রেসের ব্যবসা শুরু দিয়েছেন। অনেকের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে এই প্রেসে আদর্শলিপি ছাপান তিনি। প্রতিটা অক্ষর ছাপানোর সময় গভীর মমতায় ছুঁয়ে দেখেন। একদিন এই ভাষা ব্যবহারের উপর শাসকের বাধার কালো হাত থাকবে না। সে হাত ভেঙ্গে দিতে হবে। মায়ের ভাষার উপর কারো খবরদারি চলবে না। তাই তো ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় রফিক উদ্দিন।
ময়মনসিংহের আব্দুল জব্বারের পড়ালেখা একদমই আগায় নি। একদম ছেলেবেলায় ঘর পালিয়ে বার্মা পাড়ি জমান। এক যুগ পরবাসে কাটিয়ে দেশে ফিরেন তিনি। জীবনটাকে গুছিয়ে নিয়ে বিয়েটা করে সংসারী হলেন। একটা ফুটফুটে পুত্রসন্তান এলো ঘর আলো করে। এতটুকু পুতুলের মত একটা মানুষ! আব্দুল জব্বারের বুকটা মায়ায় ভরে যায় ছেলেকে কোলে নিয়ে। কিন্তু বাস্তবতা যে বড় কঠিন। শাশুড়ির চিকিৎসা করাতে ঢাকায় আসেন তিনি। ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করান। চার মাস বয়সী দুধের সন্তানের কথা ভেবে বুকে অনবরত রক্তক্ষরণ হয় তাঁর।
সদ্য তারুণ্যে পা দেওয়া আবুল বরকত বরাবরই পড়ালেখায় ভাল। উচ্চ পর্যায়ের পড়াশোনার জন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে পাড়ি জমালেন তিনি। ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। অত্যন্ত মেধাবী বরকতকে আলোড়িত করলো ভাষা আন্দোলন। ভাষার টান যে প্রাণের প্রতি স্পন্দনে। আন্দোলন দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়লো সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, অফিস আদালতে এবং রাজপথের সবখানে। ছাত্র জনতার সাথে মিছিলে নেমে পড়লেন বরকত। ভাষার দাবী যে সবার আগে!
বায়ান্নর সেই উত্তাল দুপুর
সকাল এগারোটা থেকেই শিক্ষার্থীদের সমাবেশ শুরু। সমগ্র বাংলা আজ উত্তাল। ভাষার প্রশ্নে কোন ছাড় নয়। রক্ত ঢেলে দেবো রাজপথে, তবুও উর্দুকে মেনে নেবো না। মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিক্ষকদের সাথে নিয়ে অনুরোধ করেন ছাত্রদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার জন্য। কিন্তু আজ তো থেমে যাবার দিন নয়। ঢাকার রাজপথ কেঁপে উঠেছে চেতনার উচ্ছ্বাসে। শত বছরের শোষণের জবাবে আজ জন্ম নিয়েছে সচেতনতার ধান। সমবেত ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার। বিপুল সংখ্যক জনতা এগিয়ে যাচ্ছেন দৃপ্ত পদক্ষেপে। তারুণ্যের উদ্দীপনায় উজ্জ্বল একেকটা মুখ। তাতে নেই কোন ভয়, দ্বিধা, সংকোচ। মৃত্যুর ভয় যার নেই তাকে ঠেকাবে সাধ্য কার? বিপ্লবের স্ফূরণ মিছিলের প্রাণে। সমুদ্রে মত গভীরতা আজ জনতার ঢলে।
তাঁর ছেলে আজ মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় শহীদ হলো
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের সন্নিকটে এগিয়ে যাচ্ছে মিছিল। শাসক গোষ্ঠী পেশিশক্তির নির্লজ্জ প্রদর্শনীর মহড়া বসালো। হিংস্র পশুর মত ঝাঁপিয়ে পড়লো পুলিশ অস্ত্র হাতে নিরীহ ছাত্রদের উপর। কিন্তু আজ তো প্রাণ দেবে বলেই মিছিলে নেমেছে জনতা। নির্লজ্জ দানবের মুহুর্মূহু গুলিবর্ষণে কেঁপে ওঠে রাজপথ।
ঢাকা মেডিকেলের হোস্টেল প্রাঙ্গনে অবস্থানরত রফিকউদ্দিনের মাথায় আঘাত করে একটি গুলি। সেই গুলিতে মাথার খুলি উড়ে যায় বীর তরুণ রফিকের। যে হৃদয়ের সবটুকু ভালবাসা দিয়ে আদর্শলিপি প্রকাশ করতেন গভীর মমতায় তাতে আজ নেই প্রাণের স্পন্দন। মেডিকেলের বারান্দায় পড়ে থাকে বাংলার প্রথম ভাষা শহীদের নিথর দেহ।
মিছিলের অগ্রভাগে থাকা সালামের বুকে এসে বিঁধে পুলিশের গুলি। ভাষার দাবীতে স্লোগান দিতে থাকা সালাম লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। তাজা রক্তে ভেসে যায় রাজপথ। সংসার আর করা হলো না জনমদুখী সালামের। ভাষার অধিকার রক্ষার মহৎ দাবীতে প্রাণ দিলেন তিনি।
জব্বার শাশুড়িকে হাসপাতালে রেখে ছাত্রদের সাথে নেমে এসেছিলেন মিছিলে। দানবের নিষ্ঠুর গুলি খুঁজে নেয় তাঁকে। গলগল রক্তে ভেসে যায় জব্বারের দেহ। চার মাসের শিশু সন্তানকে রেখে যেই হাসপাতালে শাশুড়ির চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন, সেই হাসপাতালেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন জব্বার।
মেধাবী ছাত্র আবুল বরকত “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” বজ্রকণ্ঠের স্লোগানে মুখরিত করে রেখেছিলেন মিছিলের অগ্রপ্রান্ত। পুলিশের সাথে ছাত্র জনতার সংঘর্ষে একটি গুলি ছুটে আঘাত করে বরকতের তলপেটে। সুঠামদেহী উচ্ছ্বল বরকতের পরনের নীল হাফ শার্ট, খাকি প্যান্ট ভেসে যায় রক্তে। দু তিনজন ধরাধরি করে বরকতকে কাঁধে তুলে জরুরী বিভাগের দিকে দৌঁড়াতে থাকেন। ডাক্তাররা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন বরকতকে বাঁচাতে। কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। রক্তে ভেসে যাচ্ছে হাসপাতালের বিছানা। বহুকষ্টে বরকত একবার মুখ তুলে বলেন, “খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি বোধহয় বাঁচবো না ডাক্তার! আপনার কাছে অনুরোধ রইলো, মাকে পৌঁছে দেবেন আমার খবর। তাঁর ছেলে আজ মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় শহীদ হলো।” যে বরকত ঝড় তুলতেন মিছিল-মিটিঙে, যাঁর ডাকে জোয়ার উঠতো আন্দোলনে, তিনি আজ প্রাণহীন পড়ে রইলেন রক্তের সাগরে। সাতাশ বছরের টগবগে তরুণ বরকত শহীদ হলেন মাতৃভাষার আন্দোলনে।
আরেক দুঃসাহসী তরুণ শফিউর সাইকেলে করে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন। হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করা হয় তাঁকে। কিন্তু সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি। শফিউরের মেয়ে শাহনাজের বয়স মাত্র তিন বছর। তিনি মৃত্যুশয্যায় আকুতি করেন ভাইয়ের কাছে, “আমার মেয়েকে দেখে রেখো তোমরা। আমার যে আর কখনো ফেরা হবে না তার কাছে!” শফিউরের মৃত্যুর তিন মাস পর জন্মগ্রহণ করে তাঁর ছেলে শফিকুর রহমান। বাবাকে কোনদিন দেখা হয়নি তার। কিন্তু যে ভাষার জন্য প্রাণ দিলেন বাবা, সেই ভাষায় চিরদিন গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হবে তাঁর নাম।
এই নির্মম আগ্রাসনের শিকার কেবল ছাত্রজনতাই হয়নি। সেদিন ঢাকার রাজপথ অহিউল্লাহ নামের এক নয় বছরের শিশুর রক্তেও রঞ্জিত হয়েছিল। রাজমিস্ত্রীর সন্তান নাবালক অহিউল্লাহর নবাবপুর রোডের সামনে মাথায় গুলি লাগে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করে এই ক্ষুদে বিপ্লবী। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে অমর হয়ে রইলো এক দুঃসাহসী শিশুর নাম। রক্ত ও ভালবাসার বিনিময়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার যে অনন্য ইতিহাস তাতো কোনদিন ম্লান হবার নয়।
লক্ষ শহীদের বিনিময়ে আমরা যে ভাষা পেয়েছি সে ভাষায় হাসি যে ভাষায় কাদি সেই ভাষায় প্রকাশ করি নিজেদের অনুভূতি।
স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৪৬৭ Date:- ২১/০২/২০২১
ধন্যবাদ সবাইকে 😊😊
-👨নাম:- রাজীব বনিক
👬কমিউনিটি ভলেন্টিয়ার
👫রেজিষ্ট্রেশন টিম মেম্বার
🔢ব্যাচ:- দশম
🖋রেজি:- ১৮৭৯৯
🇧🇩জেলা:- ফেনী