আমরা পাগলের মতো ছুটে গিয়ে দেখি আমাদের প্রাণপ্রিয় আব্বু গাড়ির ভিতরে নিথর দেহে শুয়ে আছে
অনেকদিন ধরে লিখবো লিখবো ভাবছিলাম,কিন্তু যখনই লিখতে বসি কেন জানি, আব্বুর কথা খুব বেশি মনে পড়ে যায়। আমি আমার আব্বু কে অনেক বেশি ভালোবাসি, সত্যি বলতে আমি যখন এই গল্পটুকু লিখতে বসেছি তখন আমার দুচোখে শুধুই অশ্রু বেয়ে চলেছে কারণ আমার আব্বুর প্রতিটি স্মৃতি আমাকে আবারো মনে করিয়ে দিলো, তখন আমার চোখের সামনে আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় আমার আব্বুর ছবিগুলো ভাসছিল। আর বলছে, মা আর কাঁদিস নে, এইতো আমি তোর পাশেই আছি, কোথাও যায়নি তোকে ছেড়ে, আর এই সুন্দর পৃথিবীটুকু ছেড়ে, কোথাও যাইনি আমি, কোথ্থাও না। কখনোই না, আমি তোদের মাঝে আছি, ছিলাম এবং থাকব, অনন্তকাল....
এবার বলি আমার প্রাণপ্রিয় আব্বুর কথা। আমার আব্বু খুবই মধ্যবিত্ত বড় পরিবারের সেঝো সন্তান ছিল। আমার দাদুর অনেকগুলো সন্তান ছিল, মানে - ১১ জন। আর দাদা-দাদু মণি সহ -১৩জন।
কিন্তু এত বড় পরিবারের দায়ভার দাদাভাই একাই নিতে পারত না। এমনকি তার সন্তানদের কেউ ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া, চিকিৎসা ও পড়াশোনা করাতে পারতো না। তাই আমার চাচা- জেঠারাও খুব অল্প পড়াশোনা করেছে।
তার মধ্যে সবচেয়ে দুঃখের বিষয় ছিল, চিকিৎসার অভাবে আমার কিছু চাচা ও ফুফী খুব ছোট বয়সেই মারা গেলেন। কিন্তু আমার আব্বু ও চাচা-জেঠারা হাল ছাড়েননি। তারা অনেক কষ্ট করে দিনের পর দিন খেয়ে না খেয়ে দিন কাটিয়েছেন।
তারপর আমার বড় জেঠা খুবই অল্প বয়সে সংসারের হাল ধরতে অনেক কষ্টে বিদেশ পাড়ি জমান। শুধুই তার পরিবারের একটু সুখে থাকার আশায়। তারপর আস্তে আস্তে বড় জেঠা একে একে আমার আব্বু ও চাচাদের বিদেশ নিয়ে যান। এইভাবে করে আস্তে আস্তে আমার আব্বুরা সব ভাই মিলে সংসারের হাল ধরতে শুরু করল।
এরই মধ্যে হঠাৎ করে আমার দাদাভাইও না ফেরার দেশে চলে গেলেন, সবাইকে মাঝ পথে একা ফেলে। তারপর আমার দাদুমণি একাই তার প্রাণপ্রিয় সন্তানদের বুকে আগলে রেখে মানুষ করেছেন। এরই মাঝে আমার দাদুর পরিবারটি আল্লাহর অশেষ রহমতে হাসিখুশি ও আনন্দে দিন কাটছিল।
এবার আসি আমার আব্বুর কথা নিয়ে। আমার আব্বু মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলেন। কি অবাক হচ্ছেন তো??
হ্যাঁ, এটাই সত্যি। যখন সংসারের তাড়নায় আমার আব্বু বিদেশ যেতে চেয়েছিল, তখন আমার দাদুমণি যেতে দিতে চাইনি। বলল, বাবা আমার তুই এত ছোট বয়সে ঐ দূর দেশে কী করবি? তুই যে আমার কলিজার টুকরো, একা কি করে দিই তোকে আমি যেতে, আর কি নিয়ে থাকবো আমি এই ঘরে, একে একে আমার পুরো ঘর যে অন্ধকার হয়ে আসছে। তোরা সবাই কেন যে এই অসহায় মাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছিস রে বাবা...
আমি যে আর বাঁচবো না তোদের ছাড়া।
আমি তো মা... বুকে পাথর নিয়ে আর কতদিনই বা বাঁচবো বল। যাসনে সোনা, বাবা আমার, মাকে একা ফেলে। ঠিক তখন আমার আব্বু বলল, মা আমি যে তোমার সুখের জন্য বিদেশ যাচ্ছি আর যাওয়ার সময় তোমার মুখের হাসি আর তোমার শরীরের গন্ধ নিয়ে যাচ্ছি রে মা। আর তোমার শাড়ির আঁচল জড়িয়ে রাখবে আমায় সব সময়। তুমি আমাকে নিয়ে ভেবো না মা,
আমি ঠিকই একদিন তোমার বুকে ফিরে আসবো
ততদিন পর্যন্ত তুমি শুধুই আমার জন্য দোয়া করবে। এরপর আমার দাদুমণি বুকে পাথর চেপে, চোখের কোণায় অশ্রু লুকিয়ে, মুখে হাসি দিয়ে প্রাণপ্রিয় ১৬ বছরের আদরের কলিজার টুকরো মানিককে বিদায় দেন। তারপর শুরু হয় আমার আব্বুর প্রবাসী জীবন যুদ্ধ।
একে একে বিভিন্ন জায়গায় প্রতিনিয়ত কাজ শিখছে। তারপর বিভিন্ন জায়গায় পার্ট টাইম জব করতো। এভাবে চলতে লাগলো আমার আব্বুর একা একা সংগ্রামী জীবন যুদ্ধ। এভাবে কেটে যায় বহু বছর। এরই মাঝে আমার ফুফীদের বিয়ে দিলো। আমার আব্বু সংসারের হাল টানতে টানতে কখন যে নিজের বয়স পার হয়ে গেল, টেরও পাননি। অবশেষে আমার দাদুমণি জোর করে আমার আব্বুকে বিয়ে করাল।
তারপর শুরু হয় আমার আব্বুর আর এক নতুন অধ্যায়। বিয়ের কিছুদিনের মাথায় আমার আব্বু আমার আম্মুকে নিয়ে বিদেশে সংসার পাতে। সুখে দুঃখে দিন কাটছিল তাদের। এরই মাঝে কোল জুড়ে এলো আমার বড় ভাই। তার কয়েক বছর পর ঘর আলোকিত করে এলাম আমি। এইভাবে বিদেশে আমাদের ছোট্ট পরিবার সুখে দুখে আনন্দে কাটতে লাগল। তার মধ্যে আমার আব্বু প্রচুর অর্থ সম্পদের মালিক হোন। তার একটি মহৎ স্বপ্নের উদ্যোগে আমাদের গ্রামে একটি জায়গা কিনেন। যেখানে প্রতিষ্ঠিত হবে একটি মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানা। আলহামদুলিল্লাহ এরই মাঝে শহরেও একটি বাড়ি করেন। মোটামুটি সুখে-দুখে দিন পার করছিল আমাদের ছোট্ট পরিবারটি। হঠাৎ একটি দুঃসংবাদ আমাদের পুরো জীবনটাকে তছনছ করে দিয়েছে। আর সেই দুঃসংবাদটি হলো আমার দাদুমণি গুরুতর অসুস্থ। আর সেই সংবাদটুকু পেয়ে আমার আব্বু এক কাপড়েই আমাদের সবাইকে নিয়ে দেশে চলে আসেন। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, আমাদের আর ফিরে যাওয়া হলো না নিজের ঘরে। তারপর দাদুমণি সহ আমাদেরকে শহরের নতুন বাড়িতে একা রেখে কিছুদিন পর আব্বু আবার চলে যান বিদেশে, নিজের ব্যবসা বাণিজ্য দেখতে। তখন আমি এতটাই ছোট ছিলাম যে, কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখলাম আব্বু স্ট্রোক করেই আবার বিদেশ ফেরত হয়েছেন। তারপর থেকে আব্বু দেশেই ছিল। আর বিদেশ যাওয়া হলো না তার। এবার দেশেই কিছু একটা বিজনেস শুরু করলো। তার কিছুদিন পর আমাদের ঘর আলো করে এলো আমার ছোট ভাই। তখনো আলহামদুলিল্লাহ আমার দাদুমণিসহ ভালোই কাটছিল আমাদের দিনকাল।
হঠাৎ একদিন আমি স্কুল থেকে এসে দেখলাম আমার প্রাণপ্রিয় আব্বু পুরো শরীরে ব্যান্ডেজ করা বিছানায় পড়ে আছে। তখন হয়তো আমি ক্লাস ১/২ তে পড়ছিলাম।
কিছু বুঝে উঠার আগেই ঘরে ঢুকে ভয় পেয়ে গেলাম। চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম আর তখনই আম্মু এসে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, কাঁদে না মা, উনি তোমার আব্বু।
কিন্তু তখনও আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, যে উনি আমার আব্বু। তারপর ধীরে ধীরে আর ভয়ে ভয়ে আব্বুর পাশে গেলাম আর জিজ্ঞেস করলাম
আমি - আব্বু ও আব্বু তুমি এই কাপড়ের ভিতরে কি করছো?
আমার যে খুব ভয় করছে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসো না...
তখন আব্বু শুধু আমার দিকে তাকাচ্ছে আর দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে আর বিড় বিড় করে বলছে, মামণি ভয় পেয়ো না,
আব্বু আছি তো, তোমার সাথে লুকোচুরি খেলছি মা।
এভাবে আমি আরো কিছুদিন খেলবো তোমার সাথে।
তারপর আব্বু আবার তোমাদেরকে নিয়ে দোকানে যাব।
কিন্তু সত্যি বলতে কি জানেন, আমি একটু ও বিশ্বাস করিনি আমার আব্বুর কথা। কেননা আব্বু যখন দুষ্টুমি করে তখন মুচকি মুচকি হাসে আর যখন কষ্ট পাই তখন ও হাসে। কিন্তু দুচোখে অশ্রু বেয়ে।
তাই আমি বারবার আম্মুকে বললাম, কে মেরেছে আমার আব্বুকে এতটা নিষ্ঠুর ভাবে।
বলো কে, কে মেরেছে?
শেষ পর্যন্ত আম্মু বিকট শব্দে জোরে কান্না করে। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলছে, মা তোমার আব্বুকে কেউ মারেনি। তোমার আব্বু তিন তলা ছাদ থেকে মাথা ঘুরে নিচে পড়ে যায়। আসলে সেই সময় আব্বু আবারো ২য় বারের মতো স্ট্রোক করেছিল। বিশ্বাস করুন আমি আজও ভুলতে পারিনা সেই স্মৃতি, সেই কান্না, সেই আহাজারি আর আমার আব্বুর সেই কষ্টের দিনগুলো।
আমাকে এখনো দিনরাত তাড়া করে বেড়ায়।
আমার আব্বুর বেডে অসুস্থ অবস্থায় এইভাবে ৬/৭ মাস কেটে গেল। আল্লাহর অশেষ রহমতে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল। এরপরে আব্বু আর কোন কাজ করতে পারেননি। একপ্রকার বেকারত্ব জীবন বেছে নেন। কারণ আব্বুর পুরো শরীর সার্জারি করা ছিল। শরীরের কিছু কিছু জায়গায় প্লাস্টার ও করা ছিল। তাই পরিশ্রম একদমই নিষিদ্ধ ছিল আব্বুর জন্য।
তারপর ধীরে ধীরে আমাদের সংসার বড় হতে লাগলো। এইভাবে সুখে-দুখে কাটতে লাগলো।
এইবার বলুন আমাদের ৫ ভাই বোনের বাবা-মা সহ এত বড় সংসার কিভাবে চলত। আমাদের যত সহায় সম্পত্তি ছিল, সবটুকু বিক্রি করে দিয়েই আমাদের পরিবার চলত।তার মাঝেও বিভিন্ন আইনি জটিলতাও ছিল আমার আব্বুর। সারাজীবন দেখতাম, শুধু কোর্টে আর কোর্টৈ যেতেন। কিন্তু কখনো আমাদেরকে তার কষ্টটুকু বুঝতে দিতেন না। সব সময় হাসিখুশি থাকত পরিবার নিয়ে। এত অসুস্থতার মাঝেও তিনি
৫ ওয়াক্ত নামাজ ঘরে বসে আদায় করতেন। বছর খানেক পরে আমরা বড় হলাম। ৫ ভাই-বোনই পড়াশোনা করছি। তবে খুবই কষ্ট করে।
এবার আসলো, আমাদের জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিন। সেটি হলো ২০০৭ সালের ২০শে এপ্রিল। সেদিন খুব ভোরে আমার আব্বু সকালবেলা নাস্তা করে বের হলো কিছু একটার উদ্দেশ্যে।
তখন বাজে মনে হয় সকাল ৮:০০টা। ঠিক তখনই কার যেন একটা ফোন আসে বাসায়। বলল, তোমাদের বাবা চট্টগ্রাম মেডিকেলে আছে। তোমরা কেউ এসে তাকে নিয়ে যাও। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে তখন আমরা কেউ কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। তাই আমার ভাইয়েরা ছুটে গিয়েছিল মেডিকেলের উদ্দেশ্যে। তার কিছুক্ষণ পরে আমার ভাইরা এসে বলল, আব্বুকে কোথায় শোয়াবে, গ্রামে না শহরে....
কিন্তু বিশ্বাস করুন আমরা কেউ তখন কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। ঠিক যখনি এম্বুলেন্স এর শব্দ পেলাম, আমরা পাগলের মতো ছুটে গিয়ে দেখি আমাদের প্রাণপ্রিয় আব্বু গাড়ির ভিতরে নিথর দেহে শুয়ে আছে নিঃশব্দে। ঠিক তখনই মনে হলো, মাথার উপর পুরো আকাশটি ভেঙ্গে পড়েছে, পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে আর বুক ফেটে মনে হচ্ছে যেন শরীরের প্রতিটি রক্ত বেরিয়ে আসছে আর বলছে, আব্বু কেন তুমি এমনটা করলে, কেন কেন কেন...
এতটা স্বার্থপর না হলেও তো পারতে।
কেন আমাদেরকে একা ফেলে আর এতিম করে চলে গেলে না ফেরার দেশে।
আমার আব্বুর অনেক বড় একটা স্বপ্ন ছিল। তার স্বপ্ন ছিল মৃত্যুর আগে তিনি যেন তার প্রতিষ্ঠিত মসজিদ ও মাদ্রাসা আর এতিমখানার প্রতিষ্ঠানটি চালু করে যেতে পারেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমার আব্বুর সেই স্বপ্নটুকু আর পূরণ করা হলো না। তার আগেই তিনি চলে গেলেন অর্ধনির্মিত কাজটি ফেলে। তাই আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, যদি বেঁচে থাকি আর সুস্থ থাকি তাহলে আমি আমার আব্বুর সেই অপূর্ণ স্বপ্নটুকু পূরণ করবো ইনশাআল্লাহ। কিন্তু কিভাবে কি করবো তা আমার জানা নাই। কেননা আমি আমার প্রাণপ্রিয় আব্বুকে অনেক অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি। তাই সবাই আমার জন্য ও আমার আব্বুর জন্য দোয়া করবেন।
তাই আমি সব সময় দোয়া করি আল্লাহ তা'আলা যেন আমার আব্বুকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মোকাম দান করেন। আমিন ছুম্মা আমিন
দোয়া করি আল্লাহ তা'আলা যেন পৃথিবীর সকল বাবা-মাদেরকে সুস্থতা ও নেক হায়াত দান করেন।
পরিশেষে বলব, প্লিজ সবাই আমার লিখাগুলো ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কেননা যখন লিখতে বসেছি, তখন আমি খুব বেশি অশ্রুসিক্ত চোখে ভেঙ্গে পড়েছিলাম তাই..
সবাইকে ধন্যবাদ আমার এই লেখাটা আপনাদের মূল্যবান সময় ব্যয় করে পড়ার জন্য।
স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৪৭৪
Date:- ০২/০৩/২০২১
শিরিন সুলতানা
কমিউনিটি ভলান্টিয়ার
নিজের বলার মত একটা গল্প ফাউন্ডেশন এর গর্বিত সদস্য
টপ টুয়েন্টি ক্লাব সদস্য
রেজিস্ট্রেশন-৪৬৫৩৮
ব্যাচ -১২
জেলা - চট্টগ্ৰাম