সবার জীবনের গল্প আর ভাগ্য এক হয়না।
বর্তমানে বাংলাদেশে এখন বেশ কিছু পরিচিত শব্দ আমাদের কানে আসে, আর তা হচ্ছে স্টার্টআপ, উদ্যোক্তা, স্বাবলম্বী হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানো, সামাজিক যোগাযোগ ব্যবসা (সোশ্যাল মিডিয়া বিজনেস), ডিজিটাল মার্কেটিং, ই-কমার্স এবং অ্যাপস ডেভেলপার। আমাদের দেশের অনেক তরুণ আছে যারা মেধা আর যোগ্যতার গুণে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোতে চাকরি নিয়ে নিশ্চিন্তে জীবন পার করে দিতে পারতো। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তারা তা না করে নিজেই কিছু করার চেষ্টা করছে। উদ্যোমী তরুণদের এ প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। এক্ষেত্রে অনেকে মহৎ উদ্যোগ নিয়েছেন তরুন উদ্যোক্তা তৈরিতে। যারা তাঁদের মেধা, শ্রম ও মানসিক শক্তির মাধ্যমে তরুণ, বেকার সমাজের ব্যাক্তিবর্গকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন নিজের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি আরও অনেকের কর্মসংস্থান করার। আমি নিজ প্রচেষ্টায় একজন আগত সফল উদোক্তা হতে চাই, কারন সফলতার কোন শেষ নেই। তাই আমিও চাই এ দেশের সাহসী তরুণরা উদ্যোক্তা হওয়ার পথে এগিয়ে আসুক এবং চাকুরীর পেছনে না ছুটে নিজের একটি বিজনেস প্রতিষ্ঠান দার করে দেশের বেকারত্ব দুরিকরনে অগ্রনি ভুমিকা পালন করুক।
আমি ছোটবেলায় উদ্যোক্তা হওয়ার কথা ভাবিনি, হয়তো উদ্যোক্তা নামটির সাথেও পরিচিত ছিলামনা। বরং মনের ভিতরে লুকায়িত ইচ্ছে ছিল একজন ইঞ্জিনিয়ার হব। অন্যদিকে মা-বাবার চাপ ছিল আমি সাধারণভাবে পরালেখা শেষে একটি নিরাপদ চাকরি করি। উল্লেখ্য যে, যেহেতু আমিই ছিলাম পরিবারের ছোট, সবাই যেহেতু জেনারেল লাইনে পড়াশোনা করেছে, তাই আমাকে মাদ্রাসায় পড়াবেন, আর হয়েছিলও তাই। এটিই হচ্ছে আমাদের দেশের মূল সমস্যা। আমাদের সমাজ এবং পরিবার চায় প্রত্যেকেই আরেকটি প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানিতে চাকরি করুক। সন্তান কি হতে চায়, তা আমরা হয়তো অনেকে মুল্যায়ন করিনা। আলহামদুলিল্লাহ, এর মাঝেও অনেক মঙ্গল রয়েছে, হয়তো মাদ্রাসায় আলিম পর্যন্ত পরাশুনা করে ইসলাম সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। হায়াত, মউত আল্লহর হাতে, তবে বাবার ইচ্ছে, তাঁর জানাজা যেন কোন ধার করা মৌলভী দিয়ে না করতে হয়। আলহামদুলিল্লাহ, আলিম পাশের পরে ইংরেজীতে অনার্স ভর্তি হই। যেহেতু ব্যাকগ্রউন্ড মানবিক ছিল, তাই আর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বপ্নের দিকে ছোটা হয়নি।
ছাত্রজীবনের শুরু থেকে নিজের পড়ার পাশাপাশি ইংরেজি প্রাইভেট পড়াতাম (যদিও আমি মাদ্রসার্ আলিম ক্লাসের ছাত্র ছিলাম, আমি জেনারেল এইচ, এস, সির ইংরেজি পড়াতাম একই ক্লাসে থাকাকালীন) অনার্স প্রথম বর্ষ পরীক্ষার পরে টিউশনি করে মোটামুটি ৫৬ হাজার টাকা জমা হয়েছিল যা দিয়ে একটি ল্যাপটপ কিনি। আর শুরু করি নতুন কিছু করার। ২০১০ সালের freelancer.com এ একাউন্ট খুলি, প্রথম কাজ ৫ দিনে পাই, ৪০০ ডলারের। কিন্তু সেখানে বেশিদিন কাজ করা হয়নি। একাউন্ট খুললাম oDesk.com (বর্তমানে Upwork.com) এ, আর এখানেও কাজ পাই একাউন্ট খোলার দুইদিনে (Virtual Assistant হিসেবে, প্রথম ঘন্টাভিত্তিক কাজ, ঘন্টায় ১ ডলার রেট)। এভাবেই টিউশনি আর ফ্রিলেন্সিং করে চালিয়ে যাই দুইবছর, ভাগ্যক্রমে ২০১২ সালে গুগল এর মেটাওয়েব টেকনলজিতে তাঁদের একটি প্রজেক্টে কাজ করার সুযোগ হয়, আর এর মাঝে আমার আইটি জগতে ঢোকা। কাজ করি গুগল সার্চের ইন্টারনাল ডাটাবেইজ আপডেটের। আর এই অভিজ্ঞতার আলোকে শুরু করি ব্লগিং, প্রযুক্তি নিয়ে লেখালেখি। যা পরবর্তীতে আইটি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়ে কিছু বেকারের কর্ম সংস্থানের সুযোগ করে দেয়ার ভাগ্য হয়। আর অবচেতনভাবে বা অনিচ্ছা সত্ত্বেও হয়ে উঠি একজন সম্ভাব্য উদ্যোক্তা। পড়ালেখা শেষে চাকুরীর চেষ্টা করা হয়নি, তবে পড়ানো যেহেতু একটা নেশায় পরিনত হয়েছে, তাই না পড়িয়ে হয়তো সময় ভালো কাটেনা। তাই নিজ এলাকায় থাকার জন্য একটি কলেজে ইংরেজী প্রভাষক হিসেবে যোগদান করি। অদ্যবধি সেখানেই আছি বিজনেস এর পাশাপাশি। নিজের যদি প্রবল ইচ্ছেশক্তি থাকে, তাহলে সবসময় নামি দামি প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার সুযোগ না থাকলেও পরিবারের স্বপ্নের পাশাপাশি নিজের স্বপ্নেরও বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
আমাদের এই সমাজব্যাবস্থা এখনও সেই পর্যায়ে যায়নি। আমরা অন্যের চাকুরীর ব্যাবস্থা করার চেয়ে নিজের চাকুরী খুজতে ব্যাস্ত। কেউ ভাবে না যদি সবাই অন্যের চাকরি করে, তবে চাকরিদাতা হবে কে, কোম্পানি তৈরি করবে কে। স্বাধীনতার পর উদ্যোক্তা উন্নয়নের পথে বাংলাদেশের পথচলা খুব বেশি গতিময় না হলেও দেশের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছেন বেশ কিছু প্রতিভাবান উদ্যোক্তা। যাঁরা স্বপ্ন দেখেছেন এবং সেই স্বপ্ন পূরণে ঝুঁকিও নিয়েছেন। তাঁদেরই প্রচেষ্টার ফল আজকের স্বনামধন্য ব্র্যান্ড আর এফ এল, আকিজ, স্কয়ার, প্রাণসহ আরো অনেক কোম্পানি।
“একজন উদ্যোক্তার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি গোছানো প্রতিষ্ঠান পায়, আর একজন চাকুরীজীবীর ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সবসময় শুরু থেকেই শুরু করতে হয়, যেমন পরালেখা, চাকুরীর প্রস্তুতি, ছাকুরিতে জগদান, প্রোমোশন, অবসর।“
যখন একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আমি যাত্রা শুরু করি, তখন আমি কোনো সাহায্যকারী পাইনি এবং শিখতে হয়েছে অনেক কষ্টে, সবচাইতে বড় সাহায্যকারী এক আল্লাহ, দ্বিতীয়ত গুগল সার্চ। তবে ইংরেজি ব্যাকগ্রউন্ড (চলমান সেসময়) অনেক কাজে দিয়েছে। আমি অনেক ব্লগ, পোর্টাল এর লেখা পড়েছি, আর সে থেকেই লেখালেখিতে উৎসাহ পাই। সত্যিকার অর্থে আমি চলতে চলতেই শিখেছি। এগিয়েছি, বাধা পেয়েছি এবং সেখান থেকে শিখেছি। একজন নতুন উদ্যোক্তাকে বলব, উদ্যোক্তা হওয়ার পথটা সহজ নয়, এটির পথে পথে আছে ঝুকি। তবে একবার সফলতা আসলে আর হয়তো পেছনের দিকে ফিরে তাকাতে হবেনা। তাই উদ্যোক্তা হওয়ার প্রারম্ভে অল্প অল্প করে শুরু করতে হবে। আমাদের সমাজে ধনী পরিবার থেকে উদ্যোক্তা হলে কিছু আর্থিক সুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি কোন ঝুঁকিতে পড়লে তা কাটিয়ে উঠার সুযোগ থাকে। কিন্তু আমাদের মত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে এ সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আমাদেরকে প্রতিটি পদক্ষেপেই মোকাবিলা করতে হয় একেকটি বাধা । আর সেই বাধা শুরু হয় অর্থনৈতিক টানপরেন থেকেই। নিজের পরিবারের বা পরিচিতদের যদি সমর্থন দেয়ার মত উল্লেখ যোগ্য কেউ না থাকে, আর পুঁজির যদি কোনধরনের স্বল্পতা থাকে, তাহলে অবশ্যই আপনাকে সাহস নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে।
একজন উদ্যোক্তা হওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা হলে যা করতে হবে, প্রথমত আপনার লক্ষ্য স্থির করতে হবে, আপনি কী বিষয়ে অভিজ্ঞ, কোন কাজে আপনি উৎসাহ পান, কোন কাজ করতে আপনার ভালো লাগে, কোন কাজ করতে কখনও বিরক্তিভাব আসেনা ঠিক সে ধরনের কাজ নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। যেমন আমি Computer and Internet Savvy ছিলাম এবং আছি। তাই হয়তো আমার সেক্টর এটিই, আর আমার নিজের কখনও বিরক্তি আসেনা এই কাজে।
আপনাকে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ গুণ অর্জন করতে হবে, আর তা হচ্ছে ধৈর্য, যা একজন উদ্যোক্তার জন্য খুব বেশি প্রয়োজন। উদ্যোক্তা হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে দেখবেন আপনার সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতাই বেশি আসে। কিন্তু আপনাকে প্রতিটি ব্যর্থতাকে অত্যন্ত ধৈর্যসহকারে মোকাবেলা করতে হবে। আর নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে আপনার লক্ষে পৌঁছানোর জন্য।
আপনার কাছে হয়তো পর্যাপ্ত অর্থ থাকবেনা, কারন এটিই পৃথিবীতে একমাত্র জিনিস, যা কখনই পর্যাপ্ত থাকেনা। যেটি আপনাকে করতে হবে, তা হচ্ছে, হাতে যা আছে তাই নিয়ে নেমে পড়তে হবে। কিছুদিন আগে ফেইসবুকে লিখেছিলাম
“যারা একবারে বড় করে শুরু করতে চায়, তাঁদের সফলতাও আসে দেরীতে ।”
তাই আপনার কাছে যা আছে, তা দিয়েই শুরুটা করুন, আর নিজের চেষ্টার উপরে কাজ করে যান, সৃষ্টিকর্তার উপরে ভরসা রাখুন, চেষ্টা অব্যহত রাখুন, সফলতা একদিন আসবেই, ইনশাআল্লাহ।
আপনাকে আপনার যে সীমিত অর্থ বা পুজি রয়েছে, সে অর্থের যথাযথ ও প্রত্যাশিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আপনাকে সবসময় মনে রাখতে হবে যে, অল্প পুজি নিয়ে আর শূন্য হাতে একটি মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা আপনি , তাই আপনার জন্য এ পথটি কখনই সহজ নয়। প্রাথমিক অবস্থায় আপনাকে নিজের ব্যাবসায় মনোনিবেশ করতে হবে। অর্থের অপচয় যেন কোনোক্রমেই না হয়। এককথায়, আপনাকে মিতব্যায়ী হতে হবে।
বর্তমান সময়ে যারা ঝুঁকি নিতে পারে, একসময় তারাই হবে সফল উদ্যোক্তা এবং তাদের তৈরি সেবা, পণ্য কিংবা উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে সমাজের গতিপ্রকৃতি পরিবর্তন হবে। যে বিষয়ে আপনি আপনার স্টার্টআপ করবেন, সে বিষয়ে আগে যথেষ্ট গবেষনা করবেন। যে ধরনের বিজনেস করার পরিকল্পনা নিয়েছেন, এরকম লোকদের সাথে কিছুদিন উঠাবসা করবেন। ব্যবসার ধরন বুঝবেন। তাহলে হয়তো ঝুকিটা কম থাকবে। কিন্তু অধিক লাভের আশায় একেবারে না বুঝে বেশি ইনভেস্ট করলে, আপনার স্টার্টআপ হবে অনেকটা জুয়া খেলার মতো, আর ভাগ্যের উপরে।
পরিশেষে বলতে চাই,
"একজন উদ্যোক্তা, একজন দেশের অর্থনৈতিক যোদ্ধা। আপনার ব্যর্থতার সময় উপহাস করার অনেক লোক থাকবে, আবার সফলতার পেছনেও দেখবেন আপনার ক্ষতি করারও অনেক লোক থাকবে এবং আপনাকে হারাতে অনেক কূটকৌশল বেছে নিতে পারে। সাহস করুন, ধরে রাখুন, আর এই কথা ভাবুন, উদ্যোক্তারা হল দেশের অর্থনৈতিক যোদ্ধা, এরা কখনই হারেনা। শুরুতে আপনার কাজের স্বীকৃতি নাও পেতে পারেন, কিন্তু আপনার মধ্যে যে ন্যায়পরায়ণতা, সততা এবং পরিশ্রম রয়েছে, তাঁর বদৌলতে আপনার সফলতার স্বীকৃতি আপনি একদিন ঠিকই পাবেন।"
আপনি হয়ে উঠবেন রোল মডেল। সবার সফলতা কামনা করি। সবার কাছে দোয়াও প্রার্থনা করি।
সবাইকে ধন্যবাদ আমার এই লেখাটা আপনাদের মূল্যবান সময় ব্যয় করে পড়ার জন্য।
Date:- ০৩/০৩/২০২১
"স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৪৭৫
মমিনুল ইসলাম
শিক্ষক, ব্লগার ও উদ্যোক্তা
ব্যচ নং ১২
রেজিস্ট্রেশন নং ৪২৩০৬
বীরগঞ্জ, দিনাজপুর।