এস, এস, সি পরিক্ষা দিলাম ভালো রেজাল্ট করলাম এখন কলেজে ভর্তি হবো কি যে আনন্দ
আমি খাদিজা আক্তার।মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম।আমার বাবা ছোট খাটো একটা ব্যবসায় করেন।তা দিয়েই আমাদের সংসার চলে।আমরা তিন ভাই বোন।তাদের ভিতরে আমি মেজো,আমার বড় বোন এবং ছোট একটা ভাই রয়েছে।আমি ছোটবেলা থেকেই দেখেছি আমার বাবা আমাদের জন্য অনেক কষ্ট করেছেন।কারন আমাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী হচ্ছেন আমার বাবা।আমার মা একজন গৃহিনী।তবে বাবা মায়ের কষ্ট হলেও আমাদের কোনো কিছুর প্রয়োজন অপূর্ন রাখেন নি।
আমি ছোট বেলা থেকেই শান্ত স্বভাবের ছিলাম।সবার সাথে মিশতে পারতাম।সবাই আমাকে খুব ভালোবাসতো বিশ্বাস করতো।
আমাদের পরিবারে পরাপর আমরা দুই বোন ছিলাম।তাই অনেকে অখুশিও ছিলো,কিন্তু তার পরেও আমরা দু বোন নম্র ভদ্র ছিলাম বলে, মা বাবা আমাদের ভালোবাসতো।তবে তাদের ছেলে সন্তানের জন্য চাপা একটা কষ্ট রয়েই গেছে।
আমি আর আমার বড় বোন লেখা পড়ায় খুবই আগ্রহী ছিলাম।আমি তখন ছোট, বড় বোন আমাকে স্কুলে নিয়ে যেতো আদর করতো।এক কথায় আমার বড় বোন আমার জীবনের অন্যতম একজন ছিলো।আল্লাহ আমার জন্য আমার বোনকে ছায়া হিসেবে দান করেছেন।এরকম আমাদের দিনগুলো চলতে লাগলো হঠাৎ করে আমাদের পরিবারে খুশির আমেজ নেমে আসলো আমাদের একটা ভাই হলো।ভাইকে পেয়ে আমরা সবাই খুশি।কিন্তু সেই খুশির সময় যেতে না যেতেই আমাদের সংসারে নেমে আসলো শোকের ছায়া।আমার বড় আপু আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চিরদিনের জন্য আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।আমার আপু খুব ভালো ছিলো।তখন আমার আপুর বয়স ছিলো ১১ বছর।সামান্য একটু জ্বর হয়ে সে ২০০২ সালে মারা যায়।আমি আমার বোনকে হারিয়ে একা হয়ে যাই।আজও আমার মা বাবা, বোনের জন্য ভেবে ভেবে কাঁদেন।আমাদের সংসারের বড় সন্তান ছিলো তো সে,মা বাবার কোল জুড়ে প্রথমে আমার আপু দুনিয়াতে আসছিলো তো।তাই তো আজও আমাদের পরিবারে তার স্থানটা অন্যতম।
আমি ছোট বেলা থেকেই লেখা পড়ায় খুব আগ্রহী ছিলাম।আমাদের বাসা থেকে স্কুল অনেক দুরে ছিলো।পুরো পথ পায়ে হেটে যেতাম আবার পায়ে হেটে আসতাম।ছোট থেকেই ইচ্ছা ছিলো আমি লেখা পড়া করে অনেক বড় হবো অনেক বড় চাকরি করবো।বাবা মাও কখনো বাধা দিতো না, কারন পড়াশুনায় একটু ভালো ছিলাম তাই।তবে তাদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে একটু কষ্ট হতো আমি বুঝতাম কিন্তু আমাকে তারা কখনো বুঝতে দেইনি।কারন আমার লেখা পড়ার করার অনেক ইচ্ছা ছিলো পড়াশুনায় বেশ মনযোগী ছিলাম।তাই তারা কষ্ট হলেও আমার পাশে ছিলো।আর আমার মনেও ইচ্ছা শক্তিটা আরও বেড়ে গেলো যে কষ্ট হলেও আমাকে লেখাপড়া করে কিছু একটা করতে হবে।যেহেতু আমি এখন পরিবারে বড় তো, মা বাবার পাশে তো আমাকেই দাড়াতে হবে।তাছাড়া আমার বাবা এত পরিশ্রম করে যাচ্ছে আমার জন্য তার এই কষ্ট কোন ভাবেই আমি বিফলে যেতে দিবো না আমাকে ভালো ভাবে পড়াশোনা করে যেতে হবে।
এভাবেই চলতে লাগলো কিছু দিন পর এস, এস, সি পরিক্ষা দিলাম ভালো রেজাল্ট করলাম।এখন কলেজে ভর্তি হবো কি যে আনন্দ ছিলো মনে।কিন্তু ঠিক তখন থেকেই কিছু ছোট ছোট সমস্যা আসতে শুরু করলো।বাবার কাছে অনেকেই বিয়ের জন্য প্রস্তাব নিয়ে আসতে শুরু করলো।প্রথমে বাবাও চাইতেন না যে আমাকে এত তাড়া তাড়ি বিয়ে দিবেন।কিন্তু বাবাকে অনেকে বলে, মেয়ে বড় হইছে বিয়ে দাও,মেয়েদের এতো পড়াশুনা করানোর কি দরকার ছেলেকে পড়াও কাজে লাগবে।বাবাও একটা সময় এসে অন্যের কথায় বিয়ে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল।আমিও কোনো ভাবে বিয়েতে রাজি হইনি আমার একটাই কথা ছিলো যে আমি পড়াশুনা শেষ না করে বিয়ে বসবো না।মাও আমাকে সাপোর্ট দিলো তারও একটা কথা আমার একটা মেয়ে কেনো এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিবো।সে সব সময়ই আমার হয়ে বাবাকে বুঝাতো।এভাবেই নানা সমস্যার ভিতর দিয়ে আমি আমার লেখাপড়া চালিয়ে গেছি।এখন আমি চলতিবছরে অনার্স শেষ করতে পেরেছি, আলহামদুলিল্লাহ।
আমরা গ্রামে থাকি।আমার প্রাইমারি থেকে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত সবটাই আমাদের এলাকায় সম্পূর্ণ করেছি।গ্রামের পরিবেশটা একটু অন্যরকম।মেয়েদেরকে গ্রাম্য সমাজ একটু অন্য দৃষ্টিতে দেখে সেটা সবাই আমরা জানি।গ্রামের পরিবেশে থেকে এই পর্যন্ত লেখাপড়া চালিয়ে নিয়ে আসতে অনেক কাঠঘর পোহাতে হয়েছে আমাকে।গ্রাম্য সমাজে কুসংস্কারের প্রচলনটাই বেশি।এতটা পথ পারি দিতে এলাকার মানুষের কুকথা,আত্নীয় স্বজনদের হেয় দৃষ্টি ইত্যাদির ভিতরে পরতে হয়েছে আমাকে হাজার বার।
বাবাকে বলতো মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দাও বয়স বেশি হলে বিয়ে দিতে পারবা না।তখন কেউ পছন্দ করবে না আর পছন্দ করলেও তখন অনেক টাকা যৌতুক দিতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি নানা কথা।লোকের কথা শুনে অনেক খারাপ লাগতো কিন্তু তার পরেও কখনো পিছুপা দেইনি আমাকে কেউ থামিয়ে রাখতে পারেনি। দুচোখ ভরা স্বপ্ন ছিলো লেখাপড়া করতেই হবে তারপর ভালো একটা চাকরি করবো বাবার পাশে দাড়াবো।আর যারা আমাকে নিয়ে কথা বলছে তাদেরকে দেখিয়ে দিবো যে মেয়েরাও পড়াশুনা করে চাকরি করতে পাড়ে এবং পরিবারকে সাপোর্ট দিতে পারে।যাক সর্বপরি আল্লাহ আমার মনের আশা পূরন করেছেন পড়াশুনাটা করতে পেরেছি।আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।সব কিছু ঠিক থাকলে মাস্টার্সটাও সম্পন্ন করতে চাই সবার দোয়া কামনা করছি।
বাবা আমাদের দু ভাই বোনকেই লেখাপড়া করাচ্ছেন।আমি অনার্স শেষ করলাম সবে আর আমার ছোট ভাইটা ক্লাস টেনে পড়ে।
অনার্সে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই নিজের ভিতরে কিছু করার ইচ্ছা চলে আসে কারন বাবা একা আর পারছে না ছোট ভাইয়ের খরচ আমার খরচ সংসারের খরচ ইত্যাদি।তাই ভাবলাম কিছু একটা করতে হবে।ফাকে ফাকে ২-১ টা টিউশুনি করাতাম তাতে যে টাকা পেতাম তা দিয়ে নিজের হাত খরচটা চালাতাম।কেননা তখন বাবার কাছে কিছু চাইতে খারাপ লাগত। চাকরিও পাচ্ছি না এই সব চিন্তায় দিন কেটে যায়।চাকরির জন্য অনেক চেষ্টা করছি কিন্তু আত্বীয় স্বজন ছিলো না সুপারিশ করার মতো, তাই চাকরিটা আর হলো না।চাকরির না পাওয়াতে আমি একে বারেই হতাশ হয়ে পড়ি ভাবি আমার লেখা পড়া কি তা হলে বিফলে যাবে।বিশেষ করে অনার্স টা শেষ করতে অনেকটা কষ্ট হয়েছে।
হঠাৎ করে কিছুদিন আগে এক ভাইয়া আমাকে "নিজের বলার মতো একটা গল্প"ফাউন্ডেশনের কথা বলেন এবং আমাদের প্রিয় মেন্টর জনাব ইকবাল বাহার জাহিদ স্যারের কথা বলেন।সে আমাকে এই ফাউন্ডেশন সম্পর্কে সব বুঝিয়ে বলেন, পাশাপাশি আমিও দেখি।আমি এই ফাউন্ডেশনে দেখলাম এখানে সবই তো আছে।তার পরে সেই ভাইয়ার সহযোগিতায় এই ফাউন্ডেশনে রেজিস্ট্রেশন করি। আমি স্যারের প্রতিটা সেশন পড়ি।ইকবাল বাহার জাহিদ স্যারের প্রতিটা সেশন আমাকে অনুপ্রানিত করে তোলে। আমি সাহস পাই সামনে এগিয়ে যাওয়ার।আমার ভিতরে এখন উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছা।স্যারের একটা কথা আমাকে বার বার অনুপ্রানিত করে,,চাকরি করবো না,চাকরি দেবো। খুব আফসোস হয়, আরও আগে কেন? এই ফাউন্ডেশনে সাথে যুক্ত হতে পারলাম না।
নিজের বলার মতো একটা গল্প ফাউন্ডেশনে যুক্ত হয়ে আমি এখন অনেক কিছু নতুন ভাবে শিখছি।কারন এখানে শেখার কোনো শেষ নেই।চাকরিটার উপর এখন কেমন জানি একটা অনিহা চলে আসলো এখন মনে হয় চাকরিটা আর আমকে দিয়ে হবে না ।বিশেষ করে এই প্লাটফর্মে কিছু বড় আপু,বড় ভাইয়াদের দেখে নিজের ভিতরে আরো অনেক ভালো লাগলো,তাদের দেখে আরও আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি।এই প্লাটফর্মের ছোট বড় সবাই অনেক ভাল, মানবিক মনের। সবাই সবার পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছে এক কথায় আমি মুগ্ধ।এই ফাউন্ডেশনের মধ্যে যত সময় থাকি মনে হয় আমি আমার কাজটাই করে যাচ্ছি। হয়তো বিনিময়ে কোনো টাকা পয়সা পাচ্ছি না তবে আমি মনে করি, যা পাচ্ছি তা কখনো টাকা দিয়ে পেতাম না। এখান থেকে শিখেছি কি ভাবে ভালো মানুষ হওয়া যায় যা এই বর্তমান যুগে খুবই কঠিন। প্রিয় মেন্টর জনাব ইকবাল বাহার জাহিদ স্যারের ছাত্রী হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে হচ্ছে। অনেক আফসোস করছি আরো আগে কেন স্যারের দেখা পেলাম না।অসংখ্য ধন্যবাদ আমার গ্রামের প্রিয় Masud Rana ভাইকে(দুবাই প্রবাসী) যিনি আমাকে এই ফাউন্ডেশনে যুক্ত করেছেন।
আমার লেখায় ভুলত্রুটি হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন সবাই।আর সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন আমি যেনো গ্রাম্য সমাজকে দেখিয়ে দিতে পারি যে আমরা মেয়েরাও পারি।আমি যেনো তাদের কালো মনে আলো ফুটিয়ে তুলতে পারি
দোয়া করবেন সবাই আমি যেনো খুব তাড়াতাড়ি আমার জীবনে সফলতার একটি গল্প আপনাদের সাথে শেয়ার করতে পারি।
আবারও লক্ষ্য কোটি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি প্রিয় মেন্টর আপনার প্রতি।
পরিশেষে সকলের সহযোগিতা ও ভালোবাসা এবং দোয়া কামনা করছি এবং আমার এই ছোট্ট আকারে লেখা আমার জীবনের সুখ দুঃখের গল্পে ভুল ত্রুটিগুলো মাফ করে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরনা দিয়ে পাশে থাকবেন বলে আমি আশা করি।দোয়া করবেন যেন ফাউন্ডেশনের সেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে পারি।
সবাইকে ধন্যবাদ আমার এই লেখাটা আপনাদের মূল্যবান সময় ব্যয় করে পড়ার জন্য।
"স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৪৭৭
Date:- ০৭/০৩/২০২১
নামঃখাদিজা আক্তার
ব্যাচ নং১২
রেজিঃনং ৪৩৯৭৩
পেশাঃছাত্রী
রক্তের গ্রুপঃএবি+
জেলাঃবরগুনা।
থানাঃপাথরঘাটা