গত রমজানের ঈদের তৃতীয় দিন আমার নানা মারা যায়
এই সুন্দর পৃথিবীতে আমার জন্ম নানার বাড়িতে।
নানারা পাঁচ ভাই, আমার নানা ভাইদের বড়, আমার নানার প্রথম মেয়ের ঘরের প্রথম নাতি আমি।
জন্মের পরই যেনো সবার আদরে বেড়ে উঠি।
আমার নানার প্রথম দুই পুত্র জন্মের পর মারা যাওয়ার কারণে, নানা খুবই চিন্তিত ও ভয়ে ছিলো। প্রথম নাতি যদি কিছু হয়ে যায়। নানারা সংগ্রামের পর হিন্দু পরিবারের কাছ থেকে বর্তমান বসতভিটা গুলো কিনে এই খানে বসবাস করেন। কিছু সমস্যা ধর্মীয় জ্ঞান থেকে বললে সবাই অবশ্যই বুঝবেন, যা বচ্চাদের সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। সেই ভয়ে নানার বাড়ির সবাই ভয়ে থাকতো আমাকে নিয়ে। নানার পস্রাবে সমস্যা ছিলো, রাতে একবার বের হলে আর ঘরে ঢুকতো না। পৌষ মাসের শীতে রান্নাঘরে একটি পাটি ও কাঁথা দিয়েই বাকিটুকু রাত কাটাতো আমার নানা। আমার নানা কখনই আমাকে দুলাভাই বা নানা ছাড়া কথা বলতেন না। মৃত্যু্র পূর্বেও দুলাভাই দুলাভাই বলছিলো।
গত রমজানের ঈদের তৃতীয় দিন আমার নানা মারা যায়। আল্লাহ আমার নানাকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুণ।(আল্লাহুম্মা আমিন)
শুধু নানাই না সেই আদরটা এখনো কোনো কমতি নেই।
আজ অব্দি নানা বাড়িতে গিয়ে নির্দিষ্ট করে বলতে পারি না আজ কোন ঘরে খাবার খাবো। কেউ কেউ তো রাগও করে খাইতে যাই না কেনো। একা মানুষ কয় ঘরে খাবো! কেনণা, পাঁচ নানার পুত্র বউরাও আমাকে মামা কেউ বা বাবা বলে অনেক আদর ও সম্মান করে।
নানা বাড়িতে অনেক দিন পর পর যাই, সবাই এক সাথে বসে আমার শিশু কালের কথা গুলো বলে আর মায়া গুলো বাড়িয়ে দেয়।
বাবা মায়ের কথা আর কী বলবো! আমার জন্মের পূর্বে সংসারে অনেক অভাব ছিলো। বাবা একা দাদার সংসার দেখতে হয়েছে। বাবা ও ফুফুদের মুখের কথা- আমার বাবা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় দাদার সাথে মানুষের জমিতে চাষাবাদ করতো। আমার বাবা খুবই ভালো ছাত্র ছিল। পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য স্যারের বাড়িতে রাত কাটিয়েছিলো। মাঝরাতে হারিকেন জ্বালিয়ে পড়তেন। এত পড়ার পরও বৃত্তি পায় নি। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে সংসারের অভাবে ঢাকা চলে যান। 'রাজ মিস্ত্রী' কাজে যোগ দেন। সারাদিন রাজ কাজ করে রাতে ওভারটাইম হিসেবে আট তলা দশ তলাতে ইট উঠাতেন! রাতে ঘুমানোর সময় মাথায় ইট দিয়ে ঘুমাতেন। অনেক কষ্ট করে টাকা উপার্জন করে মাস শেষে বাড়ি এসে দাদার হাতে টাকাগুলো দিতেন, দাদা যে কতখুশি হতো আর দোয়া করতো বাবা এখনো বলে। বাবার কষ্টের টাকা দিয়েই বড় তিন ফুফুকে বিয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে আমার ফুফুরা আমার বাবাকেই চিনেনা! বাবা মাঝে মাঝে অনেক কান্না করে।
আমার মা বাবার ফ্যামেলিতে প্রথম এসে কিছুই পায় নি। যা পেয়েছে বিয়ের প্রথম পাঁচ বছর সবই কষ্ট আর কষ্ট। দাদা মারা যাওয়ার পর আমার ছোট চাচা ও ফুফুরা আমার বাবাকে মাথার উপর অনেক ঋণ চাপিয়ে দিয়ে আলাদা করে দেন। নতুন ভাবে ঘর তৈরি ও আসবাবপত্র কিনতে গিয়ে বাবা প্রথমেই হিমসিম খাচ্ছিলো। পৌষের শীতে একটি কাঁথা গায়ে দিয়ে মা আমার রাত কাটিয়েছেন। আমি ছোট, আমার শরীরে ঠান্ডা লাগবে জেনে শাড়ী দিয়ে রুমের পার্টিশন দিয়েছিলো। মা কখনই ভালো কিছু খেতেন না, আমি জন্মের পর মায়ের বুকের দুধ না পাওয়াতে টাকা জমিয়ে জমিয়ে আমার জন্য বাজার থেকে দুধ কিনে আনতেন। দুইটি শাড়ী দিয়ে এক বছর পাড় করে দিতো। আমাকে পড়াশোনা ও সকল কাজে বাবা-মা দুইজনই সহযোগিতা করতো।
আমার বাবা বর্তমানে একজন রাজ মিস্ত্রী কন্ট্রাক্টর। বাবার হাত ধরে কয়েকশত বেকার ছেলে মিস্ত্রী কাজ শিখে দেশ ও বিদেশে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। বাবার খোজ খবর উনারা বিদেশ থেকে প্রায়ই নেন। আমার বাবা আলহামদুলিল্লাহ আজ যে পর্যায়ে আছেন আমার দাদার দোয়া। আজ দাদা নেই, বাবা প্রায়ই বলেন- সুখের সময় কেউ দুনিয়াতে থাকে না!
উদ্যোক্তা জীবনে পা রাখতে গিয়ে প্রথমেই বাবা-মা হাসাহাসি করে। যে ছেলে এত আদরের মধ্যে থাকে সে কিনা উদ্যোক্তা হবে। তবুও ব্যবসার প্রথম মূলধনটা আমার হাতে তুলে দেন। আজ পর্যন্ত জানতে চায় নি কত টাকা আমার হয়েছে। উল্টো ব্যবস্যার কাজে গত সাপ্তাহে ত্রিশ হাজার টাকা ধার হিসেবে নিয়েছি আম্মুর কাছ থেকে।
দূর দূরন্তে ডেলিভারি দিতে যেতে হয়। সারা দিন একের পর এক বাবা-মা ফোন দিয়ে খোজ খবর নেন। মাঝে মাঝে ব্যস্ত থাকলে মায়ের ফোনটা যদি রিসিভ করতে দেরি হতো। বাবা ফোন দেওয়া শুরু করতো।
যখন যা চোখের সামনে পড়ে খাবার হোক বা শখের হোক, বাসায় আনলেই বকা শুনতে হয়। আমার টাকাগুলো কেনো খরচ করি। নতুন ব্যবসাতে গিয়েছি নিজের শখ নিজে মিটাইতে। ফ্যামেলিতে বাবা যা খাওয়াচ্ছে কম কিসে। আমি সব সময় মনে করি আমার বাবা-মা আমার একজন ভালো বন্ধু। বাবা-মায়ের প্রতি ভালোবাসা সব সময়।
প্রথমে আমি তাকে ভালোবাসার কথা বলি নি, সেই আমার বিভিন্ন গুণাগুণে দেখে আমাকে প্রপোজ করে। প্রায় চার বছর রিলেশনের পর একদিন ওর বিয়ে হয়ে যায়।
আমাকে জানানো হয় নি বিয়ের কথা, যেদিন ছেলে পক্ষ দেখতে এসে বিয়ে করে নিয়ে যায়, সেদিন আমার ঢাকা লালবাগ আমদানি রপ্তানি অধিদপ্তরের একটি পরীক্ষা ছিলো। বাড়িতে এসে শুনি বিয়ে হয়ে গিয়েছে।
অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম তখন।
করোনায় যখন চারপাশ শূণ্য মরুভূমিতে একা ছেড়ে দেওয়ার মতো সবাই সবার দিন গুলো পার করছি।
ঠিক তখনই Tariqul Islam ভাই ২২শে মে একটি লিংক দিয়ে বললো ফর্মগুলো পূরণ করতে।
একটি শিক্ষণীয় একটি গ্রুপ রয়েছে।এইখানে রেজিস্ট্রেশন করে গ্রুপে এক্টিভ থাকতে। ভাইয়ের সাথে আমার পূর্বের পরিচয়। ২৩ই মে আমাকে গ্রুপের লিংক দেওয়া হয়, আমি গ্রুপে জয়েন করি। ভাই আমাদের চাঁদপুর জেলার ই সন্তান বর্তমানে প্রবাসে আছে। ভাইয়ের জন্য অনেক দোয়া ও ভালোবাসা রইল।
এরপরই করোনায় বাড়ির তিন জন মিলে একটি মুরগির খামার দেই। প্রথম প্রথম ভালোই চলছিলো।
হঠাৎ করে যখন দাম কমা শুরু হলো, আমরা অনেক লোকসানের খাতায় নাম লিখাই। শেষবার ৬৫ হাজার টাকা লোকসান হয়। আমাদেরমোট এক লক্ষ বিষ হাজার টাকা লোকসান হয়।
কী করবো বুঝতে পারি নি। গ্রুপে দীর্ঘ দিন সময় দেওয়ার পর সবার উদ্যোক্তা জীবন দেখে আমিও উদ্যোক্তা হবো বলে সিদ্ধান্ত নেই। স্যার একটা কথা বলতেন, নিজের কাছের পণ্য নিয়ে যেনো প্রথমে কাজ শুরু করি। কম দামে কিনে যেনো কম দামে কাস্টমারের হাতে পৌছে দিতে পারি।
চিন্তায় পড়ে যাই কি নিয়ে কাজ করবো। তখন ই Tariqul Islam ভাইকে কল দিলাম।বললাম ভাই কি নিয়ে কাজ করব তখন ভাই বলল বর্তমানে কাষ্টমারের মেটাল চাহিদা বেশি ও আমাদের জেলার সেরা পন্য নিয়ে শুরু করতে পারো।
তখন মনে হলো, চাঁদপুরের সিগনেচার পণ্য ইলিশ নিয়ে কাজ করবো।
কিন্তু অনলাইনে ইলিশের উদ্যোক্তার তো অভাব নেই। আরো চিন্তায় পড়ে যাই অন্য কিছু নিয়ে করা যায় কিনা। তখন ভাই বলল চিন্তা করো না,সেবা ভালো দিবা আর কাষ্টমারের বিশ্বাস অর্জন করবা।
আমার মন কেন যেনো বার বার ইলিশের দিকেই টানছিলো। আমি তখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি নি ইলিশ নিয়ে কাজ করবো কি না। কলেজ জীবনের তিন বন্ধু একত্রিত হই, আমার মনের কথাটা প্রকাশ করি। ওরা আমাকে সাপোর্ট দেয়। বন্ধুরা আমাকে বললো সবাই যেহেতু ইলিশ নিয়ে কাজ করে, আমি যেনো অরিজিনাল চাঁদপুরের ইলিশ নিয়ে কাজ করি। তাহলে আর সমস্যায় পড়তে হবে না। ইলিশ ও চাঁদপুরের অরিজিনাল ইলিশের মধ্যে স্বাদে, গুণে, মানে অনেক পার্থক্য রয়েছে।
পরদিনই বিভিন্ন ঘাটে ঘুরে ঘুরে চাঁদপুরের ইলিশ চেনার বিষয় গুলো খুঁজি। কেনন, চাঁদপুর বর্তমানে ৯৫% বাহিরের ইলিশ আসে, যা চাঁদপুরের নামে বিক্রি হচ্ছে। সেখান থেকেই চাঁদপুরের অরিজিনাল ইলিশ চিনতে হয়। ১৫ দিন টানা চাঁদপুরের ছয়টি ঘাটে ঘুরে ইলিশ সম্পর্কে কিছুটা সাধারণ জ্ঞান নিয়ে ১লা সেপ্টেম্বর ইলিশ নিয়ে কাজ করা শুরু করি।
আলহামদুলিল্লাহ, শুধু মাত্র ইলিশই গত ছয় মাসে _আঠারো _লক্ষ+ টাকার সেল দিয়েছি!
যেখানে আমার এক রিপিট কাস্টমারই পাঁচ লক্ষ টাকার ইলিশ সেল করিয়ে দিয়েছেন! এটা আমার জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। আলহামদুলিল্লাহ।
"স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৪৭৮
Date:- ০৮/০৩/২০২১