আমাদের অনেক সম্পদ থাকা সত্যেও কোন কিছু বুঝে নিতে পারেন নি
আমি যখন খুব ছোট আমার বয়স মাত্র দের বছর, তখন থেকেই আমার মায়ের জীবন যুদ্ধ শুরু হয়।
আমার দের বছর বয়সে আমার বাবা নারকেল গাছ থেকে পরে যান তার বুকের ৫ টা হার ভেঙ্গে যায়,পরিবারে আমার দুই ভাই ও আমার মা,বাবা আমি সহ ৫ জন। আমার বাবা ছিলেন একজন রিক্সা চালক। ৩ বছর বয়সে আমার বাবা তার বাবা কে হারান,
আমাদের অনেক সম্পদ থাকা সত্যেও কোন কিছু বুঝে নিতে পারেন নি আমার বাবা ও কাকা দু জনেই খুব ছোট ছিলেন, চাচার বয়স ছিলো মাত্র ৫ বছর, আমার দাদার রেখে যাওয়া সমস্ত সম্পদ দখল করে নেন এলাকার কিছু শশক্তিশালী লোকে, আমার দাদা ছিলেন একা তার কোন ভাই বা বোন ছিলো না,তাই
কেউ ছিলো না আমার দাদির পাশে দারানোর জন্য।
অনেক কষ্টে বড় হয় আমার বাবা ও চাচা,
ছোট থেকে বাবা ছিলেন খুব শান্ত, আমি বড় হয়ে যখন বুঝতে শিখেছি তখন ও দেখেছি বাবা খুব শান্ত আর নরম মনের মানুষ ছিলেন। বাবা যখন নারকেল গাছ থেকে পরে গিয়েছে তখন দাদি ও আর বেচে নেই।
মাথার উপর আমাদের কোন বট গাছ ছিলো না, তাই
মা কেই হাল ধরতে হয়েছে।আমার মা ও তখন মাত্র ২০ বছরের মেয়ে,মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাবা তাকে বিয়ে করে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসেন। বাবার অসুস্থ আমাদের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার।
দীর্ঘ ৩ মাস হাসপাতালে থেকে কোন রকম জীবন্ত লাশ হয়ে ফিরে আসেন আমাদের মাঝে,,,আমাদের ঘরে তখন একটা টাকা তো দূরের কথা এক মুঠো চাউল ও ছিলো না,, আমার মা ব্যাধ্য হয় মানুষের দোয়ারে হাত পাততে,,,কিছু দিন এভাবে চলতে থাকে আর আমাদের কষ্ট ও বারতে থাকে,
৬ মাস পর আমার মা ঘুরে দারান তিনি মনে মনে ভাবেন
আর নয় অন্যের কাছে হাত পাতা,তিনি কাজ করবেন
তার পরিবারের জন্য। তাই আমার মা অন্যের বাড়ি মাটি কাটা কাজ করেন,,, যে দিন থেকে মা অন্যের বাড়িতে কাজ শুরু করেন সেদিন থেকে আমরা পেট ভরে ভাত খেতে পারতাম তবে ৩ বেলা নয় ১ বেলা,
প্রতিদিন আমার মা অন্যের বাড়ি কাজ করতো আর যা পেত তা দিয়ে বাবার চিকিৎসা ও আমাদের খাবার যোগাতে মার খুব কষ্ট হতো, তবুও মা হাল ছারেনি,
আমার মা কঠর পরিশ্রম করতেন,,, দিন দিন আমাদের অভাব কমে আসতে লাগলো বাবা ও অনেক টা সুস্থ হয়ে গেলেন, এভাবেই কেটে গেলো ৩ বছর।
এর মাঝে আমার মা ভাইকে স্কুলে দিল , আমার ৫ বছর হতেই আমাকে ও স্কুলে দেন, তবে খুব কষ্ট হতো মায়ের।
মা সকালে ঘরের কাজ করে তারপর কাজে যেতেন আবার সন্ধায় বাড়ি ফিরে ঘরের কাজ করতেন।
আমি যখন থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই মায়ের মুখে একটা কথা শুনেছি, আমার সন্তান বড় হলে
আমার কষ্ট থাকবেনা,মা আমাদের জন্য কত কিছু করেছে যা বলতে গেলে আমার বুক ফেটে কান্না আসে, আমি দেখেছি আমার মা, রাস্তায় কাজ করেছে,আবার কখনো ইট ভাটায় কাজ করেছে কখনো অন্যের বাড়ি ঝি এর কাজ করেছে,,
আমি দেখেছি মায়ের চোখে হাজার ও স্বপ্ন
দেখেছি মায়ের কষ্ট,আমি কখনো আমার মা কে
দেখিনি নতুন কাপড় পরতে, দেখিনি মাকে কখনো সাজগোছ করতে, দেখিনি মায়ের মুখেহাসি, দেখেছি শুধু কষ্ট আর কষ্ট,,
আর সেই কষ্ট নেমে আসে আমার উপর। আমার ভাই লেখাপড়া খুব ভালো ছিলেন সব সময় প্রথম হতেন
কিন্তু ভাগ্যের কি নিরম্মম পরিহাস টাকার জন্য ভাইয়া ক্লাস 5 প্রথম হওয়ার পর ও তাকে স্কুলে ভর্তি করা হয় না, আমি তখন ক্লাস থ্রি তে পরি।
ভাইয়া স্কুল বাদ দিয়ে মায়ের সাথে ইট ভাটায় কাজ শুরু করেন, আর আমার উপর সংসারের সব কাজ।
ভাইয়া বাড়িতে থাকতে সব কিছু ভাইয়া করতো বাবা ও বাড়ির কাজে সাহায্য করতো কিন্তু ভাইয়া কাজে যাবার পর থেকে সব কিছু আমাকেই করতে হতো,,, আমি ও খুসি মনে সব কিছু করতাম যদি ও আমার কষ্ট হতো।
ভালো লাগতো এটা ভেবে যে আমি স্কুলে পরতে পারছি।আমি ও খুব ভালো ছাত্রি ছিলাম,, তবে মা বাড়িতে না থাকায় সংসারে কাজের চাপ অনেক হয়ে পরে, যার ফলে ঠিক মত পরতে পারতাম না,
আমি যত বড় হতে লাগলাম সংসারের সব কাজ যেন আমার ঘারে পরতে থাকে সকালে রান্না ছাড়া সব কাজ আমাকে ই করতে হতো, মা ও অনেক বদলে গেছে তত দিনে, তিনি যেন টাকা ছাড়া কিছু বুঝেন না, তাই সংসারে উন্নতির জন্য গরু ছাগল হাস মুরগী পালন শুরু করেন, আর সমস্ত কাজ আমাকেই করতে হতো, কারণ মা আর ভাইয়া সকালেই কাজে চলে যেতেন,,
আর বাবা তো কিছুই করতে পারতেন না,, তবে সব সময় আমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করতেন।
আমি গরু ছাগল হাস মুরগী সব কিছু দেখে রাখতাম পাশাপাশি লেখাপড়া চালিয়ে যেতাম,, স্কুলে যাওয়া আগে ঘাস কেটে রেখে যেতাম বাবা খাবার দিতো আবার স্কুল।থেকে এসে ঘাস কাটতাম,
খুব কষ্টের মাঝে সময় পার হতো তবুও অনেক সুখি মনে হতো কারণ সন্ধা হলে আমরা সবাই একসাথে
একঘরেই বসবাস করতাম রাতে সবাই একসাথে খাবার খেতাম,
প্রতিদিন রাতেই আমাদের সবার সাথে দেখা বা কথা হতো, সারাদিন কেউ কাউকে দেখা বা কথা বলার তেমন সময় হতো না,, আমাদের ঘর টা ছিল অনেক ছোট আর তাই রাতে একসাথে মাটিতে পাটি বিছিয়ে ঘুমাতাম,,,আমাদের জীবন ছিলো শুধু কষ্ট আর কষ্ট, যে কষ্ট আমাকে আজো কাদায়,,,
আস্তে আস্তে আমাদের সংসারে উন্নতি হতে লাগলো,
আমাদের অভাব কমে গেলো, আমাদের ঘর হলো
আমার সব কষ্ট দূর হতে লাগলো,,, কিন্তু মায়ের কষ্ট আর দূর হলো না,,, আমরা ভালো খাবার পেতাম ভালো পোশাক পেতাম, কিন্তু মা সেই আগের মত সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত কাজ করতে হতো।।
আমি কখনো আমার মা কে দেখিনি আমার নানা বাড়িতে বেড়াতে যেতে,,, আমরা যেতাম কিন্তু মা যেতেন না, তিনি বলতেন কাজ বাদ দিয়ে যাওয়া যাবেনা,,, তিনি বলতেন বেড়াতে গেলে কাজে যাওয়া হবে না, আর কাজে না গেলে টাকা দিবে না, আর টাকা না পেলে আমাদের ভালো কিছু দিতে পারবেন না
আমি আমার মায়ের অনেক করুন দৃশ্য দেখেছি,
দেখেছি আমার মায়ের সন্তান হারানোর আর্তনাদ।
আমার ছোট একটা বোন ছিলো, মাত্র দের বছর বয়সে
টাকার অভাবে অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসা না পাওয়ার কারনে আমাদের ছেরে চলে গেছেন, মা কে আমি সেদিন ও চুপ থাকতে দেখেছি, নীরবে চোখের পানি ফেলেছেন কিন্তু থেমে যান নি তিনি।আমার বোনের মৃত্যু যেনো আমার মা কে কাজের প্রতি আরো উৎস সৃষ্টি করেছিলো।।মায়ের সেই করুন মুখ খানা আজো আমার চোখে ভাসে।
আজ আমরা বড় হয়েছি কিন্তু আমার মায়ের মুখে আজ ও হাসি ফুটাতে পারিনি। পারিনি মায়ের স্বপ্ন পুরন করতে,,,, আমি ছোট থেকে স্বপ্ন দেখতাম লেখা পড়া করে ভাল কিছু করবো মা কে সাহায্য করবো
মায়ের মুখে হাসি ফুটাবো,,,কিন্তু আমার সব স্বপ্ন
যে স্বপ্ন ই রয়ে গেলো,,, আমি যখন ক্লাস 8 পরি ঠিক তখন মা অসুস্থ হয়ে পরেন, মায়ের যক্ষা হয়,কথায় আছে যার হয় যক্ষা তার নাই রক্ষা,
একদম ঠিক তাই মা যেনো মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা দিতে শুরু করে,, আমরা প্রান পনে চেষ্টা চালাই মাকে সুস্থ করতে,,, আমাদের জমানো সমস্ত টাকা খরচ করতে থাকি মায়ের চিকিৎসার জন্য। মা আর কাজ করতে পারেনা ভাই ও তেমন টাকা পায় না যা পায় তা দিয়ে কোন রকম দিন চলতে থাকতে, জমানো টাকা দিয়ে মায়ের চিকিৎসা চালিয়ে যায়,,আমার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়,,, আমি ভেঙ্গে পরি,,, মায়ের এ অসুস্থ মা চলে যাবেন এ কথা কিছুতেই মানতে পারছিলাম না আমি,,
ছোট থেকেই নামাজ কে খুব ভালোবাসতাম আর তাই বিশ্বাস ছিল মা সুস্থ হবেন,,, সেই আত্তবিশ্বাস নিয়ে
মায়ের সেবা করে দুই বছরে মা কে সুস্থ করে তুলি,,,
কিন্তু আমাদের ঘরে আবার সেই অভাব চলে আসে,নুন আনতে পান্তা ফুরায়,,,,
আমার এইটের প্রথম ও দ্বিতীয় পরিক্ষা দেওয়া হয় না,, স্কুলের প্রধান শিক্ষক মায়ের অসুস্থতা বিবেচনা করে ফাইনাল পরিক্ষা দেওয়া অনুমতি দেন।। পরিক্ষা দিলেও রেজাল্ট তেমন ভালো করতে পারিনি,,,তবুও নাইনে ভর্তি হয়,,,,
ক্লাস নাইনে কোন রকম লেখাপড়া চালিয়ে যায়,,,
যদিও ঠিক মত ক্লাস করতে পারিনি তবুও রেজাল্ট অনেক ভালো হয়,,, আর সেই সাথে মা ও অনেক সুস্থ হয়ে উঠেন,,,, কিন্তু মা আর কাজ করতে পারেন না, মা বাবা দুজনেই অসুস্থ আর বেকার,,, এ যেনো আমাদের জীবনের আরেক টা অন্ধকার,, ভাই ও কেমন যেনো পালটে গেছে,,,,, আগের মত কাউকে কেয়ার করেনা
সংসারের প্রতি দ্বায়িত্ব পালন করতে চায়না,,,,
বাবা মা দুজনেই ভেঙে পরেন, আমার আর টেনে ভর্তি হওয়া হলোনা সব কিছু বদলে গেলো শুরু হলো
আমার জীবনের নতুন গল্প।
২০০৬ সালে ২৫শে ফেব্রুয়ারি বাবা রোড এক্সিডেন্টের আমাদের ছেড়ে চিরো বিদায় নেন,,মা হয় বিধবা আর আমি হলাম এতিম,, বাবা আমাদের রোজগার করে খাওতেন না ঠিক ই কিন্তু রোদ বৃষ্টি ঝরে ছায়া হয়ে ছিলেন।। বাবার চলে যাওয়া যেনো আমার জীবনের প্রথম পরাজয়।।।
আজ এ পর্যন্ত,,, আগামীকাল আবার লিখবো আমার আর আমার মায়ের নতুন জীবনের কাহিনি,, আমার লেখার মাঝে ভুল হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন সবাই।
সবাই আমার মায়ের জন্য দোয়া করবেন
"স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৫৬০
Date:- ২৭/০৬/২০২১
নাম রিতা আক্তারী
ব্যাচ ১৩
রেজিঃ ৬০৯৭৮
জেলা ফরিদপুর।