আমাদের সবচেয়ে ভালো সুযোগ ছিল আমার বাবার সততা
আসসালামু আলাইকুম শুভ সকাল।
আশা করি সকলেই ভালো আছেন। আজ আমি আমার নিজের জীবনের উত্থান-পতনের গল্প তুলে ধরবো আপনাদের কাছে ৷ আমি দেবাশীষ দে প্রীতম প্রিয় ফাউন্ডেশন এর প্রথম থেকে বাগেরহাট জেলা টিমের ডিস্ট্রিক্ট অ্যাম্বাসেডর হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত আছি । আমার জন্ম ১৯৯৭ সালের মে মাসের ২১ তারিখে বাগেরহাট সদরে । , অনেক টানাটানির সংসারের প্রথম সন্তান আমি ৷ পারিবারিক সূত্রে নিম্ন মধ্যবিত্ত ৮ জন সদস্যের যৌথ পরিবারের ছেলে আমি । আর আমরা সকলেই জানি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জীবনে কত কষ্ট করে বড় হতে হয় । জীবনে নানা বাঁধা পেড়িয়েও সংসারের হাল টিকিয়ে রাখতে হয় । পারিবারিক সূত্রে আমার বাবা আস্তে আস্তে করে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ছোট্ট একটি হার্ডওয়্যার এর দোকান৷ যেটা আমাদের জীবন জীবিকার প্রধান পুঁজি । পারিবারিক ব্যবসা বলতেও এই একটা ছোট পরিসরে হার্ডওয়ারের দোকান । এই টানাপড়া জীবনেই খুব কষ্ট করে বড় হতে থাকি আমি ৷ কিন্তু হঠাৎ আমাদের পরিবারে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার । সময়টা ২০০৭ সালের তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র । তখন হঠাৎই আমার বাবা প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ে, বাবার হার্টে চারটি ব্লক ধরা পড়ে। ভেঙ্গে যায় পরিবারের সকলের মন , ভেঙ্গে যায় আমাদের সাজানো গোছানো সংসার৷ উন্নত চিকিৎসার জন্য পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে গিয়ে বাবার চিকিৎসা করাতে আমাদের সকল পুঁজি পাতি শেষ হয়ে যায় । দোকানটাও অচল হয়ে যায় শেষ-মেষ দোকানটা বিক্রি করেই বাবার চিকিৎসা করাতে হয়৷ আমরা একদম নিঃস্ব হয়ে যাই । কিন্তু তখন থেকেই শুরু হয় আমাদের জীবনের নতুন সংগ্রাম । ২০০৭ সাল সপ্তম শ্রেনীর ছাত্র আমি তখন কি বা বুঝি জীবন সংগ্রামের। সংসারের এই পরিস্থিতি বাধ্য করেছিল তখন আমাকে জীবন সংগ্রামে নামতে। তখন আমাদের সবচেয়ে ভালো সুযোগ ছিল আমার বাবার সততা এবং বাগেরহাট শহরে তাঁর ব্যপক পরিচিতি । আর সেটাই আমাদের পরবর্তী কাজ করার শক্তি যুগিয়েছে৷ ফ্যামিলি সাপোর্ট পেয়েই তখন লেখাপড়ার পাশাপাশি আবার নতুন করে আবার শক্ত হাতে ধরেছিলাম ব্যবসার হাল । বাবার সকল পুরাতন কাস্টমার আর কোম্পানির মহাজনেরাই পাশে দাড়িয়েছে সেই দুর্দিনে আমাদের । তবে এবার নতুন ভাবে নতুন আঙ্গিকে মাত্র ৪০ হাজার টাকা নিয়ে আবার একদম ছোট পরিসরে শুরু করেছিলাম আমাদের পূর্বের পারিবারিক ব্যবসাটিই । প্রথম অবস্থায় তেমন একটা লাভ পাচ্ছিলাম না ব্যাবসায়িক দীর্ঘ বিরতি এবং কম্পিটিশন মার্কেটের কারণে । তবুও হতাশ হয়নি লেগেছিলাম । একটি বছর কঠোর ভাবে লেগে থেকে কষ্ট করে গেছি । অবশেষে পুনরায় দীর্ঘদিনের কষ্টের ফলস্বরূপ ব্যবসাটা পূর্বের ন্যায় মোটামুটি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল । তাই আজ এ পর্যন্ত আশার সুযোগ হয়েছে ৷ এর পর ঘটে গিয়েছে আমার জীবনের আরো এক কষ্টময় ঘটনা । ক্রিকেট ছিল আমার জীবনের একটা স্বপ্ন । ছোটবেলা থেকেই এলাকায় ভালো খেলার সুবাদে বড় ভাইয়াদের সাথে বিভিন্ন জায়গায় ম্যাচ খেলার সুযোগ পেতাম , পরবর্তীতে নিজের প্রতিভা দিয়ে বাগেরহাট জেলা টিমের হয়ে অনূর্ধ্ব ১৪ , অনূর্ধ্ব ১৬ , অনূর্ধ্ব ১৮ ক্রিকেট দলে খেলার সৌভাগ্য হয়েছিল । জেলা বয়সভিত্তিক দলে ভালো পারফর্মেন্স করার মাধ্যমে । ২০১২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ন হবার পরবর্তীতেই খুলনা বিভাগীয় দলে ক্রিকেট খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম । সেখানেও ভালো পারফর্মেন্স করার সুবাদে বিকেএসপি (বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) তে ভর্তি এবং অনুশীলনের সুযোগ হয়েছিল ৷ ভালোই পরিচিত হয়েছিলাম খেলার সুবাদে, খেলা চালিয়ে যাচ্ছিলাম নিয়মিত। সেই সাথে পারিবারিক ব্যবসাও। ২০১৬ সালে সুযোগ হলো ঢাকা বি লিগে খেলার। সিটি ব্যাংকের হয়ে খেলতাম । সেখানেও ভালো খেলার সুবাধে সুযোগ হলো অনুর্ধ্ব ১৯ এ দলে খেলার। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস ২০১৭ সালে শরীরে ধরা পড়ে কঠিন এক ব্যাধি যার জন্য মেডিকেল পর্যায়ে বাদ পড়ে যাই আমি । ইচ্ছে ছিল ক্রিকেটে প্রতিষ্ঠিত হয়ে নিজের পরিবারের জন্য ভালো কিছু করার কিন্তু একমুহূর্তেই মাটিতে মিশে যায় আমার সকল স্বপ্ন ৷ তার সেই কঠিন ব্যাধিটির নাম থাইরয়েড, স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশি হারে আমার ওজন বৃদ্ধি পাচ্ছিল দ্রুত গতিতে । জীবনের স্বপ্ন পূরণ করতে ছুটে বেরিয়েছি এদেশ থেকে ও দেশ। ভারত, সিঙ্গাপুর কোনোটাই বাদ রাখিনি ৷ কিন্তু জীবনে বাধাটা আসলোই। হলো না আর এই রোগের কোনো সঠিক চিকিৎসা। জীবনের এতো ব্যর্থতা একটা সময় আমাকে হাফিয়ে তুলেছিলো। সিদ্ধান্ত নিলাম এ জীবন রেখে কি করবো তাই সুসাইড এটেম নিলাম। কিন্তু ভাগ্য যাকে ভালোবাসে যম কি আর তাকে নাগাল পায় , ভাগ্যের জোরে বেচেঁ ফিরে আসলাম আবারো ২০ টি ঘুমের ওষুধ খেয়েও বেঁচে গেলাম । তখোনো পাশে দাড়ায় ছোট বেলার ভালো লাগার মানুষটি । সব সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেয় আমার সাথে । আমার সব স্বপ্ন আশা শেষ হয়ে গেছে জেনেও সে আমাকে ছেড়ে যায়নি , ফাঁকা পকেটেও সে আমার পাশেই ছিল , সকল সময় আমাকে সাহস দিয়ে গেছে তুমি পারবে ঘুরে দাঁড়াতে , তার কথায় আমারও মনে কঠিন বিশ্বাস জন্ম নিয়েছিল আমি সত্যিই আবার পারবো ঘুরে দাঁড়াতে । একটা সময় আমি প্রচুর লেখালেখিও করতাম। ২০১৮ সালে আমার জীবনে লেখালেখি থেকেও দুইটা প্রাপ্তি এসেছিল। আমার লেখা একটি বই স্থানীয় বইমেলায় স্থান করে নিয়েছিল এবং সেইসাথে সেই বছরে ভালোবাসা দিবসে তরুন-তরুনীদের বিনোদনময়ী একুশে টিভি ভ্যালেন্টাইন্স ডে অল টাইমে সেরা লাভ স্টোরি লেখায় উইনার ছিলাম। ২০১৬ এ বাবার অপারেশনের পার হয়েছিল ৯ টি বছর। আর এই ৯ টি বছরে বাবার পিছনে বিপুল পরিমাণ টাকা আমাদের চিকিৎসা ব্যয় হয়েছে । তবুও আমরা হাল ছাড়িনি । তার ৪০ হাজার টাকার ব্যবসাটা এখন ২০ লক্ষ টাকার ব্যবসায় পরিণত হয়েছে । এছাড়াও নিজে কিছু করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে মাঝখানে আমি আর আমার চাচতো ভাই মিলে ২০১৬ সালে ৫ লক্ষ টাকা দিয়ে গড়ে তুলেছিলাম f&f টি নামে একটি চাঁ পাতা প্রসেসিং কোম্পানি । বাংলাদেশের ২৪ টি জেলায় আমার কোম্পানির চা পাতা বিক্রি হতো। ২০ জন কর্মচারী আমাদের কোম্পানিতে চাকরি করতেন । গত ২৫/১০/২০২০ তারিখ আমার জীবনে নেমে আসে আরও একটি অন্ধকারময় মুহূর্ত, আমার কোম্পানির পণ্যবাহী ট্রাকটি একটি সড়ক দুর্ঘটনার কবলিত হয় যার ফলে আমার আমদানীকৃত কোম্পানির সকল মালমাল রাস্তার পাশে লেকের পানিতে পড়ে নষ্ট হয়ে যায় । আমার মালের ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৭ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা । আবারো নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলাম আমি অর্থনৈতিক সংকট এবং চাচাতো ভাইয়ের চক্রান্তে অ্যাক্টরে থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল আমাকে । তবে আমি জীবনে হেরে যেতে শিখেনি। কোনো বাধাই তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি , হাল ছেড়ে দেয়নি শক্ত হাতে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য লেগে পড়েছিলাম । কারণ আমার বিশ্বাস ছিল হয়তো আজকে আমার সময়টা খারাপ যাচ্ছে কিন্তু নিশ্চয়ই আগামীতে খুব ভালো কিছু হয়তো আমার জন্য অপেক্ষা করছে । তাই তো হেরে যেতে শিখেনি লড়াই করে নিজের জায়গাটা আবার শক্ত পোক্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছি আর এপর্যন্ত হেরে যাওয়া জীবনে বার বার হাত ধরে টেনে তুলেছে আমার ভালোবাসার মানুষটি। আমার এতো এতো দুর্দিনেও একটি দিনের জন্যও ভুলে যায়নি আমার ভালোবাসার মানুষটি৷ সবসময় সাপোর্ট দিয়ে চলেছে একদিন আমি অনেক বড় হবো অনেক ভালো অর্থনৈতিক অবস্থানে পৌঁছাব । অবশেষে গত 26 এপ্রিল 2021 তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই আমি । কিন্তু বিয়ের খরোচ সামলাতে গিয়ে আবারো লক্ষাধিক টাকার দেনা হয়ে গেছি আমি , কোনভাবেই আমি আমার বাবাকে বলতে পারিনি যে বাবা আমি অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়ে গেছি কারণ আমি জানি আমার বাবা এত বড় ধাক্কাটা সামলাতে পারবে না কারন আমার বাবা হাটের পেসেন্ট , তাই কাছের বন্ধু বান্ধবের থেকে লক্ষাধিক টাকা ধার নিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানটি পার করেছি এখন অনেক বেশি দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে আমার জীবন , জীবনে কখনই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারলাম না যখনই একটু ভালো অবস্থানে গিয়েছি আবার নিঃস্ব হয়ে ফিরে এসেছি ।
আপনারা সকলে আমার জন্য দোয়া করবেন আমি যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি সকল বিপদ কাটিয়ে আবার যেন ভালো কিছু শুভ আরম্ভ করতে পারি ।
প্রিয়া ইকবাল বাহার জাহিদ স্যার এর স্বপ্ন দেখা প্রতিষ্ঠান এর 64 জেলার 164 জন মানুষকে নিয়ে শুরু করা সদস্যের মধ্যে আমি একজন , প্রিয় স্যারের কাছ থেকে বাগেরহাট জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার পর থেকে চেষ্টা করে গেছি বাগেরহাট জেলা টিম টাকে শক্তিশালী ভাবে গড়ে তোলার , সেই লক্ষ্যেই বিগত তিন বছর দিনরাত অবিচল কষ্ট করে গেছি বাগেরহাট জেলা টিম টাকে সুসংগঠিত ভাবে গড়ে তোলার জন্য , অবশেষে আমরা সফল এখন বাগেরহাট জেলা টিম অনেক বেশি সুসংগঠিত , অনেক বেশি পরিপক্ব সারা বাংলাদেশের কাছে নিজেদেরকে তুলে ধরার লক্ষ্যে , আশা করছি বিগত দিনে বাগেরহাট জেলা টিম সারা বাংলাদেশের কাছে আরও অনেক ভালো অবস্থান গড়ে তুলতে সক্ষম হবে । টিম টাইগার্স এর জয় হোক । বাগেরহাট জেলা টিমের সকল সদস্যদের আমার মনের অন্তস্থল থেকে অনেক অনেক ভালোবাসা রইলো আশা করছি আপনারা সর্বদা এভাবেই আমার পাশে থাকবেন । ধন্যবাদ ।
স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৫৬০
Date:- ২৭/০৬/২০২১
দেবাশীষ দে প্রীতম
ডিস্ট্রিক্ট অ্যাম্বাসেডর বাগেরহাট জেলা
তৃতীয় ব্যাচ, রেজিঃ নাম্বার ৬০১