জমিতে রোধে পুরে বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করতেন
আমার শৈশব স্মৃতি
১-১-১৯৮৫সালে আমার জন্ম হয়
আমার শৈশব স্মৃতি গুলো অনেক সুন্দর ও মজার ছিল আমাদের পরিবারে ৬ ভাই কোন বোন নেই। ছয় ভাইয়ের মধ্যে আমি ছিলাম পঞ্চম প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ও ম্যডাম সবাই অনেক আদর করত । কারণ পড়াশোনা মোটামুটি ছিলাম । খেলাধুলায় মেতে উঠতাম স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা দৌড়ে এবং মুরগির লড়াইয়ে বার বার জয় লাভ করতাম।
আমার বাবা ছিলেন একজন কৃষক বাবা যখন জমিতে রোধে পুরে বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করতেন সত্যি বাবার প্রতি তখন অনেক মায়া হত। আমি সবসময় চেষ্টা করতাম বাবাকে কৃষি কাজে সাহায্য করার জন্য।
তারপর ২০০৩ সালে S S C পাশ করি
কোন এক কারনে আমার আর লেখাপড়া করতে ভালো লাগছিলো না , "কারণটা না হয় অন্য আরেকদিন আপনাদের সাথে শেয়ার করবো" বন্ধ- বান্ধবের সাথে আড্ডা আর ঘুরাঘুরিতে আমার দিন কাটছিলো মাঝে মাঝে বাবাকে জমি চাষ-বাসের জন্য সাহায্য করতাম।
একদিন বাবাকে বললাম আমি আর দেশে থাকব না আমাকে বিদেশ পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেন আমার মেজ ভাই কুয়েত প্রবাসী ছিল বিদায় বাবাকে বললাম ভাইকে বলেন আমাকে কুয়েত নিয়ে যেতে অথবা অন্য কোন দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিতে। তারপর ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে ভাই আমার জন্য কুয়েতের ভিসা পাঠালো জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আমি মাতৃভূমি ছেড়ে পাড়ি জমালাম সুদূর মরুর-দেশ দৌলত আল-কুয়েতে।
শুরু হল কর্ম জীবন
প্রবাস জীবন সম্বন্ধে একটা ধারণা ছিল কারণ আমার মেজো ভাই কুয়েত প্রবাসী ছিল সেই বিদায় প্রবাস জীবন অনেক কষ্টের হয় শুনছিলাম তখন এতটা যে কষ্ট হয় তা কল্পনা করতে পারি নাই প্রতিদিন ১৬ থেকে ১৭ ঘন্টা কাজ করতে হতো আমার। শুরুতে বাবা মা আত্মীয় স্বজন ছেড়ে আমার থাকতে কষ্ট হত মেজো ভাই ছিল বিদায় আস্তে আস্তে নিজেকে মানিয়ে নিতে সহজ হয়েছে। যখন বাড়িতে বাবা মার সাথে কথা বলি ,, মা জিজ্ঞেস করে বাবা তুমি কেমন আছ ? তুমি খান খেয়েছ কি? না খেয়ে মাকে বলতাম মা আমি খেয়েছি আমি অনেক ভালো আছি আপনি টেনশন করবেন না । ঈদ সময় মা জিজ্ঞেস করতেন বাবা তুমি ঈদের জন্য নতুন জামা কাপড় কিনেছো আমি কোন কিছু না কিনেও মাকে খুশি করার জন্য অনবরত মিথ্যা বলতাম মা আমি জামা প্যান্ট জুতো সবকিছু কিনেছি।
প্রবাসীরা কত বড় অভিনেতা অভিনেত্রী তা বলে বোঝানো যাবে না প্রতিনিয়তঃ তারা তাদের ফ্যামিলির সাথে অভিনয় করে যাচ্ছে।
দীর্ঘ ৯ বছর টানা প্রবাস জীবন শেষে এবার দেশে ছুটিতে যাওয়ার পালা বাবা বারবার তাগিদ দিচ্ছিলেন তুমি দেশে আসবে কবে আমার শরীরটা ভাল না তুমি একটু আসো তোমাকে দেখতে মন চাচ্ছে ৩-৬-২০১৫ সালে চলে গেলাম বাংলা মায়ের কোলে। আমি যে দিন বাড়িতে যাই সেই দিন অনেক বৃষ্টি ছিল আমি গাড়ি থেকে নেমে দেখি বাবা বৃষ্টির মধ্যে ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আমাকে দেখেই বাবা দ্রুত এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন তুই এতদিন আমাদেরকে ছেড়ে কিভাবে ছিলি তোর কি একটুও আমাদের কথা মনে পড়ে নাই। বাবাকে সামলে নিয়ে বাড়ির দিকে চললাম। রাস্তার মধ্যে অনেক আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা হলো কুশল বিনিময় হলো দীর্ঘ নয় বছরের প্রবাস জীবনের সকল কষ্ট যেন এক নিমিষেই ভ্যানিশ হয়ে গেলো।
কিছুদিন পর তোড়জোড় শুরু হল আমার বিয়ের জন্য ১৭-৭-২০১৫ বাবার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করি।
কথায় আছে সুখের দিন বেশি স্থায়ী হয় না সুখের দিনগুলো দ্রুত কেটে যায় আমারও তাই হল দেখতে দেখতে ছুটি শেষ হয়ে গেলো চলে এলাম কুয়েত ।
তারপর কিছু দিন যেতে না যেতেই বাবা বিষন অসুস্থ হয়ে পড়েন,, বাবাকে দ্রুত ঢাকায় স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো , বাবার অবস্থা আস্তে আস্তে খারাপের দিকে যেতে লাগলো , বড় ভাই ফোন করে বিস্তারিত জানালো আমাকে আমি আমার কোম্পানীর ম্যানেজার কে বিস্তারিত বলে ছুটির আবেদন করলাম দেশে যাওয়ার জন্য কিন্তু কোন কাজ হলোনা , কারন আমি কিছুদিন আগে ছুটি কাটিয়ে আসলাম। হাসপাতালে ভর্তির নয় দিনের মাথায় বড় ভাই কান্না কন্ঠে ফোন করে জানালো বাবা নামক মাথার উপরে ছায়াটি ছিল উনি আর আমাদের মাঝে নেই , বড় ভাই বলল মৃত্যুর কিছু আগ মুহূর্তেও আমার কথা বাবা বারবার বলতেছিলো আমি আর আমার লোকমান হোসেন কে শেষ বারের জন্যও দেখতে পারবোনা । আমি আর মনে হয় বাঁচব না ।তোমারা সকল ভাই মিলে মিলে চলবা বলতে না বলতেই বাবা পৃথিবীর সকলের মায়া ত্যাগ করে বাবা চলে গেলেন না ফেরার দেশে। যেখান থেকে কেউ কোন দিন আর ফিরে আসে না । আমি এতই হতভাগা যে প্রবাস নামক জেল খানার কারণে বাবার কবরে দু মুঠো মাটি পর্যন্ত দিতে পারি নাই।
যার বাবা পৃথিবীতে বেঁচে নেই সেই বুজে বাবা হারানোর যন্ত্রণা কতটুকু । কিন্তু কিছুই করার নাই । এ যে প্রকৃতির নিয়ম পৃথিবীতে কেউ চির দিন বেঁচে থাকে না। তাই বাবার জন্য প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পরে দুই হাত তুলে দোয়া করি।
বাবা তুমি ঐ পাড়ে ভালো থেকো
বাবার মৃত্যুর পর আমার চারদিক যেন অন্ধকার হয়ে আসছিল কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারছিলাম না মনে হচ্ছিল সবকিছু ছেড়ে দেশে চলে যায়। অশান্ত মন কে শান্ত করার চেষ্টা করলাম , কোনো লাভ হলো না , ডিসিশন নিয়ে ফেলেছিলাম যে আমি একেবারে দেশে চলে যাবো। এক বন্ধুর সাথে আমার মনের কথা গুলো শেয়ার করলাম আমার সব কথা শুনে বন্ধু বলল আপাতত তুমি দেশে যেওনা দেশে যাওয়ার আগে এমন কিছু করো যাতে করে তুমি তোমার ফ্যামিলি নিয়ে দুবেলা খেয়ে পড়ে সচ্ছলভাবে চলতে পারো তুমি একটু চিন্তা করে দেখো দেশে গিয়ে তুমি , আবেগ দিয়ে গল্প ছিনামা বানানো যায় কিন্তু বাস্তব জীবন অনেক কঠিন। আমার বন্ধুর কথাগুলো শুনে আমি আমার ডিসিশন চেঞ্জ করলাম , মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম দেশে এমন কিছু করবো যাতে করে আমার পরবর্তী প্রজন্মের কারো প্রবাস নামক জেলখানায় আসতে না হয়। কি করি কি করা যায় প্রবাসে থেকে ভাবতে লাগলাম। ঠিক তখনই আমার রুমমেট S.A. Sahab ভাই এর মাধ্যমে নিজের বলার মতো একটা গল্প ফাউন্ডেশনের খোঁজ পেলাম।
ইকবাল বাহার জাহিদ স্যার এর প্রতিটি সেশন পড়ে নিজেকে নতুন করে আবির্ভাব করলাম। আমি মনে করি একটি মানুষের পুরো জীবন পরিবর্তন করে দিতে পারে স্যারের একটি মাত্র সেশন। নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করছি এইরকম একটি প্লাটফর্মের সন্ধান পেয়েছি যে প্ল্যাটফর্ম কিনা আমাকে নতুন করে আবার শুরু করবার উৎসাহ উদ্দিপনা যুগিয়েছে।
আমি নিজেকে আরও ভাগ্যবান মনে করছি আমি NRB কুয়েত শৃংখলায় এক ধাপ এগিয়ে টিমের একজন গর্বিত সদস্য হতে পেরে , এনআরবি কুয়েত টিমের প্রতিটি সদস্যকে কত আন্তরিক , একে অন্যকে কি পরিমান শ্রদ্ধা করে ভালোবাসে তা বলে বুঝানো যাবে না আমার বুকে জমানো যে চাপা কষ্ট ছিল প্রিয় ভাইদের সংস্পর্শে এসে আমি সব ভুলে গেছি।
একটি কথা না বললেই নয় আমাদের প্রাণপ্রিয় মেন্টর ইকবাল বাহার জাহিদ স্যার যে পরিমাণ সম্মান এবং ইজ্জত আমাদের প্রবাসীদের দিয়েছেন তা অবিশ্বাস্য স্যার বলেছেন প্রবাসীরা বাংলাদেশের অক্সিজেন প্রত্যেকটা ইভেন্টে প্রত্যেকটা কাজে প্রবাসীদের প্রায়োরিটি দিয়ে থাকেন আমাদের স্যার। প্রবাসীরা আপনার কাছে চির কৃতজ্ঞ প্রিয় মেন্টর দোয়া করি মহান স্রষ্টার কাছে তিনি আপনাকে দীর্ঘায়ু করুক এবং আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।
আর এটা কোন কপি কিংবা অন্যের গল্প নয়। সম্পুর্ন আমার বাস্তব জীবনের গল্প। আমার লেখার মধ্যে ভূল ত্রুটি হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
বাংলাদেশ সহ বিশ্বের সব জায়গায় কোরনা ভাইরাসের প্রভাব আবার বেড়েই চলেছে তাই বলব একটু সাবধানে চলাফেরা করবেন। দোয়া করি আপনারা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকেন না কেনো আল্লাহ যেনো আপনাদের সুস্থ ও নিরাপদে রাখে।
স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৫৬১
Date:- ২৮/০৬/২০২১
ধন্যবাদান্তে
........................................
আমি লোকমান হোসেন
ব্যাচ-১৩
রেজিস্ট্রেশন-৫৪২৬৯
জেলা-নরসিংদী
বর্তমানে কুয়েত প্রবাসী