৬০০তম স্টেটাস অব দ্যা ডে হওয়ার_অনুভুতি প্রকাশ
এই বাবা শব্দের মাঝে লুকিয়ে আছে অনেক রাগ, অনেক অভিমান, অনেক ভালোবাসা।
বাবারা একটু শাসন বেশি করেন, যেটা আমরা চাই না, আমাদের খুব খারাপ লাগে। ছোট বেলায় কতো মন খারাপ থাকতো, মনে হতো আমার বাবা একটু বেশি শাসন করে কেন? আমার বাবা এতো রাগি কেন? আমার বাবা খুব খারাপ।
কিন্তু এখন হাড়ে হাড়ে বুঝি আমার বাবা ই শ্রেষ্ঠ বাবা, কতই না ভালোবাসতেন আমাকে। ওই যে আমাকে বকা দিয়েছেন সেই বকার মাঝে লুকিয়ে রেখেছিলেন অনেক অনেক ভালোবাসা। এখন বুঝি আমার বাবা আমাকে অনেক আদর করতেন। পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বাবা আমার বাবা ছিলেন। আমার বাবার মতো আর কোন বাবা নেই।
আমার বাবা আমাকে বকা দিয়েছেন কারণ আমি যেন শিখতে পারি, আমি যেন ক্লাসের ১ম স্থান অর্জন করতে পারি, আমি যেন সকল ছেলে মেয়ে থেকে ভালো হতে পারি।অনেক সময় মেরেছেন, কারণ আমি যেন খারাপ কাজ না করি, আমি যেন খারাপ না হয়ে যাই। এই সকল কিছু ছিলো আমার জন্য,তার জন্য কিছুই না, হয়তোবা এতোটুকু যে মানুষ বলবেন তোমার ছেলে /মেয়ে অনেক ভালো।
আমার বাবা ছিলেন আমার প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। স্কুলে ক্লাস ওয়ান টু তে থাকাকালীন সময়ে বাবাকে বাবা বলেই ডাকতাম কিন্তু ক্লাস থ্রি তে যখন উঠলাম বাবা একদিন আমাকে বললেনঃ-
" দেখো আব্বু তুমি আস্তে আস্তে বড়ো হয়ে যাচ্ছো, স্কুলে যদি তুমি আমাকে বাবা ডাকো তাহলে আমি তোমার প্রতি দুর্বল হয়ে যাবো তুমি স্কুলে আমাকে স্যার বলবে, আর বাড়িতে বাবা বলে ডাকবে, আমি হয়তো তোমাকে শিখাতে কম পারবো'।
তারপর থেকে কখনোই স্কুলে বাবাকে বাবা বলে ডকতে পারতাম না শুধু স্যার বলতাম । এমন ও অনেক সময় গেছে বাড়িতে ও স্যার বলে পেলতাম।
নিয়মনীতি, শৃঙ্খলার দিকে সবসময় খুব কঠিন অবস্থায় ছিলেন আমার বাবা।
একদিন আমি,আমার বড়ো ভাই ও আব্বু মিলে মাটি কাটতে গিয়েছিলাম আমাদের মেইন রাস্তার পাশের খেতে। সেখানে আমরা মাটি কাটার সময় এক লোক বললেন স্যার আপনি মাটি কাটেন কেন? দু একজন মানুষ নিয়ে ও তো কাটতে পারেন। আমার বাবা উত্তরে বলেছিলেন আমি নিজের কাজ নিজেই করি। তাছাড়া আমি যদি আমার ছেলেদের এখন থেকে কাজ না শিখাই তাহলে তো তারা সমাজে চুরি করবে।
"
এইজন্যই আমার বাবা শ্রেষ্ঠ প্রশিক্ষক।
আমি একদিন আমার পাশের বাড়ির একজনের খেত থেকে একটা শসা নিয়েছিলাম। বাবা দেখে আমাকে খুব মারছিলেন, যার খেত তিনি অনেক কষ্ট করে এই ফসল করেছেন আর তুই এই শসা না বলে নিলি কেন? পরে ওই ক্ষেতের মালিক এই কথা শুনে আমাদের বাড়িতে অনেক গুলো শসা দিয়ে গেছেন। তিনি বাবাকে বলেছিলেন স্যার ওরে মারার দরকার ছিলো কি আমারে বললেই হতো যে আমার ছেলে একটা শসা খেয়েছে, আমার বাবা উত্তরে বলেছেন আমি যদি আমার ছেলেদের এখন থেকে শাসন না করি তাহলে আজ আপনার ক্ষেত থেকে একটা শসা নিয়েছে আরেক দিন যে আরেক জনের ক্ষেত থেকে আরো বেশি নিয়ে যাবে। তখন ওই লোকটা বাবাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন।
ছোট বেলায় ক্ষেতে খামারে কিভাবে কাজ করতে হয় সকল কিছু আমাদের শিখিয়েছেন আমার বাবা।
একেবারে প্রাইমারী স্কুল থেকে এইচ এস সি পর্যন্ত আমি কখনোই জানতাম না যে পড়াশোনা করতে টাকার প্রয়োজন আছে।
সবসময় স্কুলে গিয়ে স্যারদের সাথে আমার বিষয়ে কথা বলে আসতেন।
হাইস্কুলের শিক্ষকরা আমাকে খুব আদর করতেন। একদিন ৭ম শ্রেনীতে আমার বাবা ক্লাসে হাজির। স্যারকে জিজ্ঞেস করলেন আমি পড়াশোনা কেমন করি। স্যার বললেন আপনার ছেলে প্রতিদিন ই পড়াশোনা শিখে আসে। বাবা স্যারকে বললেন পড়াশোনার ব্যাপারে কোন ছাড় দিবেন না যদি মারতে হয় মারবেন যদি আপনি মারতে না পারেন তাহলে আমাকে খবর দিয়েন।
৭ ম শ্রেণীর পরে চলে আসি ঢাকায়। আমার বোনেরা ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এ পড়াশোনা করে। তাই তাদের সাথে আমাকে ও এখানে পড়াশোনা করতে হবে।
আমাদের বাসা ছিলো তেজগাঁও বেগুনবাড়ি টেক্সটাইল কোয়ার্টারে।
এখানে বাবা যত টাকা বেতন পেতেন পুরো চেকটাই পাঠিয়ে দিতেন।
কখনো নিজের জন্য একটা টাকাও রাখতেন না।
একদিন শবে বরাতের দিন রাতে বাবা ঢাকায় আসে। আমার বোনদের কাছে একটা কাগজ মোড়ানো কিছু একটা দেয়। আপু জিজ্ঞেস করলে বাবা বলে টাকা আছে। আমি খুলে দেখে সকল কিছু কাগজ কোনো টাকা নাই। পরে বুঝতে বাকি রইলো না যে আব্বুর টাকা সব হাইজ্যাক করে নিয়ে গেছে। ওই মাসটা আব্বুর খুব কষ্ট হয়েছিল।
আমার বোনদের পলিটেকনিক পড়া শেষে চাকুরী হয়ে যায়। তারা সাভারে চলে যায় চাকুরির উদ্দেশ্যে। আমি আমার এক বন্ধুর সাথে তার বাসায় উঠি৷ ২ মাস থাকার পরে আব্বু বুঝতে পারলো আমার পড়াশোনা হচ্ছে না।সামনে আমার এসএসসি পরীক্ষা। আম্মুকে বললেন ঢাকায় আমাকে নিয়ে একটা বাসায় উঠতে।
আমি আর আম্মু ঢাকার মগবাজারে একটা বাসায় উঠি।
আলহামদুলিল্লাহ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আব্বুর এই সিদ্ধান্ত আমাকে জিপিএ ৫ এনে দিয়েছেন।
২০০৬ সালে আব্বু খুব আসুস্থ হয়ে পড়ে। অনেক ডাক্তার দেখিয়ে আব্বুর ক্যান্সার ধরা পড়ে।
এই ক্যান্সার ধরা পড়া থেকে শুরু করে আব্বু অনেক হাসপাতালে ঘুরাঘুরি করে। কেমোথেরাপি দিয়েছেন ঢাকার মিরপুরের একটি হাসপাতালে। তারপর রেডিয়েশন থেরাপি দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ আস্তে ধীরে আব্বু সুস্থ হয়ে উঠলো। রেডিও থেরাপির কারণে আব্বুর দাড়ি গুলো উঠে গিয়েছিল।
কিন্তু আব্বুর এক অজানা রোগ ছিলো সেটা আব্বু নিজে জানতো। সেটা হলো ডায়াবেটিস। এই ডায়াবেটিস এর কথা আমরা কেউই জানতাম না। কারণ কারো সাহায্য ছাড়াই আব্বু নিজে নিজে হাসপাতাল ও চিকিৎসা করাতো। চিকিৎসাতে কতো টাকা ব্যায় হয়েছে বা কোন ডাক্তারের কাছে যাবে সেটা আব্বু কাউকে কষ্ট না দিয়ে নিজেই করতেন।
২০০৬ সালে যখন ক্যান্সার ধরা পড়ে তখন থেকেই রিপোর্টে ডায়াবেটিস ও ধরা পড়ে। কিন্তু ডায়াবেটিস টাকে গুরুত্ব দেয় নাই।
আমার বাবা পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বাবা।
২০০৯ সাল এর কথা আমি কখনো ভুলতে পারবো না। আমি তখন চট্টগ্রামে পড়াশোনা করি। আমার বড়ো আপুর বাড়ি চট্টগ্রামে এবং আমার দুলাভাই চট্টগ্রাম এর একটা কলেজের প্রভাষক সেই সুবাদে আমি আমার দুলাভাই এর কলেজ থেকে এইস এসসি তে পড়াশোনা করি। আমি চকবাজারের একটা কোচিং সেন্টারে কোচিং করি। একদিন সন্ধ্যা ৭.৩০ এ আমি বাজারে গিয়েছিলাম বাজার করতে। এমন সময় আমার মেঝো ভাই আমাকে কল করে বলে যে আব্বু খুব অসুস্থ। আমি যেন তাড়াতাড়ি ঢাকা আসি। আমি বাজার থেকে আর বাসায় না গিয়ে আমার সাথে এক রুমমেট থেকে কিছু টাকা নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। ভোর ৪ টার দিকে আমি শাহবাগ বারডেম হাসপাতাল এ পৌছাই। তখন দেখি আমার বাবা ৯ তলায় একটি বেডে ভর্তি। আমার মেজো ভাইও ভাবি ওখানে সারারাত ছিলো। ভাইয়া দিনে ডিউটি আছে এই জন্য ভাইয়া এ ভাবি সকালে বাসায় চলে গেছে।
আমি বাবার কাছে একা বসে আছি।
বাবা আমার কাছে অনেক কথা বলেছেন। এটাই যে বাবার শেষ কথা আমার জানা ছিলো না। বাবা আমাকে একমুহূর্তের জন্য ও সরতে দেন নাই। ডাক্তার বলেছেন ঔষধ আনতে কিন্তু বাবা বলে নার্সদের দিয়ে আনাতে, আমি নাস্তা খেতে ও যেতে পারি নাই বাবা বলেন হাসপাতাল থেকে আমাকে যে নাস্তা দিবে সেটা তুই খাবি বাহিরে যাবি না আমার কাছে বসে থাক।
১২ টার দিকে বাবা বললো বাবা বাথরুমে যাবে আমি নিয়ে গেলাম। বাথরুম শেষে আমি বাবাকে বিছানায় দিয়ে বললাম আমি একটু বাথরুমে যাবো। বাবা বসে আছে বললো তাড়াতাড়ি আসবি। আমি বাথরুম থেকে শুনি কে যেন বললো ৯৫৭ নাম্বার বেডের রোগীর অবস্থা খারাপ। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
তাড়াতাড়ি বের হয়ে দেখি বাবার পাশে আরো অনেক ডাক্তার, নার্সরা বাবাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করলো।
হে আল্লাহ তুমি আমার বাবাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করো।বাবা আমাদেরকে এতিম করে চলে গেলেন।বাবার অভাবটা কখনও পুরন হবে না।আমি আপনাকে অনেক বেশি মিস করি বাবা।সবাই আমার বাবার জন্য দোয়া করবেন যেন রাব্বুল আলামীন আমার বাবাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করেন।
"স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৬০০
Date:- ১৯/০৮/২০২১
মো: ফরহাদ চৌধুরী
কমিউনিটি ভলেন্টিয়ার
টপ টেন ক্লাবের মেম্বার
রেজিষ্ট্রেশন টিম এর মেম্বার
নিজের বলার মতো একটি গল্প ফাউন্ডেশন।
ব্যাচঃ ১১
রেজিষ্ট্রেশন নংঃ২৬১৭৩
নিজ জেলা চাঁদপুর
বর্তমানে কুমিল্লা