আমি চোখের পানি মুছতে মুছতে বললাম,
অনেকেই বলেন আমরা প্রবাসীরা নাকি দেশের অক্সিজেন, আমরা নাকি দেশের সব কিছুতে সবার আগে এগিয়ে আসি, আসলে আমি নিজে যা মনে করি তা হল,
আমরা দেশটাকে ভালবাসি, আপনারা আবার ভেবে বসেন না যে, আপনারা দেশকে ভালবাসেন না,
আপনারা ও ভালবাসেন কিন্তু আমরা দেশটাকে ভালবাসি,
এই ভালবাসাটা আমরা প্রবাসীরা বেশি উপলব্ধি করি, যা দেশে থেকে হাতে গনা কয়েক জন ব্যতীত কেউ উপলব্ধি করতে পারেনা,
আমরা যারা প্রবাসি আছি তারা দেশের কিছু একটা দেখলে আবেগ আপ্লূত হয়ে যাই,
শৈশবের সেই স্কুল মাঠ, পদ্মফুলে ভরা দিঘি, পুকুরে গোসল, দোল খাওয়া সেই ধানের জমি, বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলা, বাবার শাসন মায়ের আদর খুব মিস করি,
মিস করি আপুর সাথে দুষ্টমি ভাইয়ের সাথে জগরা,
বন্ধুর সাথে বলতে না পারা গল্প, পাশের বাসার আন্টির জগরার অভিনয়, বলতে না পারা ভালবাসা, কুড়িয়ে পাওয়া হাসের ডিম,
দশ টাকা মা-কে দিয়ে 30 দিন নিয়ে যাওয়ার পর ও মায়ের কাছে রয়ে যাওয়া দশ টাকার ঝৃণ,
সব প্রবাসীরাই এগুলো খুব বেশি মিস করে, তাই দেশে যারা আছে তাদের থেকে আমরা দেশকে ভালবাসাটা বেশি উপলব্ধি করি,
কেউ কেউ তো আছেন তাদের জীবনের প্রায় অর্ধেক কাটিয়ে দিয়েছেন প্রবাসে যেন নিজের পরিবার নিজের দেশটা ভাল থাকে,
প্রবাসী এক ভাইয়ের জীবন গল্প বলি,
পাশের প্যাল্টের এক ভাই, আমি যখন এখানে আসি, এসেই এই ভাইকে কে পাই, ওনি অততন্ত সহজ সরল, ভাইকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম ভাই আপনার জিবনের গল্প বলেন, ভাই বলতে শুরু করলেন, প্রথম বছরে অনেক কষ্ট করেছি না খায়া থেকেছি অনেক সময়,
আমি প্রশ্ন করে বসলাম, সৌদি আরব কি কেউ না খেয়ে তাকে নাকি?
তিনি বলতে শুরু করলেন বেতন ছিল ৪০০ রিয়াল ছোট্ট মেয়েটা অসুস্থ ধারদেনা করে এখানে আসছি, পাওনা দ্বাররা প্রতি দিন বাড়িতে আসে, যদি তিন বেলা খাবার খাই তো ৪ হাজার টেকা ও পাটানো যাবো না, আমি বললাম বেতন এতো কম কেন?
তিনি বললেন আমি কি আর তগো মত পড়া লেখা জানি গেদা,
প্রথম আসার পর তো কয়ছিল আবার দেশে পাটাই দিবে ভাষা বুঝি না কিছু কইতে পারি না, অনেক কান্না কাটির পরে কামে রাকছে,
আমি বললাম যার মাধ্যমে আসলেন থাকে কিছু বলেননি?
তিনি হাসতে শুরু করলেন হাসতে হাসতে তার দুচোখ দিয়ে অঝরে অশ্রু ঝরছিল,
হাসি থামিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন,
গেদা দুঃখের সময়ের কথা মনে করিয়ে দিলি, যে আমারে নিয়া আইছে হে কয় কাজ না করতে পারলে আমার কি? তুমি আইছ, তুমি ছলে গেলে তোমার বিষয় আমার কিছু করার নাই,
আমি ওনাকে বললাম দুঃখ শুনতে চাই না সুখের সময়ের কথা বলেন, আমি ও সুখি হতে চাই সুখি হওয়ার জন্য এখানে আসছি,
আবার বলতে শুরু করলেন এক বছর পর থেইক্কা সুখ আর সুখ এক বছরের মধ্যে ভাষা শিখছি তারপর বেতন বারছে।
আমিজিজ্ঞেস করলাম কয় দিন হল সৌদিতে আছেন?
তিনি বললেন ২৭ বছর ধরে,
আমি হাসতে হাসতে বললাম বাড়িতে যাবেন কবে? আমার বয়স তো ২৭, আমার সমান বয়স তো কাটিয়ে দিলেন, আর কতো থাকবেন?
ওনি ও হেসে উত্তর দিলেন আর জানে কয় না এখন এক বারে ছইলে যাব,
সেই ভাই চলে গিয়েছিলেন কিন্তু ৬মাস পরে আবার আসতে হল,
আমি ওনাকে দেখেই হেসে জিজ্ঞেস করলাম ভাই আপনি না একেবারে চলে গেলেন,
ওনি চোখের পানি ছেরে দিয়ে বলতে লাগলেন বড় মাইয়েটার বিয়ে টিক হয়ছে ছোট্ট মাইয়েটার ও বিয়ের বয়স হয়ে গেছে যা জমানো টাকা ছিল তার অর্ধেক শেষ অই গেছে ৬মাসে, আর কিছু দিন হলে বাকি টাকা গুলি ও শেষ হই যাইত, জানডায় কয় না আর বিদেশ থাকি, কি করুক কিছুতো করার ও নাই,
বড় মেয়েটার বিয়ে হয়েছে গত ছয় মাস আগে, ভাই যে কত খুশি ছিল সরাসরি না দেখলে বুঝা যেত না,
জিজ্ঞেস করলাম পুরো জীবন তো কাটিয়ে দিলেন বিদেশে, আপনি কি সুখি? অভাক করা এক উত্তর পেলাম, বাড়িতে সবাই ভাল থাকলে আমার দেশটা ভাল থাকলে আমি সুখি না থেকে পারি? এমন আরো একটা জীবন পাইলে ও কাটিই দিতাম পরিবার ও দেশটা ভাল রাখবার জইন্যে,
গত তিন মাস আগে ভাইর ছোট্ট মেয়েটার বিয়ে টিক হয়েছিল,
ভাই খুব টেনশনে ছিলেন টাকার জন্য, রাতটি ছিল বৃহষ্পতিবার ঘুমিয়েছিলেন আর উঠেন, চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে গেলেন ডাক্তারের রিপোর্ট ছিল বেশি দুশ্চিন্তার কারণে হার্ট অ্যাটাক করে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে গেলেন, তার বাড়িতে খবর দেওয়া হল, প্রথমে অনেক কান্না কাটি করে তার পরিবার,
পরে যখন ই বলা হয় তার লাশ দেশে পাটাতে হলে কিছু টাকা করছ হবে দেশ থেকে দিতে হবে, কোভিট 19 এর জন্য, কিছু দিন কোন ফ্রিজে রাখতে হবে ওখানে ও কিছু খরচ হবে,
যখন ফ্লাইট চালু হবে তখন পাটানো হবে,
দেশ থেকে উত্তর আসলো লাশের সাথে কোনো টাকা থাকবে কি না?
যেহেতু সাধারণ নিয়মে মৃত্যু তাই টাকা দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না,
যখন বলা হল টাকা থাকবে না তখন লাইনটা কেটে গেল,
ভাবলাম নেটওয়ার্ক সমস্যা হয়তো তাই কেটে গেছে,
আবার কল করা হলে কেউ একজন বলল এতো বার কল করার কি আছে?
যেভাবে পারেন ওখানেই দাপন করেন, করোনার সময় দেশে ও অনেক জামেলা হবে,
যেখানে মারা গেছে ওখানেই দাপন করেন মরে গেছে আমাদের ও বিপদে ফেলে গেছে,
কল টা খেটে গেল আমি দারিয়ে আছি আমার চোখ থেকে পানি ঝরছে, আমার পাশের আর এক ভাই বলতে লাগল ভাই আপনার চোখ থেকে পানি ঝরতেছে কেন?
আমি চোখের পানি মুছতে মুছতে বললাম,
ভাই আমার বলেছিল আর একটা জীবন থাকলে সেই জীবন টা পরিবার ও দেশটা ভাল রাখতে এখানে কাটিয়ে দিবেন, পরিবার তার অনুমোদন দিয়েছে।
ভাই আমার এখানেই আর একটা জীবন কাটাবেন।
বেছে থাকাকালীন সময়ে ভাই অনেক সুখি ছিলেন, সব কিছু বিলিয়ে দিয়ে,
সব সময় বলতেন দেওয়ার মাঝে যে সুখ গেদা, সেই সুখ একবার পাইলে জিবনে কখনো নিতে ভাল লাগবে না
মারা যাওয়ার পরে হয়তো ভাই আমার সুখে নাই দেশ ও পরিবার থাকে ভাল থাকতে দিচ্ছে না হয়তো,
আমরা কয়েকজন বাংলাদেশি মিলে কিছু টাকা জমা করে পাটাতে চেয়েচিলাম, কিন্তু ওনার পরিবার কোন আগ্রহ ই দেখায়নি তাকে দেশ নিতে,
একটা দেশ প্রেমিক ভাই হারালাম যে কারাপ খবর গুলো শুনতে চাইত না, ভাল কোন খবর শুনলেই আমার কাছে এসে বলতো, গেদা কি পড়ালেখা করছ দেখি, এই খবর টা বাইর কইরে পড়ে শুনাও,
একটা ভাল খবর যাকে সামনে পেত তাকেই বলত, সেই ভাল খবর প্রচার চলত আর একটা ভাল খবর না আসা পর্যন্ত,
আমি 12 তম ব্যাচের আগে থেকেই নিজের বলার মত একটা গল্প গ্রুপটা কে ফলো করতাম,
একদিন ভাইকে আমাদের স্যারের একটা ভিডিও দেখিয়েছিলাম হয়তো তখন 11 তম ব্যাচের শুরুর দিক হবে,
তিনি প্রতি দিন সন্ধার সময় আমার কাছে আসতেন,
আর বলতেন ইকবাল বারী রে দেখাও তো যে ভালা কাম করে, স্যারের নামটা ওনি মনে রাখতে পারতেন না,
আমি হাসতাম আর বলতাম ইকবাল বাহার জাহিদ, ইকবাল বারী না, তিনি বলতেন ওই আরকি আমি মোক্ষশুক্ষ মানুষ এতো বড় নাম কি মনে থাকে গেদা,
ওনি বেছে থাকলে হয়তো এতো দিনে রেজিষ্ট্রেশন করে দিতাম নিজের বলার মত একটা গল্প ফাউন্ডেশনে,
আজ এ পর্যন্ত ই আমি চাই সব প্রবাসীরা খোঁজে পাক নিজের বলার মত একটা গল্প,
আর নিজের বলার মত একটা গল্প ফাউন্ডেশন পেয়ে গেলে নিজের বলার মত একটা গল্প তৈরি করা শুধু সময়ের ব্যাপার,
এমন অনেক প্রবাসী আছে,
যারা আমার থেকে ও বেশি দেশকে ভালবাসে শুধু সঠিক দিক নির্দেশনার জন্য তৈরি করতে পারেনা নিজের বলার মত একটা গল্প।
কষ্ট করে যারা পড়বেন তাদের কে অনেক অনেক শুভকামনা ও ধন্যবাদ,
দোয়া করবেন সকল প্রবাসিদের জন্য,
আমার প্রিয় দেশটা আমারা প্রবাসীরা সব সময় অন্তরে লালন করি আমরা মরে গিয়ে ও পরিবারকে ভাল রাখতে চাই,
সবশেষে আবার ও ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা আমাদের সবার প্রিয় শিক্ষক ইকবাল বাহার জাহিদ স্যারের প্রতি যার জন্য সপ্ন দেখা এবং নিজের বলার মত একটা গল্প তৈরি করার সাহস পাচ্ছি।
ধন্যবাদান্তে
মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম জুয়েল
কমিউনিটি ভলান্টিয়ার
নিজের বলার মত একটা গল্প গ্রুপের গর্বিত সদস্য।
ব্যাচঃ 12
রেজিঃ 37168
থানাঃ মাধবপুর
জেলাঃ হবিগঞ্জ