আল্লাহ্র অশেষ মেহেরবানীতে আমার স্ত্রীর একটা
পড়াশোনা টাকে বরাবরের মতই ৪ নং সাবজেক্ট মনে করতাম আর বাবা আমার স্কুল শিক্ষক হওয়াতে এর জন্য কম পিটানি খেতে হত না । কিন্তু কে শোনে কার কথা । নিজের মত করেই ছুটে চলতাম এদিক থেকে অদিক। ছুটতে ছুটতে পার হয়ে গেল প্রাথমিকের গণ্ডি , এবার উঠলাম হাইস্কুলে যেখানে সবচেয়ে বড় আতংক ছিল আমার বাবা । তিনি ছিলেন অংকের শিক্ষক আর আমি ছিলাম অংকে কাঁচা যার সুবাদে স্কুলে গেলে ভালভাবে প্রস্তুতি নিয়েই যেতে হত কেননা অন্য স্টুডেন্টরা বড় ভুল করলেও মাফ আছে কিন্তু আমার ছোট ভুলের জন্য অনেক খেসারত দিতে হত। তবে আমি পড়াশোনাতে যাই ছিলাম না কেন ভিতরে ভিতরে ছিলাম অনেক জেদি আর অন্যয়কে কখনো সহ্য হত না । আর এই জিদ এবং অন্যয়ের প্রতিবাদের খেসারত দিতে হয়েছে আমার বাস্তব জীবনে । শেয়ার করবো ইনশাআল্লাহ্ ।
এভাবেই একদিন এস এস সি শেষ হয়ে যায় । আর আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আতংক থেকে বেচে যাই চিরদিনের জন্য ।
কলেজ জীবন ঃ
---------------------
* কলেজ জীবনটা কেটেছে বেশির ভাগ সময় বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর ঘোরাঘুরির মধ্য দিয়ে । কখন যে শেষ হয়ে গেল আমার আনন্দ ময় সেই জীবন কিছুই টের পাইনি । এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়ে এবার কোথায় কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হব এই নিয়ে আমার বাবার সাথে কথা হল । বাবা বললেন তুমি রাজশাহীতে থাক এখান থেকেই কোচিং কর আর বললাম ঢাকাতে যাব এই নিয়ে শুরু হয়ে গেল আমার বাবার রাগারাগি । উনি আসলে কিছুতেই চাইছিলেন না আমি ঢাকাতে আসি কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিল ঢাকাতে আসার । যেহেতু আমি পড়াশোনা টাকে বেশি প্রাধান্য দেইনি সেজন্য আমি বুঝেছিলাম ক্যারিয়ার যদি গড়তে হয় তবে ঢাকাতেই আসতে হবে । সুতরাং একটা পর্যায়ে ঢাকাতেই চলে আসলাম। কিন্তু আমার বাবার কথা আমি যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পাই তবে আমাদের বাড়ির আসে পাশে কোনো একটা কলেজে ভর্তি হতে হবে। না হলে উনি ঢাকাতে আমার এত খরচ বহন করতে পারবে না । আমি সব কিছু মেনে নিয়ে চলে আসলাম ঢাকাতে সাথে ছিল আমার একমাত্র বন্ধু, যার সাহসে আমার ঢাকাতে আশা। কিন্তু এক সময় সেও চলে গেল নওগাঁতে আর আমি একা একা থেকে গেলাম ঢাকাতে । শুরু হল আমার জীবনের নতুন অধ্যায় ।
নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঃ
-----------------------------
* জাকঝমক এই ঢাকাতে আমার পরিচিত বলতে আমার এলাকার এক চাচা আর এক বড় ভাই ছিল। আমার চাচা কোচিং এ ভর্তি করিয়ে উঠিয়ে দিলেন মোহাম্মাদপুরের কোনো এক মেসে। যেখানে ছিল আমার সেই বড় ভাই আর অন্য এলাকার ৬ জন মেম্বার যাদেরকে জীবনের প্রথম দেখলাম। যাই হোক এক সময় সবার ভালবাসা পেলাম আর মেসের মধ্যমণিও হয়ে গেলাম।
*শুরু করলাম কোচিং করা । প্রথম প্রথম বেশ ভালো লাগত ক্লাসগুলো কিন্তু কিছুদিন যেতেই পড়ার এত চাপ আশা শুরু হল যে একসময় পড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম কারণ আমি বরাবরের মতই পড়াশোনাকে ভয় পেতাম । যাইহোক এভাবে একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হল কিন্তু কোন বিশ্ববিদ্যালয়েই আমার চান্স হল না । আর আমার বাবা কিছুতেই ঢাকাতে রাখতে চাইলেন না । কিন্তু আমি বাবাকে বললাম আমি ঢাকাতেই থাকব আর নিজের খরচেই থাকব। এই জিদ নিয়ে থেকে গেলাম ঢাকাতে আর ভর্তি হলাম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে।
* ভর্তি হবার পর থেকেই আমার একটাই চিন্তা আমি কিভাবে নিজের খরচ নিজে চালাবো আর বাবর কাছ থেকে কোনো খরচ নিতে হবে না । ঐ সময়টা আমার মা আমাকে যথেষ্ট সাপোর্ট দিয়েছে টাকা দিয়ে । কারণ আমার বাবার প্রচণ্ড রাগ ছিল আমি কেন ঢাকাতে পরে আছি। একটা সময় আমার মেসের এক বড় ভাইকে ধরলাম চাকরির জন্য । ভাইকে বারবার বলাতে চাকরি ম্যানেজ করে দিল। আমার চাকরিটা হল সুপের শপের আইটি ডিপার্টমেন্টে । যখন আমি চাকরি শুরু করি তখন মাত্র অনার্স ১ম বর্ষ শেষ করেছি।
এভাবে চাকরি আর পড়াশোনা চলছিল বেশ ভালোই চলছিল আমার দিনগুলো । একদিন আমাদের সুপের শপে পরিচয় হয় আমাদের এক মেয়ে কাস্টমারের সাথে । তারপর তার সাথে কথা বলতে বলতে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠে । সে ছিল যথেষ্ট সহজ সরল, হাস্যজ্জল আর অনেক কেয়ারিং একটা মেয়ে । এক সময় সে বলে তুমি যে কাজটা এখানে করছ এই একই কাজ দেশের বাহিরে করলে আরও নিজেকে এগিয়ে নিতে পারবে। এখনেতো অনেকেই তমাকে উপড়ে উঠতে দিবে না ।
তার কথাটা বেশ মনে ধরল এবং বিদেশে যাওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগলাম ।
বিদেশ যাওয়ার স্বপ্নঃ
------------------------
আমি যেতে চেয়েছিলাম আমেরিকাতে এটা শুনে বাবা প্রথমে রাজি ছিল না কারণ আমার প্রতি তার কনফিডেন্স অনেক কম ছিল । বাবা ভালভাবেই জানে আমি পড়াশোনা মোটেই পছন্দ করি না আবার সেই আমিই যাব পড়াশোনার জন্য । এটা উনি মেনে নিতে না পারলেও আমার জিদের কারণে রাজি হলেন। আর আমাকে কিছু টাকা দিলেন প্রসেসিং করার জন্য । প্রসেসিং এর ৩ মাসের মাথায় আমার আই ২০ কার্ড আসে আমেরিকার নরদান আরিজোনা ইউনিভার্সিটি থেকে এরপর ভাইভা ফেস করলাম আমেরিকান এম্বাসিতে । আলহামদুলিল্লাহ্ আমার ভিসা হয়ে গেলো । ভিসা সংগ্রহ করলাম জুলাই মাসের ১৩ তারিখে ২০১৩ সালে। ভিসা পেয়ে চিন্তা করলাম যে মেয়েটার উৎসাহে আমি এত বড় এচিভমেন্ট করলাম তাকে নিয়েই যাব । আমি আমর পরিবারকে জানালাম মেয়েটির ব্যপারে আমার বাবা মা দ্বিমত করলেন না । আমার বাবা আর ছোট ভাই ঢাকাতে আসল বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এবং দুই পরিবারের সম্মতিতে আমাদের বিয়ে সম্পূর্ণ হল ১৪ জুলাই ২০১৩। আর বিয়ের পরদিন থেকে আবার শুরু করলাম আমার স্ত্রীর ভিসা প্রসেসিং ।
ভিসা টা পাওয়ার পরে জবটাও ছেড়ে দেই , আর আমি তখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আবার যে এজেন্সির মাধ্যমে ভিসা প্রসেসিং করেছি তাদেরকে ৫ লাখ টাকা এবং অনান্য খরচ মিলিয়ে প্রায় ৮ লাখ টাকা নিমেষেই শেষ । একদিকে এত বড় ক্ষতি অন্যদিকে জব নেই আবার নতুন নতুন বিয়ে, মাত্র ১৫ দিনের বিয়ের জীবনে এত বড় ধাক্কা আমি কিভাবে সামলাবো নিজেই জানি না । আমার পরিবার পুরোপুরি হতাশ হয়ে গেলো এত টাকা নষ্ট হয়ে গেলো । যাই হোক শুরু হল জীবনের অতুন অধ্যায় । আমি জব খুঁজতে শুরু করলাম কিন্তু সেই মুহূর্তে কথাও জব হচ্ছিলনা । আমার কাছের মানুষ যারা ভিসার পাওয়ার কথা শুনে খুশি হয়েছিল ভিসা বাতিল হওয়ার পরে যেন আরও বেশি খুশি হল । আমি সবই বুঝতে পারছিলাম কিন্তু কিছুই করার নেই কারণ খারাপ সময়ে কাছের মানুষগুলো এত নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারে তা আমার জানা ছিল না ।
* আমি কত জায়গায় ঘুরেছি একটা জবের জন্য কত রাস্তা পায়ে হেঁটেছি তা আমার জানা নেই তবে হাটতে হাটতে ক্লান্ত হয়ে কখনো কখনো রাস্তাতে বা কখনো কোন মাঠের মধ্যে ঘুমিয়ে পরতাম তারপর আবার ছুটে চলা শুরু হত । এভাবে একটা সময়ে হতাশায় আমার বেচে থাকার আগ্রহটাই নষ্ট হয়ে গেলো । পকেটে টাকা নেই , নেই কোন জব পাবার সম্ভবনা , পাশে থেকে সান্ত্বনা দেয়ার মত কেউ নেই ।
আমার ঘুরে দাঁড়ানো ঃ
----------------------------
একসময় আল্লাহ্র অশেষ মেহেরবানীতে আমার স্ত্রীর একটা জব মিলল যা আমাকে নতুন করে বেচে থাকার স্বপ্ন দেখাল। কিছুদিন পরেই আবার আমার একটা কাজের ব্যবস্তা হল একটা শপিছ এর দোকানে । আমি আর কোনও চিন্তা না করে ঢুকে পরলাম । আমি চিন্তা করলাম এই জবটা চালিয়ে যেতে হবে আর আমাদের দুইজনের পড়াশোনা টাও শেষ করতে হবে। এভাবেই চলছিল আমাদের জীবন । কিছুদিন পরে আমার এক কাস্টমার আমাকে তার অফিসে দেখে পাঠাল । আমি গেলাম তার অফিসে এবং উনি আমাকে ওনার অফিসের সেলস ডিপার্টমেন্টে জয়েন্ট করতে বলে স্যালারিও বেশ ভালোই কিন্তু সমস্যা হল আমার অনার্স এর সাটিফিকেট নেই তাই উনি আমাকে এডমিন এর কাছে না পাঠিয়ে সরাসরি নিয়োগ দিলেন। আলহামদুলিল্লাহ্ তখন থেকে সংসার , পড়াশোনা আর চাকরি এক সাথে শুরুকরলাম বেশ ভালোভাবেই । কিন্তু জবের মধ্যে কোনও আনন্দ খুঁজে পেতাম না সবসময় মনে হত নিজে যদি কিছু একটা করতে পারতাম । কেননা আমি আমার প্রথম কর্পোরেট লাইফটাতেই দেখেছি কর্পোরেট পলিটিক্স কতটা ভয়ংকর হতে পারে । যাইহোক এভাবে একসময় অনার্স শেষ হল আর আমিও শুরু করলাম জব চেঞ্জ করা । আমি বেশ কয়েকটি নামীদামী কোম্পানিতে জব করেছি কিন্তু সবগুলোতেই দেখেছি কর্পোরেট পলিটিক্স এর ভয়াবহতা । যার কারণে নিজে কিছু একটা করার স্বপ্নে বিভোর ছিলাম।
জব থেকে শিক্ষা ঃ
----------------------
জব এমন একটা বিষয় যেখানে অন্যের জন্য গলা পানিতে নামলেও আপনার জন্য হাঁটু পানিতে নামার কাউকে পাশে পাবেন না । আর ভালো সময়ে কোম্পানি পাশে থাকে কিন্তু খারাপ সময়ে নিজের স্বার্থে যত ভালো মানুষই হন না কেন ছুড়ে ফেলে দিতে একবারও চিন্তা করে না ।
উদ্যোক্তা জীবনে প্রবেশ ঃ
-------------------------------
আমি ২০১৬ সালে মোহাম্মাদপুর থেকে চলে আসি বসিলাতে । এখানে আসার কিছুদিন পরেই ছোট একটা মার্কেট হয়। আমি আর আমার স্ত্রী দুজনেরই ইচ্ছা ছিল নিজেরা কিছু করবো সেই ইচ্ছা থেকেই ২০১৭ সালে একটা দোকান নিয়ে নেই। আলহামদুলিল্লাহ্ ব্যবসা ভালো চলার কারণে আরও একটা দোকান নেই এবং আমদের ব্যবসায়িক জীবনের পরিধি বাড়িয়ে নিয়ে খুচরার পাশাপাশি পাইকারি যাত্রা শুরু হয়। যেখানে কসমেটিক্স এবং পোশাক নিয়ে নতুন যাত্রা শুরু হয়। তখনও আমার জব চলছিল আর আমার দোকান দেখাশোনা করত আমার স্ত্রী । এভাবে ভালোই চলছিল । কিন্তু করোনার প্রভাবে ২০২০ সালে আমার জবটা চলে যায় । আর আমিও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হই জব করবোনা। পারলে জব দিব ।
গ্রুপে যুক্ত হওয়া ঃ
----------------------
আমরা অনলাইনে একটা পেজও খুলি কিন্তু অনলাইনে বেশি সময় দেয়া হয় নাই যার কারণে অনলাইনে কিছু একটা করার ইচ্ছা থেকে অনলাইন ঘাটাঘাটি করতে করতে একসময় খুঁজে পাই " নিজের বলার মত একটা গল্প" । এখানে রেজিস্ট্রেশন করেছি ২০২১ এর জুনে । অনেক ভালো লাগে এই গ্রুপে সময় কাটাতে । স্যারের লেকচার শুনি, অনেক ভাই বোনদের জীবনের গল্প শুনে নিজেকে আরও মোটিভেট করতে পারি।
গ্রুপ থেকে প্রাপ্তি ঃ
----------------------
গ্রুপে জয়েন্টের পর থেকে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছি যে বিষয়টা নিয়ে সেটা হল এখন আর নিজেকে একা মনে হয় না । মোটিভেট হওয়ার জন্য কারও কাছে যেতে হয় না । কারণ এই গ্রুপটা স্যার এমন ভাবে সাজিয়ে রেখেছেন মনে হয় যেন উদ্যোক্তার আঁতর ঘর। গ্রুপ থেকে শিখছি কিভাবে একজন ভালোমানুষ হওয়া যায়, কিভাবে মানুষের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দিতে হয় আর সেই সাথে কিভাবে একজন সৎ , এবং নিষ্ঠাবান উদ্যোক্তা হতে হয়।
"স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৫৯৯
Date:- ১৮/০৮/২০২১
মোঃ সুজাউদ্দৌলা
ব্যাচঃ ১৪
রেজিস্ট্রেশন নম্বরঃ ৬৫৬৬৮
জোনঃ ধানমন্ডি
জেলাঃ সিরাজগঞ্জ
ঢাকা মোহাম্মাদপুর থেকে