ছোট বেলা থেকেই স্বপ ছিলো বড় হয়ে ডাক্তার হব। কিন্তু
মানব জীবন নাটকের চেয়েও নাটকীয়। বাস্তব জীবনের একেক টা অংশ নিয়েই তৈরী হয় গল্প বা নাটক। প্রতিটি মানুষের জীবনে থাকে নিজের চাওয়া পাওয়ার একেকটা গল্প যা একান্ত তার নিজস্ব। হতে পারে তা সুখের অথবা দুঃখের। কিন্তু এই গল্পটা যার জীবনের সেই বুঝে এই গল্পটা তার কতটা জুড়ে আছে।
#আমার_জীবনের_গল্পঃ বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এ দেশের আনাচে কানাচে প্রায় ১৩০০ নদীর বাস। তেমনি একটি নদী মেঘনার কোল ঘেসে রয়েছে নোয়াখালী জেলার একমাত্র দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া। যাকে আমরা সাগর দ্বীপ হাতিয়া নামেই চিনি। এই হাতিয়া উপজেলায় ১৯৯৬ সালের শেষের দিকে এক মধ্যবিত্ত পরিবারের আমার জন্ম। যদিও আমাদের বংশ অনেক নামকরা ছিলো এবং পূর্ব পুরুষদের অবস্থা ভালোই ছিলো। পরিবারের ৪ সন্তানের মধ্যে আমি বড় এবং একমাত্র কন্যা সন্তান। ছোট বেলা থেকে বাবা, চাচা, জেঠা, ফুফু ও অন্যান্য সকল আত্মীয় স্বজনের অনেক আদরের ছিলাম। ছিলাম দাদীর কলিজা।
#শিক্ষা_জীবনঃ নিদিষ্ট বয়সে শুরু হয় আমার শিক্ষা জীবন। লেখা পড়াই সব সময়ই ভালো ছিলাম। ২০০৬ সালে যখন ৫ম শ্রেণীতে পড়ি তখন বাবা আমাদের নিয়ে চলে আসেন খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাংগা উপজেলায়। হাতিয়া থেকে আসার কথাই আমার দাদী, চাচা, জেঠা কেউই রাজি ছিলোনা। দাদী তো দিনের পর কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন। কিন্তু বাবা তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন, কারণ হাতিয়া হচ্ছে নদী ভাঙন প্রবণ এলাকা। বাবার চিন্তা ছিলো এখানে জায়গা কিনে ঘর বাড়ি করলে কয়েক বছর পর যদি নদীতে ভেঙে যায় তখন কি করব?
সেবছর বছরের অর্ধেক চলে যাওয়াই আমাকে আর স্কুলে ভর্তি নেইনি, কারণ সেবছর প্রথম সমাপনি পরীক্ষার রেজিষ্ট্রেশন করা হয়, যা আমার করা হয়নি একস্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হওয়ার কারণে। এরপর ২০০৭ সালে আমি সমাপনি পরীক্ষা দেই, স্কুল থেকে ২য় স্থান অধিকার করি পাশাপাশি সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পাই। হাই স্কুলে ভর্তি হই। এই পর্যন্ত ভালোই ছিলাম।
হাতিয়া থেকে চলে আসার পরই আমাদের জীবনের চরম মুহূর্তের দেখা মিলে। নতুন জায়গায় এসে বাবা কি করবে ভেবে পায়না। অবশেষে আমাদের মুখে খাবার তুলে দিতে পরের কাজ করতে শুরু করেন। অথচ বাবাকে এর আগে কখনো এতো পরিশ্রমের কাজ করতে হয় নি।শুরু হয় আমাদের দিন এনে দিন খায় অবস্থা। একদিন বাবার কাজ না থাকলে আমাদের না খেয়ে থাকতে হতো। থাকার ভালো ঘর ছিলো না। মাঝেমধ্যে প্রবল ঝড় বৃষ্টিতে ঘরের চালা তুলে নিয়ে যেতো। গুটিসুটি মেরে সবাই ঘরের এককোণে বসে থাকতাম। কিন্তু আমাদের এই দুঃসময়ে আমাদের আত্মীয় স্বজনরা সবসময় পাশে ছিলো।
আমার হাই স্কুল ছিলো বাড়ি থেকে ৫/৬ কি মি দূরে। পাহাড়ি রাস্তায় প্রতিদিন ১.২০ মিনিট হেটে হেটে যেতে হতো আবার বাড়ি ফিরতে হতো। মাঝেমধ্যে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেতো।
স্কুলের স্যারেরা সবসময় আমাকে অনেক স্নেহ করতো। পড়াশোনায় বিভিন্ন ভাবে হেল্প করত। নিদিষ্ট সময়ে ২০১০ সালে জে এস সি পরীক্ষা দিয়ে নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। অনেকেই নিষেধ করেছে যাতে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি নাই হই। প্রাইভেট টিউশন ইত্যাদিতে অনেক খরচ, কিভাবে সামলাবো। কিন্তু আমি পিছ পা হয়নি। এতে আমার বিজ্ঞান স্যারই আমার মনে সাহস যুগিয়েছিলেন। এভাবেই ২০১৩ সালে এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে ৪.৩১ পেয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে প্রথম হই।
এরপর বাবা, মা, পরিবারকে ছেড়ে আমি আবার হাতিয়া চলে যায়। সেখানে হাতিয়া আদর্শ মহিলা কলেজ এ মানবিক বিভাগে ভর্তি হই। থাকতে শুরু করি যে বাড়িতে আমার জন্ম সেই ঘরে, আমার কাকার বাড়িতে। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশতঃ সেই বাড়িতে আমি চার মাসের বেশি থাকতে পারিনি। চলে যায় আমার মায়ের মামার বাড়ি।
আলহামদুলিল্লাহ সেখানে আমি খুব ভালোই ছিলাম। নানা, নানী, আন্টি, মামা সবাই আমাকে ছোট বেলা থেকেই অনেক আদর করতো। উনারা আমার পড়ার সকল খরচ বহন করতেন। সেখানেই থেকে খুব ভালো ভাবে পড়াশোনা শুরু করি। উদ্দেশ্য একটাই ভালো রেজাল্ট করা। কিন্তু পরীক্ষার রেজাল্ট আশানুরূপ ভালো হয়নি মাত্র ৪.০০ পেয়ে উত্তীর্ণ হই।
এইচএসসি তে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই ইচ্ছে ছিলো একটা ভালো সাবজেক্ট নিয়ে অনার্স করব। কিন্তু তা ভাগ্যে কুলাইনি। আমাকে আবারো হাতিয়া আদর্শ মহিলা কলেজ এ ডিগ্রিতে ভর্তি হই। স্থান ওই নানু বাড়িতেই। এরপর ২০১৯ এ ডিগ্রি পরীক্ষা দেই যার রেজাল্ট হয় ২০২০ এর জানুয়ারিতে।
এখন আমি নোয়াখালী সরকারি কলেজ এ সমাজবিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্স প্রিলিমিনারিতে অধ্যায়নরত আছি। আমার শিক্ষা জীবনের কখনো আমাকে কেউই পড়াশোনা করতে অনুৎসাহিত করেনি বরং সবাই উৎসাহ দিয়েছে লেখাপড়া করে যাতে ভালো কিছু করি। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করি।
#কর্মজীবনঃ ছোট বেলা থেকেই স্বপ ছিলো বড় হয়ে ডাক্তার হব। কিন্তু একটা সময় বুঝতে পারি ডাক্তার হওয়ার পথ অনেক কঠিন। তখন থেকে ভাবতাম লেখাপড়া শেষ করে ভালো চাকরি করব। বাবা মায়ের দুঃখ মোচন করব। এ উদ্দেশ্য নিয়েই ২০১৬ সালে নোয়াখালী জেলা থেকেই প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা দেই এবং প্রথম ধাপে লিখিত পরীক্ষাই উত্তীর্ণ হই, ভাইভা ফেইস করি। কিন্তু চাকরি হয় নি। এরপর ও চেষ্টা করে গিয়েছি।
অনলাইনে এসে অযথা টাইম ওয়েস্ট করতাম। আস্তে ধীরে দেখতে পাই অনলাইনে অনেকেই বিজনেস করে। ধীরে ধীরে ২০১৯ সালে পরিচিত হই Julekha Khatun Suma আপুর সাথে যিনি সবসময় সবাইকে উৎসাহ দিতেন যাতে সবাই স্বাবলম্বী হয়। বিশেষ করে আপু মেয়েদের নিয়ে কাজ শুরু করেন। আপুর জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। তখন ভাবতে থাকি আমারো কিছু করা উচিত। ঠিক এই সময় আফিফা ইসলাম রোজিনা আপু আমাকে #নিজের_বলার_মত_একটা_গল্প এই গ্রুপে ইনভাইট করেন।
তখন ৭ম ব্যাচ চলে। তখন কিছু বুঝতাম না, সবার পোস্ট গুলো দেখতাম, পড়তাম। স্যারের সেশন গুলো পড়তাম, খুব ভালো লাগতো প্লাস সাহস ও পেতাম। কিছু করার প্রবল ইচ্ছে হতো। আস্তেধীরে মনে হলো আমার কি করা উচিত, আমি কি করব?
২০১৯ সালে আমি আবার মাটিরাংগা ফিরে আসি। এখানে অনেকেই বাঁশ ও প্লাস্টিকের বেতির দ্বারা মোড়া বানায়,যা ব্যাপারি এসে কিনে নিয়ে যায়। আমিও এই কাজ টা পারি সেই ক্লাস সেভেন থেকে। আমিও বানাতাম মায়ের সাহায্য নিয়ে। আমি হাতিয়া চলে যাওয়াই আমার এ কাজটি বন্ধ হয়ে যায়। বাড়ি আসার পর ঘরে বসে না থেকে আমি আবারো কাজ টা শুরু করে দেই।
হঠাৎ একদিন মনে হলো আমি তো এ কাজ টি পারি। তবে কি এটা নিয়ে অনলাইনে কাজ করতে পারব। ভাবতে থাকি। আমার কথাগুলো সুমা আপু, Abdul Halim ভাইকে বলি, উনারা আমাকে বললেন তুমি এটা নিয়ে কাজ শুরু করে দাও। হালিম ভাইয়া নিজেই আমাকে প্রথম মোড়া অর্ডার করেন। সেই থেকে শুরু হয় আমার উদ্যোক্তা জীবন। এই উদ্যোক্তা জীবনে বার বার হতাশ হলেও স্যারের প্রতিটি সেশন আমাকে নতুন করে শুরু করার সাহস যোগাই। আলহামদুলিল্লাহ ভালোই যাচ্ছে আমার উদ্যোক্তা জার্নি।
এরই মাঝে খাগড়াছড়ি জেলা থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারী প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা দেই এবং লিখিত ও ভাইভা উভয় স্থানে উত্তীর্ণ হয়ে গত ১৩ ই জুন প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক হিসেবে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করি।
এখন আমার জীবনের একটাই লক্ষ্য শিক্ষকতার পাশাপাশি আমি একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে পরিচিত করব ইনশাআল্লাহ।
#নিজের_বলার_মতো_একটা_গল্প_ফাউন্ডেশন থেকে আমার প্রাপ্তি আমি কখনো বর্ণনা করে শেষ করতে পারব না।
১. এ গ্রুপ থেকে আমি একটা ভালো মানুষের পরিবার পেয়েছি।
২. হাজার হাজার ভাই বোন পেয়েছি।
৩.নিজেকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছি।
৪. স্যরের মতো সুযোগ্য ব্যাক্তির সান্নিধ্য পেয়েছি।
"স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৫৬৪
Date:- ০১/০৭/২০২১
আমি ইপতেদা আক্তার নীলা।
নিজ জেলাঃ নোয়াখালী
বর্তমান বসবাস রত জেলাঃ খাগড়াছড়ি
ব্যাচঃ ৮ম
রেজিষ্ট্রেশন নংঃ ৫৫৩২
ব্লাড় গ্রুপঃ B+