আমরা সবাই একটি পাত্রে খাবার নিয়ে ভাগাভাগি করে খেতাম
আমি একটি সাধারন মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে।আমার বাবা একজন কন্টাকটর ও মা গৃহিণী। দাদা- দাদি ,মা -বাবা, আর আট ভাইবোন নিয়ে আমাদের পরিবার। আমি পরিবারের সপ্তম সন্তান।
ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলাম।
বাবা -মা তো প্রতিটা সন্তান নিয়েই স্বপ্ন দেখেন।এজন্য তাদের করতে হয় হাঁড়ভাংঙ্গা পরিশ্রম। আমাকে নিয়ে বাবার, একটু বেশিই স্বপ্ন ছিলো। এত বড় সংসারে অনেক সাধ থাকলেও সাধ্য ছিলোনা।
আমি ছোটবেলা থেকেই বাবা মার কষ্টগুলো বোঝার চেষ্টা করতাম।সহজে চাইতাম না বাবার উপর বেশি চাপ দিতে।এমনিতেই বাবার মাথার উপর ছিলো, এত বড় সংসারের চাপ। তাছাড়া জেলা সদরে থাকার সুবাদে গ্রাম থেকে কেউ হসপিটালে,কোর্টে বা বিভিন্ন কাজে এলে আমাদের বাসায় আসতো।প্রায় প্রতিদিনই একজন না একজন মেহমান থাকতোই।
বাবা -মার প্রতিদিনই করতে হতো সংসার চালানোর যুদ্ধ। মা বাড়তি আয়ের জন্য হাঁস- মুরগী পালন করতো।
আমরা সবাই একে অন্যের দুঃখগুলো বুঝতাম।খাবারের যোগান কম থাকলে আমরা সবাই একটি পাত্রে খাবার নিয়ে ভাগাভাগি করে খেতাম।
বড়রা অল্প খেয়েই উঠে যেত।বলত,"পেট ভরে গেছে"।এমনটি বলার কারন,ছোটরা যাতে ছোট পেট ভরে খেতে পারে।
আমি যখন প্রথম শ্রেণিতে পড়ি।তখন লক্ষ্য করলাম আমাদের এলাকার কিছু মেয়েরা বিকেলে ব্রাক স্কুলে পড়ে।কারণ তাদের পড়াশুনা করার সামর্থ্য ছিলোনা।আর ঐ স্কুল থেকেই তাদের প্রয়োজনীয় সবকিছু দেওয়া হতো ফ্রিতে।
আমি ভাবলাম আমি ও যদি ঐ স্কুলে পড়ি,তবে বাবার কিছুটা খরচ কমবে।এই ভেবে ঐ স্কুলে পড়ার কথা বাবাকে বলি,বাবা রাজি হলো না।
বাবা চাইতো, আমি এই জেলার ভালো স্কুলেই পড়ি।
এরপর আমি বাবার কাছে বায়না ধরি,দুই স্কুলেই পড়ার।বাবা- মা অবশেষে রাজি হয়।
বাবা মাকে বলি নাই যে,আমি কেন পড়তে চাই ঐ স্কুলে?
ভর্তি হলাম, দুই স্কুলেই দ্বিতীয় শ্রেণীতে।শুরু করি দুই স্কুলে পড়াশুনা।দ্বিতীয় শ্রেণিতে সকালের স্কুলের সময় ১০ঃ০০টা থেকে ১২ঃ০০টা।আর বিকালে ব্রাক স্কুলের সময় ছিলো ৪ঃ০০টা থেকে ৫ঃ৩০ পযর্ন্ত।
এরপর আমি তৃতীয় শ্রেণিতে উঠি।এখন সকালের স্কুলের সময় ১২ঃ০০টা থেকে ৪ঃ০০টা।আর বিকালের স্কুল ৪ঃ০০টা থেকে ৫ঃ৩০ পর্যন্ত।দুইটা স্কুল পাশাপাশি থাকায় একটা স্কুল ছুটির পরে দৌড়ে যেতাম আরেক টা স্কুলে।তারপর বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা।ভালোই চলছিলো,আবার একটু কষ্টঔ হচ্ছিলো।কারন আমি কখনোই টিফিন নিতাম না। সকালে খাওয়ার পর আর খাওয়া হতো না।
এভাবেই পড়ি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেনি।
এবার পঞ্চম শ্রেণীতে উঠি।বাবা এবার বাধা দেয়। তাই ব্রাকে পঞ্চম শ্রেণীতে আর পড়া হয়নি।
এরপর ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠি। স্কুল ড্রেস , জ্যামিতি বক্স লাগবে। এদিকে বড় ভাই বোনেরাও পড়াশুনা করছে। তাদের ও খরচ আছে। তাই আমরা একে অন্যের ছোট হওয়া ড্রেস, ব্যবহার করা জ্যামিতি বক্স ভাগ করে পর্যায়ক্রমে ব্যবহার করতাম।টিফিন নেই না, তাই বাবা টাকা দিয়ে দিতো স্কুলে গিয়ে খাওয়ার জন্য।
কিন্তু আমি খরচ করতাম না।সেই টাকা জমিয়ে আমার খাতা কলম ও প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতাম। বাবার থেকে চাইতাম না। বাবা সবই বুঝতো। তাইতো সবসময় বাবা আমার স্কুলের কাছাকাছি কাজ নেওয়ার চেষ্টা করতো এবং টিফিনের সময় কাজ ফেলে ঘার্মান্ত শরীরে স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে থাকতো - একটি রুটি আর কলা নিয়ে।
পরিচিত কেউকে পেলে পাঠিয়ে দিতো বা নিজেই আসতো । এরপর মাঝে মাঝে আমিই চেক করে দেখতাম বাবা আসছে কিনা।
এরপর আমি অষ্টম শ্রেণিতে উঠলাম।ক্লাসে সবাই আমাকে অনেক ভালোবাসত। তাইতো ক্লাস ক্যাপ্টেন নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে ফাস্ট ক্যাপ্টিন নির্বাচিত হই।আমিও সবাইকে ভালোবাসতাম।
ক্লাসে কেউ যদি কোনো বিষয়ে না বুঝতো।আমি টিফিন সময়ে বুঝিয়ে দিতাম।ড্রয়িং এ অনেক ভালো ছিলাম ,তাই পরিক্ষায় অনেকের ড্রয়িং সুযোগ পেলে করে দিতাম। বড় ভাই এবং বড় বোনের এস. এস.সি পরীক্ষার পর পর বিয়ে হয়ে যায় । বাবা মনে মনে ঠিক করেছিলো কষ্ট করে হলেও আমাকে অনেক পড়াবে। আমার ছোটবেলা থেকেই শিক্ষিকা হওয়ার স্বপ্ন ছিলো।
অনেক স্বপ্নজাল বুনছিলাম নিজের মনের মধ্যে । পড়াশুনায় প্রবল আগ্রহ ছিলো আমার।
সারাদিন বই আর আমি। এর বাইরে কোনো জগত ছিলোনা আমার। কত রাত যে পড়ার টেবিলে ঘুমিয়েছি হিসেব নাই । স্বপ্ন দেখেছি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর।
এরপর আমি দশম শ্রেণীতে উঠি। দেখতে মোটামুটি ঠিকঠাক থাকায়। আত্নীয় - স্বজন , পাড়া প্রতিবেশী বিয়ের প্রস্তাব আনতে থাকে। বাবা সকলকেই না করে দেয়। এবার সবাই একটু রেগে যায় বাবার প্রতি।
এদিকে সবাই আমার বিয়ের প্রস্তাব আনতে শুরু করে দিয়েছে।সবার যেন আমাকে বিয়ে দেওয়া জন্য মাথা ব্যাথা হয়ে গেছে।
কোনো প্রকার আগ্রহ নেই নতুন জীবন নিয়ে।আমার বিয়ে হয়ে গেল। আমার শশুরবাড়ি চট্রগ্রাম। আমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো।১২ দিন পর বাবার বাড়ি শরীয়তপুরে আসলাম। এসেই আমার বই খাতা গুলো উল্টে- পাল্টে দেখছি।আমার কিশোরী মন যেন এই কয়দিন পরে,শান্তির পরশ পেল।
পরদিন ছুটে গেলাম বিদ্যালয়ে।সবার কাছ থেকে পড়ালেখা সম্পর্কে খোঁজ খবর নিলাম।
এরপর তিন চারদিন পরেই বই খাতা নিয়ে চলে গেলাম শশুর বাড়িতে।কিছুদিনের মধ্যেই আমি বুঝতে পারলাম শশুর বাড়ির লোকেরা আমাকে পড়াতে চায় না।তারা নাতি নাতনির মুখ দেখার জন্য অপেক্ষা করছে ।হাজবেন্ড ও পরিবারের কাছে অসহায়। কি আর করার ভেঙে গেলো আমার স্বপ্ন।
এদিকে বাবা সব সময় নিজেকে অপরাধী ভাবতে লাগলো।আমি বলতাম, "দোয়া করো বাবা, একদিন না একদিন হয়ত সময় বদলাবে"।কারো প্রতি কোনো অভিযোগ নেই আমার।জীবনটা সহজ সরল ও পজিটিভ ভাবে কাটিয়ে দিচ্ছিলাম।
এরপর জন্ম হয় আমার প্রথম সন্তানের ।কিন্তু মনের মধ্যে সেই অপূর্ণ স্বপ্নটাকে কখনও ঘুমোতে দেইনি। এদিকে আমার হাজবেন্ডের ব্যবসায় অনেক লস হয়।হাজবেন্ড প্রবাসে চলে যায়।
এরপর মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করি। মেয়েকে ক্লাসে দিয়ে আমি বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে থাকি।শিখার প্রতি আমার ভালোবাসাটা বরাবরই ছিল। এর পর কয়েক বছর কেটে যায়।আমার দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হয় ।
হঠাৎ একদিন খবর পাই মা স্টক করেছে ১ হাত ও ১পা প্যারালাইসিস হয়ে গেছে।আমি ছুটে যাই মা -কে দেখতে।মা একটু সুস্থ হয়ে বলে, "তোর স্বপ্নটা আমাদের কারনে নষ্ট হয়ে গেল"।
আমি বললাম,"কে বলছে আমার স্বপ্ন নষ্ট হয়ে গেছে"।আমি তো সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছি।মনে মনে আমি হতাশায় ভুগতে লাগলাম।
আমার মন যখন হতাশার অন্ধকারে আচ্ছন্ন, তখনই ফেইসবুকে চোখের সামনে একদিন ভেসে উঠলো "নিজেকে বলার মত গল্প গ্রুপ"টি।আরও দেখতে পেলাম সেখানে লেখা ছিলো আমাদের প্রিয় মেন্টর জনাব ইকবাল বাহার জাহিদ স্যারের কিছু কথা।
যা তাৎক্ষণিক ভাবে অনুপ্রেরণা ও সাহস দিয়েছে আমার মনে।সেখানে লেখা ছিলো ,
"স্বপ্ন দেখুন, সাহস করুন,শুরু করুন লেগে থাকুন-সফলতা আসবেই"
আমার আগ্রহটা আরোও বেড়ে গেলো।এরপর আমি জয়েন হলাম। কথাগুলো আমার মনের ভিতর কড়া নাড়তে শুরু করলো।তখন এই গ্রুপ সম্পর্কে কিছুই জানতাম। স্যারের কথাগুলোতে অনেক সাহস পেয়েছিলাম স্বপ্নেের দিকে যেতে।
শুধু তো স্বপ্ন দেখলে হবে না।সাহস করে শুরু করতে হবে।
এবার সাহস করে হাজবেন্ডের কাছে অনুমতি চাই উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার।হাজবেন্ডও এবার আমাকে সাপোর্ট করে।শুরু করি পড়াশুনা । বাবা-মা এবার মনে একটু শান্তি পায়।
ভাবনায় পড়ে গেলাম-বাবাকেও কি সফল হয়ে দেখাতে পারবো না।
তখন মনে পড়লো,আমার মনে অনুপ্রেরণা ও সাহস জাগানোর গ্রুপটির কথা।
এরপর খুঁজে বের করলাম প্রিয় গ্রুপটিকে।রেজিস্টেশন করলাম ১০ম ব্যাচে।
এরপর টানা ৯০দিনের সেশন কমপ্লিট করলাম । অনেক কিছু শিখলাম এই ৯০দিনের সেশনে। অনেক জড়তাই এবার কেটে গেল আমার।আমি নতুন কিছু স্বপ্ন আবিষ্কার করলাম নিজের মধ্যে।সন্ধান করতে লাগলাম নিজে কোন কাজে দক্ষ ।কিছুদিন পরই আমার চাকরি হয় একটি প্রাইভেট স্কুলে।কিন্তু এখন আমার স্বপ্ন চাকরি করবো না চাকরি দিবো। নিজে মালিক হওয়া যায়,এমন বিজনেস করবো।বাবার ইচ্ছাতে চাকরিতে যুক্ত হই।যা কিছুদিন পরই করোনা মহামারির কারণে বন্ধ হয়ে যায়।এখন আর আমি হতাশ হইনি।এরপর নিজের মধ্যে থাকা প্রতিভাকে নিয়ে চর্চা শুরু করলাম এবং নিজেকে ব্রাডিং করতে লাগলাম এই প্লাটফর্মে এ যেন, আমার সেই ভালোবাসার স্কুলটা।আমি
এই প্লাটফর্মে এসে স্যারের অনুপ্রেরনায় শুরু করি, ব্লক বাটিক,হ্যান্ডপেইন্ট নিয়ে বিজনেস এবং পাশাপাশি দেশীয় পোশাকও তুলে ধরার চেষ্টা করছি। এভাবেই আমি সফলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত।
আমার হাজবেন্ড ও যুক্ত হয়েছে এই প্লাটফর্মে।সেও দেশে এসে এই ব্যবসায় যুক্ত হবে।দুজন মিলে ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যাবো।সবাই পাশে থাকবেন।
অজস্র ধন্যবাদ আমাদের প্রিয় মেন্টর এবং ভালোবাসার প্লাটফর্মকে।যার কারনে, আজ আমি নিজের পরিচয় তৈরি করতে পেরেছি।ঘুঁরে দাঁড়িয়েছি হতাশা থেকে বের হয়ে।বাবাকে দেখাতে পেরেছি আমার সফলতা।হাজবেন্ড ও পরিবারের জন্য কিছু করতে পারছি।সবই সম্ভব হয়েছে এই প্লাটফর্মে এসে।
নিজের জায়গা থেকে,নিজের দায়িত্ব
---------------------------------------------------
এখন আমার বিজনেস থেকে অর্জিত আয় বাবাকে ঔষুধ কিনতে,ছোট ছোট সাধগুলো পূরন করতে দিতে পারছি।
বাবাকে বলতে পারছি,"এই নাও তোমার মেয়ের ইনকামের টাকা"। কারো অনুমতি নিতে হয়না।বাবার বুকও আনন্দে ভরে ওঠে।
অবশ্য আগেও দিয়েছি কিন্তু এতোটা আনন্দ হয়নি।নিজের ইনকাম থেকে দিলে যতটা আনন্দ হয়।আপনজনদের সাহায্য করতে পারছি।অসহায়দের সাহায্য করতে পারছি।
"স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৫৬৬
Date:- ০৪/০৭/২০২১
মোসা:সালমা আক্তার
১০ম ব্যাচ,রেজি:১৩৭৬১
বর্তমান অবস্থান :শরীয়তপুর সদর
পেশা:শিক্ষিকা+উদ্যোক্তা
পেজ:ইশরাত কারুকুঞ্জ