বউ সাজানো শুরু ক্লাস সেভেন থেকে আমি ২০১৬ সালে প্রশিক্ষণ নিয়ে
আমি শেখ সাথী রহমান এটা আমার ভোটার আইডি কার্ডের নাম। জন্ম সূত্রে পাওয়া সুরাইয়া সাথী আমার প্রিয় আব্বা নামটি রেখে ছিলেন।
১৯৮৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সিগনাল টাওয়ার গ্রামে মোংলা উপজেলায় আমার জন্ম।আমি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মেয়ে।
আমি একজন বিউটি এক্সপার্ট ও ছোট খাটো লেখক।
আমার একটি প্রতিষ্ঠান আছে গ্লো বিউটি কেয়ার এন্ড ট্রেনিং সেন্টার, মোংলা এবং চারটি যৌথ কাব্যগ্রন্থে আমার কবিতা প্রকাশ পায়।আমি ছোট বেলা থেকেই সাহিত্য অনুরাগী ছিলাম।১৯৯৬ সাল থেকে কবিতা লেখা শুরু করি ও স্কুল জীবনে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সদস্য ছিলাম।
ছেলেবেলা ও স্কুল জীবনঃ আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। পাঁচ ভাই দুই বোন। আমি পরিবারের ছোট মেয়ে। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের হলেও বড় হয়েছি রাজ কুমারীর মত।আমার বড় পাঁচ ভাই আমাকে রাজ কুমারীর মত করে মানুষ করেছে। আমি যখন যে জিনিস টা চেয়েছি তখন সেটা হাজির। ছোট বেলা অভাব কি কোন দিন বুঝি নাই। খুবই আহ্লাদে বড় হয়েছি। সৌখিন ভাবে বড় হয়েছি এখন ও মনে পড়লে মনে হয় স্বপ্ন। আমি সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলাম।ক্লাস থ্রি থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে এভাবে সেভেন পর্যন্ত মোংলাতে পড়াশুনা করি। যখন অনেক বেশী প্রস্তাব আসতে শুরু করে তখন ভাইয়ারা ভাবে আমাকে খুলনা পাঠায় দিবে বড় বোনের কাছে এছাড়াও আমার নানা বাড়ী,চাচা, ফুফু আত্নীয় স্বজনের বাড়ী খুলনাতে এছাড়া আমাদের গ্রামের বাড়ী সুভ দিয়াপাড়া ফকিরহাট থানা,জেলা বাগেরহাট আর আব্বার বিজনেসের সূত্রে মোংলাতে বাড়ী করা।
যা ই হোক ভাইদের যে চিন্তা সেই কাজ ক্লাস এইটে খুলনা কলেজিয়েট গার্লস স্কুলে আমাকে ভর্তি করা হয়। ওখানেই আমি পড়াশুনা করি এস এস সি (২০০১) পর্যন্ত। স্কুল জীবনে ড্রইং আমার নেশা ছিল খুবই পছন্দ করতাম ক্লাসে সবার থেকে ড্রইং এর সব সময় আমি বেশি নাম্বার পেয়েছি। গার্স গাইডে ছিলাম সার্টিফিকেট ও আছে,হ্যান্ডবল ও কাবাডি খেলতাম স্কুল পর্যায়ে এত প্রতিভা থাকা সর্তেও কোনটা নিয়ে সামনে এগোতে পারি নাই।
বিবাহকালঃ আমি এস এস সি পরিক্ষা দিয়ে বাড়ীতে (মোংলা)আসার এক মাস পরই বিবাহিত জীবনে পা রাখি মাত্র পনের বছর বয়সে আর সে দিনই আমার স্বপ্নের জগৎ ভেঙ্গে যায়।পাঁচ ভাইয়ের পছন্দের ছেলে (ব্যবসায়ী) বড় পরিবারের ছেলে অনেক নাম ডাক এছাড়া ছেলে আমাকে দুবছর ধরে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ভাইদের পিছেন ঘুরে। আমার বড় ভাইয়া বলে তুমি মোংলা বাড়ী কিনলে বোন বিয়ে দিব,সে বিয়ের সাত দিন আগে মোংলা একতলা বাড়ী সহ সাড়ে সাত কাটা জমি কিনে (ইনশাআল্লাহ সে বাড়ী এখন দ্বিতীয় তলা) তারপরও আমার মা,আব্বা, বড় বোন ও আমি বিয়েতে রাজি ছিলাম না।আমার ইচ্ছা ছিল অনেক পড়া শুনা করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিবাহ করব আর বিবাহ সংসার এগুলা আমি কিছুই বুঝতাম না এছাড়াও ছেলেদের বাড়ী গ্রামে আর আমরা শহরে।তাদের বাড়ী কারেন্ট নাই, চলাফিরা, খাওয়া দাওয়া,এড জাস্ট না সেটাও একটা করন ছিল তবে আমার বিয়ের দিন রাতে আমি দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহ কে বলে ছিলাম আমি যেন ঐ পরিবারে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারি আর ডাইরিতে ও লিখে ছিলাম। আল্লাহ কবুল করে নিল।
সন্তান ও সাংসারিক জীবনঃ আমার বয়স কম থাকায় বিয়ের শুরুতে বাচ্চা নেয়নি আমার স্বামী সে কথা দিয়ে ছিল আমার ভাইয়া কে আমাকে বিয়ের পর পড়াবে কিন্তু বিয়ের পর সে আমাকে পড়াতে রাজি না আর আমার শাশুড়ি ও বলে আর পড়াশুনার দরকার নাই যা শিখেছ ওতেই হবে ছেলেমেদের পড়াশুনা শিখাতে।আর স্বামী বলে আমার বউকে দিয়েত আর চাকরি করাব না যে পড়াশুনা করতে হবে।আমি অনেক কান্না কাটি করি পড়ার জন্য কিন্তু সে পড়াতে নারাজ আমি মোংলা সরকারি কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্রী ফরম ফিলাপের টাকা জমা দেওয়া হয় পরিক্ষার জন্য তবুও পরিক্ষা দিতে পারি নাই। আমার সব স্বপ্ন চাপা দিয়ে আমি শ্বশুরবাড়ির সবার মন জোগাতে শুরু করি অনেক সুনাম অর্জন করি ভালো বউয়ের উপাধিও পায়ই।
২০০৭সালে ৫ অক্টোবর আমি প্রথম মা হয়েছি সে এক নতুন অনুভূতি নতুন জগৎ নতুন আশা নতুন ভাবে বেঁচে থাকার শক্তি।কোল আলো করে আসে আমার বড় ছেলে শেখ ইউনুস রহমান সিয়াম। তখন থেকে স্বপ্ন দেখি ছেলেকে নিয়ে তাকে অনেক পড়ালেখা শিখাব অনেক বড় চাকুরী করবে এভাবে চলতে থাকে। আমার স্বামীর শখ বিদেশ যাওয়া সেই শখে সে নিজের বিজেনেস বিক্রি করে, নিজের বোনের জামাই সৌদিআরব থেকে আসে তার মারফৎ সৌদিআরব চলে যায়।নতুন স্বপ্ন বুকে নিয়ে পাড়ি দেয় বিদেশ২০০৮ সালে।তখন আমি আবার কলেজে ভর্তি হয়ে পড়া শুনা শুরু করি। সংসারের সব কাজ করে ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে রাত ১১ টার পর পড়তে বসতাম এভাবে পড়তে থাকি কিন্তু আমার স্বামীর বিদেশ যাওয়ার পর শুরু হয় নতুন জীবন। সে খুবই বিপদে পড়ে কারণ ভাগনি জামাই সিটারি করে সে ফ্রি ভিসা দেওয়ার কথা বলে মাজরা ভিসা দেয়।আমার স্বামীও পরিবারের ছোট সন্তান অনেক আদরে বড় হয়েছে তাছাড়া বড় ঘরের সন্তান ঐ কাজ সে করতে পারবে না। সে কারনে সে বিপদে পড়ে। সৌদি আরবের ৪ মাস থাকার পর মক্কা থেকে যখন উমরা হজ্জ করে বের হয় তখন সৌদি পুলিশ তাকে ধরে কারণ তার আকামা ছিলো না। ১২ দিন সৌদি জেল খাটার পরে বাংলাদেশে ফেরত আসে।
এবং ৪ মাস বেকার থাকে তখন চলতে খুব কষ্ট হত।
তার ভীতর পড়া শুনা চলত। আমার শ্বশুর গ্রামের বাড়িতে থাকতো এবং সে এক বছর বিছানায় ছিলো তখন আমরা যেয়ে যেয়ে দেখতাম এভাবে এইচ এস সি পরিক্ষার সময় হয়ে আসতে লাগল। পরিক্ষার ৪ দিন আগে শ্বশুর মারা যান। মরা বাড়ী ৪ দিন থাকার নিয়মে ৪ দিন থেকে পরীক্ষার দিন আমি বাড়ী আসি। তখন আমার কলেজের স্যার ফোন দেয় সাথী তুমি কোথায় পরিক্ষা দিবে না। আমি বলি স্যার আমি পরিক্ষা দিব না আমি কিছু পড়ি নাই। শ্বশুর মারা গিয়েছ শশুড়বাড়ী ছিলাম মাত্র আসসি। স্যার বলে তোমার পড়া লাগবে না তুমি পরিক্ষা দাও পারবে আমি স্যারের কথা মত পরিক্ষা দিতে যায়। ইনশাআল্লাহ ১ম পরিক্ষা ভালো হয় এভাবে সব পরিক্ষা দিয়ে ফেলি এবং A- এ পাশ করি আলহামদুলিল্লাহ,সেদিনও এক স্যারের উৎসাহে আমি এইচ এস সি পাশ করি ২০১০ সালে।এর পর যখন অনার্স করতে চাই তখনও সে রাজী না সে কারণে আর পড়া হয় নাই ২০১৩ সালের১৪ ই অক্টোবরে ছোট ছেলে শেখ ইউসুফ রহমান সিফাত আসে কোল জুড়ে আবার সংসারে মনোযোগী হয়ে পড়ি।
ব্যবসায়ীক জীবনঃ আমার শ্বশুর মারা যান ২০১০সালে আর ভাসুর ইউনিয়ন পরিষদের রানিং চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় মারা যান ২০১৩ সালে তখন আমার স্বামী একমাত্র ভাই কে হারিয়ে অনেক অসুস্হ হয়ে পড়েন এবং ২০১৬ সালে আমার শাশুড়ি মারা যান তখন আরো ভেঙ্গে পড়ে ও অসুস্থ হয়ে যায় সে মুহুর্তে আমি বললাম আমার কিছু করা উচিৎ কারণ যদি কোন এক্সিডেন্ট হয়ে যায় আমাদের দেখবে কে?? সবাই সবার সংসার নিয়ে ব্যাস্ত কারণ আমার স্বামী যখন বিদেশ ছিল আমার শ্বশুড়বাড়ীর কেউ আমার ছেলে ও আমাকে হেল্প করেনি অনেক কষ্ট করেছি।তখন সে ভাবল কথা ঠিক কারণ আমাদের অনেক জমি আছে কিন্তু নগদ টাকা নাই।তখন সে বললো তুমি সবাই কে ফ্রী সাঁজিয়ে দাও আর তোমার সাঁজের অনেক সুনাম যাও তুমি পার্লারের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসো।
আমি ছোট বেলা থেকে সাঁজতে ভালো বাসতাম রং নিয়ে খেলতে ভালোবাসি সে কারোনে বাটিক ব্লকের কাজ শিখি ২০০২ সালে।আর পহেলা বৈশাখে,স্কুল প্রোগ্রাম এ, ঈদের সময় এলাকার সব মেয়েরা আমার কাছে সাজদে আসতো এছাড়াও এলাকার ভিতরে বিয়ে, শ্বশুরবাড়ির, বাপের বাড়ির আত্মীয়-স্বজনের বিয়েতে আমি বউ সাজাতাম। বউ সাজানো শুরু ক্লাস সেভেন থেকে। আমি ২০১৬ সালে প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০১৬ সালেই পার্লার ওপেন করে ফেলি খুলনাতে। সবাই অবাক আত্মীয়-স্বজনরা। তারপর স্বামী বিজনেসের কারনে খুলনা থেকে ২০১৭ সালে চলে আসি দিগরাজ (মোংলা) আমার পার্লার অনেক ভালো বিজনেস চলে ও অনেক সুনাম অর্জন করে ফেলেছিল অল্প দিনে আর দিগরাজ বি এন স্কুলে ছেলেরা পড়াশুনা করে সব দিকে সুবিধা হয় কিন্ত ২০২০ সালে করোনাতে স্কুল বন্ধ থাকায় আর পার্লার ভাড়ার বাসায় বন্ধ থাকায় আমরা নিজ বাড়িতে চলে আসি।
এখন নতুন করে নিজ বাড়িতে পার্লার ওপেন করেছি মোটামুটি চলছে করোনাতে,,,এভাবেই চলছে জীবন সংগ্রাম। আজ বিজনেসে আসার সহযোগী আমার স্বামী তার সাপোর্টে সমাজের মানুষের কথা কানে তুলি না। এভাবেই সারা জীবন ছায়া হিসাবে চাই ছেলের বাবাকে।
উপসংহারঃপরিশেষে বলতে চাই সব মিলায় এ মহামারি তে আলহামদুলিল্লাহ এখনও ভালো আছি জীবন মানে সংগ্রাম, সংসার এবং ব্যবসায়ী উত্থান-পতন থাকবেই এ গুলোকে মেনে নিয়েই সংগ্রাম করেই জীবনে চলতে হবে।এই কয়েক বছরে বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শ্রম দিয়েছি মেধা দিয়েছি কিন্তু কষ্টের সফলতা পায়নি।এখান থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি কেঁদেছি আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছি। পরম সৃষ্টিকর্তার দয়ায় আমি একটি ভালো মানুষের ফাউন্ডেশন উপহার পেয়েছি, পেয়েছি ইকবাল বাহার স্যারের মত একজন শিক্ষক। নিজের বলার মত একটি গল্প তৈরি করার ফাউন্ডেশন। এই কয়েক মাসে শিখেছি কিভাবে মনোবল ফিরে পেতে হয় ঘুরে দাঁড়াতে হয় ইনশাল্লাহ আমি আবারও আগের অবস্থানে ফিরে যাব তার থেকেও বেটার কিছু করতে পারবো জীবনে সবাই দোয়া করবেন, সবাই সহযোগিতা করবেন। সবার জন্য রইল দোয়া ও শুভকামনা।
"স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৫৭১
Date:- ১০/০৭/২০২১
ধন্যবাদান্তে
নামঃসুরাইয়া সাথী
ব্যাচঃ১৩
রেজিঃ ৫৮৪৯৪
ব্লাড গ্রুপঃ এ পজেটিভ
বর্তমান অবস্থানঃ মোংলা
টিম টাইগার্স বাগেরহাট
ওনার অফ গ্লো বিউটি কেয়ার এন্ড ট্রেনিং সেন্টার, মোংলা