আজ থেকে ৬/৭ বছর আগে ক্রিস্টাল পুতির ব্যাগের যাত্রা শুরু
সবার জীবনে নিজের একটা গল্প থাকা দরকার যেই গল্পটা থেকে আর একজন মানুষ অনুপ্রানিত হয়।।একেক জনের জীবনের গল্প একেক রকমের ।। জীবনের গল্প লিখে বা বলে শেষ করা যাবে না ।।
আমরা ৩ ভাই বোন...আমার জন্মস্থান মধ্যবিও রক্ষণশীল পরিবার প্রিয় নানুর বাড়ি নোয়াখালীতে ।।বাবা সরকারি চাকুরীজিবি ছিলেন ।। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত । ৩ ভাই বোনের মধ্যে শ্রদ্ধেয় বড় দুই ভাইয়ের পর আমার স্থান...আমি শান্ত স্বভাবের কিন্তু সবাইকে নিয়ে হাসি খুশি থাকতে পছন্দ করি।। ছোটো এবং একমাত্র বোন বলে সকলের আদরের ও ছিলাম আলহামদুল্লিলাহ এখন ও আছি ...।ভাইয়াদের অকৃত্রিম ভালোবাসা কখনো বোনের অভাবটা বুঝিনি...
ছোটবেলা থেকেই নিজে কিছু করবো এটা চিন্তা করতাম।যখন ১০ম শ্রেণীতে এ পড়ি তখন জীবনের প্রথম একটা টিউশন করতাম মাত্র ২০০ টাকা বেতনে ।। সেই টাকাটা আমার কাছে বিশাল ব্যাপার ছিলও । ভাল লাগত যখন মাস শেষে বেতন পেতাম ।। আমার আব্বু,আম্মু , ভাইয়ারা সব সময় বিশ্বাস করতেন মেয়েদের পড়াশোনার পাশাপাশি হাতের কাজ জানা ভাল।তবে পড়ালেখার যেন ক্ষতি না হয়। যে কোন পরিস্থিতিতে অন্তত নিজের ড্রেস এবং ঘরের টুকটাক সেলাই করে নিজেরটা নিজেই তৈরি করা যায়।।আম্মু বলতেন মেয়েদের কাজ জানা ভাল কখন কোন কাজে লাগে কেউ বলতে পারে ন। আমাদের পাশের এলাকায় যুব উন্নয়ন একাডেমী থেকে আম্মু ও ভাইয়ার পরামর্শে কাটিং এন্ড টেইলারিং এর কোর্স টা করে ফেলি । আমার ছোটো ভাইয়া আমাকে একটা সেলাই মেশিন কিনে দিয়েছেন ।।টৈইলার এর কাছে গেলে ড্রেস পছন্দমতো হয় না আবার সঠিক তারিখে দেয় না। যা খুবই বিরক্তকর। এখন নিজের পোশাক নিজে সেলাই করে গায়ে দিয়ে আনন্দ পাই। আসলেই নিজের কাজ নিজে করার মধ্যে অন্য রকম তৃপ্তি পাওয়া যায়।
উদ্যোগটা জীবনের গল্প----
অনার্স করেছি আমি এশিয়া সর্ববৃহৎ মহিলা কলেজ --ইডেন মহিলা কলেজ থেকে ।অনার্সে অধ্যয়ন রত অবস্থায় দেশ টিভি তে দুরপাথ নামে একটা অনুষ্ঠান হতো ।সেঁটা দেখতাম সেখানে হাতের কাজের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। যেমন-পুতির,ব্লক,বাতিক, মোমের শোপিচ, সেলাই , পিঠা তৈরি ,সুই সুতার , কুরশিকাটা, প্রাকৃতিক জিনিস দিয়ে ওয়ালমেট, গহনা তৈরি কাজ ইতাদি বিভিন্ন বিষয়।। যা আমার দেখতে খুব ভাল লাগত।টেইনার রা বলতেন আপনারা এসব কাজ শিখে উদ্যোগটা হতে পারেন।।
আজ থেকে ৬/৭ বছর আগে ক্রিস্টাল পুতির ব্যাগের যাত্রা শুরু হয় এবং এর চাহিদা খুব বেশি থাকে... আমি পুতির ব্যাগ বানানো শুরু করি।এলাকার দোকান থেকে কিছু পুতি আর রগ সুতা কিনে আনি ।এলাকার দোকান আবার নতুন পুতির কাজ সবাই করে তাই দাম টা একটু বেশি ছিল।। আম্মু বলতেন কাজ না করলে তো বুঝা যায় না কেমন।। দাম বেশি হোক শিখা তো হয়েছে। । কাজ করলেই কাজ সম্পর্কে ধারণা আসে ।। সব সময় আমার আম্মু আমার প্রতিটা কাজে উৎসাহ দিতেন।হোক সেটা খারাপ।নষ্ট হলে বলতেন মানুষের শুরুতে কি সব ভাল হবে নাকি... করতে করতে ঠিক হবে।।ধর্য্য দিয়ে কাজ করতে হবে। আমার সাথে বসে পুতির কাজ চেষ্টা করতেন বলতেন পারি না মা চোখে দেখি না।। মা আছে বলেই হয়তো অগোছালো থাকি।আমি কাজ শেষ করার পর এলোমেলো করে রাখতাম আমার আম্মু সব কিছু সুন্দর ভাবে গুছিয়ে রাখতেন।। এটা লাগবে পাচ্ছি না আম্মু ।।তখন আম্মু একটা মুচকি হাসি দিয়ে বের করে দিতেন।কখন ও কোন রাগ, অভিমান করতেন না শত কষ্টের মধ্যে।। ছোটো বেলা থেকেই আমি দেখেছি আমার মমতাময়ী মা কে।। হাজার কষ্টের মধ্যেও মুখে এক ঝলক হাসি লেগেই থাকতো। ১ম ব্যাগ টা ভাল হয় নি ব্যাগটা নরম হয়েছে।আমি তো হাতে কলমে কারও থেকে প্রশিক্ষণ নেই নাই। একদিন আমাদের পাশের বাসার ভাবি আমার ব্যাগ টা দেখে বলেছেন তোমার ব্যাগটা এই ভাবে হবে। পরে খুলেই আবার নতুন করে তৈরি করি।। আর বলল তুমি যদি ব্যাগ বানাতে চাও তাহলে আমার বাসায় যেও। আমি বিকালে মাঝে মাঝে অনার বাসায় যেতাম উনি নিজের কাজ করতো ও আমাকে বলতো। উনার থেকে একটু ধারণা নিয়ে বাসায় চেষ্টা করতাম। সখের বসে ব্যাগ তৈরি করি।একদিন আমার মামা বিদেশ থেকে আমাদের বাসায় আসেন। আমি ১ম নিজ হাতে একটা ব্যাগ তৈরি করেছি খুশি হয়ে মামাকে দেখালাম।। মামার খুব পছন্দ হয়েছে ব্যাগটি দেখে। তিনি বললেন সেল করবা আমি কিনব। আব্বু অমত পোষণ করেছিলেন কারন এত সুন্দর ব্যাগ আর আমি কষ্ট করে করছি। আব্বু কে বললাম থাক আমি আমার জন্য আর একটা তৈরি করব। যেহেতু আমি তৈরি করতে পারি ।আমার শিখা ও হছে সাথে পুতি কিনার খরচটা পোষে যাচ্ছে। ২য় টা তৈরি করলাম তখন সেটা দেখে আমার আর এক রিলেটিভ কিনে নিয়ে গেল। আমি তো মহা খুশি।।আমি তো ভাবতে ও পারি নাই যে সেল হবে। তো আমার আগ্রহ দেখে আমার ছোটো ভাইয়া চক বাজার থেকে পুতি কিনে আনে ।এবং অফিস শেষে আমার সাথে বসে ব্যাগ বানানোর কাজে সাহায্য করে উৎসাহ দিতেন। যাতে আমার কষ্ট কম হয় এবং বোরিং না হই। আলহামদুল্লিলাহ আমি যেভাবে বলে দিতাম সেই ভাবে করতো আমার থেকো ও দ্রত ।। তখন আমি অনেকগুলু ব্যাগের অর্ডার পেয়েছি ।। আমি অনলাইন সম্পর্কে তেমন বুঝতাম না।। ছোটো ভাইয়া আমাকে আমার নামে একটা পেজ খুলে দিয়েছেন । উনার ইচ্ছা আমার কাজ আমার নামের মাধ্যমে ছড়িয়ে পরুক। আলাহামদুলিল্লাহ অফলাইনে ব্যাগের ব্যাপক সারা পেয়েছিলাম।। আর ব্যাগের পাশাপাশি ঝারবাতি কয়েকটা সেল করেছি।
এরপর এলাকার একটা স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে জয়েন্ট করি । শিক্ষকতা পেশাটা আমার ভাল লাগে ।কিছুদিন করার পর একটা কওমি মহিলা মাদ্রাসায় জেনারেল শিক্ষিকা হিসেবে ১.৫ বছর ছিলাম।। আমার পুতির কাজ এর পাশাপাশি কয়েকটা ড্রেস আমার ছোটো ভাইয়ার সাথে যেয়ে কিনে আনলাম ভাবছি সেল যদি না হয় আলহামদুল্লিলাহ মাদ্রাশায় আমার ৫ টা ড্রেস সেল হয়। আমি তো মহা খুশি।আমার বড় ভাইয়া কওমি মাদ্রাসার অধ্যয়নরত ছিলেন তাই তিনি সময় পেতেন না আমার সাথে ড্রেস কিনতে যেতে। ভাইয়া মাদ্রাসা থেকে এসে আমি নিজ হাতে ওয়ালমেট, ব্যাগ, নতুন ড্রেস সেলাই ইতাদি কাজ গুলা দেখে খুব খুশি হতেন এবং বলতেন মাশা আল্লাহ খুব ভালো হয়েছে।পেজটা তে কিছু ড্রেস এর ছবি এড করি কিছু সমস্যার কারনে ড্রেস সেল অফ রাখি ।
=======
প্রিয় প্ল্যাটফর্মের সন্ধান----
আমি হাতের কাজ পারতাম কিন্তু আমার মধ্যে সাহসের অভাব ছিলও। আমার ছোটো ভাইয়া আমকে স্যার এর ইউটিউব এর ভিডিও লিঙ্ক দিয়েছেন।বলতেন শুধু শুধু ইউটিউব এ সময় নষ্ট না করে স্যার এই মোটিভেশন ভিডিও গুলু দেখ ভাল লাগবে।। ভাইয়া নিজেও ও প্রিয় স্যার জনাব ইকবাল বাহার জাহিদ স্যার এর ইউটিউব এর ভিডিও দেখতেন সাথে আমিও ও দেখতাম।। দেখে খুব ভাল লাগা কাজ করল।। নিজের মধ্যে কিছু করার ইচ্ছশক্তি কাজ করতে লাগলো যে আমি পারব ।। এরপর ভাইয়া আমাকে নিজের বলার মতো একটা গল্পের লিঙ্ক দিল।। আমি ৯ ম ব্যাচ থেকে যুক্ত আছি। ভাইয়া বলেছেন আগে স্যার এর সেশন গুলো দেখ ... তো আমি সেশন পড়তে লাগলাম ।। বুঝার চেষ্টা করতাম।
সব প্রিয় ভাইয়া আপুদের উদ্যোক্তা হয়ে উঠার গল্প পড়ি খুব ভাল লাগে এবং নিজের কিছু করার ইচ্ছাসক্তি জাগ্রত হয়।
১১ তম এ ব্যাচে এসে রেজি করে ফেলি। আমার ছোটো ভাইয়া বলতেন নিজের যে কাজটা করতে ভাল লাগে সেটা করা উচিৎ।। আমার নানু আমাকে বিভিন্ন পিঠা তৈরি করে খাওয়াতেন। সেই থেকে আমি পিঠার প্রেমে পরে যাই। আমার উদ্যোগটা জীবন শুরু করেছি হাতের তৈরি বিভিন্ন পিঠা নিয়ে, সাথে রেখেছি ফ্রজেন খাবার। আলাহামদুলিলাহ হাটি হাটি পা পা করে সকলের দোয়ায় ভাল সাড়া পাচ্ছি। খাবারের আইটেম এর পাশাপাশি সুতির বিভিন্ন ড্রেস রেখেছি। এখন আর বিভিন্ন ফানি জায়গায় সময় দেয়া মানে জীবন থেকে মূল্যবান সময় নষ্ট।। এখন শত বাস্তথার মাঝে প্রিয় প্লাটফর্ম এ না আসলে ভাল লাগে না।। একটা নেশা কাজ করে।। "আমরা নারী আমরাই পারব "।। সমাজের নারীরা অবহেলিত ,বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আমার ইচ্ছা নিজে একজন সফল উদ্যোগতা হয়ে সমাজের নিরীহ মানুষের পাশে দাঁড়াবো ।। অসহায় মানুষদের সাহায্য করবো।
সবাই আমার জন্য আমার আব্বু আম্মু ও ভাইয়াদের জন্য দোয়া করবেন ।
পরিশেষে বলব , নিজের বলার মতো একটা গল্প ফাউন্ডেশন এর ফাউন্ডার এবং সবার জন্য আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকে অনেক অনেক দোয়া ও শুভ কামনা রইলো। এতক্ষণ আপনাদের মূল্যবান সময় ব্যয় করে লিখাটি পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
লেখার মাঝে কোন ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন ।
পরিশেষে সকলের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করে আজকের মত বিদায় নিলাম।।
"স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৫৭১
Date:- ১০/০৭/২০২১
নাম- মরিয়ম সুলতানা
ব্যাচ- ১১
রেজি :নং - ২৬৭৮৮
জেলা- নারায়ণগঞ্জ
জোন-ওয়ারী