বেকার হয়ে শুরু করলাম ব্যবসা। ব্যবসায় সফলতা পাওয়ার জন্য ২০০৩ সাল থেকে বিভিন্ন স্কিল সংক্রান্ত ৮০টিরও বেশি কোর্স করেছি।
প্রতিটা মানুষের জীবনের একটা গল্প থাকে। সে হিসাবে আমার জীবনেরও একটা গল্প আছে। আজ আমি তা সংক্ষিপ্ত আকারে বলার চেষ্টা করব।
আমি মোঃ সাজ্জাদ হোসেন। কাজ করি গার্মেন্টস নিয়ে। বর্তমানে গার্মেন্টস বায়িং হাউজে সিনিয়র মার্চেন্ডাইজার (Account Manager) হিসাবে কাজ করছি। পাশাপাশি ২০০৪ সাল থেকে ছোট আকারের বিভিন্ন রকমের বিজনেস করে আসছি।
আমি বলতে গেলে তেমন কোন ধনী বা উচ্চ শিক্ষিত পরিবারের সন্তান না। ১৯৮৬ সালে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করি। আমার শেষ বিষয়ের পরীক্ষা চলাকালীন সময় প্রচন্ড শিলাবৃষ্টি হয়। সেই শিলাবৃষ্টিতে আমাদের পাকা ধান মাটিতে ঝরে পড়ে। সাধারণত চৈত্র মাসের শেষের দিকে আমাদের গ্রাম এলাকায় সে সময় প্রচন্ড অভাব থাকত। কারন বৈশাখ মাসের শুরুতে বোরো ধান কাটা শুরু হত। নতুন ধানের আশায় সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত। অন্যদের মত আমাদের পরিবারও এক সপ্তাহের মধ্যে নতুন ধান ঘরে তোলবার অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু সে আশা তো পূরন হয়ইনি বরং এক সপ্তাহের মধ্যে আমাদের খাওয়ার মতো ঘরে কোন ভাত ছিল না।
তাই এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার পর শুরু হলো অভাব। গ্রামে এমন কোন লোক ছিল না যে তার বাড়ি থেকে কিছু ধান বা চাল এনে আমরা রান্না করে খাব। কারন প্রায় সবার একই অবস্থা ছিল। যদিও তখন এ বিষয়টি আমার বাবা মা আমাকে তেমন একটা বুঝতে দেয়নি। কোন না কোন উপায়ে আমার খাবারের ব্যবস্থা হতো। এর মধ্যে একদিন সন্ধ্যায় আমার বৃদ্ধ বাবা ৮/৯ মণ ধান নিয়ে বাড়িতে হাজির। অন্য গ্রামের আমাদের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে এ ধান আনা হয়েছিল। এ ধান দিয়ে কোন রকমে আমাদের পরিবার চলতেছিল। এর মধ্যেই আমার পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হল।
এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার পর কলেজে ভর্তি হতে হবে। কিন্তু আমাদের উপজেলায় কোন কলেজ ছিল না। আমার সহপাঠীদের সবাই কলেজে ভর্তির জন্য বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছিল। কেউ যাচ্ছিল নেত্রকোনা, আবার কেউ যাচ্ছিল ময়মনসিংহ শহরে। কিন্তু টাকার অভাবে আমি কোথাও যেতে পারছিলাম না। শুধু অপেক্ষায় ছিলাম পরে যেকোন একদিন কলেজে ভর্তি হব। শেষে সময় মতো কোথাও ভর্তি হতে পারলাম না। ১৯৮৭ সালের জানুয়ারি মাসে বোর্ড থেকে স্পেশাল পারমিশন নিয়ে কোন রকমে পাশের উপজেলার একটা কলেজে ভর্তি হলাম। ভর্তির টাকা কিভাবে যোগাড় হয়েছিল তা জানতে পারিনি। শুধু বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমার বড় বোন সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে চাকুরী করতে গিয়েছিল।
কলেজে ভর্তির পর ছিল না থাকার জায়গা। ১০ কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে ক্লাস শেষ করে আবার ১০ কিলোমিটার হেঁটে বাড়িতে আসতাম। এভাবে কিছুদিন ক্লাস করেছি। অনেক চেষ্টার পর ব্যবস্থা হল জায়গীরের। কিন্তু সেখানে বেশি দিন থাকা হয়নি। এই কলেজ থেকে টিসি নিয়ে চলে গেলাম আরেক কলেজে। সেখানে আমার কয়েকজন স্কুলের সহপাঠী ছিল। দুই বছরের পড়া এক বছর পড়লাম। এইচএসসিতে দ্বিতীয় বিভাগ পেলাম। তবে প্রথম বিভাগের কাছাকাছি নম্বর পেয়েছিলাম।
যাহাই হোক, স্নাতক পড়ার জন্য চলে গেলাম ময়মনসিংহে। সেখানে ভর্তিও হয়ে গেলাম। পড়াশোনার ও থাকা খাওয়ার খরচ মিটানোর জন্য শুরু করলাম টিউশনি। টিউশনির টাকায় আমার খরচ চলে যেত। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন অবস্থা হতো যে, আমার ছাত্র-ছাত্রী ও আমার পরীক্ষা একই সময় হতো। তখন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজের পরীক্ষার পড়া বাদ দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতে হতো। এটা ছিল আমার ছাত্রজীবনে টিউশনি করার সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক। এভাবেই গণিতে স্নাতক(সম্মান) ও স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় শ্রেণীতে পাস করলাম।
স্নাতকোত্তর পাস করার পর শুরু হলো চাকরির পরীক্ষা দেয়া। একের পর এক পরীক্ষা দেয়া চলছিল। ছোটখাটো চাকুরীও হচ্ছিল একটার পর একটা। সর্বশেষ ২০০০ সালে সরকারি প্রাইমারি স্কুলের চাকুরী ছেড়ে উপজেলা প্রোগ্রাম অফিসার(১ম শ্রেণী) হিসেবে যোগদান করলাম। এ চাকুরীতে থাকা অবস্থায় ২০০১ সালে বিসিএস ভাইবাও দিলাম। ফাইনালি বিসিএস-এ আর টিকতে পারলাম না। এদিকে ২০০২ সালে ৩০ জুন আমাদের প্রজেক্টের মেয়াদ শেষ হলো। সরকার উপজেলা প্রোগ্রাম অফিসারের পদটি বিলুপ্ত করে দিয়ে প্রজেক্ট আর নবায়ন করেনি। ফলে আমার মত প্রতিটি উপজেলা প্রোগ্রাম অফিসার বেকার হয়ে যায়। এদিকে সরকারী চাকুরীতে পরীক্ষা দেয়ার বয়সও শেষ হয়ে যায়।
যুব উন্নয়ন অফিসার, উপজলা প্রজেক্ট অফিসার (উপবৃত্তি), উপজেলা মহিলা বিষয়ক অফিসারের মত আমিও সরকারি প্রজেক্টে ছিলাম। উপজেলা পর্যায়ের এ পদগুলোতে সবাই আগের মত চাকুরী করছে। তাদের অনেকেই রাজস্ব খাতে চলে গেছে। কিন্তু আমরা উপজেলা প্রোগ্রাম অফিসারগণ আমাদের স্টাফসহ সবাই বেকার হয়ে যাই।
বেকার হওয়ার পর আমার স্কিল বলতে যা ছিল তা হলো ছাত্র পড়ানোর অভিজ্ঞতা। শুরু করলাম আবার ছাত্র পড়ানো। জীবনের ৩০ বছর পার করে চাকুরী হারিয়ে ঢাকা শহরে মানুষের বাসায় গিয়ে ছাত্র পড়াতাম। কিন্তু সেটাও স্থায়ী ছিল না। অনেক সময় প্রক্সি হিসেবে পড়াতাম। এরই মধ্যে আমার ছাত্র জীবনের জুনিয়র এক ভাই আমাকে টিউশনির চিন্তা বাদ দিয়ে কিছু একটা শুরু করতে বলল।
জুনিয়র ভাইয়ের পরামর্শের কয়েকদিন পরই ইত্তেফাক পত্রিকায় দেখলাম যে, একজন প্রিন্টিংয়ের কাজ শেখাবে। দেরী না করে ভর্তি হয়ে গেলাম কাজ শিখতে। আমাকে শেখানো হলো কিভাবে স্ক্রীনপ্রিন্টের সাহায্যে ভিজিটিং কার্ড করা হয়। স্ক্রীনপ্রিন্ট ও অফসেট প্রিন্টের সাহায্যে কিভাবে কাজ করা হয় তার সামান্য জ্ঞান লাভ করতে পারলাম।
এই সামান্য জ্ঞান নিয়েই শুরু করলাম ভিজিটিং কার্ড ওর্ডার পাওয়ার মার্কেটিং। একটা ব্যাগ নিয়ে সকালে বের হতাম, আবার রাতে মেসে ফিরতাম। কোন দিন ওর্ডার পেতাম, কোন দিন পেতাম না। অনেকেই ভালো ব্যবহার করত, আবার কেউ কেউ খুব বাজে ব্যবহার করত। এভাবে চলতে চলতে প্রিন্টিংয়ের অন্যান্য কাজ পাওয়া শুরু হলো। কাজ করতে করতে বেশ কিছু ভালো মানুষের সাথে আমার পরিচয় হল। কিছু বড় প্রতিষ্ঠানেও কাজ করা শুরু করলাম। কিন্তু কম লাভে এবং বাকীতে কাজ করতে হতো। আমার তেমন কোন পুঁজি ছিলো না। তাই বড় বড় কাজগুলো হাতছাড়া হতে লাগলো। বিজনেসও আস্তে আস্তে খারাপ হতে লাগলো।
হতাশ হয়ে বিজনেসকে ডাইভার্ট করে গার্মেন্টস এক্সেসরিতে চলে গেলাম। শুরু হলো নতুন সেক্টরে মার্কেটিং। এগুচ্ছিলাম ভালোভাবেই। কিন্তু এ সেক্টরে তেমন কোন ভাল মানুষের সাথে কাজ করার সৌভাগ্য হয় নাই। ক্লায়েন্টের কথা আর কাজের কোন মিল পেতাম না। অনেক সময় পেমেন্ট না পাওয়ার অবস্থা হতো। আবারও হতাশা আস্তে আস্তে গ্রাস করতে শুরু করল।
গার্মেন্টস এক্সেসরিজ ব্যবসা চালু অবস্থায় বায়িং হাউজে চাকুরী নিলাম। আমার প্রতিষ্ঠানের একজনকে পুরো দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে চাকুরীতে মনোযোগ দিলাম। বায়িং হাউজে আমার যেসব এক্সেসরিজের কাজ ছিল সেগুলোই আমার প্রতিষ্ঠান করত। প্রথম দিকে প্রতি সপ্তাহে একদিন অফিসে গিয়ে খোঁজ-খবর নিতাম। আস্তে আস্তে চাকুরীর ব্যস্ততা বাড়তে লাগলো। আমার ব্যবসায় মনোযোগ কমতে লাগলো। যদিও প্রফিট ভালোই হচ্ছিল। কিন্তু ঠিক মতো ফলোআপ না করার কারনে যতই দিন যাচ্ছিল প্রতি মাসে ততই লস গুণতে হচ্ছিল।
যে বায়ারের কারনে আমার চাকুরী স্থায়ী হয়েছিল সেই বায়ারের অর্ডার হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেল। ফলে ঠিক মতো এক্সেসরিজের কাজ আমার প্রতিষ্ঠানকে দিতে পারছিলাম না। অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের কাজও ছিল না। শেষে চাকুরী ঠিক রেখে এক্সেসরিজের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই।
এক্সেসরিজের ব্যবসা বন্ধ করে দেয়ার বেশ কয়েক বছর পর ২০২০ সালের আগস্ট মাসে নতুন করে আরও একটা ব্যবসা শুরু করি। এ ব্যবসাটি গার্মেন্টস এক্সপোর্ট করার জন্য। তবে বিদেশে গার্মেন্টস এক্সপোর্টের পাশাপাশি দেশেও পাইকারী সেল করি। এই ব্যবসাই এখন চলছে। আশা করছি এ ব্যবসা দিয়ে ভালো কিছু করা সম্ভব হবে।
আমি ছিলাম গণিতের ছাত্র। বেকার হয়ে শুরু করলাম ব্যবসা। ব্যবসায় সফলতা পাওয়ার জন্য ২০০৩ সাল থেকে বিভিন্ন স্কিল সংক্রান্ত ৮০টিরও বেশি কোর্স করেছি। এমনকি ২০২০ সালেও আমি তিনটা কোর্স করেছি। তবে সবগুলো কোর্সই ছিল বিষয় ভিত্তিক সর্টকাট টাইপের। এ কোর্সগুলো হয়ত আমার জ্ঞান ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু দীর্ঘ ১৭ বছরে করা এতগুলো কোর্সের একটার সাথে আরেকটার সমন্বয় ঘটাতে আমি ব্যর্থ হয়েছি। ফলে এগুলো আমার বিজনেসগুলোতেও তেমন কোন কাজে লাগেনি।
'নিজের বলার মত একটা গল্প' ফাউন্ডেশন-এ জয়েন করার পর এখানকার ৯০টা সেশনের ভিডিও একটানা দেখলাম। সেশনের পাশাপাশি বিভিন্ন গেস্ট নিয়ে যে আলোচনাগুলো করা হয়েছে, সেগুলোও দেখার চেষ্টা করছি। আমার দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতায় অনেক কিছুই শিখেছি। কিন্তু এই প্লাটফরমে যা কিছু পেলাম তা ছোট ছোট আকারে গোছানো। বিজনেসের সবগুলো উপাদান এখানে গোছানো অবস্থায় আছে। আমার মতে বিজনেসের জন্য এই সেশন ও আলোচনাগুলো একটা কমপ্লিট সলিউশন।
বিজনেসের এই বিদ্যা কাজে লাগিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য সবার দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করছি।
ধৈর্য ধরে যারা আমার এই লেখাটি পড়েছেন তাদের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
"স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- ৫৮২
Date:- ২৮/০৭/২০২১
মোঃ সাজ্জাদ হোসেন
ব্যাচ # ১৩
রেজিঃ # ৫৩৩৫৭
কাফরুল থানা
মিরপুর-১৪, ঢাকা।
নিজ জেলাঃ নেত্রকোনা।
সত্ত্বাধিকারীঃ Saimex Export (শুধুমাত্র পাইকারী বিক্রেতা)।
https://www.facebook.com/saimexexport/
মোবাইল# ০১৭১৬ ৩৩৯৫১০