এভাবে কেটে গেল আরো কয়েকটি বছর। আস্তে আস্তে ঋন শেষ হওয়ার পথে। বড় ভাই বিভিন্ন জায়গায়
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। প্রথমেই শুকরিয়া আদায় করছি সেই সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ তাআলার, যিনি আপনাকে,আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং হাজারো কোটি নেয়ামত দিয়ে ঢেকে রেখেছেন এই পৃথিবীতে। সমস্ত প্রকার বিপদ আপদ থেকে মুক্ত রেখেছেন । দোয়া ও সুস্থতা প্রার্থনা করছি সেই সমস্ত ভাই বোনদের জন্য যারা এই মহামারী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। মাগফিরাত কামনা করছি করোনা যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকদের জন্য। সম্মানিত ভাই ও বোন আপনাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা, সম্মান, ভালোবাসা ও সালাম। আসসালামু আলাইকুম।
ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আমাদের সকলের প্রিয় শিক্ষক,প্রিয় মেন্টর,সময়ের সেরা মোটিভেশনাল স্পিকার, তরুনদের প্রানের স্পন্দন জনাব ইকবাল বাহার জাহিদ স্যার এর প্রতি যার অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে তীল তীল করে গড়ে উঠেছে আমাদের এই প্রিয় প্লাটফর্ম। স্যারের দীর্ঘায়ু ও সফলতা কামনা করছি।
৷৷ ৷৷💝 #নিজের_বলার_মত_একটা_গল্প_প্লাটফর্ম৷💝৷৷ ৷৷
স্বপ্নবাজ তারুণ্যের প্রতিক, নতুন প্রাণের উদ্দমী এক নেতা,স্বপ্ন কে বাস্তবে রুপদান করার রুপকার হচ্ছে আমাদের প্রিয় শিক্ষক ও তার নিজের বলার মত একটা গল্প প্লাটফর্ম।
আমি রিফাত হোসেন
কমিউনিটি ভলান্টিয়ার
ব্যাচঃ১০ম
রেজিঃ১১৯৩১
জেলাঃ মুন্সিগঞ্জ
বর্তমান অবস্থানঃ সিঙ্গাপুর
আজকে আমার বাবার গল্প বলবো। জীবনের কঠিন বাস্তবতায় যুদ্ধ করা একজন সৈনিক হলো আমার বাবা।গল্পটা বড় হবে, তারপরও কষ্ট করে যদি পড়েন তাহলে চির কৃতজ্ঞ থাকবো।
স্বপ্ন গুলোকে সাজিয়ে গুছিয়ে সুন্দর করে লালন পালন করতে পারলে তার বাস্তবায়ন করাও নাকি সম্ভব। শুধু প্রয়োজন হয় ধৈর্য্যশক্তি আর প্রতিকূলগামী সময়ের সাথে যুদ্ধ করার সৎসাহস।
১৯৯১ সাল। নিম্ন মধ্যবৃত্ত এক বাবার গল্প। আব্বা শুরু করলেন তার প্রবাস জীবন। ইরাকে গেলেন। ইরাক যাওয়ার কয়েক মাস পরেই ইরাকে যুদ্ধ শুরু হলো। আমার তখনও জন্ম হয়নি। আমার মা ছিল গর্ভবতী। গর্ভের সেই সন্তানটিই হলাম আমি। আব্বা যখন ইরাক গিয়েছিলেন দেশে রেখে গিয়েছিলেন ২বছরের এক পুত্র সন্তান, গর্ভবতী স্ত্রী আর বাবা-মা। সহায় সম্পত্তি ঐরকম না থাকায় ধার দেনা করে বিদেশ গিয়েছিলেন। এখনকার মত ডিজিটাল যুগ ছিল না সেই সময়টায়। ছিল না কোনো মোবাইলের প্রচলন। হাতের লেখা চিঠি আর ট্যাব রেকর্ডের ফিতার মধ্যে কথা রেকর্ড করে কথা বলাই ছিল যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যমে প্রবাসীদের সাথে। আব্বা বিদেশ যাওয়ার কয়েক মাস পরেই যুদ্ধ শুরু হয়। যেহেতু মোবাইলের যুগ ছিল না তাই কোনো ভাবেই আব্বার খোঁজ খবর পাচ্ছিলো না আমার পরিবার। কয়েক গ্রামের মধ্যে একটা বাড়িতে রেডিও ছিল। যার মাধ্যমে যানতে পারলো যুদ্ধ পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে সে দেশে। অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এদিকে যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক মাস অতিবাহিত হওয়ার পর ও আব্বার খোঁজ খবর পাচ্ছে না। পরিবারের সবাই পাগলপ্রায় বাবার জন্য।
পরিবারের সেই কঠিন সময়ে আমার আগমন এই পৃথিবীতে। যখন সবাই ধরেই নিয়েছে বাবা মারা গেছে। বাবার শোকে আস্তে আস্তে দাদার মাথাটা নষ্ট হতে থাকল। দাদা নাকি সে সময় বাবার নাম নিয়ে সবসময় ডাকতো আর বলতো আমার ছেলে বেঁচে আছে। আমার ছেলে কি আইছে?
এদিকে পাওনাদাররা যখন বুঝতে পারলো বাবা মারা গেছে তখন তারা তাদের পাওনা টাকার জন্য বিভিন্ন ভাবে চাপ দিতে থাকল। টাকার জন্য গ্রাম্য সালিশ বসালো। দাদা কে বললো তাদের পাওনা টাকা শোধ করতে। দাদা পাওনা টাকা শোধ করতে অপারগ হওয়ায় ভিটা বাড়ি ছাড়া যে যা পারছে নিয়ে গেছে। পাওনাদারেরা থাকার ঘরটা ও নিয়ে যাওয়ার কারনে ছোট্ট একটা ছাউনি ঘর উঠিয়ে বসবাস করতে থাকলো দাদা আমাদের সবাই কে নিয়ে। সে ছাউনি ঘরে আবার সবার যায়গা হয় না। তাই বাধ্য হয়ে দাদা আমাদের ২ ভাই সহ মাকে নানীর বাড়ি দিয়ে আসলো। দাদা হারালো তার সন্তান, বাড়ি ঘর এবং সর্বশেষ তার আদরের নাতীদের কেও তাদের নানীর বাড়িতে রাখতে বাধ্য হলো। এতো শোক সইতে না পেরে দাদা পাগল হয়ে গেলো কিছু দিনের মধ্যে পুরোপুরি।
আমার মা ও পাগল প্রায় স্বামী হারিয়ে। খেয়ে না খেয়ে দৌড়াদৌড়ি করতো বিভিন্ন জায়গায় বাবার খোঁজ নেওয়ার জন্য। একটা সময়পর সবাই ভেবেই নিল আব্বা আর বেচে নেই। এদিকে পাগল দাদার অবস্থা খারাপের দিকে যেতে লাগলো আস্তে আস্তে। এখন কাউকেই আর চিনতে পারছে না। তবে পাগল অবস্থায় ও আব্বার নামটা ভুলে নাই। শুধু নাকি বলতো আমার কাশেম কই?( কাশেম বাবার নাম).আমার কাশেম মরে নাই। আমি কাশেম কে দেখমু। খুবই কষ্টকর ও হ্রদয়বিধারক একটা সময় পার করেছে আমার পরিবার সেই সময়। আমি ছোট্ট ছিলাম বিধায় বুঝতে পারি নাই তবে এখন সেই সময়ের কষ্টটা অনুধাবন করতে পারি। কিভাবে আমার মা সেই সময়টা পার করেছেন।
দীর্ঘ প্রায় ২ বছর পর আমাদের পরিবার জানতে পারলো বাবা মারা যায়নি। বাবা বেচে আছেন। যুদ্ধকালীন সময়ে তাদের কোম্পানি তাদের কে একটি নিরাপদ জায়গায় নিয়ে রেখেছে। কিন্তু সেখান থেকে বাহির হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। যেহেতু চিঠির যুগ ছিলো,বাহিরে বের হওয়ার সুযোগ না থাকায় তাই কোনো চিঠি পাঠানোর সুযোগ ছিলনা। খবরটা শুনে পরিবারের সবার মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে গেলো। পরিবারে আনন্দের বন্যা বয়ে গেলেও আমার দাদার কাছে সে আনন্দ ছোঁয়া পৌছালো না। কারন তখন তিনি কিছুই বুঝেন না। তখন তিনি সম্পূর্ণ পাগল।
সেই মহেন্দ্রখন আসলো আমাদের পরিবারে। সরকারের সহায়তায় বাড়িতে আসলেন বাবা। সেটা ছিল আমাদের পরিবারের সবচেয়ে আনন্দের দিন। দাদা তখন আব্বা কে চিনতে পারছেন না। যার কথা চিন্তা করতে করতে পাগল হলেন সে তার সামনে হাজির হওয়ার পরও চিন্তে পারছেন না। আব্বা নিজের পরিচয় দিলেও দাদা নাকি বলতো মিথ্যা কথা কস কেনো। আমার ছেলেতো ইরাক থাকে😥। এভাবে চলে গেল কিছু দিন। শেষ পর্যন্ত নিজের সন্তান কে সামনে পেয়েও চিনতে না পারার কারনে ছেলে হারানোর বেদনা নিয়ে দাদা বিদায় নিলেন পৃথিবী থেকে।😥😥
আব্বা দেশে আসলেন শূন্যহাতে। বাড়িতে নেই একটা ভালো থাকার ঘর। তার মানে একেবারে শূন্য হাতে শুরু করলেন আবার জীবন যুদ্ধ। মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতে লাগলেন। হয়ে গেলেন একজন জেলে। এভাবে কেটে গেলো ২-৩ টা বছর। পরিবারের আয় উন্নতি হচ্ছে না তেমন। এতদিন পর্যন্ত সব গল্প আমার দাদীর মুখে শুনেছি।
১৯৯৫-১৯৯৬ সাল হবে। ভাগ্য উন্নয়নের জন্য আবারও ঋন করে প্রবাসে পারি দিলেন। সৌদি আরব। এখন সুদের টাকা আর পরিবারের সংসার খরচ দিয়ে আর তেমন কিছুই থাকে না। এভাবে কেটে গেল আরো ২ বছর। আব্বা দেশে আসলেন ছুটিতে। কয়েক মাস দেশে থেকে আবার চলে গেলেন। আমার আরেক টি ভাই হলো। তখনকার সৃতি মোটামুটি আমার সব মনে আছে।
সৌদি আরবে থাকা অবস্থায় আব্বা হঠাৎ একদিন খবর পেলেন যুদ্ধকালীন সময়ে যারা যারা ইরাকে আটকা পরে ছিল তাদের জন্য একটা অনুদান আসবে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো আব্বার নাম ও আছে সে তালিকায়। এককালীন ২৮০০০০ টাকা পেল ১৯৯৮ সালের দিকে। আব্বা চলে আসলো দেশে। দেশে এসে একটি বেকারি দিল। আব্বা লেখা পড়া জানতো না। তাই ম্যানেজার এবং ক্যাশিয়ার নিয়োগ দিল আমাদের ২জন আত্মীয়কে। সবকিছু ভালোই চলছিল। প্রতিদিন সেল হতে ৫-১০ হাজার টাকা ঐ সময়ে। একটা সময় পর বেকারির লাভ খোঁজে পাচ্ছে না। এভাবে ২ টা বছর কাটালো। তারপর বাধ্য হলো বেকারিটা ছেড়ে দিতে। এরমধ্যে আমাদের আরো একটি ভাই হলো। আমরা চার ভাই হলাম।
তারপর বেকারি হারিয়ে আব্বা একটা মুদি দোকান দিল। যেটা আব্বা নিজে চালাতো। সেটা ২০০০ সালে হবে। ভালোই চলছিল। আমার বড় ভাই তখন ক্লাস সিক্সে পড়ে। হঠাৎ আমার চাচা তার বাড়ি টি বিক্রি করে দিবে। দাদার সম্পদ অন্য কেউ কিনবে এটা ঠিক হবে না ভেবে, আব্বা বাড়িটা কিনার সিদ্ধান্ত নেয়। হাতে টাকা নাই। কিনবে কিভাবে। আবার ঋন করলো। বাড়িটা কিনলো। এদিকে আমার বড় ভাই দোকানের বিজনেস টা মোটামুটি বুজে গেছে। আব্বা তাই ভাইকে দোকানটা বুঝিয়ে দিয়ে আবারো পারি জমান বিদেশ বাড়ি কিনার ঋনের টাকা পরিশোধের জন্য। ঋন করতে হলো বাড়ি ও বিদেশের টাকা যোগাড় করার জন্য।
এভাবে কেটে গেল আরো কয়েকটি বছর। আস্তে আস্তে ঋন শেষ হওয়ার পথে। বড় ভাই বিভিন্ন জায়গায় আড্ডাবাজি করতে গিয়ে দোকানের লস করে বসলেন। তাই সিদ্ধান্ত হলো আব্বা ভাইকে বিদেশ পাটিয়ে দিবেন। এদিকে আমি SSC দিলাম। ভাইয়ের ভিসার জন্য এক দালাল কে দিল ২৮০০০০ টাকা। দালাল ভিসা দিল। ফ্লাইটের দিন বুঝতে পারলাম এটা জাল ভিসা ছিল। টাকাগুলো মাইর গেলো। আবার পাসপোর্ট জমা দিলাম আমার এক আত্মীয়র কাছে। সে ভিসা দিল। ২৫০০০০ টাকা দিয়ে বড় ভাই গেলে ডুবাই।
আমি HSC দিলাম। আমার ছোট্ট ভাই ২ জন বড় হচ্ছে। আমি অর্নাস ১ম বর্ষ শেষ করলাম। কোনো এক কারনে আমি পড়াশোনা ছেড়ে দিলাম চলে আসলাম সিঙ্গাপুর।(পড়াশোনা ছাড়ার কারনটা অন্য কোনো দিন বলবো) এখন বাপের ২ ছেলে আছি, ডুবাই আর সিঙ্গাপুর। আর বাকি ২ ছেলে একজন মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপ্লোমা করে। বিএসসি করার অপেক্ষায় আছে আরেক জন সাইকোলজি তো অর্নাস করছে। বাবা তার শূন্য হাত থেকে আজ এই পর্যন্ত আসছে। ছাউনি ঘর থেকে এখন একটা বিল্ডিং হয়েছে। আব্বার সবচেয়ে বড় সম্পদ এখন তার চারটা ছেলে। বিদেশে বড় ভাইয়ার একটা গাড়ি ও আছে আলহামদুলিল্লাহ। পড়াশোনা না জানার কারনে অনেক জায়গায় লস করেছেন আব্বা। বাস্তবতা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে তুমি বিপদে পড়লে তোমার হাতটি ধরে তুলার মত মানুষ খুবই কম এই সমাজে। হার না মানা জীবন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন সামনের দিকে। সামনে ভালো একটা বিজনেস প্লানিং চলছে। সবাই দোয়া করবেন আমার আব্বার জন্য। আব্বা যেনে জীবনের সফলতার সর্বোচ্চটা দেখে যেতে পারেন।
কষ্ট করে এতবড় পোষ্টটি পড়ার জন্য আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। লেখায় ভুল ক্রটি কে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখবেন দয়াকরে । সবার জন্য শুভ কামনা রইল। পৃথিবীর সমস্ত বাবাদের প্রতি ভালোবাসা। বাবাকে ভালোবাসি কথাটা এখনো বলা হয়নি তবে বাবাকে কতটা ভালোবাসি তা শুধু আমার অন্তর যানে। এই পৃথিবীরতে যদি একজন মানুষ কে সম্মান করি,ভালোবাসি সে হলো আমার বাবা।
স্ট্যাটাস অফ দ্যা ডে -২৮২
১৮-০৭-২০২০
রিফাত হোসেন
জেলাঃ মুন্সিগঞ্জ
ব্যাচ১০ম
রেজিঃ১১৯৩১