দিনে দিনে এই রসমালাইয়ের খ্যাতি দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে
উনিশ শতকের প্রথম দিকে ত্রিপুরা রাজ্য তথা কুমিল্লার ঘোষ সম্প্রদায় দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে ক্ষীর বানিয়ে তাতে ছোট আকারের শুকনো ‘ভোগ’ বা রসগোল্লা ভিজিয়ে যে মিষ্টান্ন তৈরি করে, তা ক্ষীরভোগ নামে পরিচিতি পায়। ক্রমান্বয়ে এই ক্ষীরভোগ রসমালাই নামে পরিচিত হয়ে উঠে। ১৯৩০ সালে কুমিল্লা শহরের মনোহরপুরে মাতৃভান্ডার নামে দোকানে ঐতিহ্যবাহী ও বিখ্যাত এই রসমালাই বিক্রি শুরু হয়। খনিন্দ্র সেন ও মণিন্দ্র সেন নামের দুই ভাই রসমলাই তৈরি করে বিক্রি শুরু করেন। খুব অল্প দিনের মধ্যে রসমালাইয়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। হয়ে ওঠে কুমিল্লার ঐতিহ্যের অংশ। বর্তমানে এ মাতৃভান্ডার পরিচালনা করেন শংকর সেন।
দিনে দিনে এই রসমালাইয়ের খ্যাতি দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। যেকোনো আচার-অনুষ্ঠান এবং মিষ্টিপ্রিয় মানুষের কাছে রসমালাই এক প্রিয় নাম হয়ে ওঠে। মাতৃভান্ডারের ব্যবস্থাপক অনুপম দাস জানান, ১৯৯৮ সালের দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে জেলা পরিক্রমা অনুষ্ঠানে কুমিল্লার অন্যান্য ঐতিহ্য দেখানোর পাশাপাশি মাতৃভান্ডারের রসমালাইও দেখানো হয়। এরপর সারা দেশে রসমালাইয়ের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। গত সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের আপ্যায়ন করা হয় এই রসমালাই দিয়ে। আর কুমিল্লায় কোনো পর্যটক বা অতিথি এলে রসমালাইয়ের স্বাদ নেননি এমন ঘটনা বিরল।
কুমিল্লার মাতৃভান্ডারের রসমলাই এর নাম শুনলেই জিভে জল এসে যায়। সুস্বাদু আর ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টান্নের যাত্রা শুরু হয়েছিল কুমিল্লা থেকেই। তাই আসল রসমলাইয়ের স্বাদ পেতে যেকোনো জায়গার হলে চলবে না, আসল স্বাদ পেতে হলে আসতে হবে কুমিল্লাতেই। কুমিল্লার সেই ঐতিহ্যবাহি মাতৃভান্ডারে। আসল মাতৃভান্ডার ছাড়া কুমিল্লার রসমালাই পাওয়া যাবে ভগবতি পেড়া ভান্ডার, শীতল ভান্ডার, পোড়াবাড়ি, জলযোগসহ কয়েকটি মিষ্টি দোকানে।
কুমিল্লার যত খ্যাতি তার সঙ্গে খাদি বস্ত্রের পাশাপাশি চলে আসে রসমালাইয়ের নাম। কুমিল্লায় এলে রসমালাই না নিয়ে ফেরার মানেই হয় না।
তবে আসল রসমলাইয়ের স্বাদ পেতে চাইলে পেতে হবে আসল জিনিস। কারণ কুমিল্লা শহরকে ঘিরে নকল রসমালাইয়ের অগণিত দোকান গড়ে ওঠায় আসল যে রসমলাই, তার স্বাদ অনেকেই পান না। সত্যিকারের তৃপ্তির ঢেঁকুর তখনই দিতে পারবেন যদি চিনে নিয়ে ঠিক ঠিক জায়গা থেকে আসল জিনিসটা কিনতে পারেন। কুমিল্লার বিখ্যাত এই রসমলাই পেতে আপনাকে যেতে হবে কুমিল্লা শহরের মনোহরপুরের কুমিল্লা মাতৃভান্ডাার নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। এইখান থেকেই অমৃত এই রসমলাই যাত্রা শুরু করেছিল।
প্রতিষ্ঠাতা: খনিন্দ্র সেন ও মনিন্দ্র সেন
১৯৩০ সালে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার খড়িয়ালার খনিন্দ্র সেন ও মনিন্দ্র সেন নামে দুই ভাই কুমিল্লায় এসে শহরের মনোহরপুর এলাকায় মাতৃভান্ডার নামে একটি দোকান দিয়ে ক্ষীরভোগ বা রসমালাই বিক্রি শুরু করেন। সুস্বাধু হওয়ায় এ বিক্রি বাড়তে থাকে। এক সময় জনপ্রিয় হয়ে উঠে। খনিন্দ্র সেনের এক ছেলে এবং দুই মেয়ে। বড় ছেলে শংকর সেন। দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে মারা গেছেন। ছোট মেয়ের নাম স্মৃতি সেন। মনিন্দ্র সেন বিয়ের করেন নি। ১৯৪০ সালে খনিন্দ্র সেন মারা গেলে একমাত্র ছেলে শংকর সেন মাতৃভান্ডার পরিচালনা করা শুরু করেন। তিনিও এখন বয়সের ভাড়ে নূহ্য।
শংকর সেন জানান, বাবা ওয়াপদার চাকুরি ছেড়ে মাতৃভান্ডার মিষ্টি দোকানটি দেন। এটি মূলত মনোহরপুরের রাজরাজেশ্বরী কালীমন্দিরকে ঘিরে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাবার বানানো রসমালাই পাকিস্তান আমল থেকে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠে। আমার বাবা খনিন্দ্র সেনই প্রথম রসমালাই বিক্রি শুরু করেন।
মাতৃভান্ডারের ব্যবস্থাপক অনুপম দাস জানান, মাতৃভান্ডার নামে এ মিষ্টি দোকান প্রতিষ্ঠিার পর তাদের আর পেছনে তাকাতে হয় নি। তিনি জানান, বর্তমানে তাদের দোকানে উত্তম দে এবং ক্ষিতিষ মোদক নামে দুই জন অভিজ্ঞ কারিগর এই রসমালাই তৈরি করছেন। তাদের কাছ থেকে নতুন প্রজন্মের কারিগররা রসমালাই তৈরি শিখে নিচ্ছেন।
যে ভাবে তৈরি হয়:
কুমিল্লার মাতৃভান্ডারের ঐতিহ্যবাহী রসমালাই তৈরির প্রক্রিয়া খুবই সহজ। একটি পাতিলে বা করাইয়ে একমন দুধ দুই ঘন্টা ধরে জ্বাল দিলে তা ঘন হয়ে ১৩/১৪ কেজি ক্ষীর তৈরি হয়। এর দুধ থেকে পাওয়া ছানার সাথে কিছু ময়দা দিয়ে খামির তৈরি করে বানানো হয় ছোট ছোট গুলি বা রসগোল্লা। এক কেজি ছানাতে এক ছটাক পরিমাণ ময়দা দিয়ে এ গুলি বানানো যায়।
কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী মাতৃভান্ডারের কারিগর উত্তম দে জানান, এক মণ দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন ক্ষীর তৈরি করে তাতে ছোট গুটি বা শুকনো রসগোল্লা দিয়ে ১৪ কেজির মতো রসমালাই বানানো যায়। এক মণ দুধে এর বেশি তৈরি করলে রসমালাইয়ের আসল স্বাদ আর থাকে না।
কুমিল্লার রসমালাইয়ের অন্যান্য দোকানঃ
কুমিল্লার মাতৃভান্ডার ছাড়াও বিখ্যাত রসমালাই বিক্রি হয় কুমিল্লার মনোহরপুরের ভগবতী পেড়া ভান্ডার, কান্দিরপাড়ের জলযোগ আর জিলাস্কুল রোডে পোড়াবাড়ি মিষ্টি দোকানে। তবে এ মিষ্টি দোকানগুলোর মধ্যে রসমালাইয়ের পাশাপাশি ভিন্ন মিষ্টান্ন বিক্রি হয়।
কুমিল্লার মনোহরপুরের রাজরাজেশ্বরী কালীমন্দিরকে কেন্দ্র করে ঘরে উঠে তিনটি মিষ্টির দোকান। এদের মধ্যে রসমালাইয়ের জন্য বিখ্যাত মাতৃভান্ডার, ভগবতি পেড়া ভান্ডার আর শীতল ভান্ডার। এডভোকেট কিরনময় দত্ত ঝুনুর ভগবতি পেড়া ভান্ডারের রসমালাই মাতৃভান্ডারের রসমালাইয়ের মতোই সুস্বাধু। মাতৃভান্ডারের পরপরই রয়েছে ভগবতি পেড়া ভান্ডারের অবস্থান। রসমালাই ছাড়াও এখানে অন্যান্য মিষ্টান্ন বিক্রি হয়।
স্পঞ্জ এর জন্য বিখ্যাত হলেও কুমিল্লার কান্দিরপাড়ের জলযোগ এক সময় বিখ্যাত ছিলো লুচি, সিঙ্গারার জন্য। অন্তত ৯৫ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এ দোকান এক সময় মুহুরী বাবুর দোকান নামে পরিচিত ছিলো। এটি প্রতিষ্ঠা করেন জয় চন্দ্র রায়। ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তিনি মারা যাওয়ার পর তার চার ছেলে জলযোগের হাল ধরেন। এর মধ্যে ৩য় ছেলে দুলাল রায় জলযোগে মিষ্টি ও রসমালাইয়ের পাশাপাশি স্পঞ্জও বিক্রি শুরু করেন। চার ভাইয়ের সবাই পালা করে দোকান পরিচালনা করেন। তারা এখনো যৌথ পরিবারে আছেন। অন্য তিন ভাই হচ্ছেন তপন রায়, রতন রায় ও স্বপন রায়। তাদের পিতার আদি বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দির মোহাম্মদপুরে। এখন তারা থাকেন কুমিল্লা শহরের ঝাউতলায়।
জয় চন্দ্র রায়ের ছেলে স্বপন রায় জানান, জলযোগ এখন বিখ্যাত এবং সমাদৃত স্পঞ্জ এর জন্য। তবে আমাদের রসমালাই মিষ্টান্ন প্রিয়রা খুবই পছন্দ করে।
জলযোগের প্রধান কারিগর প্রমোদ পাল কাজ করে প্রায় ৫০ বছর ধরে। তার সাথে আরো ৪ কারিগর আছেন। পর্যাক্রমিকভাবে কারিগররা শিখে নিচ্ছেন রসমালাই ও স্পঞ্জ বানানোর কাজ। জলযোগে এক কেজি রসমালাই বিক্রি হয় ২২০ টাকায় আর স্পঞ্জ বিক্রি হয় ২০০ টাকায়।
পোড়াবাড়ি
চমচমের জন্য বিখ্যাত টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির নামানুসারে কুমিল্লায় পোড়াবাড়ি নামে মিষ্টি দোকান প্রতিষ্ঠা করেন আওয়ামীলীগ নেতা আলহাজ্ব মো: ওমর ফারুক। তিনি এখন কুমিল্লা জেলা পরিষদের প্রশাসক। রসমালাইয়ের পাশাপাশি পোড়াবাড়ির দই ভোজন বিলাশী মানুষের কাছে খুবই প্রিয়। পোড়াবাড়ির পরিচিতিও বেশি দইয়ের জন্য। তবে এর দোকানের রসমালাই খুবই সুস্বাধু। দোকানটি পরিচালনা করেন ব্যবস্থাপক মহসিন উদ্দিন আহমেদ শেখর। পোড়াবাড়ির বেশ কয়েক কারিগর রয়েছে। এদের মধ্যে প্রমোদ ঘোষ, কৃষ্ণ ঘোষ, দীলিপ ঘোষ, দ্বীনেষ ঘোষ অন্যতম। পোড়াবাড়িতে দই, রসমালাই ছাড়াও অন্যান্য মিষ্টান্ন বিক্রি হয়।
অসাধু মিষ্টি দোকান
রসমালাইয়ের ঐতিহ্য আর সুখ্যাতিকে পুঁজি করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নেমে পড়েছে রসমালাই বিক্রিতে। ঐতিহ্যবাহী রসমালাইয়ের উদ্ভাবক মাতৃভান্ডারের নামের সামনে 'কুমিল্লা', 'কুমিল্লার', 'আদি', 'খাঁটি', 'মা', 'নিউ' ইত্যাদি নাম ব্যবহার করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে কুমিল্লার পদুয়ার বাজার থেকে আলেখারচর পর্যন্ত চোখে পড়বে অসংখ্য মিষ্টির দোকান। সবারই দাবি তাদের দোকানে কুমিল্লার আসল রসমালাই পাওয়া যায়। এ রকম অন্তত ২০টি মিষ্টির দোকান রয়েছে মহাসড়কের পাশে। দোকানগুলোর সাইনবোর্ডে কোনোটিতে লেখা আছে 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত', কোনোটিতে লেখা 'আমাদের একমাত্র শাখা এটি', কোনোটিতে আছে 'আমাদের দ্বিতীয় শাখা'। সত্যি কথাটা হলো, মাতৃভান্ডারের নাম ব্যবহার করে ভেজাল রসমালাই তৈরি করে এবং বিক্রি করে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করছে এসব অসাধু ব্যবসায়ী। সেই সঙ্গে তারা নষ্ট করছে কুমিল্লার আসল ও অতুলনীয় স্বাদের রসমালাইয়ের সুনাম।
যে স্বাদ, গুণ আর ঐতিহ্যের কারণে রসমালাইয়ের জগৎজোড়া খ্যাতি, সেই রসমালাই ভেজাল আর নকলের ভিড়ে জৌলুস হারাতে বসেছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা ঐতিহ্যবাহী রসমালাইয়ের প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের নাম নকল করে বা ওই নামের সামনে-পেছনে অন্য শব্দ ব্যবহার করে ভেজাল বা নকল রসমালাই তৈরি করে এবং তা বিক্রি করে রসনাবিলাসী মানুষকে প্রতারিত করার পাশাপাশি রসমালাইয়ের ঐতিহ্য ধ্বংস করছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে নকল ও ভেজাল রসমালাইয়ের ভিড়ে এখন আসল রসমালাই চেনাই দুরূহ হয়ে পড়েছে।
কিভাবে যাবেন আসল রসমালাই বা মাতৃ ভান্ডারে।
ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে কুমিল্লা যাওয়া যায়। আসলটিতে যেতে হলে রিকশায় বা সি এন জি যোগে কান্দিরপাড় যেতে হবে। কান্দিরপাড় থেকে তিনশত গজ পূর্ব দিকে সাত্তার খান ও খন্দকার মার্কেট পার হয়ে মনোহরপুরে কালীমন্দির এর সামনে যে মাতৃ ভান্ডার তাই হলো আসল মাতৃ ভান্ডার।
স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- 208
Date: 28/04/2020
ওয়ায়েস করনি ( জুয়েল)
ব্যাচঃ সপ্তম।
সদস্যঃ রিসার্চ অ্যান্ড প্রোমোশন টিম।
জেলাঃ কুমিল্লা
বর্তমান অবস্থানঃ মতিঝিল জুনের এরিয়া ঢাকা।
রেজিষ্ট্রেশন নাম্বারঃ ১৩৪০