আমি ছিলাম ভীষণ আড্ডাবাজ ও ভ্রমণ পিয়াসী একজন ছেলে
"আস্সালামু আলাইকুম"
দুঃখ নিয়ে লিখতে লিখতে আর ভালো লাগেনা, তারপরেও লিখতে বসলেই দুঃখটা কেনো জানি বারবার ফুটে উঠে।
সব সময় যে আমি ভালো তাও কিন্তু ঠিক নয়। তবে ভালো হওয়ার চেষ্টায় অনবরত। তেমনি আমার জীবনেও আমি যে খারাপ তারও অনেক উদাহরণ রয়ে গেছে জীবনে - তার ভিতর অন্যতম ছিলো, মাঝে মাঝে পরিবারের অবাধ্য হয়েও কিছু করতাম।
আমি ছিলাম ভীষণ আড্ডাবাজ ও ভ্রমণ পিয়াসী একজন ছেলে। এর ধারাবাহিকতায় আড্ডা দিতে দিতে চলে যেতাম অনেক দূর, বিভিন্ন ডিস্ট্রিক্টে, ঘুরেছি বাংলার অনেকগুলো আনাচে-কানাচে জায়গায় - হয়তো সব জায়গায় নয়। তবে দেখেছি বেতিক্রম, ভিন্নধর্মী, ভিন্ন ভিন্ন মানুষ। দেখেছি বাংলার মনোরম নীলাচল অপরূপ দৃশ্য সবুজ শ্যামল বাংলা স্মৃতিময় কিছু অপূর্ব ছায়া।
শুধু যে দেখেছি তা কিন্তু নয়, অর্জন ছিলো অনেক বেশি। পৃথিবীতে চলতে চলতে যেকোনো কিছু থেকেই কিছু না কিছু জীবনে অর্জিত হয় এবং অন্যের জন্য উপকারও বয়ে আনতে পারে।
অতীতের ন্যায় প্রবাস থেকে নতুন ছুটিতে গিয়ে, পরিবারকে বললাম একটু বন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরে আসি। আব্বু বলল যাওয়ার দরকার নেই। আম্মু বলল রেস্ট নাও। আমার কিছুতেই ভালো লাগছিলো না ঘরের ভিতর। মেজাজটা কেমন খিটখিটে হয়ে আসছিলো। এমনিতেই আমার মেজাজটা খুব গরম ও কিছুটা একপেশে। পাশাপাশি খুব ঠাণ্ডা প্রকৃতির হাস্যজ্জল ও মিশুক প্রকৃতির একজন মানুষ।
যাই হোক অবশেষে গেলাম বেড়াতে সমুদ্র সৈকতে। হোটেল থেকে গাড়ি করে সমুদ্র সৈকতে এসে, সবাই যে যার মতো একটু দূরত্বে গিয়ে বসলাম এবং বাদাম খাচ্ছিলাম। হঠাৎ এক ভদ্রলোক এসে পাশে বসলো, আনমনে চিন্তা করতে লাগলো এবং চোখের পানি পড়ছিলো। জিজ্ঞাস করতে লাগলাম কোন সমস্যা ? উনি চোখটা মুছে বলল না! কোন সমস্যা নেই। যাই হোক কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলছিলাম ভালই লাগলো, আমরা একটু হাঁটতে শুরু করলাম ভদ্রলোক পিছু নিলো, আমি পেছনে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে সাথেই স্বাভাবিকভাবেই নিয়ে চললাম। সাথে আমরা আরো কয়জন ছিলাম। ভদ্রলোক নিজের কিছু দুঃখের কথা আমাদের সাথে বলতে লাগলো, আমরাও সাদরে শুনতেও লাগলাম এবং খুব আফসোস হচ্ছিলো তার জন্য। ভরা দুপুর আমাদের আগে পিছে আরো অনেক লোক হাটাহাটি করছিলো। সামনে ডাব বিক্রি করছিলো, আমার আবার খুব পছন্দ, দাঁড় করিয়ে সবাইকে ডাব খাওয়ালাম, নিজেও খেলাম। ডাবের ভিতরে যে আবরণ থাকে, সেইটা আমি বেশি পছন্দ করি! ডাবের পানির সাথে মিক্স করে খেতে। যাই হোক ভদ্রলোক গল্প করতে করতে, তার ছেলের প্রবাস জীবনের গল্প বলতে লাগলো, প্রায় 15 বছর ছেলে প্রবাসে, মেয়েদের বিয়ে দিয়েছে। তিনি এখানে এসেছেন বেড়াতে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে। কিছু টাকা মেয়ের কাছে বাবার রেখেছিলো, সেইগুলো নিয়েও যাবে এবং নতুন নতুন নাতী-নাতনীদের দেখার জন্য মনটা আনচান করেছিলো, তাই দেখতে আসা (এক কাজে দুই কাজ)। ছেলে আসবে বাড়িতে আগে থেকেই সব গুছিয়ে রাখতেই সকল চেষ্টা। ভদ্রলোককে খুবই ভাল লেগেছে, ছেলের জন্য কিছুদিন আগে জায়গা সম্পত্তি নিজের গুলো হিসাব করে রেখেছিলেন। ছেলে আসামাত্রই সবকিছু বুঝিয়ে দিবে, বলছিলেন অনেক বছর তো প্রবাসে কাটিয়ে দিয়েছে আমার ছেলে, সব দুঃখ আমরা বুঝি। ছেলের যাতে জীবনে অসুবিধায় না পড়তে হয়- আমাদের সুখে-দুখে যেমন সে দাঁড়িয়েছে এর প্রতিদান আমরা হয়তো কখনো দিতে পারবো না, তবে তার জন্য আমাদের সবকিছু অন্যদের তুলনায় বেশি করে রেখেছি। অন্তত ছেলেটার মনে তৃপ্তি যাতে আসে। হয়তো ছেলের বউ ভিতরগত ব্যাপারটা জানে অথবা জানে না কিন্তু বাবার মনে ছিলো তা আমি সাক্ষী। উনি আমাদের সাথে সরল মনে বলে যাচ্ছিলো। উনি আমাদের নাম্বার নিলো, আমরাও নিলাম। যাই হোক মেয়ের বাসা থেকে একদিন পর আবার কল দিলো দেখা করার উদ্দেশ্যে বিদায়ী বেলায়। যাই হোক সময় স্বল্পতায় উনার সাথে আবার দেখা করি (উনি আসেন) হোটেলে। অনেক কিছু আলাপ-আলোচনার পরে, উনিও হাস্যোজ্জ্বল অবস্থায় চলে গেলেন।
সেই যে গেলেন প্রায় 15 দিন আর কোন যোগাযোগ নেই।
হঠাৎ এক ভদ্র মহিলার কল! বললেন ওই ভদ্রলোকের নাম নিয়ে ওয়াইফ পরিচয়য়ে, তিনি অসুস্থ আপনাদেরকে মিস করতেছে!
আমি প্রথমে না চিনলেও একটু পরে চিনতে পেরেছি। অবশ্য আগেই বাসায় যাবো বলছিলাম, উনি অসুস্থ সেহেতু উনাকে দেখতে যাবো এতে করে উনার সাথে দেয়া ওয়াদাও পুরো হয়ে যাবে। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা ভদ্রলোকের বাসায় গেলাম উনাকে দেখতে - উনি আমাদের দেখেই যেনো বড় নিঃশ্বাস নিলেন, খুব কেঁদেছে সেই দিন এবং মনের দুঃখের কথা সব বলা শুরু করলেন অনবরত। 15 দিন আগের ঐদিন ওনাকে গাড়িতে মলম পার্টি নিরব অ্যাটাক করেছে, যা ওনি বুঝতে পারেনি, উনার হাতব্যাগটা নিয়ে যায়। ওখানে ছিলো ওনার ছেলের টাকাগুলো।
যেহেতু তিনি মলম পার্টিদের ব্যাপারে বুঝতে ও চিনতে পারেনি, বিবরণ দিতে পারছিলো না। তবে প্রথমে আমি ধারণা করেছিলাম আমাদের পিছনে পিছনে ঘুরা ওই লোক গুলোদের মাঝে কেউ কি হতে পারে কিনা? শুধু আইডিয়া নেয়ার উদ্দেশ্যে ওই হাইওয়ে রোডের টহলরত পুলিশ ভাইদের হেল্প নিয়ে, কলের মাধ্যমে জানতে পারলাম আলাপচারিতায় গল্পের মাধ্যমে ওই রোডে স্পেশালি কিছু মলম পার্টি কাজ করে, যারা শুধু নিজেদের পেসেনজার হিসেবে জাহির করে, কোন লং প্ল্যানিং ছাড়া। এরকম অনেকগুলো কেস ওনাদের জানা আছে এবং ওনারা সেগুলো নিয়ে, শ্বশ্ব দায়িত্বশীলরা কাজ করে যাচ্ছে। যাই হোক জেনেও লাভ নেই যা ঘটে যাওয়ার ঘটে গেছে।
উনার ঐদিনের কান্নাগুলো ছিলো প্রবাসী ছেলের কিছু টাকা তিনি হারিয়ে ফেলেছেন ওই ভয়ে অথচ তিনি যে 15 দিন বাসায় এবং হাসপাতালে এর কোন বিন্দু পরিমাণ চিন্তা নেই।
প্রবাসে আমরা যারা আছি, হয়তো অনেকেই পরিবারের বাহ্যিক বিষয়গুলো বিবেচনা করি। মাঝে মাঝে এইসব কাহিনী নিজের চোখে না দেখলে হয়তো আমিও ভাবতাম সারা বছর বিদেশ করে ফ্যামিলিকে চালিয়ে কি পাবো?।।
আসলে কি তাই?
আমরা প্রবাসে যেমন পরিবারকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত থাকি, পরিবারও আমাদের নিয়ে ভীষণ চিন্তিত থাকে কিন্তু তাদের ত্যাগ গুলো আমরা যেকোনো খুটিনাটিতেই ভুলে যাই! - হয়তো সবাই নয়।
তবে এই ঘটনার পর থেকে আমি নিজে নিজে শিখেছি, শুধু একটা বিষয় নয় অনেকগুলো বিষয়। যা এখানে পরিলক্ষিতঃ
1) জেনেছি অনাকাঙ্ক্ষিত খারাপ লোকদের একটা টিম কাজ করে।
2) জেনেছি প্রবাসী ছেলের প্রতি পরিবাররা যত্নবান।
3) জেনেছি নিজের কষ্টের কথা ত্যাগ করে সন্তানের ভবিষ্যতে নিয়ে ভাবা।
4) জেনেছি প্রবাসী সন্তান থেকে টাকা নিয়ে চলা পরিবার, অল্পতেই কিভাবে ভেঙে পড়ে।
(আসলে পরিবারের যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন সন্তানের দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় থাকেনা। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা প্রবাসীরা পরিবারকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিয়ে থাকি সামর্থ্য অনুযায়ী। হয়তো সবাই, হয়তো কেউ কেউ।
5) জেনেছি বাবা মা হয়তো অধিকার খাটিয়ে গর্ব করে কিছু করতে চায় কিন্তু পারে না -প্রবাসী ছেলের কথা চিন্তা করে, বুক ভাঙা আর্তনাদ আর কান্না জর্জরিত থাকে ভিতরে ভিতরে, সেটা আমরা প্রবাসীদের বুঝতে দেয় না।
6) একজন প্রবাসী হয়ে নিজের বাবা-মার প্রতি ভালোবাসা থাকলেও, শ্রদ্ধা ভালোবাসা আরো বেশি জন্ম নিলো।
7) আরো কিছু প্রিয় পাঠক আপনারা যদি পেয়ে থাকেন অনুগ্রহ করে কমেন্টসে দিবেন......
আসোলে যদি আড্ডাবাজ ও ভ্রমণপিয়াসু না হতাম, হয়তো বন্ধুদের সাথে আড্ডাও দিতাম না, ঘুরতেও বের হতাম না। ঐদিন সমুদ্রের পারে পরিচয় হতো না এই ভদ্রলোকের সাথে। হয়তো রয়ে যেতো স্বচক্ষে না দেখা, অনেক অজানা কাহিনী।
উল্লেখ্য আমার পরিবার কখনোই আড্ডা দেয়া প্রশ্রয় দেয়া দূরে থাক বরং আমাকে কোথাও বের হতে দিতো না এর প্রধান কারণ ছিলো আমার সাবধানতা অবলম্বন করার জন্য, পাশাপাশি পরিবেশগত কারণে (যেহেতু প্রবাস থেকে ছুটিতে)। তবে আমি সব সময় ইনিয়ে বিনিয়ে বলে কয়ে চলে যেতাম। ভালোবাসা অবিরাম, ভালোবাসার পরিবার।
আসলে লিখলে আবেগ ধরে রাখা যায় না, ছোট করে লিখলেও পুরো লেখাটার সার্থকতা আসে না। তারপরেও যতটুকু পারা যায় ছোট করে লেখার চেষ্টা করি।
আর ধন্যবাদ প্রিয় মেন্টর Iqbal Bahar Zahid স্যার এতো সুন্দর সুন্দর শিক্ষনীয় আয়োজন রাখার জন্য। আসলে আপনি যদি গল্প লিখতে না বলতেন, হয়তো আজ এভাবে সব সময় সহজ-সরল বাস্তব জীবনের ঘটে যাওয়া গল্প লেখা হয়ে উঠত না। আসলে আমি ভীষণ গর্বিত, এতো ইউনিক প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হতে পেরেছি তাই।
সবাই দোয়া করবেন, যেনো এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারি।
"স্ট্যাটাস অব দ্যা ডে"- 216
Date:- 06/05/2020
মোঃ ইফতেখার আলম মজুমদার
কান্ট্রি অ্যাম্বাসেডর
সপ্তম ব্যাচ
রেজিঃ- 1378
ব্যবসাঃ- চট্টগ্রাম
বর্তমানঃ- জেদ্দা,সৌদি আরব
জেলাঃ- ফেনী