ধাপে ধাপে বার বার ব্যর্থ হয়ে অবশেষে আমার উদ্যোক্তা জীবন থেকে ফিরে আশার গল্প।
আমার জীবনের গল্প 












আপনি পৃথিবীর যে কোনো লাইব্রেরিতে কোনো বই কিনতে গেলে শুধু বইয়ের নাম টা বললেই আপনাকে বইটা দিয়ে দিবে কিন্তু যখন আপনি " জীবনের গল্প"নামের কোনো বই কিনতে যাবেন তখনই আপনাকে নাম মেনশন করে বলতে হবে যে অমকের জীবনের গল্পের বইটা দেন, তাইনা? কারণ বইয়ের নাম এক হলেও গল্প গুলা ভিন্ন ভিন্ন, একটা বইয়ের গল্পের সাথে আরেকটা বইয়ের গল্প কখনোই মিলবেনা। বইয়ের নাম এক কিন্তু গল্প গুলা ভিন্ন ভিন্ন কি অদ্ভুত,তাইনা?




তো আজকে আমার জীবনের গল্প নামক অসমাপ্ত বইটা থেকে কিছু অংশ আপনাদের সাথে শেয়ার করছি.......
----------- বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম -----------


আশা করছি মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে সকলেই ভালো আছেন।আমিও ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ।

এরপর শ্রদ্ধা ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা আমার বাবা মায়ের প্রতি যারা আমাকে খুব যত্নে বড় করেছেন এবং এখনো তাদের মায়া মমতার ছায়াতলে আগলে রেখেছেন। সবার কাছে আমার বাবা মায়ের জন্য দোয়া চাই,আল্লাহ যেন আমার বাবা মাকে নেক হায়াত দান করেন এবং সুস্থ রাখেন।







যারা আমার ভিতরের আমিটাকে প্রতিনিয়ত বাহিরে বের করে নিয়ে আসছে। আজকে আপনাদের সাথে আমি আমার জীবনের গল্প শেয়ার করছি।


আমার নাম মো:শিহাব উদ্দিন। আমার জন্ম নব্বই দশকের একেবারেই শেষ দিকে টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার নবগ্রাম গ্রামে নানার বাড়িতে। তিন ভাই বোনের মধ্যে আমি ২য় এবং বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে।আমার বাবা একজন মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং মা একজন গৃহিণী।


জন্মের পর থেকেই আমার বেড়ে উঠা গ্রামে। আমাদের গ্রামের নাম চানপুর গ্রাম। এটা টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার নগদা শিমলা ইউনিয়নে অবস্থিত। আমাদের গ্রামের গঠন হলো, পুরো গ্রামেই পাশাপাশি সবার বাড়ি, গ্রামের রাস্তার পাশে সবারই গরুর গোয়াল ঘর,তার সামনে সবার বাহির বাড়ি, তার সামনে সবারই থাকার ঘর, তার সামনে সবারই উঠোন, তার সামনেই সবারই বাঁশ ঝার এবং তার পরেই পুরো গ্রাম জুড়ে ছোট নদী।এই নদী এবং সামনের রাস্তা আমাদের পুরো গ্রামটাকে রেললাইনের মত ধরে রেখেছে।

রোজার দিনে ইফতার নিয়ে বাহিরবাড়ি এসে সবাই মিলে আড্ডা দিতে দিতে ইফতার করা আমার শৈশব কালের এক সেরা স্মৃতি।

তারপরও শৈশব জীবনের জন্য আলহামদুলিল্লাহ।


আমার মা একজন মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ছিলেন এবং ধার্মীক একজন মানুষ। তাই আমার মা আমার জন্মের পর আমার নাড়ি (অমরা বা গর্ভফুল) মাদ্রাসার মাঠে পুঁতে ছিলেন যাতে আমি মাদ্রাসায় পড়তে পারি এই ভেবে।(যদিও এটা কুসংস্কার)
যখন আমার ৫ বছর বয়স হলো তখন স্কুলে ভর্তি করাবে।আমার আশে পাশের চাচাত ভাইয়েরা তখন কিন্ডার গার্টেনে ভর্তি হয়।আর ঐ সময় কিন্ডার গার্টেন আমাদের উপজেলায় অনেকটা নতুন। তাই সবার পরামর্শে কিন্ডার গার্টেনের পড়া শুনার মান অনেক ভালো শুনে আমাকেও কিন্ডার গার্টেনে প্লে গ্রুপে ভর্তি করিয়ে দেয়।


কখনো যদি নানু বাড়ি যেতাম তখনও স্কুলে না যেতে পারার কারণে কান্নাকাটি করতাম।তাই আমার মামা আমার নানুবাড়ি এলাকার স্কুল ভ্যানে তুলে দিয়ে আসত।
এভাবেই আমার কিন্ডার গার্টেন থেকে প্রাইমারী জীবন শেষ হয়।



এভাবেই অনেক কষ্ট করে ২০১৮ সালে নটরডেম কলেজ ময়মনসিংহ থেকে এইচ এস সি পাশ করি।




আমি তেমন ভালো ছাত্র ছিলাম না কখনোই।
সব সময়ই মধ্যম ক্যাটাগরির ছাত্র ছিলাম।
PSC: GPA-5 (সাধারণ গ্রেড বৃত্তি)
JSC: GPA-5 ( গোল্ডেন প্লাস, টেলেন্টপুলে বৃত্তি + উপজেলায় ৬ষ্ঠ পজিশন)
SSC: GPA-5 ( গোল্ডেন প্লাস,সাধারণ গ্রেড বৃত্তি)
HSC:GPA-4.58
JSC এবং SSC তে বেশি ভালো করার কারণ ছিল পাবলিক পরীক্ষায় স্যারদের কিছুটা সহযোগিতা।ঐ সময়ে ছাত্রদেরকে স্কুলের স্যাররা পরীক্ষায় সহযোগিতা করত।





নদীর উপর দিয়ে আনা লাইনের কারেন্টের তারের সাপোর্ট /আর্থিং হিসেবে ব্যাবহার করা হয়েছিল জিয়াই তার /গুনা।যেটার উপরে কোন অন্তরক প্রলেপ ছিল না।যদিও কারেন্টের তারের উপর রাবারের প্রলেপ আছে।
প্রায় বছর খানিক হওয়ায় এবং বর্ষাকাল হওয়ায় ঐ জিয়াই তার মরিচা ধরে মাঝে মাঝে ভেঙ্গে যায় এবং এর একটা অংশ তারের সাথে পেচিয়ে কারেন্ট হয়ে নদীর পানির উপর ঝুলে থাকে। কিন্তু পানিতে স্পর্শ করে নাই। আর যেটা ছিল আমার বসানো জালের একটু সামনেই।




পরে আরো লোকজন আসে।ডাকা ডাকির এক পর্যায়ে নদীর ঐ পাড় থেকে একজন গিয়ে মেইন সুইচ খুলে দেয়।আমাকে বাঁচাতে গিয়ে আমার দুই চাচাত ভাই সহ আমরা তিনজন বিদ্যুতায়িত হই।

গ্রামের লোকেরা আমাকে এবং আমার চাচাত ভাইকে পানি থেকে তুলে এবং যার যার ঘরে সরিষার তেল আছে তা এনে শরীর ডলতে ডলতে হাসপাতালে নিয়ে যায়।গ্রামের মানুষের ভাষ্যমতে যখন শরীর ডলতে ছিল তখন পুড়া স্থান থেকে চামড়া উঠে আসতেছিল।

ঐ মুহুর্তটা আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কখনোই ভুলতে পারব না। 








ছোট বেলায় যখন খেলারছলে কলাপাতার ছাওনি দিয়ে ছোট দোকান বানিয়ে ১ টাকা ২ টাকা দিয়ে চকলেট,চানাচুর আচার বিক্রি করতাম,তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতাম আমি বড় হয়ে একজন উদ্যোক্তা হবো। যদিও তখন উদ্যোক্তা শব্দটার সাথে পরিচিত ছিলাম না।



আমার কাছে টিউশনির ৭-৮ হাজার টাকা ছিল।আমি সেই টাকা নিয়ে সাথে সাথে ঢাকা চলে যাই।ঢাকায় সদরঘাট,গুলিস্থান ঘুরে ঘুরে কিছু কাপড় কিনি।কাপড় কিনে এনে সেগুলো বাড়ির আশে পাশে দুই একটি করে বিক্রি করতে থাকি।অনলাইনে কোথায় সেল করব সেটা তখন আমি জানতাম না।ফেইসবুকে এক দুইটা পোস্ট করলাম।কিন্তু কোন সেল হচ্ছে না।তাই সেই কাপড় নিয়ে শহরে/ বিভিন্ন হাটে ফুটপাতে নিয়ে যাই।কিন্তু যেই এক দুইটা সেল হয় তা দিয়ে রিকশা ভাড়ার টাকাই হয় না। ফুটপাতে বসে থাকতে অনেক লজ্জা লাগতো।কারণ শহরে অনেক মানুষ আমাকে চিনত।যখন কোন পরিচিত মানুষ, স্যার,বন্ধু,বান্ধব আসতো সাথে সাথে আমি দৌঁড়িয়ে লুকানোর চেষ্ঠা করতাম।
এইভাবে কয়েকদিন ফুটপাতে বসলাম। কিন্তু তেমন সেল হলো না।সর্বশেষ কাপড়গুলো নিয়ে একটা ওয়াজ মাহফিলের মেলায় দোকান দিলাম।সেখানে অল্প কিছু সেল হলো।মেক্সিমাম কাপড়ই রয়ে গেল।প্রায় পুরেটাই লস হলো।আমার কাপড়ের আইটেম গুলো ছিল শীতের কিছু হুডি,বাচ্চাদের গেঞ্জি, পায়জামা, জগার্স,মেয়েদের প্লাজু,টপস,কিছু গেঞ্জি এই টাইপের।


তখন আমার কিছু বন্ধু কলেজ বন্ধ থাকা অবস্থায়ও ঝিনাইদহ শহরে (যেহেতু আমি ঝিনাইদহ পড়াশুনা করি) মেস ভাড়া নিয়ে থাকত।তখন মনে মনে স্থির করলাম আমি ঝিনাইদহ চলে আসব এবং মেসে থেকে টাঙ্গাইলের শাড়ি নিয়ে আবার বিজনেস শুরু করব।কিন্তু কলেজ বন্ধ থাকায় আব্বা কোন ক্রমেই আমাকে ঝিনাইদহ আসতে দিবে না।আর ঐ সময়ে আমাদের সাংসারিক কিছু কাজের চাপ ছিল।
কিন্তু আমার ত বাড়িতে বসে থেকে আর ভালো লাগছে না।আমি আব্বা আম্মার সাথে ঝগড়া করতে লাগলাম।সর্বশেষ ঝগড়া করে বাড়ি থেকে ঝিনাইদহ চলে আসি। আসার সময় আম্মাকে বলে আম্মার ব্যাংক থেকে উঠানো টাকা থেকে ৮ হাজার টাকা নিয়ে আসি টাঙ্গাইলের শাড়ি কিনার জন্য।


ঝিনাইদহে এসে আমি ফেইসবুক হতে আমাদের এই প্রিয় "নিজের বলার মত একটা গল্প ফাউন্ডেশনের" দেখা পাই।





কিন্তু আমাদের হাতে কোন টাকা ছিল না।তখন আমরা বিভিন্ন ব্যাংকে ঘুরতে থাকি স্টুডেন্ট লোন করার জন্য।কিন্তু কোন ব্যাংকই আমাদের টাকা দেয় না।তখন আমি আমার গ্রাম থেকে একজনের কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা ধার নিয়ে আসি।আরেক বন্ধু নিয়ে আসে ১০ হাজার টাকা। এই মোট ২৫ হাজার টাকা আমাদের নতুন বিজনেসের মূলধন।আমরা গুগল ঘাটাঘাটি করে একটা নাম ঠিক করি, পেইজ খুলি,পেইজ বুস্ট করি, শপিং ব্যাগ বানাই।আমরা প্রথমদিকে পাঞ্জাবী দিয়ে শুরু করি।যেহেতু ঈদের আগে এবং ঢাকা থেকে ঝিনাইদহের দূরত্ব অনেক বেশি। তাই যাতায়াত খরচ বেশি পড়ে যাবে বিধায় আমরা ইউটিউবে বিভিন্ন প্রমোটিং ভিডিও দেখে, সরাসরি না গিয়ে কুরিয়ারে প্রোডাক্ট সংগ্রহ করি।যেটা ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল।
আমরা পেইজে প্রচার চালাতে থাকি। ফাউন্ডেশনে সেল পোস্ট করি।কিন্তু এক্টিভিটি কম থাকায় পোস্ট তেমন রিচ হয় না।তাই সেল ও তেমন আসে না।আমাদের আরেকটি বড় সমস্যা ছিল, না দেখে প্রোডাক্ট নেওয়ার কারণে প্রোডাক্টের মান যেমনটা আশা করেছিলাম তেমন হয় না।আর দামও অনেক বেশি পড়ে যায়।সব মিলিয়ে অল্প কিছু প্রোডাক্ট সেল করতে পারি।আর পুনরায় ঢাকায় যেয়ে নতুন প্রোডাক্ট আনা হয় না। এখানেও বড় ধরনের একটা লস হয়।

ধাপে ধাপে প্রায় ৫০ হাজার টাকা লস করে বার বার ব্যর্থ হয়ে অবশেষে আমার উদ্যোক্তা জীবন থেকে ফিরে আসি।


আমি প্রিয় প্লাটফর্মে রেজিস্ট্রেশন করেছিলাম ১৩ তম ব্যাচে।কিন্তু তখন বিজনেসে ব্যর্থ হয়ে বিভিন্ন কারণে হতাশ হয়ে ফাউন্ডেশনে কন্টিনিউ করা হয়নি।মেসেঞ্জার গ্রুপে যুক্ত ছিলাম, সেশন চর্চা ক্লাসের লিংক দেওয়া হতো, গ্রুপে বিভিন্ন পোস্টের নোটিফিকেশন আসত।কিন্তু সব সময় শুধু অ্যাভোয়েড করতাম। কখনো গুরুত্ব দিতাম না।কিন্তু ১৯ তম ব্যাচের শেষের দিকে হঠাৎ করে একদিন সেশন চর্চা ক্লাসে যুক্ত হই।যুক্ত হয়ে সবার কথা শুনে, স্যারের দেওয়া সেশন পড়ে আমার খুবই ভালো লাগে।এক কথায় আমি ফাউন্ডেশনের প্রেমে পড়ে যাই। 



আমি তারপর থেকে প্রতিনিয়তই সেশন চর্চা ক্লাসে যুক্ত হতে থাকি। অনলাইন, অফলাইন মিটআপ গুলোতে যুক্ত হওয়ার চেষ্ঠা করি।আমার ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্ন আবার জোড়া লাগতে থাকে।আমি বার বার হেরে যাওয়ার কারণ গুলো প্রতিটি সেশনের মাধ্যমে খুঁজে পেতে থাকি।আমার পূর্বের উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার বড় কারণ ছিল, না বুঝে,না শিখে বিজনেস শুরু করা,প্রোডাক্ট নির্বাচনে ভুল করা,মূলধন কালেক্ট করতে ভুল করা, নেটওয়ার্কিং এর অভাব,পণ্য সোর্সিংয়ের অভাব, লেগে থাকতে না পারা ইত্যাদি।ব্যাপার গুলো প্রতিটি সেশনের মাধ্যমে আমার কাছে ক্লিয়ার হতে থাকে।আমি মানসিক ভাবে শক্তি পেতে থাকি।নতুন করে আবার স্বপ্ন সাজাতে থাকি। সব থেকে বড় কথা আমি আমার প্যাশন টাকে খুঁজে পাই।
আমি বার বার হোঁচট খেয়েও স্যারের অসাধারণ সব সেশন পড়ে উঠে দাঁড়ানোর সাহস পাই।



সবার সামনে বক্তব্য দেওয়া আমার প্রিয় শখের মধ্যে একটি।তাই প্রতিনিয়ত সেশন চর্চা ক্লাসে কথা বলে আমার কথা বলার জড়তা কাটাতে পারি এবং গ্যালারি ভর্তি অডিয়েন্সের সামনে বক্তব্য দেওয়ার সাাহস পাই।







আমি এখন সময় নিচ্ছি এবং প্রিয় প্লাটফর্মে সময় দিচ্ছি। ইনশাআল্লাহ আমার সময় একদিন ঠিকই বদলাবে এবং আমি আমার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারব বলে বিশ্বাস করি।


গল্পটা অনেক লম্বা হয়ে গেছে সেই জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। 
যারা এতোটা ধৈর্য্য নিয়ে শেষ পর্যন্ত পড়েছেন সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই!



Date:- ২৩/০১/২০২৩ইং
আমি -

















